‘সুলতান’ এরদোয়ানের হোঁচট খাওয়া by মনজুরুল হক
হোঁচট
খেলেন সুলতান। বেশ বড় রকমের হোঁচট বলা যায়, কেননা আঘাত দৃশ্যত হালকা মনে
হলেও কোমর সোজা রেখে তিনি আর দাঁড়াতে পারবেন কি না, সেই প্রশ্ন অনেকেই
ইতিমধ্যে রাখতে শুরু করেছেন। অথচ মাত্র কদিন আগেও মনে করা হচ্ছিল সুলতান
সম্ভবত ওসমানিয়া সাম্রাজ্যের প্রেতাত্মায় জীবন সঞ্চারিত করে নিজেই হয়ে
উঠবেন মুসলিম বিশ্বের অধীশ্বর, আর সেই সঙ্গে বিশ্বরাজনীতির একজন লড়াকু
খেলোয়াড়। অন্তত সে রকম এক গন্তব্য ঠিক করে নিয়েই হাঁটছিলেন তিনি এবং সেই
হাঁটার পথে অসতর্ক পদচারণ এখন সুলতানকে ফেলে দিয়েছে মস্ত বড় এক গাড্ডায়।
২০০৩ সালে প্রথমবারের মতো ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে টানা ১১ বছর তুরস্কের প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন ছিলেন রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে তুরস্কে এতটা দীর্ঘ সময় ধরে কোনো নেতাই ভোটের মাধ্যমে জনগণের আস্থা লাভ করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেননি। তুর্কি ভাষার আদ্যাক্ষরের সংক্ষিপ্ত নামকরণ একেপি নামে পরিচিত তুরস্কের ইসলামপন্থী ন্যায় ও গণতান্ত্রিক দলের নেতা সেটা পেরেছেন নিজেকে অনেকটা জনগণের কাছের মানুষ হিসেবে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে।
তাঁর এই অগ্রযাত্রা কণ্টকমুক্ত পথে হেঁটে যাওয়ার মধ্য দিয়ে হয়নি। কামাল আতাতুর্কের ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ধর্মনিরপেক্ষতার পতাকা সমুন্নত রাখা তুর্কি সামরিক বাহিনীর বিরোধিতা এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই জনতার সারিতে দাঁড়িয়ে সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন এরদোয়ান ও তাঁর অনুসারীরা।
ফলে জনতার আস্থাও তাঁরা সহজেই লাভ করতে পেরেছিলেন, যার ফলে ধর্মনিরপেক্ষ ইসলামি রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত তুরস্কে ২০০৩ সালে প্রথমবারের মতো সরকার গঠনে সক্ষম হয় একেপি এবং এরদোয়ান হয়ে ওঠেন জনতার পছন্দের নেতা। তবে তাঁর পতনের সূচনাও মনে হয় সেখান থেকেই।
ধর্মকে রাজনৈতিক প্রচারের বাহন হিসেবে ব্যবহার করা দল একেপি শুরু থেকেই হয়ে পড়েছিল একক নেতার ওপর নির্ভরশীল একটি দলে। এরদোয়ানের প্রভাব দলে এতটাই বিস্তৃত যে তাঁর নির্দেশের বাইরে কিছুই সেখানে হয় না। এ-ও যেন হচ্ছে আমাদের সেই সংস্কৃতি—অর্থাৎ, গণতন্ত্র সরকারের গঠনের বেলায় মেনে চলব, দলের ভেতরে নয়। সে রকম অবস্থায় এরদোয়ান নিজেও চাননি দলের ভেতরে কিংবা বাইরে তাঁকে চ্যালেঞ্জ করার মতো কেউ দাঁড়িয়ে যাক। ফলে ক্রমাগতই তিনি হয়ে উঠছিলেন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোর ভেতরের একজন একনায়ক।
