যুদ্ধাপরাধের বিচার নুরেমবার্গ থেকে ঢাকা by শাহরিয়ার কবির
পশ্চিম ইউরোপের অধিকাংশ দেশ, আমেরিকা,
কানাডা, রাশিয়া, ইসরাইল ও আরও কয়েকটি দেশ যুদ্ধাপরাধ সহ মানবতাবিরোধী বহু
কর্মকান্ড যা আন্তর্জাতিক আইন ও রীতিনীতির পরিপন্থী সেসব তাদের দেশীয় আইনে
সংজ্ঞায়িত করে বিচারের ক্ষেত্র প্রসারিত করেছে।
নুরেমবার্গ ট্রাইবুনালে ‘গণহত্যা’ স্বতন্ত্র অপরাধ হিসেবে সংজ্ঞায়িত হয়নি।
ঢাকার ট্রাইবুনাল গণহত্যাকে স্বতন্ত্র অপরাধ হিসেবে গণ্য করেছে এবং এই
ট্রাইবুনালে অভিযুক্ত আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে
প্রথম রায়ে এ বিষয়ে নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশের আগে কোনও
দেশের নিজস্ব আইনে গণহত্যা (মবহড়পরফব)-কে অপরাধ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়নি।
ইংরেজিতে দুটি শব্দ সধংং শরষষরহম ও মবহড়পরফব-এর বাংলা গণহত্যা, কিন্তু দুটির অর্থ এক নয়। সধংং শরষষরহম হচ্ছে নির্বিচারে হত্যা, যা বাংলাদেশে সংঘটিত হয়েছিল ১৯৭১-এর ২৫ মার্চের পর। কিন্তু এই সধংং শরষষরহম দ্রুত মবহড়পরফব-এ রূপান্তরিত হয়েছে যখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায় বিশেষভাবে হিন্দুরা। এর পাশাপাশি আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী-সমর্থক এবং স্বাধীনতার পক্ষের বাঙালি জাতি। একটি নৃগোষ্ঠী, সম্প্রদায় ও জাতিকে যখন সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে হত্যা এবং অন্যান্য প্রক্রিয়ায় নিশ্চিহ্নকরণের উদ্যোগ নেয়া হয় সেটা মবহড়পরফব. গণহত্যা বিশেষজ্ঞ মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আর জে রুমেল এই ধরনের গণহত্যাকে আরও বিভাজন করেছেন। একটি হচ্ছে সরকার বা রাষ্ট্র কর্তৃক, অপরটি হচ্ছে সরকারের বাইরের কোন গোষ্ঠী, দল বা সম্প্রদায় কর্তৃক। সরকার কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যাকে রুমেল অভিহিত করেছেন ফবসড়পরফব হিসেবে। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশে সধংং শরষষরহম, মবহড়পরফব, ঢ়ড়ষরঃরপরফব ও ফবসড়পরফব সব ধরনের হত্যা সংঘটিত হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে আইএমটির চেয়ে আইসিটির অবস্থান স্বচ্ছ এবং নিঃসন্দেহে দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী। দেশীয় আইন ও দেশীয় আদালতে গণহত্যার বিচার করে বাংলাদেশ যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, গত শতাব্দীতে গণহত্যার শিকার অথচ বিচারবঞ্চিত এমন বহু দেশের জন্য তা অনুকরণযোগ্য বিবেচিত হবে।
যুদ্ধাপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনাল যে বিশাল আয়োজনের পাশাপাশি আইনী লড়াইয়ের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে আইএমটির প্রতিদিনের ধারাবিবরণী পাঠের অভিজ্ঞতা থেকে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় বিশ্বের বিচারব্যবস্থায় তা এক অনন্য অধ্যায়, অতীতে যেমনটি দেখা যায়নি, ভবিষ্যতেও যাবে কি না সন্দেহ। বাংলাদেশে আইসিটির আয়োজন আইএমটির আয়োজনের তুলনায় কিছুই নয়। কিন্তু যে সীমিত সম্পদ, লোকবল ও রসদ সম্বল করে ঢাকার ট্রাইব্যুনাল যাত্রা শুরু করেছে, দশ মাসের ভেতর একটি মামলার শুনানি শেষ করে রায় দিয়েছে তাতে সংশ্লিষ্টদের দেশপ্রেম ও পেশাগত দক্ষতার পাশাপাশি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দৃঢ়তা প্রতিফলিত হয়েছে।
নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হয়েছিল অপরাধ সংগঠনের অব্যবহিত পরে অথচ বাংলাদেশে বিচার শুরু হয়েছে প্রায় চল্লিশ বছর পর। সময়ের ব্যবধানে বহু প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগী মৃত্যুবরণ করেছেন, বহু তথ্যপ্রমাণও হারিয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে অধিকাংশ সময় ক্ষমতায় ছিল ’৭১-এর গণহত্যাকারীরা এবং তাদের সহযোগীরা। ক্ষমতায় থাকার সুযোগে তারা বহু তথ্যপ্রমাণ নষ্ট করেছে এবং পাঠ্যপুস্তক ও প্রচার মাধ্যম থেকে ’৭১-এর গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ শুধু নয় সমগ্র মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মুছে ফেলতে চেয়েছে। মুক্তিযুদ্ধোত্তর একটি প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনাহীনতার এক অন্ধকার সময়ের ভেতর। যাদের অনেকে পাকিস্তানী লেখক এবং তাদের বাংলাদেশী দোসরদের মিথ্যাচারের শিকার। তার মনে করে ’৭১-এ তিরিশ লাখ মানুষের গণহত্যা, সোয়া চার লাখ নারীর পাশবিক নির্যাতন ইত্যাদি পরিসংখ্যান অতিরঞ্জিত। তারা মনে করে ’৭১-এ কোন মুক্তিযুদ্ধ হয়নি, পশ্চিম পাকিস্তানের ভাইদের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের ভাইদের কিছু রাজনৈতিক বিষয়ে মতপার্থক্যকে হিন্দু ভারত গৃহযুদ্ধে রূপান্তরিত করেছে এবং এই গৃহযুদ্ধের সুযোগে ভারত পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ সৃষ্টি করেছে। আওয়ামী লীগ ভারতের এই চক্রান্তের প্রধান সহযোগী ছিল এবং এখনও ভারতের স্বার্থে কাজ করছে। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে এদেশের মানুষের অনন্যসাধারণ ত্যাগ, জীবনদান, শৌর্যবীর্যের পাশাপাশি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসরদের দ্বারা নৃশংসতম গণহত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ যেমন সংঘটিত হয়েছে, গণহত্যার একই নৃশংসতায় হত্যা করা হয়েছে ইতিহাসের এই অমোঘ সত্য। এই কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে ঢাকায় আইসিটি যে রায় দিয়েছে তা ইতিহাসের বহু বিস্মৃত সত্যকে মিথ্যার অন্ধকার বিবর থেকে মুক্ত করেছে।
আইসিটির প্রথম রায়ে গণহত্যার নৃশংসতা উপলব্ধির জন্য বাচ্চু রাজাকারের কয়েকটি হত্যা, ধর্মান্তকরণ ও ধর্ষণের উল্লেখ করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাচ্চু রাজাকার যাদের হত্যা করা হয়েছে ধর্মীয় পরিচয়ে তারা হিন্দু সম্প্রদায়ের। রাজাকারদের গণহত্যার যে পদ্ধতি ফরিদপুরের নগরকান্দায় অনুসৃত হয়েছে সারা দেশের চিত্র তারই সমার্থক। এই রায়ের সমালোচনা করতে গিয়ে জামায়াতে ইসলামীর কিছু ভাড়াটে গণমাধ্যম, পেশাজীবী ও মানবাধিকার সংগঠন মন্তব্য করেছে অভিযুক্ত ব্যক্তি একজন ধর্মপ্রচারক, ইসলামী চিন্তাবিদ তার বিচারের অর্থ হচ্ছে ইসলামকে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো, তার মৃত্যুদ- সরকারের ইসলামবিরোধী মনোভাবের প্রকাশ ইত্যাদি। এরা মনে করেহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, লুণ্ঠন প্রভৃতি অপরাধ ইসলামের সমার্থক। ১৯৭১ সালে ইসলামের দোহাই দিয়েই জামায়াতে ইসলামী গণহত্যা ও নারীধর্ষণ সহ যাবতীয় মানবতাবিরোধী নৃশংস অপরাধকে বৈধতা দিয়েছিল। একজন ধর্মপ্রচারক কিভাবে ভিন্ন ধর্মের অনুসারী বস্তু জগৎ ও পার্থিব স্বার্থের বিপরীতে আধ্যাত্মিক জগতের অনুসারী আটজন সাধু সন্ন্যাসীকে হত্যা করতে পারে এ প্রশ্নের জবাব দেয়ার প্রয়োজন তারা মনে করে না। হত্যার হুমকি দিয়ে ধর্মান্তরকরণের মতো নিষ্ঠুরতা কিভাবে অনুমোদন করা যায়? অঞ্জলী সাহাকে যেভাবে ধর্ষণ করা হয়েছে, যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, যেভাবে তাকে দাহ করতে বাধা দেয়া হয়েছেএ ধরনের নৃশংসতার ঘটনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের হলোকাস্টের পর পৃথিবীর কোথাও ঘটেনি। