দিনেকানার ছানা by শরীফ খান
দিনেকানার সেই দুটি ছানা l ছবি: লেখক |
কাগজের
খেলনা বিমানের মতো তিন জোড়া পাখি মাটি ছেড়ে ওপরের দিকে উঠল, খেলনা
বিমানের মতোই বাগানের ভেতরে দু-তিনটি পাক দিয়ে গোত্তা খেয়ে পড়ার কায়দায়
বসে গেল মাটিতে। দূরের বাগানটায় একঝাঁক ছাতারে পাখি বেজায় চেঁচাচ্ছে।
তিন জোড়া পাখির একত্রে শূন্যে ছিটকে উঠে ডানা মেলে ভেসে যাওয়ার দৃশ্যটা দেখে কৌতূহলী হলো কোবাদ খন্দকার, বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সে পায়ে পায়ে এগোল সামনের দিকে। প্রথম পাখি জোড়ার কাছে পৌঁছাতেই একটি ছিটকে উঠে হাত সাতেক দূরে গিয়ে মাটিতে বসল আবার। দ্বিতীয় পাখিটা তার পা থেকে মাত্র ফুট তিনেক দূরে—ব্যাঙের মতো গাল হা করে কোবাদকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে। বসল সে, হাত বাড়িয়ে পাখিটার মাথার চার-পাঁচ ইঞ্চি ওপরে রাখল, পাখিটা উড়েই মাত্র ১০-১২ ফুট দূরে গিয়ে মাটিতে বসল। মাটি মানে, এখানে দু-তিনটা বাঁশঝাড় আছে, তলাটা তাই ঝরা বাঁশপাতার আরামদায়ক বিছানা। ওই বিছানার ওপর থেকেই একটু আগে একসঙ্গে উড়েছিল তিন জোড়া পাখি।
হা করা পাখিটা উড়ে যেতেই কোবাদ দেখতে পেল ছানা দুটিকে—একেবারেই যেন বাঁশপাতার রং ওদের, বসে আছে পাশাপাশি। পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার। কোবাদ আঙুল বাড়িয়ে একটি ছানার মাথার তালুতে যেই না রেখেছে হাত, অমনি ওটাও ব্যাঙের মতো গাল হা করল।
আমার বাল্যবন্ধু বাগেরহাটের ফকিরহাটের সাতশৈয়া গ্রামের কোবাদের আমবাগান আছে একটা, বাগানের ওপরেই ঝুঁকে আছে পাশাপাশি দুটি বাঁশঝাড়, সে একজন শ্রমিক দিয়ে বাগানের পরিচর্যা করাচ্ছিল, নিজে বসে ছিল সবুজ ঘাসের ওপর। দুপুরের পরে বাড়ি ফিরে শোনে জলকম্প হয়েছে বাড়ির পুকুরটার জলে, দুই-পাঁচটা ছোট মাছও লাফিয়ে উঠেছিল ভয়ে। অর্থাৎ, ভূমিকম্প হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে কোবাদ মুঠোফোনে ঢাকা শহরের খবর জানতে চাইল আমার কাছে। কথা হলো প্রায় ১৭ মিনিট। সে তিন জোড়া পাখির আকস্মিক উড়ে যাওয়ার কথা বলে জানতে চাইল, ওরা কি ভূমিকম্পের আতঙ্কেই ছিটকে উঠেছিল শূন্যে! ছাতারেরা চেঁচাল কি একই কারণে! এ প্রশ্নের জবাবে কী-ই বা বলব প্রমাণপত্র ছাড়া! তবে দুজনেই একমত হলাম—কারণ ভূমিকম্পই। গত ২৫ এপ্রিলের ঘটনা এটি।
ওই তিন জোড়া পাখি ছিল দিনেকানা, পুরো বাগেরহাট-খুলনায় যেটা যথেষ্ট পরিমাণে আছে। শৈশব-কৈশোরে এরা আমাদের নিত্য প্রতিবেশী ছিল, আছে আজও। গ্রামে গেলে সন্ধ্যায়, রাতে গ্রামের পথ ধরে হাঁটলে কিংবা রাতে ঘরে শুয়ে আমি আজও চারিদিক থেকে ভেসে আসা ওদের কাব্যিক জোরালো ডাক শুনতে পাই।