কেবল নিজের মন্ত্রিসভা গঠনেই পছন্দের মানুষ তিনি বেছে নেননি, এমনকি দেশের সাংবিধানিক প্রধান প্রেসিডেন্টের পদ অলংকৃত করা মানুষটিও যেন হন তাঁরই একজন কলের পুতুল, সেটাও তিনি নিশ্চিত করে নিতে চেয়েছিলেন। সেই পথ ধরেই অবশ্য তুর্কি জনগণ প্রথমবারের মতো দেখতে পেয়েছিলেন জনতার কাতারের একজন নেতার ক্ষমতার মোহে ক্রমেই একনায়ক হয়ে ওঠার স্পষ্ট কিছু ছবি। নিজের দলের ঘনিষ্ঠজন আবদুল্লাহ গুলের প্রেসিডেন্টের পদে আসীন হয়ে প্রভাববলয় বাড়িয়ে নেওয়া পছন্দ হয়নি প্রধানমন্ত্রীর। ফলে একসময় তিনি ঠিক করে ফেলেন যে নিজেই তিনি বসবেন সেই পদে।
তবে পদের সঙ্গে সাংবিধানিক যেসব দায়বদ্ধতা প্রেসিডেন্টের ক্ষমতাকে করে দিচ্ছে অনেকটাই সীমিত, সেটাও তাঁর আবার পছন্দ নয়। ফলে তিনি চেয়েছিলেন সংবিধান রদবদল করে নিয়ে এমন একটি প্রেসিডেন্টের পদ তৈরি করে নিতে, নামে যেটা নির্বাহী প্রেসিডেন্ট হলেও কার্যত যেটা হবে সর্বময় ক্ষমতার কেন্দ্র। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক কাঠামোকে সামনে রেখে পরোক্ষ একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থা তুরস্কে তিনি গড়ে নিতে চেয়েছিলেন, যা কিনা ক্ষমতা থেকে তাঁকে অপসারণের প্রক্রিয়াকেও করে তুলবে খুবই কঠিন। আর সে রকম এক হিসাব থেকেই ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রীর পদে নিজের বশংবদ এক দলীয় নেতাকে বসিয়ে নিজে হয়ে ওঠেন প্রেসিডেন্ট।
তুরস্কের সংবাদমাধ্যমের একটি অংশ তখন থেকেই পরোক্ষে তাঁকে ‘সুলতান’ আখ্যায়িত করতে শুরু করে। নিজের হাতে আরও বেশি ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়ার প্রক্রিয়ায় বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তুর্কি নেতা। এমনকি নিজের ধর্মীয় মতাদর্শের মিত্র ফাতুল্লাহ গুলেনের সঙ্গেও একসময় দেখা দেয় তাঁর বিরোধ এবং নির্বাসিত সেই নেতার সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্তৃত্ব খর্ব করতে তিনি হয়ে ওঠেন খড়্গহস্ত। এতটা মাত্রাতিরিক্ত আত্মপ্রত্যয় যে পরোক্ষে তাঁকে নিয়ে যাচ্ছিল স্খলনের পথে, তা তিনি বিন্দুমাত্র আঁচ করতে পারেননি কিংবা চাননি। সে রকম বিধ্বংসী আত্মপ্রত্যয়ের আরেকটি প্রকাশ দেখা যায় শতাধিক কক্ষের নতুন প্রেসিডেন্ট ভবন নির্মাণের প্রক্রিয়ায়। এরদোয়ান দাবি করে বসেন আগের ভবনটি তেলাপোকায় এতটাই পরিপূর্ণ হয়ে গেছে যে মনুষ্যবাসের উপযোগী সেটা এখন আর নেই। নিজেকে তিনি হয়তো আতাতুর্কের প্রেতাত্মা থেকে দূরে রাখতে সচেষ্ট ছিলেন বলেই আতাতুর্কের সময় থেকে রাষ্ট্রপ্রধানদের বসবাসের সেই প্রাসাদ তাঁর মনঃপূত হয়নি।
অনেকেই অবশ্য প্রশ্ন করছেন, এরদোয়ান কেন আগে থেকে সংবিধান সংশোধন করে না নিয়ে নিজে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর সংবিধানের ওপর হস্তক্ষেপ করার জন্য ২০১৫ সালের নির্বাচনের অপেক্ষায় ছিলেন? দুটি ভিন্ন হিসাব সেই পথে অগ্রসর হতে তুর্কি নেতাকে অনুপ্রাণিত করেছে।
