হরতালে ঢাকাসহ সারা দেশে ৬৭ যানবাহন ভাঙচুর, ১৩টিতে আগুন- বগুড়ায় দিনভর সংঘর্ষ, নিহত ৩
জামায়াতে ইসলামীর ডাকা গতকাল
বৃহস্পতিবারের হরতালেও রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় যানবাহনে অগ্নিসংযোগ,
ভাঙচুর ও সংঘাত হয়েছে। এর মধ্যে বগুড়ায় পুলিশ ও ছাত্রলীগের সঙ্গে
জামায়াত-শিবিরের পৃথক সংঘর্ষে তিনজন নিহত হয়েছেন।
যশোরের মনিরামপুরে জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে সংঘর্ষের পর অসুস্থ হয়ে মারা গেছেন পুলিশের এক সদস্য।
বগুড়ায় নিহত ব্যক্তিরা হলেন: সরকারি আজিজুল হক কলেজের পুরোনো ভবন শাখা
ছাত্রশিবিরের সভাপতি আবু রুহানি (২০) ও কর্মী আবদুল্লাহ এবং পোলট্রি
ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান (২৮)।
অবশ্য রাতে এক বিবৃতিতে জামায়াত দাবি করেছে, বগুড়ায় তাদের চারজন নেতা-কর্মী নিহত ও ২৭ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। নিহত ব্যবসায়ী মিজানুরও তাদের কর্মী।
এদিকে ‘জামায়াত-শিবিরের চার নেতা-কর্মীকে হত্যার প্রতিবাদে’ কাল শনিবার বগুড়ায় সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে জামায়াত। দলটির বগুড়া শহর কমিটির সেক্রেটারি মাজেদুর রহমান প্রথম আলোকে এ কথা বলেন।
তবে বগুড়ার পুলিশ সুপার মোজামেঞ্চল হক তিনজন নিহত ও সাতজন গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘দুপুরে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে দুজন ও সন্ধ্যায় গুলিবিদ্ধ হয়ে একজন মারা গেছেন। এঁদের মধ্যে দুজন শিবিরের সঙ্গে যুক্ত বলে জেনেছি। অন্যজন সাধারণ ব্যবসায়ী।’ তিনি জানান, সন্ধ্যা সাতটার পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। রাত থেকে শহরে পুলিশ-র্যাবের পাশাপাশি বিজিবির সদস্যদের টহল শুরু হয়েছে।
হরতাল চলাকালে বগুড়া ছাড়া ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য জেলায় ৬৭টি যান ভাঙচুর ও ১৩টিতে অগ্নিসংযোগ করেন জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা।
গত বুধবার ঢাকায় সমাবেশ করার অনুমতি না দেওয়ায় সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা এবং ঢাকা ও চট্টগ্রামে বেলা দুইটা পর্যন্ত এই হরতাল ডাকে জামায়াত। এ হরতালে বিএনপি ছাড়াও ১৮ দলীয় জোটের আরও কয়েকটি দল সমর্থন জানায়।
বগুড়ায় ১৫ মিনিটে দুজন নিহত: প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র জানায়, দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বগুড়া শহরের ফুলবাড়ী মহিলা কলেজের সামনে ছাত্রলীগের সঙ্গে শিবিরের নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষ বাধে। শিবিরের নেতা আবু রুহানিকে ছাত্রলীগের কর্মীরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে জখম করেন। তাঁকে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকেরা মৃত ঘোষণা করেন। ওই সংঘর্ষে আহত হন শিবিরের আরও তিন কর্মী।
রুহানি বগুড়া সদরের এরুলিয়া মণ্ডলপাড়া গ্রামের আবু বক্কর সিদ্দিকের ছেলে ও সরকারি আজিজুল হক কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক (সম্মান) তৃতীয় বর্ষের ছাত্র।