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর চেয়ে তাদের সহযোগীদের অপরাধের নৃশংসতা কোনও অংশে কম ছিল না। ঢাকার ট্রাইব্যুনালের রায়ে এ বিষয়টি যথাযথভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।
নুরেমবার্গ ও টোকিও ট্রাইব্যুনাল চরিত্রগতভাবে ছিল সামরিক আদালত। আদালতের রায় ছিল চূড়ান্ত। এর বিরুদ্ধে অভিযুক্তকে আপিলের সুযোগ দেওয়া হয়নি। ঢাকার ‘আইসিটি’র আইনে অভিযুক্তকে ট্রাইবুনালের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রীমকোর্টে আপিলের সুযোগ দেয়া হয়েছে। নিঃসন্দেহে এটি মানবাধিকারের বিবেচনায় নুরেমবার্গ ও টোকিওর চেয়ে মানসম্পন্ন।
নুরেমবার্গ ট্রাইবুনালে নাৎসি যুদ্ধাপরাধীদের যখন বিচার হয় তখন সমগ্র জার্মানি যুদ্ধবিধ্বস্থ। পৃথিবীর কোথাও অভিযুক্ত নাৎসিদের প্রতি সহানুভূতি জানাবার মতো কেউ ছিল না। ’৭১-এর গণহত্যার সময় সৌদি আরব তথা মুসলিম উম্মাহ পাকিস্তানি সামরিক জান্তা এবং তাদের বাঙালি সহযোগীদের পক্ষে ছিল। আমেরিকা, চীন, আফ্রিকা এবং পশ্চিম ইউরোপের বহু দেশ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পাকিস্তানের গণহত্যাকে সমর্থন করেছে। ২০০৯ সালে ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধী ও গণহত্যাকারীদের বিচারের উদ্যোগ গ্রহণের পর পরই অপরাধীদের প্রধান দল জামায়াতে ইসলামী বিচার প্রশ্নবিদ্ধ ও বিঘিœত করাবার জন্য শত শত কোটি টাকা ব্যয় করে তাদের পক্ষে লবিস্ট নিয়োগ করেছে, তাদের পক্ষে বহু গণমাধ্যম কর্মী, মানবাধিকার কর্মী এবং বিভিন্ন সংগঠনকে ভাড়া করেছে এই বিচার সম্পর্কে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্য। আইসিটির ভেতরেও তাদের অবস্থান সম্পর্কে ওয়াকিবহাল মহল অবগত রয়েছেন। নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালকে এ ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়নি। বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বহু কারণেই নুরেমবার্গে নাৎসি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের তুলনায় অনেক বেশি জটিল। নাৎসি দর্শনের একনিষ্ঠ অনুসারী জামায়াতে ইসলামীর মিত্র যেমন দেশের ভেতরে আছে তার চেয়ে বেশি আছে দেশের বাইরে। পাকিস্তানসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জামায়াতের কোন প্রভু বা বন্ধুরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে বিচারের বিরোধিতা না করলেও কয়েকটি দেশ ও সেসব দেশের আল কায়দার সহযোগীরা অনানুষ্ঠানিক ও পরোক্ষভাবে এই বিচার সম্পর্কে ধারাবাহিকভাবে অপপ্রচার ও নেতিবাচক মনোভাব প্রদর্শন করছে যে সুযোগ নুরেমবার্গ ট্রাইবুনালে বিচারাধীন যুদ্ধাপরাধীদের ছিল না।
