অবস্থানে নতুন প্রজন্ম ॥ ফেসবুকে লাখ লাখের সমর্থন ॥ শাহবাগ বসন্ত!
’৭১ ঘাতক জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার
ফাঁসির দাবিতে ক্ষোভে বিক্ষোভে উত্তাল দেশ। কোটি মানুষের প্রতিবাদী কণ্ঠে
ধ্বনিত হচ্ছে একটি কথাই- চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় না
হলে কেউ ঘরে ফিরবে না।
মিছিল আর স্লোগানে উত্তাল ঢাকার
রাজপথ। রাস্তা অবরোধ করে রাজধানীর শাহবাগে হাজার হাজার মানুষ অবস্থান নিয়ে
বিক্ষোভ কর্মসূচী পালন করছে। এখানে তৈরি করা হয়েছে প্রতীকী ফাঁসির মঞ্চ।
চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের কুশপুতুল ঝুলানো হয়েছে ল্যাম্প পোস্টে। চলছে
প্রতিবাদী গান, স্লোগান আর কবিতা পাঠ। এতে সংহতি প্রকাশ করেছে বিএনপি ও
মৌলবাদী দলগুলো ছাড়া সকল রাজনৈতিক দল, মুক্তিযোদ্ধা, আইনজীবী, প্রগতিশীল ও
মুক্তিযুদ্ধের সংগঠন থেকে শুরু করে শিক্ষক, সাংবাদিক, বিভিন্ন
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ সকল শ্রেণী পেশার মানুষ। চট্টগ্রাম,
কক্সবাজার, সিলেট, খুলনা, নেত্রকোনাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়েছে
মানুষ দিনভর।
রাজধানীর শহবাগের কর্মসূচীতে যোগ দিতে ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলা উপজেলা থেকেও এসেছেন অনেকে। কেউ অফিস ছুটি নিয়ে, ঘরের রান্না রেখে শিশু সন্তানকে কোলে গৃহিণীরাও ছুটি এসেছেন বিবেকের তাড়নায়। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রায়ে ক্ষুব্ধ ও দেশপ্রেমিক মানুষের ঢল নামে শাহবাগে। এছাড়ার প্রেসক্লাব, মতিঝিলসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় কাদের মোল্লার রায় প্রত্যাখ্যান করে ফাঁসির
দাবিতে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ, ওয়ার্কার্স পার্টি, কমিউনিস্ট পার্টিসহ পৃথক পৃথকভাবে বিক্ষোভ করেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন।
মঙ্গলবার কাদের মোল্লার রায় ঘোষণার পর বিকেল থেকে শাহবাগের রাস্তা অবরোধ করে ব্লগার এ্যান্ড অনলাইন এ্যাকটিভিস্ট নেটওর্য়াক নামের ফেসবুকভিত্তিক একটি সামাজিক সংগঠন। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় স্লোগান ‘৭১ নামের আরেক সংগঠন। এরা সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এদিকে কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, ব্লগ, টুইটারে মন্তব্যের শেষ নেই। আন্দোলনকারীদের মুখে মুখে মিসরের তাহ্রীর স্কয়ারের মতো শাহবাগ নতুন করে ‘শাহবাগ স্কয়ারসহ নতুন প্রজন্ম স্কয়ার’ নামে পরিচিতি পাচ্ছে।
আয় রে আয় ডাক দিয়েছে মায় ॥ দিনভর প্রতিবাদী গান আর সেøাগানে মুখরিত শাহবাগ। দেশপ্রেমিক হাজারো জনতার ভিড়ে সেøাগানে সেøাগানে প্রকম্পিত হয় রাজপথ। বাস, রিকশাসহ অন্যান্য যানবাহন থেকে নেমে আসে সাধারণ মানুষ। প্রতিবাদী গান আর সেøাগানের মধ্যে ছিল- আয় রে আয় ডাক দিয়েছে মায়, অস্তিত্বের সংগ্রামে আজ জোট বাঁধ সবাই/পাকিস্তানের প্রেতাত্মা পাকিস্তানেই ফিরে যা/লাখো শহীদ ডাক পাঠালো সারাবাংলায় খবর দে, সারাবাংলা ঘেরাও করে জামায়াত-শিবির কবর দে/কারা মোর ঘর ভেঙ্গেছে স্মরণ আছে/ জামায়াত-শিবির রাজাকার এ মুহূর্তে বাংলা ছাড়, বাংলাদেশের মাটিতে জামায়াত শিবিরের ঠাঁই নেই/আমাদের ধমনিতে শহীদের রক্ত/শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না, তোমার আমার ঠিকানা শাহবাগ-শাহবাগ। গান, কবিতা আর সেøাগানের ফাঁকে ফাঁকে চরুকলার শিক্ষার্থীরা রাজাকারের নতুন নতুন কুশপুতুল তৈরি করে শহবাগ মোড়ে এনে জড়ো করে। মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচিয়ে হাজারো মানুষ যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত রাখার শপথ নেন।
এক দাবি, ফাঁসি চাই ॥ রায় পুনর্বিবেচনার মাধ্যমে ফাঁসির আদেশ না আসা পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন শাহবাগের আন্দোলনকারীরা। সোমবার কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায় ঘোষণার পর পরই শুরু হয় বিক্ষোভ। রাতভর প্রতিবাদী গান, কবিতা, মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র ও প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনীর মাধ্যমে এবং কাদের মোল্লাকে ছয়বার প্রতীকী ফাঁসিতে ঝুলিয়ে একাত্তরের শহীদদের রক্তের ঋণ শোধের দাবি জানায় হাজারো তরুণ।