৩৩ সেন্টিমিটার লম্বা এই পাখিটির নাম দিনেকানা। ইংরেজি নাম Large-tailed nightjar। বৈজ্ঞানিক নাম Coprimulgus Macrurus। লেজের লম্বা দুটি পালকের তলা তুলোট-মখমল সাদা। এক নজরে বাদামি রঙের পাখিটি আমার কাছে ক্যামোফ্লেজ রঙা পাখি। মাটিতে বা ঝরাপাতার ওপরেই দিনে বসে বসে ঝিমোয়-ঘুমায়, দেখতে পাওয়া দুরূহ ব্যাপার। মাথা বড়, চ্যাপ্টা ধরনের। ছোট শক্তপোক্ত ঠোঁট। নিঃশব্দে ওড়ে। সারা দিন মাটিতে বসে থাকার পরে সন্ধ্যায় ডানা মেলে খেলনা কাগজের বিমানের মতো শৈল্পিক ভঙ্গিতে উড়ে-ঘুরে কমপক্ষে ১০ মিনিট যাবৎ ডানার আড়ষ্টতা কাটায়। মূল খাদ্য উড়ন্ত পোকা-পতঙ্গ। বাগেরহাট-খুলনা-সাতক্ষীরা-পিরোজপুর তথা সুন্দরবন লাগোয়া জেলাগুলোতে এদের দেখা মেলে বেশি। এই এলাকার ছেলে-বুড়োর কাছে এরা এক অতি পরিচিত পাখি। দুটি ডিম পাড়ে। প্রজনন মৌসুম বসন্ত-গ্রীষ্মকাল। কোন পাখি বাসা বাঁধে না? এ রকম প্রশ্নের জবাবে কোকিলসহ আরও কয়েকটি পাখির নাম বলা যাবে। বলা যাবে, এরা ডিম পাড়ে কাক-ছাতারে-কসাইসহ অন্যান্য কিছু পাখির বাসায়।
যদি প্রশ্ন করা হয়, কোন পাখি বাসা বাঁধে না, আবার পরের বাসায় ডিমও পাড়ে না? কিন্তু ডিম পেড়ে নিজেরাই তা দিয়ে ছানা ফোটায়? এর উত্তর হচ্ছে: দিনেকানা। আমাদের দেশে আরও দু-তিন রকম দিনেকানার দেখা মেলে। দিনেকানার ডিম-ছানা বহু বহুবার দেখেছি। আমার চোখে এরা রহস্যময় পাখি।
তিন জোড়া পাখির একত্রে শূন্যে ছিটকে উঠে ডানা মেলে ভেসে যাওয়ার দৃশ্যটা দেখে কৌতূহলী হলো কোবাদ খন্দকার, বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সে পায়ে পায়ে এগোল সামনের দিকে। প্রথম পাখি জোড়ার কাছে পৌঁছাতেই একটি ছিটকে উঠে হাত সাতেক দূরে গিয়ে মাটিতে বসল আবার। দ্বিতীয় পাখিটা তার পা থেকে মাত্র ফুট তিনেক দূরে—ব্যাঙের মতো গাল হা করে কোবাদকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে। বসল সে, হাত বাড়িয়ে পাখিটার মাথার চার-পাঁচ ইঞ্চি ওপরে রাখল, পাখিটা উড়েই মাত্র ১০-১২ ফুট দূরে গিয়ে মাটিতে বসল। মাটি মানে, এখানে দু-তিনটা বাঁশঝাড় আছে, তলাটা তাই ঝরা বাঁশপাতার আরামদায়ক বিছানা। ওই বিছানার ওপর থেকেই একটু আগে একসঙ্গে উড়েছিল তিন জোড়া পাখি।
হা করা পাখিটা উড়ে যেতেই কোবাদ দেখতে পেল ছানা দুটিকে—একেবারেই যেন বাঁশপাতার রং ওদের, বসে আছে পাশাপাশি। পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার। কোবাদ আঙুল বাড়িয়ে একটি ছানার মাথার তালুতে যেই না রেখেছে হাত, অমনি ওটাও ব্যাঙের মতো গাল হা করল।