নুরেমবার্গে ২২ জন অভিযুক্ত ও ৭টি সংগঠনের বিরুদ্ধে মামলার রায় একসঙ্গে দেয়া হয়েছে। আইসিটি প্রতিটি অভিযুক্তের জন্য পৃথক অভিযোগনামা প্রণয়নের পাশাপাশি শুনানি করেছে পৃথকভাবে এবং রায় প্রদানও শুরু হয়েছে পৃথকভাবে। এতে অভিযুক্তরা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ বেশি পেয়েছেন। নুরেমবার্গে প্রথম মামলার রায় পরবর্তী পর্যায়ের বিচারের ক্ষেত্রে কতগুলো বিষয়ে দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে। ঢাকার আইসিটির প্রথম রায়ের একাধিক পর্যবেক্ষণ ও মন্তব্য পরবর্তী মামলাসমূহের রায় কিছুটা সহজ করে দিয়েছে। যদিও বাচ্চু রাজাকারের বিচার হয়েছে তার অনুপস্থিতিতে, তার নিজস্ব আইনজীবী ছিলেন না, রাষ্ট্র তার জন্য আইনজীবী নিয়োগ করেছে, পলাতক থাকার কারণে তার পক্ষে সুপ্রিম কোর্টে আপিলেরও সুযোগ নেই যা অন্যদের আছে; তা সত্ত্বেও ‘প্রধান প্রসিকিউটর বনাম মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ওরফে আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু (পলাতক)’ শীর্ষক মামলার রায়ে যেভাবে ‘ঐতিহাসিক পটভূমিকা’, ‘ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ার’, ‘অভিযোগ প্রমাণের দায়’, ‘পটভূমি ও প্রসঙ্গ’, ‘ত্রিপক্ষীয় চুক্তি ও ১৯৫ পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীর দায়মুক্তি’ ‘অপরাধের সংজ্ঞা ও উপাদান’, ‘অভিযোগের বিচার’, ‘১৯৭১ সালে বাংলাদেশ ভূখন্ডে বিরাজমান প্রেক্ষিত’ প্রভৃতি অনুচ্ছেদে এমন কিছু মন্তব্য রয়েছে যা বাংলাদেশে এবং আন্তর্জাতিক বিচার ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হিসেবে বিবেচিত হবে।
দেশীয় আইনে এবং দেশীয় আদালতে আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার নিঃসন্দেহে অত্যন্ত দুরূহ কাজ। এ ক্ষেত্রে ট্রাইবুনালের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তদন্ত সংস্থা, আইনজীবী, প্রশাসনিক বিভাগ ও বিচারকদের পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না, কিন্তু তাদের সামনে ছিল নুরেমবার্গ, টোকিও ও ম্যানিলা থেকে আরম্ভ করে চলমান কম্বোডিয়ার বিচারের ইতিহাস ও কার্যক্রম; এসব বিচারের ইতিবাচক ও নেতিবাচক বিষয়সমূহ। ঢাকার ট্রাইবুনালের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা পড়াশোনা করেছেন, বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করেছেন এবং নিজেদের কর্মক্ষেত্রের বিশাল অভিজ্ঞতার আলোকে ’৭১-এর গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের মামলার প্রথম রায় প্রদান করেছেন।
নুরেমবার্গ থেকে আরম্ভ করে কম্বোডিয়া পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যার অপরাধে ঘটনার দীর্ঘ চল্লিশ বছরের ব্যবধানে বিচার একমাত্র বাংলাদেশেই আরম্ভ হয়েছে। এই বিচার ও প্রথম রায় প্রমাণ করেছে দেশের জনগণ ও সরকার যদি চায় অপরাধ যত অতীতেই ঘটুক না কেন স্বজনহারাদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে তাদের দুঃসহ বেদনা সম্পূর্ণ উপশম না হোক লাঘব করা সম্ভব।
এই বিচার যাতে অব্যাহত থাকে এখনই প্রয়োজন আইন প্রণয়ন করে অস্থায়ী ট্রাইবুনালকে স্থায়ী ট্রাইবুনালে রূপ দেয়া। আরও প্রয়োজন বিচার বিলম্বিত, প্রশ্নবিদ্ধ ও বানচাল করবার যাবতীয় ষড়যন্ত্র, সহিংসতা ও অন্তর্ঘাত প্রতিহতকরণের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর অবস্থান গ্রহণ। এসব ষড়যন্ত্র ও অন্তর্ঘাত দেশের ভেতর মোকাবেলা করতে হবে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও আইনগতভাবে এবং দেশের বাইরে করতে হবে সর্বাত্মক কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে।