বুধবার সকালের পর থেকেই আন্দোলনে যোগ হয় নতুন মাত্রা। হরতালের মধ্যেও বিভিন্ন সংগঠন ও নানা শ্রেণী পেশার মানুষ দলে দলে শাহবাগের জমায়েতে যোগ দেন। বিকেলের পর প্রতিবাদী মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে। এখানে সংহতি প্রকাশ করে বক্তব্য রাখেন দেশের বিশিষ্টজনসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ। সকলে সমবেত কণ্ঠে সমবেত কণ্ঠে সেøাগান তোলেন- ‘যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি চাই।’
আন্দোলনকারীরা শাহবাগ মোড়ের চারদিকে চারটি সিগন্যাল পোস্টে যুদ্ধাপরাধীদের চারটি কুশপুতুল ঝুলিয়ে দিয়েছেন। মাঝখানে রয়েছে কাদের মোল্লার কুশপুতুল। এছাড়া সাপের আকৃতিতে বানানো হয়েছে জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের একটি কুশপুতুল। আঁকা হয়েছে রাজাকার লুডু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার শিক্ষার্থীরা রাস্তার বিভিন্ন প্রান্তে রাজাকারের ভয়ঙ্কর রুদ্রমূর্তির ছবি, ফাঁসির দাবিতে বিভিন্ন সেøাগান লেখেন দিনভর। আন্দোলনকারীরা শাহবাগ মোড়ের নতুন নামকরণ করে রেখেছেনÑনতুন প্রজন্ম স্কয়ার।
অসুস্থ বিক্ষোভকারীদের জন্য জাতীয় জাদুঘরের একটি কক্ষে প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিক্ষোভকারীদের মধ্যে খাবার সংগ্রহ করেছেন সাধারণ মানুষ। ওয়াসা থেকে পাঠানো হয় পানি। ঢোল, করতাল, ঢাক বাদ্য বাজনায় আয়োজন করে ঢাবির সাংস্কৃতিক ছাত্র সংগঠনসমূহের পক্ষ থেকে। রাতে কয়েক হাজার মানুষের জন্য রান্নার ব্যবস্থা করা হয়।
বিক্ষোভ সমাবেশে বিশিষ্টজনদের ॥ প্রতিক্রিয়া শাহবাগের বিক্ষোভ সমাবেশে সংহতি প্রকাশ করে বক্তব্য রেখেছেন দেশের বিশিষ্টজনরা। কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তির রায় না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মুক্তিযোদ্ধারাও। রাজাকারের হাতে স্বজন হারানো মানুষরা হুঁশিয়ারি দেন, যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে প্রয়োজনে আবারও মাঠে নামবেন তারা। কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আদালতের রায়ে জাতি হতাশ। আর এ হতাশা থেকেই সারাদেশের মানুষের মধ্যে ক্ষোভ আর বিক্ষোভ দানা বাঁধছে।
পরিবেশ ও বনমন্ত্রী হাসান মাহামুদ বলেন, কাদের মোল্লা যে অপরাধ করেছে তাতে তার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- হওয়া উচিত। আদালত যে রায় দিয়েছে তাতে সরকার ও আওয়ামী লীগও হতাশ। এ থেকে প্রমাণিত হয় যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া পুরোপুরি স্বচ্ছতা বজায় রেখে চলছে। যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে চলমান আন্দোলন অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান তিনি। কাদের মোল্লার ছয়বার প্রতীকী ফাঁসির মধ্যে প্রথম ফাঁসি হয় রাত ১টার দিকে। শাহবাগ মোড়ের বিশ্ববিদ্যালয়গামী পথে পাকিস্তানের পতাকা খচিত পোশাক পরা অবস্থায় প্রথম ফাঁসি হয়। প্রতীকী ফাঁসির সময় তরুণ-তরুণীদের কণ্ঠে বার বার উচ্চারিত হয়- দড়ি ধরে দেব টান/ফাঁসি দিয়ে নেব জান, এমন রায় দিলো কে/কসাইটাকে ঝুলিয়ে দে, নিজামী-মুজাহিদ ভাই ভাই/এক রশিতে ফাঁসি চাই, জামায়াত-শিবির রাজাকার/রক্ত চোষা জানোয়ার, আমরা আছি থাকব/সুখে দুখে লড়বো। দ্বিতীয় প্রতীকী ফাঁসির উদ্যোক্তা ছিল নাটকের দল তীরন্দাজ। রাত আড়াইটার দিকে মুক্তির গান চলচ্চিত্র শেষ হয়।
কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে শাহবাগে হাজির হন যুক্তরাজ্য প্রবাসী নাফিসা শামসুদ্দিন। অকুপাই ইউকের এই কর্মী টানা আট মাস রাস্তায় ক্যাম্প করে মাঠে ছিলেন দাবি আদায়ের জন্য। বর্তমানে ঢাকাভিত্তিক একটি মানবাধিকার সংস্থার মিডিয়া ও ক্যাম্পেইন পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার কেএম সফিউল্লাহ আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করে তিনি বলেন, আমি এখানে বক্তৃতা দিতে আসিনি। হতাশা ব্যক্ত করতে এসেছি। কাদের মোল্লা এত খুন করার পরও তার মৃত্যুদ- হয়নি। তাহলে কত খুন হলে তাকে মৃত্যুদ- দেয়া হতো?