পুলিশ জানায়, ওই ঘটনার ১৫ মিনিট পর বেলা পৌনে একটার দিকে শহরের সাবগ্রামে দ্বিতীয় বাইপাসে ছাত্রলীগের সঙ্গে শিবিরের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া হয়। তখন ওই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় ব্যবসায়ী মিজানুরকে কুপিয়ে জখম করা হয়। তাঁকে জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকেরা মৃত ঘোষণা করেন।
প্রত্যক্ষদর্শী সাবগ্রাম বাজারের মুদি দোকানি গৌরচন্দ্র প্রথম আলোকে বলেন, বাজারে পিকেটিং বা সংঘর্ষ হয়নি। মিজানুর বাসা থেকে হেঁটে সাবগ্রাম বাজারের দিকে আসছিলেন। এ সময় ১৫-২০ জন সন্ত্রাসী তাঁকে কুপিয়ে ও ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায়।
পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ: প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিকেল সাড়ে চারটার দিকে শহরের গোহাইল এলাকা থেকে জামায়াত-শিবিরের বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মী লাঠিসোঁটা ও ব্যাগ নিয়ে সাতমাথার দিকে আসতে থাকেন। সাতমাথার কাছে তাঁরা পুলিশকে লক্ষ্য করে অনবরত ককটেল ছোড়েন। জবাবে পুলিশও কাঁদানে গ্যাসের শেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। তবে উপর্যুপরি ককটেল বিস্ফোরণের মুখে পুলিশ পিছু হটে কবি নজরুল ইসলাম সড়কের মাঝে চলে আসে। পরে পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল ও রাবার বুলেট ছুড়ে জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের হটিয়ে দেয়।
ছাত্রাবাসে আগুন, গুলিবিনিময়: সন্ধ্যা ছয়টার দিকে শহরের স্টেশন রোডের সরকারি আজিজুল হক কলেজের সামনে জুয়েল ভিলা নামের একটি বেসরকারি ছাত্রাবাসে অগ্নিসংযোগ করেন শিবিরের নেতা-কর্মীরা। সেখানে ছাত্রলীগের কর্মীরা থাকতেন বলে স্থানীয় লোকজন জানান।
একই সময়ে পুলিশ ও র্যাব সদস্যরা শিবির-নিয়ন্ত্রিত জামিলনগর ঘিরে ফেলেন। শিবিরের নেতা-কর্মীরা তাঁদের দিকে ককটেল নিক্ষেপ করেন। জবাবে পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল ও রাবার বুলেট ছোড়ে। সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত এ অবস্থা চলে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, জামিলনগরের বিভিন্ন বাড়ি থেকে শিবিরের নেতা-কর্মীরা পুলিশ-র্যাবের দিকে গুলি ছোড়েন। এই সংঘর্ষে আটজন গুলিবিদ্ধ হন। তাঁদের হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকেরা আবদুল্লাহ নামের শিবিরের এক কর্মীকে মৃত ঘোষণা করেন।
সন্ধ্যা সাতটার দিকে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা শহরে জামায়াত-শিবিরবিরোধী বিক্ষোভ মিছিল করেন। এতে সাতমাথাসহ আশপাশের এলাকায় আবার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
শিবিরের নেতা আবু রুহানিকে হত্যার প্রতিবাদে সন্ধ্যা ছয়টা থেকে এরুলিয়ায় বগুড়া-সান্তাহার সড়ক অবরোধ করেন স্থানীয় লোকজন। পরে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
পুলিশকে পিটুনি: সকাল পৌনে আটটার দিকে বগুড়া উপশহর বাজার এলাকায় হরতাল পালনের সময় পুলিশ শিবিরের দুই কর্মীকে আটক করে গাড়িতে তোলার চেষ্টা করে। তাঁদের ছিনিয়ে নিতে শিবিরের কর্মীরা লাঠি দিয়ে দুই পুলিশকে পেটান। এর মধ্যে এক পুলিশের রাইফেল কেড়ে নিয়ে তা দিয়েই তাঁকে পেটানো হয়। অতিরিক্ত পুলিশ এলে শিবিরের কর্মীরা অস্ত্রটি ৫০ গজ দূরে ফেলে পালিয়ে যান।