আমরা আরও চাই নুরেমবার্গের মতো ঢাকার ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল’ ভবন একদিন জাদুঘরে পরিণত হবে। ‘গণহত্যা’, ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’, ‘শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ’ ও ‘যুদ্ধাপরাধের’ স্থান জাদুঘরের বাইরে আর কোথাও হওয়া উচিৎ নয়। সকল দেশের সকল অপরাধীর বিচার ও শাস্তির মাধ্যমে এই প্রত্যাশা পূরণ সম্ভব। বাংলাদেশ সেই প্রত্যাশা তখনই পূরণ করতে পারবে যেদিন ঢাকার আইসিটি শেষ যুদ্ধাপরাধীর বিচার সম্পন্ন করে আনুষ্ঠানিকভাবে বিচারকার্যের সমাপ্তি ঘোষণা করবে। (সমাপ্ত)
ইংরেজিতে দুটি শব্দ সধংং শরষষরহম ও মবহড়পরফব-এর বাংলা গণহত্যা, কিন্তু দুটির অর্থ এক নয়। সধংং শরষষরহম হচ্ছে নির্বিচারে হত্যা, যা বাংলাদেশে সংঘটিত হয়েছিল ১৯৭১-এর ২৫ মার্চের পর। কিন্তু এই সধংং শরষষরহম দ্রুত মবহড়পরফব-এ রূপান্তরিত হয়েছে যখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায় বিশেষভাবে হিন্দুরা। এর পাশাপাশি আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী-সমর্থক এবং স্বাধীনতার পক্ষের বাঙালি জাতি। একটি নৃগোষ্ঠী, সম্প্রদায় ও জাতিকে যখন সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে হত্যা এবং অন্যান্য প্রক্রিয়ায় নিশ্চিহ্নকরণের উদ্যোগ নেয়া হয় সেটা মবহড়পরফব. গণহত্যা বিশেষজ্ঞ মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আর জে রুমেল এই ধরনের গণহত্যাকে আরও বিভাজন করেছেন। একটি হচ্ছে সরকার বা রাষ্ট্র কর্তৃক, অপরটি হচ্ছে সরকারের বাইরের কোন গোষ্ঠী, দল বা সম্প্রদায় কর্তৃক। সরকার কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যাকে রুমেল অভিহিত করেছেন ফবসড়পরফব হিসেবে। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশে সধংং শরষষরহম, মবহড়পরফব, ঢ়ড়ষরঃরপরফব ও ফবসড়পরফব সব ধরনের হত্যা সংঘটিত হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে আইএমটির চেয়ে আইসিটির অবস্থান স্বচ্ছ এবং নিঃসন্দেহে দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী। দেশীয় আইন ও দেশীয় আদালতে গণহত্যার বিচার করে বাংলাদেশ যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, গত শতাব্দীতে গণহত্যার শিকার অথচ বিচারবঞ্চিত এমন বহু দেশের জন্য তা অনুকরণযোগ্য বিবেচিত হবে।
যুদ্ধাপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনাল যে বিশাল আয়োজনের পাশাপাশি আইনী লড়াইয়ের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে আইএমটির প্রতিদিনের ধারাবিবরণী পাঠের অভিজ্ঞতা থেকে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় বিশ্বের বিচারব্যবস্থায় তা এক অনন্য অধ্যায়, অতীতে যেমনটি দেখা যায়নি, ভবিষ্যতেও যাবে কি না সন্দেহ। বাংলাদেশে আইসিটির আয়োজন আইএমটির আয়োজনের তুলনায় কিছুই নয়। কিন্তু যে সীমিত সম্পদ, লোকবল ও রসদ সম্বল করে ঢাকার ট্রাইব্যুনাল যাত্রা শুরু করেছে, দশ মাসের ভেতর একটি মামলার শুনানি শেষ করে রায় দিয়েছে তাতে সংশ্লিষ্টদের দেশপ্রেম ও পেশাগত দক্ষতার পাশাপাশি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দৃঢ়তা প্রতিফলিত হয়েছে।
নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হয়েছিল অপরাধ সংগঠনের অব্যবহিত পরে অথচ বাংলাদেশে বিচার শুরু হয়েছে প্রায় চল্লিশ বছর পর। সময়ের ব্যবধানে বহু প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগী মৃত্যুবরণ করেছেন, বহু তথ্যপ্রমাণও হারিয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে অধিকাংশ সময় ক্ষমতায় ছিল ’৭১-এর গণহত্যাকারীরা এবং তাদের সহযোগীরা। ক্ষমতায় থাকার সুযোগে তারা বহু তথ্যপ্রমাণ নষ্ট করেছে এবং পাঠ্যপুস্তক ও প্রচার মাধ্যম থেকে ’৭১-এর গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ শুধু নয় সমগ্র মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মুছে ফেলতে চেয়েছে। মুক্তিযুদ্ধোত্তর একটি প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনাহীনতার এক অন্ধকার সময়ের ভেতর। যাদের অনেকে পাকিস্তানী লেখক এবং তাদের বাংলাদেশী দোসরদের মিথ্যাচারের শিকার। তার মনে করে ’৭১-এ তিরিশ লাখ মানুষের গণহত্যা, সোয়া চার লাখ নারীর পাশবিক নির্যাতন ইত্যাদি পরিসংখ্যান অতিরঞ্জিত। তারা মনে করে ’৭১-এ কোন মুক্তিযুদ্ধ হয়নি, পশ্চিম পাকিস্তানের ভাইদের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের ভাইদের কিছু রাজনৈতিক বিষয়ে মতপার্থক্যকে হিন্দু ভারত গৃহযুদ্ধে রূপান্তরিত করেছে এবং এই গৃহযুদ্ধের সুযোগে ভারত পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ সৃষ্টি করেছে। আওয়ামী লীগ ভারতের এই চক্রান্তের প্রধান সহযোগী ছিল এবং এখনও ভারতের স্বার্থে কাজ করছে। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে এদেশের মানুষের অনন্যসাধারণ ত্যাগ, জীবনদান, শৌর্যবীর্যের পাশাপাশি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসরদের দ্বারা নৃশংসতম গণহত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ যেমন সংঘটিত হয়েছে, গণহত্যার একই নৃশংসতায় হত্যা করা হয়েছে ইতিহাসের এই অমোঘ সত্য। এই কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে ঢাকায় আইসিটি যে রায় দিয়েছে তা ইতিহাসের বহু বিস্মৃত সত্যকে মিথ্যার অন্ধকার বিবর থেকে মুক্ত করেছে।
আইসিটির প্রথম রায়ে গণহত্যার নৃশংসতা উপলব্ধির জন্য বাচ্চু রাজাকারের কয়েকটি হত্যা, ধর্মান্তকরণ ও ধর্ষণের উল্লেখ করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাচ্চু রাজাকার যাদের হত্যা করা হয়েছে ধর্মীয় পরিচয়ে তারা হিন্দু সম্প্রদায়ের। রাজাকারদের গণহত্যার যে পদ্ধতি ফরিদপুরের নগরকান্দায় অনুসৃত হয়েছে সারা দেশের চিত্র তারই সমার্থক। এই রায়ের সমালোচনা করতে গিয়ে জামায়াতে ইসলামীর কিছু ভাড়াটে গণমাধ্যম, পেশাজীবী ও মানবাধিকার সংগঠন মন্তব্য করেছে অভিযুক্ত ব্যক্তি একজন ধর্মপ্রচারক, ইসলামী চিন্তাবিদ তার বিচারের অর্থ হচ্ছে ইসলামকে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো, তার মৃত্যুদ- সরকারের ইসলামবিরোধী মনোভাবের প্রকাশ ইত্যাদি। এরা মনে করেহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, লুণ্ঠন প্রভৃতি অপরাধ ইসলামের সমার্থক। ১৯৭১ সালে ইসলামের দোহাই দিয়েই জামায়াতে ইসলামী গণহত্যা ও নারীধর্ষণ সহ যাবতীয় মানবতাবিরোধী নৃশংস অপরাধকে বৈধতা দিয়েছিল। একজন ধর্মপ্রচারক কিভাবে ভিন্ন ধর্মের অনুসারী বস্তু জগৎ ও পার্থিব স্বার্থের বিপরীতে আধ্যাত্মিক জগতের অনুসারী আটজন সাধু সন্ন্যাসীকে হত্যা করতে পারে এ প্রশ্নের জবাব দেয়ার প্রয়োজন তারা মনে করে না। হত্যার হুমকি দিয়ে ধর্মান্তরকরণের মতো নিষ্ঠুরতা কিভাবে অনুমোদন করা যায়? অঞ্জলী সাহাকে যেভাবে ধর্ষণ করা হয়েছে, যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, যেভাবে তাকে দাহ করতে বাধা দেয়া হয়েছেএ ধরনের নৃশংসতার ঘটনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের হলোকাস্টের পর পৃথিবীর কোথাও ঘটেনি। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর চেয়ে তাদের সহযোগীদের অপরাধের নৃশংসতা কোনও অংশে কম ছিল না। ঢাকার ট্রাইব্যুনালের রায়ে এ বিষয়টি যথাযথভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।