সমাবেশে সংহতি প্রকাশ করে শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া বলেন, জনতার আদালতে কাদের মোল্লার ফাঁসি হয়েছে। তিনি বলেন, শেখ হাসিনার নির্বাচনী ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির রায়ের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু তা হয়নি। উপস্থিত তরুণদের উদ্দেশে তিনি বলেন, মঙ্গলবার থেকে আজ পর্যন্ত প্রতিবাদীদের যে অবস্থান তা সত্যি অভাবনীয়। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন সংহতি জানিয়ে দেয়া ভাষণে বলেন, চল্লিশ বছর ধরে আন্দোলন করছি। এখন এ আন্দোলনের ভার এখানকার এই নতুন প্রজন্মের হাতে তুলে দিলাম। তিনি সাঈদীর মামলার রায় না হওয়া পর্যন্ত এ অবস্থান চালিয়ে যাবার জন্য বলেন। তার এ বক্তব্যর পর অবস্থান নেয়া তরুণ প্রজন্ম দৃঢ় কণ্ঠে জানায় সাঈদীর রায় না হওয়া অবধি তারা এ অবস্থান চালিয়ে যাবে।
কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদ- মানেন না মুক্তিযোদ্ধা ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণী। কাদেরের ফাঁসি না হলে আন্দোলনের মঞ্চ ছাড়বেন না বলেও জানান তিনি। বুধবার বিকেলে শাহবাগের সমাবেশে সংহতি প্রকাশ করে তিনি একথা বলেন। একাত্তরে অমানুষিক নির্যাতনের শিকার সাহসী এই নারী জানান, আমরা যে আন্দোলন শুরু করেছিলাম, সংগ্রামী নতুন প্রজন্ম সেই আন্দোলনের সহযোদ্ধা হয়েছেন। রাজাকারের ফাঁসি না হওয়া পর্যন্ত আমরা মঞ্চ ছাড়ব না। তিনি এ সময় শাহবাগ চত্বরকে ‘প্রজন্ম চত্বর’ বলে ঘোষণা দেন।
এর আগে, আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন তথ্য কমিশনার অধ্যাপক সাদেকা হালিম। তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে এ রায় আমি মানি না। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমেই আপনারা যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি দাবি করুন।
ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম বলেন, কাদের মোল্লার রায়ে জাতি হতাশ হয়েছে। নতুন প্রজন্ম নতুন যুদ্ধে প্রত্যাশিত বিজয় ছিনিয়ে আনবে বলে আমার বিশ্বাস। মেজর (অব) কামরুল ইসলাম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এতদিন তোমরা কোথায় ছিলে। কার সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করতে আসব। কথা বলেই বুঝিয়ে দিলেন এ যেন তার নিজের আন্দোলন। প্রাণেরই চাওয়া। ডাকসুর সাবেক ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। এখান থেকে সরে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক গোলাম রহমান বলেন, আমি মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম। এই রায়ে জাতি হতাশ, আমিও হতাশ।
কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার অন্যতম সাক্ষী শহিদুল হক মামা সংহতি প্রকাশ করে বলেন, বিবেকের তাড়নায় হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে বাংলাদেশে এসেছি। কিন্তু রায়ে খুশি হতে পারিনি। ক্ষোভ জানাচ্ছি। এখন কথা একটাই সারাবাংলা ঘেরাও কর-জামায়াত- শিবির খতম কর। অন্যথায় ওরা ‘৭১-এর মতো আবারও আমাদের আঘাত করবে। কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে প্রত্যাশিত রায় না হওয়ার বিচারকদের সমালোচনাও করেন তিনি।
আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করেন এবং বক্তব্য রাখেন রাশেদ খান মেনন, আনিসুর রহমান মল্লিক, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, ইসরাফিল আলম, দুর্গাদাশ ভট্টাচার্য, আবদুস সোবহান গোলাপ, সাংবাদিক আবেদ খান, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য নূর উল আলম লেনিন, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কাজী রোজী, সাংবাদিক গোলাম সারওয়ার, অজয় রায়, পংকজ ভট্টাচার্য, সাংবাদিক আবু সাঈদ খান, প্রবীর সিকদার, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, গোলাম কুদ্দুস, পংকজ দেবনাথ, মুক্তিযোদ্ধা সেকান্দার খান, এ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, শিরিন আকতার ও দীপা খন্দকার।
সংহতি প্রকাশ করে জগন্নাথ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা কলেজ, বদরুন্নোসা কলেজ, ইডেন কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র পরিষদ, বিআইডব্লিউটিএ মুক্তিযোদ্ধা প্রাতিষ্ঠানিক ইউনিট, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, কমিউনিস্ট পার্টি, গণতন্ত্রী পার্টি, জাসদ, বাসদ, বিপ্লবী গণতান্ত্রিক পার্টি, গণতন্ত্রী পার্টিসহ প্রগতিশীল বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ দেশপ্রেমিক মানুষ সমাবেশে যোগ দেন।
ছাত্রদল নেই ॥ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে দুদিন শাহবাগের অবস্থান কর্মসূচীতে যোগ দিয়েছে প্রগতিশীল সকল ছাত্র সংগঠন। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বলে কথা নয়, দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বুধবার সকাল থেকে দলে দলে শাহবাগের সমাবেশে এসে সংহতি প্রকাশ করে। বাস্তব চিত্র হলো সকল আদর্শিক মতভেদ ভুলে কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে শাহবাগে এককাট্টা হয়েছে প্রগতিশীল সকল ছাত্র সংগঠন। সেখানে বুধবার রাত পর্যন্ত শুধু জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলকে দেখা যায়নি। মূল সংগঠন বিএনপির মতো ছাত্রদলও প্রতিক্রিয়াহীন। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ এবং ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রমৈত্রী, জাসদ ছাত্রলীগ, বাম সংগঠনগুলোর জোট, প্রগতিশীল ছাত্রজোটসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন একে একে মিছিল নিয়ে সমাবেশে সংহতি প্রকাশ করে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রদলের সভাপতি আবদুল কাদের ভূঁইয়া কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।