এ ছাড়া সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বগুড়া-ঢাকা মহাসড়কের বেতগাড়ীতে ১৫টি ও শহরের কলোনি এলাকায় তিনটি যানবাহন ভাঙচুর করেন শিবিরের কর্মীরা।
পাল্টাপাল্টি দাবি: বগুড়া জেলা ছাত্রশিবিরের প্রচার ও আন্দোলন সম্পাদক মিজানুর রহমান অভিযোগ করেন, ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে জামায়াতের কর্মী মিজানুর রহমান ও শিবিরের আজিজুল কলেজ পুরোনো ভবন শাখার সভাপতি আবু রুহানিকে হত্যা করেছেন।
অভিযোগ অস্বীকার করে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আলী আল রাজী বলেন, ‘হরতাল চলাকালে সাবগ্রামে সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে শিবিরের ওপর হামলা চালায়। ওই লোকজনের হামলায় এক ব্যবসায়ী মারা গেছেন। ফুলবাড়ীতে আমাদের কোনো ছেলে যায়নি। শিবির নিজেরাই এই ঘটনা ঘটিয়ে আন্দোলন শক্ত করতে চাইছে।’
‘মিজানুর নিরীহ ব্যবসায়ী’: নিহত ব্যবসায়ী মিজানুরের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা জেলায়। সাবগ্রামের মাস্টারপাড়ায় ভাড়া বাসায় থাকতেন। তিনি সাবগ্রাম বাজারে পোলট্রি ও হ্যাচারির ব্যবসা করতেন। বিকেলে ওই বাড়িতে গেলে বাড়ির মালিক আজিজুল হক বলেন, মিজানুর প্রায় তিন বছর ধরে তাঁর বাসায় আছেন। তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন না। তিনি নিরীহ প্রকৃতির ছিলেন।
একই কথা বলেন সাবগ্রাম বাজারের হ্যাচারি ও পোলট্রি খাদ্য ব্যবসায়ী সাইদুল ইসলামও।
মিজানুরের এক শিশুসন্তান রয়েছে। তাঁর স্ত্রী হালিমা বেগম বলেন, তাঁর স্বামী রাজনীতি করতেন না। তিনি দুপুরে বাসা থেকে হেঁটে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে যাচ্ছিলেন।
বগুড়ার পুলিশ সুপার বলেন, ‘মিজানুরের ওপর চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে পরিকল্পিতভাবে খুন করে কেউ রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির চেষ্টা করছে বলে প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।’
ঢাকার চিত্র: আধা বেলা হরতাল চলাকালে রাজধানীর প্রধান সড়কগুলোতে অন্য দিনের তুলনায় যান চলাচল ছিল কম। তবে অবাধে রিকশা চলাচল করেছে। এ সময় রাজধানী থেকে দূরপাল্লার কোনো বাস ছেড়ে যায়নি। রেল ও বিমান যোগাযোগ স্বাভাবিক ছিল। দোকানপাট বেশির ভাগই বন্ধ ছিল। তবে সরকারি দপ্তরগুলো খোলা ছিল।
হরতালের সমর্থনে মিরপুর, শেওড়াপাড়া, আজিমপুর, বাড্ডা, যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, বিশ্বরোড, কাঁচপুর এলাকায় তৎপর ছিলেন জামায়াতের কর্মীরা। তাঁদের প্রতিরোধে সতর্ক ছিল পুলিশ-র্যাবও। এর মধ্যে ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বিশ্বরোড এলাকায় করাতকল থেকে কাঠের গুঁড়ি এনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির চেষ্টা করে পিকেটাররা। পরে রাস্তায় টায়ারে আগুন ধরিয়ে দেন তাঁরা।