নুরেমবার্গ ও টোকিও ট্রাইব্যুনাল চরিত্রগতভাবে ছিল সামরিক আদালত। আদালতের রায় ছিল চূড়ান্ত। এর বিরুদ্ধে অভিযুক্তকে আপিলের সুযোগ দেওয়া হয়নি। ঢাকার ‘আইসিটি’র আইনে অভিযুক্তকে ট্রাইবুনালের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রীমকোর্টে আপিলের সুযোগ দেয়া হয়েছে। নিঃসন্দেহে এটি মানবাধিকারের বিবেচনায় নুরেমবার্গ ও টোকিওর চেয়ে মানসম্পন্ন।
নুরেমবার্গ ট্রাইবুনালে নাৎসি যুদ্ধাপরাধীদের যখন বিচার হয় তখন সমগ্র জার্মানি যুদ্ধবিধ্বস্থ। পৃথিবীর কোথাও অভিযুক্ত নাৎসিদের প্রতি সহানুভূতি জানাবার মতো কেউ ছিল না। ’৭১-এর গণহত্যার সময় সৌদি আরব তথা মুসলিম উম্মাহ পাকিস্তানি সামরিক জান্তা এবং তাদের বাঙালি সহযোগীদের পক্ষে ছিল। আমেরিকা, চীন, আফ্রিকা এবং পশ্চিম ইউরোপের বহু দেশ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পাকিস্তানের গণহত্যাকে সমর্থন করেছে। ২০০৯ সালে ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধী ও গণহত্যাকারীদের বিচারের উদ্যোগ গ্রহণের পর পরই অপরাধীদের প্রধান দল জামায়াতে ইসলামী বিচার প্রশ্নবিদ্ধ ও বিঘিœত করাবার জন্য শত শত কোটি টাকা ব্যয় করে তাদের পক্ষে লবিস্ট নিয়োগ করেছে, তাদের পক্ষে বহু গণমাধ্যম কর্মী, মানবাধিকার কর্মী এবং বিভিন্ন সংগঠনকে ভাড়া করেছে এই বিচার সম্পর্কে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্য। আইসিটির ভেতরেও তাদের অবস্থান সম্পর্কে ওয়াকিবহাল মহল অবগত রয়েছেন। নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালকে এ ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়নি। বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বহু কারণেই নুরেমবার্গে নাৎসি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের তুলনায় অনেক বেশি জটিল। নাৎসি দর্শনের একনিষ্ঠ অনুসারী জামায়াতে ইসলামীর মিত্র যেমন দেশের ভেতরে আছে তার চেয়ে বেশি আছে দেশের বাইরে। পাকিস্তানসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জামায়াতের কোন প্রভু বা বন্ধুরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে বিচারের বিরোধিতা না করলেও কয়েকটি দেশ ও সেসব দেশের আল কায়দার সহযোগীরা অনানুষ্ঠানিক ও পরোক্ষভাবে এই বিচার সম্পর্কে ধারাবাহিকভাবে অপপ্রচার ও নেতিবাচক মনোভাব প্রদর্শন করছে যে সুযোগ নুরেমবার্গ ট্রাইবুনালে বিচারাধীন যুদ্ধাপরাধীদের ছিল না।
নুরেমবার্গে ২২ জন অভিযুক্ত ও ৭টি সংগঠনের বিরুদ্ধে মামলার রায় একসঙ্গে দেয়া হয়েছে। আইসিটি প্রতিটি অভিযুক্তের জন্য পৃথক অভিযোগনামা প্রণয়নের পাশাপাশি শুনানি করেছে পৃথকভাবে এবং রায় প্রদানও শুরু হয়েছে পৃথকভাবে। এতে অভিযুক্তরা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ বেশি পেয়েছেন। নুরেমবার্গে প্রথম মামলার রায় পরবর্তী পর্যায়ের বিচারের ক্ষেত্রে কতগুলো বিষয়ে দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে। ঢাকার আইসিটির প্রথম রায়ের একাধিক পর্যবেক্ষণ ও মন্তব্য পরবর্তী মামলাসমূহের রায় কিছুটা সহজ করে দিয়েছে। যদিও বাচ্চু রাজাকারের বিচার হয়েছে তার অনুপস্থিতিতে, তার নিজস্ব আইনজীবী ছিলেন না, রাষ্ট্র তার জন্য আইনজীবী নিয়োগ করেছে, পলাতক থাকার কারণে তার পক্ষে সুপ্রিম কোর্টে আপিলেরও