আমার বাল্যবন্ধু বাগেরহাটের ফকিরহাটের সাতশৈয়া গ্রামের কোবাদের আমবাগান আছে একটা, বাগানের ওপরেই ঝুঁকে আছে পাশাপাশি দুটি বাঁশঝাড়, সে একজন শ্রমিক দিয়ে বাগানের পরিচর্যা করাচ্ছিল, নিজে বসে ছিল সবুজ ঘাসের ওপর। দুপুরের পরে বাড়ি ফিরে শোনে জলকম্প হয়েছে বাড়ির পুকুরটার জলে, দুই-পাঁচটা ছোট মাছও লাফিয়ে উঠেছিল ভয়ে। অর্থাৎ, ভূমিকম্প হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে কোবাদ মুঠোফোনে ঢাকা শহরের খবর জানতে চাইল আমার কাছে। কথা হলো প্রায় ১৭ মিনিট। সে তিন জোড়া পাখির আকস্মিক উড়ে যাওয়ার কথা বলে জানতে চাইল, ওরা কি ভূমিকম্পের আতঙ্কেই ছিটকে উঠেছিল শূন্যে! ছাতারেরা চেঁচাল কি একই কারণে! এ প্রশ্নের জবাবে কী-ই বা বলব প্রমাণপত্র ছাড়া! তবে দুজনেই একমত হলাম—কারণ ভূমিকম্পই। গত ২৫ এপ্রিলের ঘটনা এটি।
ওই তিন জোড়া পাখি ছিল দিনেকানা, পুরো বাগেরহাট-খুলনায় যেটা যথেষ্ট পরিমাণে আছে। শৈশব-কৈশোরে এরা আমাদের নিত্য প্রতিবেশী ছিল, আছে আজও। গ্রামে গেলে সন্ধ্যায়, রাতে গ্রামের পথ ধরে হাঁটলে কিংবা রাতে ঘরে শুয়ে আমি আজও চারিদিক থেকে ভেসে আসা ওদের কাব্যিক জোরালো ডাক শুনতে পাই।
৩৩ সেন্টিমিটার লম্বা এই পাখিটির নাম দিনেকানা। ইংরেজি নাম Large-tailed nightjar। বৈজ্ঞানিক নাম Coprimulgus Macrurus। লেজের লম্বা দুটি পালকের তলা তুলোট-মখমল সাদা। এক নজরে বাদামি রঙের পাখিটি আমার কাছে ক্যামোফ্লেজ রঙা পাখি। মাটিতে বা ঝরাপাতার ওপরেই দিনে বসে বসে ঝিমোয়-ঘুমায়, দেখতে পাওয়া দুরূহ ব্যাপার। মাথা বড়, চ্যাপ্টা ধরনের। ছোট শক্তপোক্ত ঠোঁট। নিঃশব্দে ওড়ে। সারা দিন মাটিতে বসে থাকার পরে সন্ধ্যায় ডানা মেলে খেলনা কাগজের বিমানের মতো শৈল্পিক ভঙ্গিতে উড়ে-ঘুরে কমপক্ষে ১০ মিনিট যাবৎ ডানার আড়ষ্টতা কাটায়। মূল খাদ্য উড়ন্ত পোকা-পতঙ্গ। বাগেরহাট-খুলনা-সাতক্ষীরা-পিরোজপুর তথা সুন্দরবন লাগোয়া জেলাগুলোতে এদের দেখা মেলে বেশি। এই এলাকার ছেলে-বুড়োর কাছে এরা এক অতি পরিচিত পাখি। দুটি ডিম পাড়ে। প্রজনন মৌসুম বসন্ত-গ্রীষ্মকাল। কোন পাখি বাসা বাঁধে না? এ রকম প্রশ্নের জবাবে কোকিলসহ আরও কয়েকটি পাখির নাম বলা যাবে। বলা যাবে, এরা ডিম পাড়ে কাক-ছাতারে-কসাইসহ অন্যান্য কিছু পাখির বাসায়।
যদি প্রশ্ন করা হয়, কোন পাখি বাসা বাঁধে না, আবার পরের বাসায় ডিমও পাড়ে না? কিন্তু ডিম পেড়ে নিজেরাই তা দিয়ে ছানা ফোটায়? এর উত্তর হচ্ছে: দিনেকানা। আমাদের দেশে আরও দু-তিন রকম দিনেকানার দেখা মেলে। দিনেকানার ডিম-ছানা বহু বহুবার দেখেছি। আমার চোখে এরা রহস্যময় পাখি।
No comments