যৌক্তিক কারণেই রায় প্রত্যাখ্যান সাংস্কৃতিক জোটের ॥ অনেক বিচারক ভয়ভীতি, লোভ-লালসার উর্ধে উঠতে পারেননি বলে মন্তব্য করেছেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের নেতারা। নেতারা বলেন, বাচ্চু রাজাকারের চেয়ে অনেক অভিযোগে অভিযুক্ত থাকার পরও কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন সাজা মেনে নেয়া যায় না। বিচারকদের এজন্য একদিন জনগণের কাছে জবাদিহি করতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তারা। বুধবার দুপুরে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব অভিযোগ করেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের নেতারা। তারা বলেন, এ রায়ে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। এ রায়ের সঙ্গে জনমতের কোন সম্পর্ক নেই। তাই এ রায় গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করার জন্য সরকারের প্রতি জোর দাবি জানান তারা। সংবাদ সম্মেলনে বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব আসাদুজ্জামান নূর বলেন, আমরা আশা করেছিলাম এবার একুশে ফেব্রুয়ারির আগে সব যুদ্ধপরাধীর বিচার শেষ হবে। কিন্তু এটা হলো না।
মফিজুল হক বলেন, বিচারকরা নানা দিক পর্যালোচনা করে রায় দিলেও এটা নিয়ে জনগণ স্বস্তি পায়নি। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন- সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, লোকশিল্পী ফকির আলমগীর ও গোলাম কদ্দুস।
চট্টগ্রামের জামালখান হয়ে উঠেছে আরেক শাহবাগ ॥ এবার জেগেছে চট্টগ্রাম। জনতার উপস্থিতিতে মুখর চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব চত্বর। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে মানুষের উপস্থিতি। জনতার বিপুল অংশগ্রহণে নগরীর জামালখান হয়ে উঠছে আরেক ‘শাহবাগ’। হয়ে উঠছে চট্টগ্রামের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারীদের ঠিকানা। ক্ষুব্ধ-ব্যথিত সকলের দাবি একটাই, সাড়ে তিনশ‘ খুন ও ধর্ষণের অপরাধী একাত্তরের কসাই আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসি। জামালখানে সমাবেত হয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ নগরীর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীসহ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোও। এছাড়া কাদের মোল্লার লঘু শাস্তি প্রত্যাখ্যান করে তার প্রতীকী ফাঁসি দিয়েছে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) শিক্ষার্থীরা।
প্রয়োজনে হরতাল দেবে আওয়ামী লীগ ॥ জামায়াতের ডাকা বুধবারের দেশব্যাপী হরতালের সময় রাজধানীর মিরপুরে হরতালবিরোধী মিছিল বের করেছে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ। মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদ-ের রায়ের বিরুদ্ধে মিছিলে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান নেতাকর্মীরা। প্রয়োজনে আওয়ামী এ রায়ের বিরুদ্ধে হরতাল দেবে, এমন মতামত ব্যক্ত করেন তারা। স্থানীয় সাংসদ কামাল আহমেদ মজুমদার বলেন, ওরা (জামায়াত) কি হরতাল দিচ্ছে, হরতাল দেয়ার কথা তো আমাদের। কাফরুল থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি জামাল মোস্তফা বলেন, এই রায় আমরা মানি না। প্রয়োজনে আওয়ামী লীগ রায়ের বিরুদ্ধে হরতাল দেবে।
দেশজুড়ে মিছিল সমাবেশ ॥ সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বুধবার সকাল থেকে রায় প্রত্যাখ্যান করে সর্বস্তরের হাজারো মানুষ জড়ো হতে থাকে। অধ্যাপক জাফর ইকবাল বলেন, নতুন প্রজন্ম রায়ের বিরুদ্ধে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। আশাকরি তাদের আন্দোলনে আমাদের বিজয় সুনিশ্চিত। এছাড়া যশোর, খুলনা, নেত্রকোনা শহীদ মিনারের দুপুরের পর থেকে কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে সমাবেশে যোগ দেয় হাজারো মানুষ।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বিক্ষোভ ॥ রায় প্রত্যাখ্যান করে কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে রাজধানীতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন বিক্ষোভ করেছে। জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বুধবার বিকেলে বিক্ষোভ করে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পাটি ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল। এই দুই দলের বাম জোট যৌথভাবে দেশব্যাপী ‘বিক্ষোভ দিবস’ পালন করে। এছাড়াও ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী প্রতিবাদী গান ও সমাবেশ করে। এসব কর্মসূচীতে পেশাজীবী নারী সমাজ, যুব ইউনিয়ন, খেলাঘর, ছাত্র ইউনিয়ন, গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরাম, বাংলাদেশ কৃষক সমিতি ও মহিলা পরিষদ সংগঠন। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে টিএসসি চত্বরে মানববন্ধন করেছে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন।
আজ আটটা থেকে সমাবেশ শুক্রবার মহাসমাবেশ ॥ বুধবার সন্ধ্যার পর ঘুরে ফিরে যাওয়া মানুষের উদ্দেশ্যে আন্দোলনকারী নেতারা মাইকে ঘোষণা দেন, বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা থেকে সমাবেশ শুরু হবে। এ সময় তারা আরও জানান, শুক্রবারও টানা চতুর্থদিনের মতো এই কর্মসূচী চলবে। ওইদিন সকাল ৮টায় শাহবাগ মোড়ে মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে।
হতাশ টিআইবি, প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ বলছে নির্মূল কমিটি ॥ আবদুল কাদের মোল্লার রায়ে হতাশা প্রকাশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থাটি অনতিবিলম্বে যথাযথ আইনী প্রক্রিয়া অনুসরণ করে আপীলসহ রায় পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছে। বুধবার এক বিবৃতিতে টিআইবি এ হতাশার কথা জানায়।
বিবৃতিতে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আদালতের রায়ের প্রতি সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা ও গভীর আস্থা রেখেই টিআইবি মনে করে, আবদুল কাদের মোল্লার ব্যাপারে প্রদত্ত রায় জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। এ রায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও শহীদদের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শনের জন্য পর্যাপ্ত নয়, বরং অবমাননাকর। আমরা হতাশ, লজ্জিত ও মর্মাহত। অপরাধের গুরুত্ব অনুসারে এরই মধ্যে বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে ঘোষিত রায়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য না থাকায় জনমনে যে হতাশা, ক্ষোভ ও আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয়েছে তা প্রকারান্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের বিরোধী পক্ষকে শক্তিশালী করবে। কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে দেয়া রায়ের ব্যাপারে জনপ্রতিক্রিয়া ও আইনী অভিজ্ঞতাকে বিবেচনায় নিয়ে প্রয়োজনে এ সংক্রান্ত আইনের সম্ভাব্য দুর্বলতার যথাযথ সংস্কার করে সর্বোচ্চ দৃঢ়তা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে মানবতাবিরোধী অপরাধের ন্যায়বিচার সম্পন্ন করার আহ্বান জানিয়েছে টিআইবি।