প্রথমটি হলো এমন কারও ওপর তিনি আস্থা রাখতে পারছিলেন না, যিনি কিনা সংবিধান সংশোধিত হয়ে যাওয়ার পর প্রচুর ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকা প্রেসিডেন্টের পদটি স্বেচ্ছায় তাঁর জন্য ছেড়ে দেবেন। কে জানে ক্ষমতার মোহে আটকা পড়ে গিয়ে নিজেরই সে রকম কোনো অধস্তন হয়তো পাকিস্তানের জুলফিকার আলী ভুট্টোর মতো একই পরিণতির দিকে তাঁকেও ঠেলে দিতে পারে। একনায়কের মনমানসিকতার এ হচ্ছে মস্ত এক দায়। কাউকেই পুরোপুরি বিশ্বাস করা তাঁদের পক্ষে কখনোই সম্ভব হয় না। আর তাই কোনো রকম ঝুঁকি এরদোয়ান নিশ্চিতভাবেই নিতে চাননি।
আর দ্বিতীয় অঙ্কটি হচ্ছে তাঁর হিসাবের ভুল, একনায়কসুলভ গণতান্ত্রিক নেতারা যে ভুল প্রায় সব সময় করে থাকেন। দীর্ঘকাল ধরে ক্ষমতাসীন থেকে বিরোধীদের সব রকমভাবে কোণঠাসা করে দেওয়ার পর তিনি অনেকটা নিশ্চিত ছিলেন যে সংবিধান বদলের জন্য প্রয়োজন হওয়া দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করা তাঁর জন্য কোনো ব্যাপারই নয়। আর এসব ভুলের সমন্বিত ফলাফল হচ্ছে তাঁর এই হোঁচট খাওয়া।
একেপি এখনো তুরস্কে হচ্ছে সংসদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল। তবে সরকার গঠনের মতো নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দলের না থাকায় শেষ পর্যন্ত হয়তো দ্বিতীয় কোনো শরিককে নিয়ে আবারও দল ক্ষমতাসীন হবে। আর সংবিধান পরিবর্তন সম্ভব না হওয়ায় এরদোয়ান হয়ে উঠবেন ঠুঁটো জগন্নাথ প্রেসিডেন্ট, নতুন প্রধানমন্ত্রী যঁার ওপর কোনো অবস্থাতেই আর সেভাবে নির্ভরশীল হবেন না। ফলে মাত্র কিছুদিন আগের পরাক্রমশালী নেতা এর মধ্য দিয়ে কোণঠাসা হয়ে পড়লেও তুরস্কের গণতন্ত্রের জন্য সেটা অবশ্যই নতুন সুবাতাস।
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক৷
২০০৩ সালে প্রথমবারের মতো ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে টানা ১১ বছর তুরস্কের প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন ছিলেন রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে তুরস্কে এতটা দীর্ঘ সময় ধরে কোনো নেতাই ভোটের মাধ্যমে জনগণের আস্থা লাভ করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেননি। তুর্কি ভাষার আদ্যাক্ষরের সংক্ষিপ্ত নামকরণ একেপি নামে পরিচিত তুরস্কের ইসলামপন্থী ন্যায় ও গণতান্ত্রিক দলের নেতা সেটা পেরেছেন নিজেকে অনেকটা জনগণের কাছের মানুষ হিসেবে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে।
তাঁর এই অগ্রযাত্রা কণ্টকমুক্ত পথে হেঁটে যাওয়ার মধ্য দিয়ে হয়নি। কামাল আতাতুর্কের ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ধর্মনিরপেক্ষতার পতাকা সমুন্নত রাখা তুর্কি সামরিক বাহিনীর বিরোধিতা এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই জনতার সারিতে দাঁড়িয়ে সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন এরদোয়ান ও তাঁর অনুসারীরা।