সুযোগ নেই যা অন্যদের আছে; তা সত্ত্বেও ‘প্রধান প্রসিকিউটর বনাম মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ওরফে আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু (পলাতক)’ শীর্ষক মামলার রায়ে যেভাবে ‘ঐতিহাসিক পটভূমিকা’, ‘ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ার’, ‘অভিযোগ প্রমাণের দায়’, ‘পটভূমি ও প্রসঙ্গ’, ‘ত্রিপক্ষীয় চুক্তি ও ১৯৫ পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীর দায়মুক্তি’ ‘অপরাধের সংজ্ঞা ও উপাদান’, ‘অভিযোগের বিচার’, ‘১৯৭১ সালে বাংলাদেশ ভূখন্ডে বিরাজমান প্রেক্ষিত’ প্রভৃতি অনুচ্ছেদে এমন কিছু মন্তব্য রয়েছে যা বাংলাদেশে এবং আন্তর্জাতিক বিচার ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হিসেবে বিবেচিত হবে।
দেশীয় আইনে এবং দেশীয় আদালতে আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার নিঃসন্দেহে অত্যন্ত দুরূহ কাজ। এ ক্ষেত্রে ট্রাইবুনালের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তদন্ত সংস্থা, আইনজীবী, প্রশাসনিক বিভাগ ও বিচারকদের পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না, কিন্তু তাদের সামনে ছিল নুরেমবার্গ, টোকিও ও ম্যানিলা থেকে আরম্ভ করে চলমান কম্বোডিয়ার বিচারের ইতিহাস ও কার্যক্রম; এসব বিচারের ইতিবাচক ও নেতিবাচক বিষয়সমূহ। ঢাকার ট্রাইবুনালের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা পড়াশোনা করেছেন, বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করেছেন এবং নিজেদের কর্মক্ষেত্রের বিশাল অভিজ্ঞতার আলোকে ’৭১-এর গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের মামলার প্রথম রায় প্রদান করেছেন।
নুরেমবার্গ থেকে আরম্ভ করে কম্বোডিয়া পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যার অপরাধে ঘটনার দীর্ঘ চল্লিশ বছরের ব্যবধানে বিচার একমাত্র বাংলাদেশেই আরম্ভ হয়েছে। এই বিচার ও প্রথম রায় প্রমাণ করেছে দেশের জনগণ ও সরকার যদি চায় অপরাধ যত অতীতেই ঘটুক না কেন স্বজনহারাদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে তাদের দুঃসহ বেদনা সম্পূর্ণ উপশম না হোক লাঘব করা সম্ভব।
এই বিচার যাতে অব্যাহত থাকে এখনই প্রয়োজন আইন প্রণয়ন করে অস্থায়ী ট্রাইবুনালকে স্থায়ী ট্রাইবুনালে রূপ দেয়া। আরও প্রয়োজন বিচার বিলম্বিত, প্রশ্নবিদ্ধ ও বানচাল করবার যাবতীয় ষড়যন্ত্র, সহিংসতা ও অন্তর্ঘাত প্রতিহতকরণের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর অবস্থান গ্রহণ। এসব ষড়যন্ত্র ও অন্তর্ঘাত দেশের ভেতর মোকাবেলা করতে হবে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও আইনগতভাবে এবং দেশের বাইরে করতে হবে সর্বাত্মক কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে।
আমরা আরও চাই নুরেমবার্গের মতো ঢাকার ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল’ ভবন একদিন জাদুঘরে পরিণত হবে। ‘গণহত্যা’, ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’, ‘শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ’ ও ‘যুদ্ধাপরাধের’ স্থান জাদুঘরের বাইরে আর কোথাও হওয়া উচিৎ নয়। সকল দেশের সকল অপরাধীর বিচার ও শাস্তির মাধ্যমে এই প্রত্যাশা পূরণ সম্ভব। বাংলাদেশ সেই প্রত্যাশা তখনই পূরণ করতে পারবে যেদিন ঢাকার আইসিটি শেষ যুদ্ধাপরাধীর বিচার সম্পন্ন করে আনুষ্ঠানিকভাবে বিচারকার্যের সমাপ্তি ঘোষণা করবে। (সমাপ্ত)
No comments