এদিকে অপর এক বিবৃতিতে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি এ রায়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছে, এ রায়ের মাধ্যমে ৩০ লাখ বাঙালীর আত্মদান, লাখ লাখ মা বোনের সম্ভ্রমহানিকে উপহাস ও অপমান করা হয়েছে। ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। কাদের মোল্লার রায় আমাদের প্রত্যাশা পূরণে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে।
খুলনায় বিক্ষোভ ॥ স্টাফ রিপোর্টার খুলনা থেকে জানিয়েছেন, কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে এবং জামায়াত-শিবিরের দেশব্যাপী হত্যা, অগ্নিসংযোগ ও ভাংচুরের প্রতিবাদে বুধবার খুলনা মহানগর ও জেলা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে নগরীতে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। একই দাবিতে ছাত্রলীগ পিকচার প্যালেস মোড়ে অবস্থান কর্মসূচী পালন করেছে।
খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ১৪ দলের সমন্বয়ক মিজানুর রহমান মিজানের সভাপতিত্বে দলীয় কার্যালয়ের সামনে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগ নেতা এ্যাডভোকেট চিশতি সোহরাব হোসেন শিকদার, শেখ হায়দার আলী, কাজী এনায়েত হোসেন, উপজেলা চেয়ারম্যান গাজী আব্দুল হাদী, এমডিএ বাবুল রানা, হুমায়ুন কবির ববি ও শেখ সিদ্দিকুর রহমান। পরে একটি বিক্ষোভ মিছিল নগরীর বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে দলীয় কার্যালয়ে এসে শেষ হয়।
খুলনা মহানগর ও জেলা ছাত্রলীগের উদ্যোগে কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে নগরীর পিকচার প্যালেস মোড় অবস্থান কর্মসূচী পালন করা হয়। খুলনা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মোঃ আরাফাত হোসেন পল্টুর সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য রাখেন জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মুশফিকুর রহমান সাগর, মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ শাহজালাল হোসেন সুজনসহ অন্য নেতৃবৃন্দ।
রাজধানীর শহবাগের কর্মসূচীতে যোগ দিতে ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলা উপজেলা থেকেও এসেছেন অনেকে। কেউ অফিস ছুটি নিয়ে, ঘরের রান্না রেখে শিশু সন্তানকে কোলে গৃহিণীরাও ছুটি এসেছেন বিবেকের তাড়নায়। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রায়ে ক্ষুব্ধ ও দেশপ্রেমিক মানুষের ঢল নামে শাহবাগে। এছাড়ার প্রেসক্লাব, মতিঝিলসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় কাদের মোল্লার রায় প্রত্যাখ্যান করে ফাঁসির
দাবিতে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ, ওয়ার্কার্স পার্টি, কমিউনিস্ট পার্টিসহ পৃথক পৃথকভাবে বিক্ষোভ করেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন।
মঙ্গলবার কাদের মোল্লার রায় ঘোষণার পর বিকেল থেকে শাহবাগের রাস্তা অবরোধ করে ব্লগার এ্যান্ড অনলাইন এ্যাকটিভিস্ট নেটওর্য়াক নামের ফেসবুকভিত্তিক একটি সামাজিক সংগঠন। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় স্লোগান ‘৭১ নামের আরেক সংগঠন। এরা সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এদিকে কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, ব্লগ, টুইটারে মন্তব্যের শেষ নেই। আন্দোলনকারীদের মুখে মুখে মিসরের তাহ্রীর স্কয়ারের মতো শাহবাগ নতুন করে ‘শাহবাগ স্কয়ারসহ নতুন প্রজন্ম স্কয়ার’ নামে পরিচিতি পাচ্ছে।
আয় রে আয় ডাক দিয়েছে মায় ॥ দিনভর প্রতিবাদী গান আর সেøাগানে মুখরিত শাহবাগ। দেশপ্রেমিক হাজারো জনতার ভিড়ে সেøাগানে সেøাগানে প্রকম্পিত হয় রাজপথ। বাস, রিকশাসহ অন্যান্য যানবাহন থেকে নেমে আসে সাধারণ মানুষ। প্রতিবাদী গান আর সেøাগানের মধ্যে ছিল- আয় রে আয় ডাক দিয়েছে মায়, অস্তিত্বের সংগ্রামে আজ জোট বাঁধ সবাই/পাকিস্তানের প্রেতাত্মা পাকিস্তানেই ফিরে যা/লাখো শহীদ ডাক পাঠালো সারাবাংলায় খবর দে, সারাবাংলা ঘেরাও করে জামায়াত-শিবির কবর দে/কারা মোর ঘর ভেঙ্গেছে স্মরণ আছে/ জামায়াত-শিবির রাজাকার এ মুহূর্তে বাংলা ছাড়, বাংলাদেশের মাটিতে জামায়াত শিবিরের ঠাঁই নেই/আমাদের ধমনিতে শহীদের রক্ত/শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না, তোমার আমার ঠিকানা শাহবাগ-শাহবাগ। গান, কবিতা আর সেøাগানের ফাঁকে ফাঁকে চরুকলার শিক্ষার্থীরা রাজাকারের নতুন নতুন কুশপুতুল তৈরি করে শহবাগ মোড়ে এনে জড়ো করে। মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচিয়ে হাজারো মানুষ যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত রাখার শপথ নেন।
এক দাবি, ফাঁসি চাই ॥ রায় পুনর্বিবেচনার মাধ্যমে ফাঁসির আদেশ না আসা পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন শাহবাগের আন্দোলনকারীরা। সোমবার কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায় ঘোষণার পর পরই শুরু হয় বিক্ষোভ। রাতভর প্রতিবাদী গান, কবিতা, মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র ও প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনীর মাধ্যমে এবং কাদের মোল্লাকে ছয়বার প্রতীকী ফাঁসিতে ঝুলিয়ে একাত্তরের শহীদদের রক্তের ঋণ শোধের দাবি জানায় হাজারো তরুণ।
বুধবার সকালের পর থেকেই আন্দোলনে যোগ হয় নতুন মাত্রা। হরতালের মধ্যেও বিভিন্ন সংগঠন ও নানা শ্রেণী পেশার মানুষ দলে দলে শাহবাগের জমায়েতে যোগ দেন। বিকেলের পর প্রতিবাদী মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে। এখানে সংহতি প্রকাশ করে বক্তব্য রাখেন দেশের বিশিষ্টজনসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ। সকলে সমবেত কণ্ঠে সমবেত কণ্ঠে সেøাগান তোলেন- ‘যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি চাই।’