ফলে জনতার আস্থাও তাঁরা সহজেই লাভ করতে পেরেছিলেন, যার ফলে ধর্মনিরপেক্ষ ইসলামি রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত তুরস্কে ২০০৩ সালে প্রথমবারের মতো সরকার গঠনে সক্ষম হয় একেপি এবং এরদোয়ান হয়ে ওঠেন জনতার পছন্দের নেতা। তবে তাঁর পতনের সূচনাও মনে হয় সেখান থেকেই।
ধর্মকে রাজনৈতিক প্রচারের বাহন হিসেবে ব্যবহার করা দল একেপি শুরু থেকেই হয়ে পড়েছিল একক নেতার ওপর নির্ভরশীল একটি দলে। এরদোয়ানের প্রভাব দলে এতটাই বিস্তৃত যে তাঁর নির্দেশের বাইরে কিছুই সেখানে হয় না। এ-ও যেন হচ্ছে আমাদের সেই সংস্কৃতি—অর্থাৎ, গণতন্ত্র সরকারের গঠনের বেলায় মেনে চলব, দলের ভেতরে নয়। সে রকম অবস্থায় এরদোয়ান নিজেও চাননি দলের ভেতরে কিংবা বাইরে তাঁকে চ্যালেঞ্জ করার মতো কেউ দাঁড়িয়ে যাক। ফলে ক্রমাগতই তিনি হয়ে উঠছিলেন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোর ভেতরের একজন একনায়ক।
কেবল নিজের মন্ত্রিসভা গঠনেই পছন্দের মানুষ তিনি বেছে নেননি, এমনকি দেশের সাংবিধানিক প্রধান প্রেসিডেন্টের পদ অলংকৃত করা মানুষটিও যেন হন তাঁরই একজন কলের পুতুল, সেটাও তিনি নিশ্চিত করে নিতে চেয়েছিলেন। সেই পথ ধরেই অবশ্য তুর্কি জনগণ প্রথমবারের মতো দেখতে পেয়েছিলেন জনতার কাতারের একজন নেতার ক্ষমতার মোহে ক্রমেই একনায়ক হয়ে ওঠার স্পষ্ট কিছু ছবি। নিজের দলের ঘনিষ্ঠজন আবদুল্লাহ গুলের প্রেসিডেন্টের পদে আসীন হয়ে প্রভাববলয় বাড়িয়ে নেওয়া পছন্দ হয়নি প্রধানমন্ত্রীর। ফলে একসময় তিনি ঠিক করে ফেলেন যে নিজেই তিনি বসবেন সেই পদে।
তবে পদের সঙ্গে সাংবিধানিক যেসব দায়বদ্ধতা প্রেসিডেন্টের ক্ষমতাকে করে দিচ্ছে অনেকটাই সীমিত, সেটাও তাঁর আবার পছন্দ নয়। ফলে তিনি চেয়েছিলেন সংবিধান রদবদল করে নিয়ে এমন একটি প্রেসিডেন্টের পদ তৈরি করে নিতে, নামে যেটা নির্বাহী প্রেসিডেন্ট হলেও কার্যত যেটা হবে সর্বময় ক্ষমতার কেন্দ্র। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক কাঠামোকে সামনে রেখে পরোক্ষ একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থা তুরস্কে তিনি গড়ে নিতে চেয়েছিলেন, যা কিনা ক্ষমতা থেকে তাঁকে অপসারণের প্রক্রিয়াকেও করে তুলবে খুবই কঠিন। আর সে রকম এক হিসাব থেকেই ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রীর পদে নিজের বশংবদ এক দলীয় নেতাকে বসিয়ে নিজে হয়ে ওঠেন প্রেসিডেন্ট।
তুরস্কের সংবাদমাধ্যমের একটি অংশ তখন থেকেই পরোক্ষে তাঁকে ‘সুলতান’ আখ্যায়িত করতে শুরু করে। নিজের হাতে আরও বেশি ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়ার প্রক্রিয়ায় বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তুর্কি নেতা। এমনকি নিজের ধর্মীয় মতাদর্শের মিত্র ফাতুল্লাহ গুলেনের সঙ্গেও একসময় দেখা দেয় তাঁর বিরোধ এবং নির্বাসিত সেই নেতার সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্তৃত্ব খর্ব করতে তিনি হয়ে ওঠেন খড়্গহস্ত। এতটা মাত্রাতিরিক্ত আত্মপ্রত্যয় যে পরোক্ষে তাঁকে নিয়ে যাচ্ছিল স্খলনের পথে, তা তিনি বিন্দুমাত্র আঁচ করতে পারেননি কিংবা চাননি। সে রকম বিধ্বংসী আত্মপ্রত্যয়ের আরেকটি প্রকাশ দেখা যায় শতাধিক কক্ষের নতুন প্রেসিডেন্ট ভবন নির্মাণের প্রক্রিয়ায়। এরদোয়ান দাবি করে বসেন আগের ভবনটি তেলাপোকায় এতটাই পরিপূর্ণ হয়ে গেছে যে মনুষ্যবাসের উপযোগী সেটা এখন আর নেই। নিজেকে তিনি হয়তো আতাতুর্কের প্রেতাত্মা থেকে দূরে রাখতে সচেষ্ট ছিলেন বলেই আতাতুর্কের সময় থেকে রাষ্ট্রপ্রধানদের বসবাসের সেই প্রাসাদ তাঁর মনঃপূত হয়নি।
অনেকেই অবশ্য প্রশ্ন করছেন, এরদোয়ান কেন আগে থেকে সংবিধান সংশোধন করে না নিয়ে নিজে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর সংবিধানের ওপর হস্তক্ষেপ করার জন্য ২০১৫ সালের নির্বাচনের অপেক্ষায় ছিলেন? দুটি ভিন্ন হিসাব সেই পথে অগ্রসর হতে তুর্কি নেতাকে অনুপ্রাণিত করেছে।
প্রথমটি হলো এমন কারও ওপর তিনি আস্থা রাখতে পারছিলেন না, যিনি কিনা সংবিধান সংশোধিত হয়ে যাওয়ার পর প্রচুর ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকা প্রেসিডেন্টের পদটি স্বেচ্ছায় তাঁর জন্য ছেড়ে দেবেন। কে জানে ক্ষমতার মোহে আটকা পড়ে গিয়ে নিজেরই সে রকম কোনো অধস্তন হয়তো পাকিস্তানের জুলফিকার আলী ভুট্টোর মতো একই পরিণতির দিকে তাঁকেও ঠেলে দিতে পারে। একনায়কের মনমানসিকতার এ হচ্ছে মস্ত এক দায়। কাউকেই পুরোপুরি বিশ্বাস করা তাঁদের পক্ষে কখনোই সম্ভব হয় না। আর তাই কোনো রকম ঝুঁকি এরদোয়ান নিশ্চিতভাবেই নিতে চাননি।
আর দ্বিতীয় অঙ্কটি হচ্ছে তাঁর হিসাবের ভুল, একনায়কসুলভ গণতান্ত্রিক নেতারা যে ভুল প্রায় সব সময় করে থাকেন। দীর্ঘকাল ধরে ক্ষমতাসীন থেকে বিরোধীদের সব রকমভাবে কোণঠাসা করে দেওয়ার পর তিনি অনেকটা নিশ্চিত ছিলেন যে সংবিধান বদলের জন্য প্রয়োজন হওয়া দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করা তাঁর জন্য কোনো ব্যাপারই নয়। আর এসব ভুলের সমন্বিত ফলাফল হচ্ছে তাঁর এই হোঁচট খাওয়া।
একেপি এখনো তুরস্কে হচ্ছে সংসদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল। তবে সরকার গঠনের মতো নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দলের না থাকায় শেষ পর্যন্ত হয়তো দ্বিতীয় কোনো শরিককে নিয়ে আবারও দল ক্ষমতাসীন হবে। আর সংবিধান পরিবর্তন সম্ভব না হওয়ায় এরদোয়ান হয়ে উঠবেন ঠুঁটো জগন্নাথ প্রেসিডেন্ট, নতুন প্রধানমন্ত্রী যঁার ওপর কোনো অবস্থাতেই আর সেভাবে নির্ভরশীল হবেন না। ফলে মাত্র কিছুদিন আগের পরাক্রমশালী নেতা এর মধ্য দিয়ে কোণঠাসা হয়ে পড়লেও তুরস্কের গণতন্ত্রের জন্য সেটা অবশ্যই নতুন সুবাতাস।
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক৷
No comments