আন্দোলনকারীরা শাহবাগ মোড়ের চারদিকে চারটি সিগন্যাল পোস্টে যুদ্ধাপরাধীদের চারটি কুশপুতুল ঝুলিয়ে দিয়েছেন। মাঝখানে রয়েছে কাদের মোল্লার কুশপুতুল। এছাড়া সাপের আকৃতিতে বানানো হয়েছে জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের একটি কুশপুতুল। আঁকা হয়েছে রাজাকার লুডু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার শিক্ষার্থীরা রাস্তার বিভিন্ন প্রান্তে রাজাকারের ভয়ঙ্কর রুদ্রমূর্তির ছবি, ফাঁসির দাবিতে বিভিন্ন সেøাগান লেখেন দিনভর। আন্দোলনকারীরা শাহবাগ মোড়ের নতুন নামকরণ করে রেখেছেনÑনতুন প্রজন্ম স্কয়ার।
অসুস্থ বিক্ষোভকারীদের জন্য জাতীয় জাদুঘরের একটি কক্ষে প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিক্ষোভকারীদের মধ্যে খাবার সংগ্রহ করেছেন সাধারণ মানুষ। ওয়াসা থেকে পাঠানো হয় পানি। ঢোল, করতাল, ঢাক বাদ্য বাজনায় আয়োজন করে ঢাবির সাংস্কৃতিক ছাত্র সংগঠনসমূহের পক্ষ থেকে। রাতে কয়েক হাজার মানুষের জন্য রান্নার ব্যবস্থা করা হয়।
বিক্ষোভ সমাবেশে বিশিষ্টজনদের ॥ প্রতিক্রিয়া শাহবাগের বিক্ষোভ সমাবেশে সংহতি প্রকাশ করে বক্তব্য রেখেছেন দেশের বিশিষ্টজনরা। কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তির রায় না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মুক্তিযোদ্ধারাও। রাজাকারের হাতে স্বজন হারানো মানুষরা হুঁশিয়ারি দেন, যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে প্রয়োজনে আবারও মাঠে নামবেন তারা। কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আদালতের রায়ে জাতি হতাশ। আর এ হতাশা থেকেই সারাদেশের মানুষের মধ্যে ক্ষোভ আর বিক্ষোভ দানা বাঁধছে।
পরিবেশ ও বনমন্ত্রী হাসান মাহামুদ বলেন, কাদের মোল্লা যে অপরাধ করেছে তাতে তার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- হওয়া উচিত। আদালত যে রায় দিয়েছে তাতে সরকার ও আওয়ামী লীগও হতাশ। এ থেকে প্রমাণিত হয় যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া পুরোপুরি স্বচ্ছতা বজায় রেখে চলছে। যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে চলমান আন্দোলন অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান তিনি। কাদের মোল্লার ছয়বার প্রতীকী ফাঁসির মধ্যে প্রথম ফাঁসি হয় রাত ১টার দিকে। শাহবাগ মোড়ের বিশ্ববিদ্যালয়গামী পথে পাকিস্তানের পতাকা খচিত পোশাক পরা অবস্থায় প্রথম ফাঁসি হয়। প্রতীকী ফাঁসির সময় তরুণ-তরুণীদের কণ্ঠে বার বার উচ্চারিত হয়- দড়ি ধরে দেব টান/ফাঁসি দিয়ে নেব জান, এমন রায় দিলো কে/কসাইটাকে ঝুলিয়ে দে, নিজামী-মুজাহিদ ভাই ভাই/এক রশিতে ফাঁসি চাই, জামায়াত-শিবির রাজাকার/রক্ত চোষা জানোয়ার, আমরা আছি থাকব/সুখে দুখে লড়বো। দ্বিতীয় প্রতীকী ফাঁসির উদ্যোক্তা ছিল নাটকের দল তীরন্দাজ। রাত আড়াইটার দিকে মুক্তির গান চলচ্চিত্র শেষ হয়।
কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে শাহবাগে হাজির হন যুক্তরাজ্য প্রবাসী নাফিসা শামসুদ্দিন। অকুপাই ইউকের এই কর্মী টানা আট মাস রাস্তায় ক্যাম্প করে মাঠে ছিলেন দাবি আদায়ের জন্য। বর্তমানে ঢাকাভিত্তিক একটি মানবাধিকার সংস্থার মিডিয়া ও ক্যাম্পেইন পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার কেএম সফিউল্লাহ আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করে তিনি বলেন, আমি এখানে বক্তৃতা দিতে আসিনি। হতাশা ব্যক্ত করতে এসেছি। কাদের মোল্লা এত খুন করার পরও তার মৃত্যুদ- হয়নি। তাহলে কত খুন হলে তাকে মৃত্যুদ- দেয়া হতো?
সমাবেশে সংহতি প্রকাশ করে শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া বলেন, জনতার আদালতে কাদের মোল্লার ফাঁসি হয়েছে। তিনি বলেন, শেখ হাসিনার নির্বাচনী ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির রায়ের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু তা হয়নি। উপস্থিত তরুণদের উদ্দেশে তিনি বলেন, মঙ্গলবার থেকে আজ পর্যন্ত প্রতিবাদীদের যে অবস্থান তা সত্যি অভাবনীয়। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন সংহতি জানিয়ে দেয়া ভাষণে বলেন, চল্লিশ বছর ধরে আন্দোলন করছি। এখন এ আন্দোলনের ভার এখানকার এই নতুন প্রজন্মের হাতে তুলে দিলাম। তিনি সাঈদীর মামলার রায় না হওয়া পর্যন্ত এ অবস্থান চালিয়ে যাবার জন্য বলেন। তার এ বক্তব্যর পর অবস্থান নেয়া তরুণ প্রজন্ম দৃঢ় কণ্ঠে জানায় সাঈদীর রায় না হওয়া অবধি তারা এ অবস্থান চালিয়ে যাবে।
কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদ- মানেন না মুক্তিযোদ্ধা ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণী। কাদেরের ফাঁসি না হলে আন্দোলনের মঞ্চ ছাড়বেন না বলেও জানান তিনি। বুধবার বিকেলে শাহবাগের সমাবেশে সংহতি প্রকাশ করে তিনি একথা বলেন। একাত্তরে অমানুষিক নির্যাতনের শিকার সাহসী এই নারী জানান, আমরা যে আন্দোলন শুরু করেছিলাম, সংগ্রামী নতুন প্রজন্ম সেই আন্দোলনের সহযোদ্ধা হয়েছেন। রাজাকারের ফাঁসি না হওয়া পর্যন্ত আমরা মঞ্চ ছাড়ব না। তিনি এ সময় শাহবাগ চত্বরকে ‘প্রজন্ম চত্বর’ বলে ঘোষণা দেন।
এর আগে, আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন তথ্য কমিশনার অধ্যাপক সাদেকা হালিম। তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে এ রায় আমি মানি না। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমেই আপনারা যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি দাবি করুন।
ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম বলেন, কাদের মোল্লার রায়ে জাতি হতাশ হয়েছে। নতুন প্রজন্ম নতুন যুদ্ধে প্রত্যাশিত বিজয় ছিনিয়ে আনবে বলে আমার বিশ্বাস। মেজর (অব) কামরুল ইসলাম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এতদিন তোমরা কোথায় ছিলে। কার সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করতে আসব। কথা বলেই বুঝিয়ে দিলেন এ যেন তার নিজের আন্দোলন। প্রাণেরই চাওয়া। ডাকসুর সাবেক ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। এখান থেকে সরে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক গোলাম রহমান বলেন, আমি মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম। এই রায়ে জাতি হতাশ, আমিও হতাশ।
কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার অন্যতম সাক্ষী শহিদুল হক মামা সংহতি প্রকাশ করে বলেন, বিবেকের তাড়নায় হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে বাংলাদেশে এসেছি। কিন্তু রায়ে খুশি হতে পারিনি। ক্ষোভ জানাচ্ছি। এখন কথা একটাই সারাবাংলা ঘেরাও কর-জামায়াত- শিবির খতম কর। অন্যথায় ওরা ‘৭১-এর মতো আবারও আমাদের আঘাত করবে। কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে প্রত্যাশিত রায় না হওয়ার বিচারকদের সমালোচনাও করেন তিনি।
আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করেন এবং বক্তব্য রাখেন রাশেদ খান মেনন, আনিসুর রহমান মল্লিক, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, ইসরাফিল আলম, দুর্গাদাশ ভট্টাচার্য, আবদুস সোবহান গোলাপ, সাংবাদিক আবেদ খান, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য নূর উল আলম লেনিন, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কাজী রোজী, সাংবাদিক গোলাম সারওয়ার, অজয় রায়, পংকজ ভট্টাচার্য, সাংবাদিক আবু সাঈদ খান, প্রবীর সিকদার, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, গোলাম কুদ্দুস, পংকজ দেবনাথ, মুক্তিযোদ্ধা সেকান্দার খান, এ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, শিরিন আকতার ও দীপা খন্দকার।
সংহতি প্রকাশ করে জগন্নাথ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা কলেজ, বদরুন্নোসা কলেজ, ইডেন কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র পরিষদ, বিআইডব্লিউটিএ মুক্তিযোদ্ধা প্রাতিষ্ঠানিক ইউনিট, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, কমিউনিস্ট পার্টি, গণতন্ত্রী পার্টি, জাসদ, বাসদ, বিপ্লবী গণতান্ত্রিক পার্টি, গণতন্ত্রী পার্টিসহ প্রগতিশীল বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ দেশপ্রেমিক মানুষ সমাবেশে যোগ দেন।
ছাত্রদল নেই ॥ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে দুদিন শাহবাগের অবস্থান কর্মসূচীতে যোগ দিয়েছে প্রগতিশীল সকল ছাত্র সংগঠন। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বলে কথা নয়, দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বুধবার সকাল থেকে দলে দলে শাহবাগের সমাবেশে এসে সংহতি প্রকাশ করে। বাস্তব চিত্র হলো সকল আদর্শিক মতভেদ ভুলে কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে শাহবাগে এককাট্টা হয়েছে প্রগতিশীল সকল ছাত্র সংগঠন। সেখানে বুধবার রাত পর্যন্ত শুধু জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলকে দেখা যায়নি। মূল সংগঠন বিএনপির মতো ছাত্রদলও প্রতিক্রিয়াহীন। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ এবং ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রমৈত্রী, জাসদ ছাত্রলীগ, বাম সংগঠনগুলোর জোট, প্রগতিশীল ছাত্রজোটসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন একে একে মিছিল নিয়ে সমাবেশে সংহতি প্রকাশ করে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রদলের সভাপতি আবদুল কাদের ভূঁইয়া কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।
যৌক্তিক কারণেই রায় প্রত্যাখ্যান সাংস্কৃতিক জোটের ॥ অনেক বিচারক ভয়ভীতি, লোভ-লালসার উর্ধে উঠতে পারেননি বলে মন্তব্য করেছেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের নেতারা। নেতারা বলেন, বাচ্চু রাজাকারের চেয়ে অনেক অভিযোগে অভিযুক্ত থাকার পরও কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন সাজা মেনে নেয়া যায় না। বিচারকদের এজন্য একদিন জনগণের কাছে জবাদিহি করতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তারা। বুধবার দুপুরে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব অভিযোগ করেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের নেতারা। তারা বলেন, এ রায়ে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। এ রায়ের সঙ্গে জনমতের কোন সম্পর্ক নেই। তাই এ রায় গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করার জন্য সরকারের প্রতি জোর দাবি জানান তারা। সংবাদ সম্মেলনে বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব আসাদুজ্জামান নূর বলেন, আমরা আশা করেছিলাম এবার একুশে ফেব্রুয়ারির আগে সব যুদ্ধপরাধীর বিচার শেষ হবে। কিন্তু এটা হলো না।
মফিজুল হক বলেন, বিচারকরা নানা দিক পর্যালোচনা করে রায় দিলেও এটা নিয়ে জনগণ স্বস্তি পায়নি। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন- সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, লোকশিল্পী ফকির আলমগীর ও গোলাম কদ্দুস।
চট্টগ্রামের জামালখান হয়ে উঠেছে আরেক শাহবাগ ॥ এবার জেগেছে চট্টগ্রাম। জনতার উপস্থিতিতে মুখর চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব চত্বর। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে মানুষের উপস্থিতি। জনতার বিপুল অংশগ্রহণে নগরীর জামালখান হয়ে উঠছে আরেক ‘শাহবাগ’। হয়ে উঠছে চট্টগ্রামের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারীদের ঠিকানা। ক্ষুব্ধ-ব্যথিত সকলের দাবি একটাই, সাড়ে তিনশ‘ খুন ও ধর্ষণের অপরাধী একাত্তরের কসাই আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসি। জামালখানে সমাবেত হয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ নগরীর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীসহ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোও। এছাড়া কাদের মোল্লার লঘু শাস্তি প্রত্যাখ্যান করে তার প্রতীকী ফাঁসি দিয়েছে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) শিক্ষার্থীরা।
প্রয়োজনে হরতাল দেবে আওয়ামী লীগ ॥ জামায়াতের ডাকা বুধবারের দেশব্যাপী হরতালের সময় রাজধানীর মিরপুরে হরতালবিরোধী মিছিল বের করেছে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ। মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদ-ের রায়ের বিরুদ্ধে মিছিলে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান নেতাকর্মীরা। প্রয়োজনে আওয়ামী এ রায়ের বিরুদ্ধে হরতাল দেবে, এমন মতামত ব্যক্ত করেন তারা। স্থানীয় সাংসদ কামাল আহমেদ মজুমদার বলেন, ওরা (জামায়াত) কি হরতাল দিচ্ছে, হরতাল দেয়ার কথা তো আমাদের। কাফরুল থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি জামাল মোস্তফা বলেন, এই রায় আমরা মানি না। প্রয়োজনে আওয়ামী লীগ রায়ের বিরুদ্ধে হরতাল দেবে।
দেশজুড়ে মিছিল সমাবেশ ॥ সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বুধবার সকাল থেকে রায় প্রত্যাখ্যান করে সর্বস্তরের হাজারো মানুষ জড়ো হতে থাকে। অধ্যাপক জাফর ইকবাল বলেন, নতুন প্রজন্ম রায়ের বিরুদ্ধে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। আশাকরি তাদের আন্দোলনে আমাদের বিজয় সুনিশ্চিত। এছাড়া যশোর, খুলনা, নেত্রকোনা শহীদ মিনারের দুপুরের পর থেকে কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে সমাবেশে যোগ দেয় হাজারো মানুষ।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বিক্ষোভ ॥ রায় প্রত্যাখ্যান করে কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে রাজধানীতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন বিক্ষোভ করেছে। জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বুধবার বিকেলে বিক্ষোভ করে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পাটি ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল। এই দুই দলের বাম জোট যৌথভাবে দেশব্যাপী ‘বিক্ষোভ দিবস’ পালন করে। এছাড়াও ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী প্রতিবাদী গান ও সমাবেশ করে। এসব কর্মসূচীতে পেশাজীবী নারী সমাজ, যুব ইউনিয়ন, খেলাঘর, ছাত্র ইউনিয়ন, গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরাম, বাংলাদেশ কৃষক সমিতি ও মহিলা পরিষদ সংগঠন। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে টিএসসি চত্বরে মানববন্ধন করেছে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন।
আজ আটটা থেকে সমাবেশ শুক্রবার মহাসমাবেশ ॥ বুধবার সন্ধ্যার পর ঘুরে ফিরে যাওয়া মানুষের উদ্দেশ্যে আন্দোলনকারী নেতারা মাইকে ঘোষণা দেন, বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা থেকে সমাবেশ শুরু হবে। এ সময় তারা আরও জানান, শুক্রবারও টানা চতুর্থদিনের মতো এই কর্মসূচী চলবে। ওইদিন সকাল ৮টায় শাহবাগ মোড়ে মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে।
হতাশ টিআইবি, প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ বলছে নির্মূল কমিটি ॥ আবদুল কাদের মোল্লার রায়ে হতাশা প্রকাশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থাটি অনতিবিলম্বে যথাযথ আইনী প্রক্রিয়া অনুসরণ করে আপীলসহ রায় পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছে। বুধবার এক বিবৃতিতে টিআইবি এ হতাশার কথা জানায়।
বিবৃতিতে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আদালতের রায়ের প্রতি সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা ও গভীর আস্থা রেখেই টিআইবি মনে করে, আবদুল কাদের মোল্লার ব্যাপারে প্রদত্ত রায় জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। এ রায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও শহীদদের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শনের জন্য পর্যাপ্ত নয়, বরং অবমাননাকর। আমরা হতাশ, লজ্জিত ও মর্মাহত। অপরাধের গুরুত্ব অনুসারে এরই মধ্যে বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে ঘোষিত রায়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য না থাকায় জনমনে যে হতাশা, ক্ষোভ ও আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয়েছে তা প্রকারান্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের বিরোধী পক্ষকে শক্তিশালী করবে। কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে দেয়া রায়ের ব্যাপারে জনপ্রতিক্রিয়া ও আইনী অভিজ্ঞতাকে বিবেচনায় নিয়ে প্রয়োজনে এ সংক্রান্ত আইনের সম্ভাব্য দুর্বলতার যথাযথ সংস্কার করে সর্বোচ্চ দৃঢ়তা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে মানবতাবিরোধী অপরাধের ন্যায়বিচার সম্পন্ন করার আহ্বান জানিয়েছে টিআইবি।
এদিকে অপর এক বিবৃতিতে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি এ রায়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছে, এ রায়ের মাধ্যমে ৩০ লাখ বাঙালীর আত্মদান, লাখ লাখ মা বোনের সম্ভ্রমহানিকে উপহাস ও অপমান করা হয়েছে। ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। কাদের মোল্লার রায় আমাদের প্রত্যাশা পূরণে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে।
খুলনায় বিক্ষোভ ॥ স্টাফ রিপোর্টার খুলনা থেকে জানিয়েছেন, কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে এবং জামায়াত-শিবিরের দেশব্যাপী হত্যা, অগ্নিসংযোগ ও ভাংচুরের প্রতিবাদে বুধবার খুলনা মহানগর ও জেলা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে নগরীতে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। একই দাবিতে ছাত্রলীগ পিকচার প্যালেস মোড়ে অবস্থান কর্মসূচী পালন করেছে।
খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ১৪ দলের সমন্বয়ক মিজানুর রহমান মিজানের সভাপতিত্বে দলীয় কার্যালয়ের সামনে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগ নেতা এ্যাডভোকেট চিশতি সোহরাব হোসেন শিকদার, শেখ হায়দার আলী, কাজী এনায়েত হোসেন, উপজেলা চেয়ারম্যান গাজী আব্দুল হাদী, এমডিএ বাবুল রানা, হুমায়ুন কবির ববি ও শেখ সিদ্দিকুর রহমান। পরে একটি বিক্ষোভ মিছিল নগরীর বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে দলীয় কার্যালয়ে এসে শেষ হয়।
খুলনা মহানগর ও জেলা ছাত্রলীগের উদ্যোগে কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে নগরীর পিকচার প্যালেস মোড় অবস্থান কর্মসূচী পালন করা হয়। খুলনা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মোঃ আরাফাত হোসেন পল্টুর সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য রাখেন জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মুশফিকুর রহমান সাগর, মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ শাহজালাল হোসেন সুজনসহ অন্য নেতৃবৃন্দ।
No comments