সকাল সাতটার দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সানারপাড়ে একটি পণ্যবাহী ট্রাকে আগুন দেন হরতালকারীরা। ছয়টার দিকে যাত্রাবাড়ী মোড়ের চাংপাই রেস্তোরাঁর সামনে ও জুরাইনে দুটি লেগুনায় আগুন দেওয়া হয়। মীরহাজিরবাগে বিআরটিসির একটি বাস ভাঙচুর করা হয়। পুলিশ ধাওয়া দিলে পিকেটাররা পালিয়ে যান।
সকালে আজিমপুরে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা রাস্তায় টায়ার জ্বালিয়ে পিকেটিং করেন। পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়েন তাঁরা। পুলিশ লাঠিপেটা করে তাঁদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় এবং তিনজনকে আটক করে।
সকাল আটটার দিকে মিরপুর অরিজিনাল ১০ নম্বরের কবরস্থানের পাশে বিহারি ক্যাম্প থেকে ১০-১৫ জন যুবক প্রধান সড়কে হরতালের সমর্থনে টায়ারে আগুন জ্বালায় ও দুটি বাস ভাঙচুর করেন। একপর্যায়ে তাঁরা যাত্রীবাহী একটি বাসে অগ্নিসংযোগ করেন। পুলিশ গিয়ে স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় আগুন নেভায়। ওই বাসের চালক বাবুল মিয়া আহত হন।
সকাল সাড়ে ১০টার দিকে পুরানা পল্টন মোড়ের কাছে দুটি ও এর কিছুক্ষণ আগে হাইকোর্টের সামনে কদম ফোয়ারার কাছে চারটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটে। এ দুই জায়গা থেকে পুলিশ চারজনকে আটক করে। সকাল নয়টার দিকে বাংলামোটরে পর পর ছয়টি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটান হরতালকারীরা। পুলিশ সেখান থেকে দুজনকে আটক করে।
হরতালের সমর্থনে কল্যাণপুরে জামায়াতের সাংসদ হামিদুর রহমানের আযাদের নেতৃত্বে মিছিল হয়। ফার্মগেটে শিবিরের আট-নয়জন ঝটিকা মিছিল বের করলে পুলিশ ছত্রভঙ্গ করে দেয় এবং একজনকে আটক করে। সকাল পৌনে সাতটার দিকে মিরপুরের কাজীপাড়ায় হরতালের সমর্থনে মিছিল থেকে পুলিশ চারজনকে আটক করে।
ঢাকা মহানগর পুলিশ জানায়, হরতালের সময় জামায়াত-শিবিরের ২২ জনকে আটক করা হয়েছে। তবে জামায়াতের পক্ষ থেকে ঢাকায় ৬৪ জনসহ সারা দেশে দুই শতাধিক নেতা-কর্মীকে আটক করার দাবি করা হয়।
জামায়াতের বিবৃতি: এক বিবৃতিতে জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম দাবি করেন, বগুড়ায় সরকারের মন্ত্রী, সাংসদ ও দলীয় নেতাদের নির্দেশে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও পুলিশ বগুড়ায় দলের চারজনকে হত্যা করেছে।
হরতাল শেষে অপর এক বিবৃতিতে জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমাদ দাবি করেন, ‘ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগের সশস্ত্র ক্যাডার ও পুলিশের তাণ্ডবের মধ্যেও দেশব্যাপী স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালিত হয়েছে। এর মাধ্যমে জনগণ চলমান ট্রাইব্যুনাল বাতিল করে জামায়াতের নেতাদের মুক্তির পক্ষে রায় দিয়েছে।’
অবশ্য রাতে এক বিবৃতিতে জামায়াত দাবি করেছে, বগুড়ায় তাদের চারজন নেতা-কর্মী নিহত ও ২৭ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। নিহত ব্যবসায়ী মিজানুরও তাদের কর্মী।
এদিকে ‘জামায়াত-শিবিরের চার নেতা-কর্মীকে হত্যার প্রতিবাদে’ কাল শনিবার বগুড়ায় সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে জামায়াত। দলটির বগুড়া শহর কমিটির সেক্রেটারি মাজেদুর রহমান প্রথম আলোকে এ কথা বলেন।
তবে বগুড়ার পুলিশ সুপার মোজামেঞ্চল হক তিনজন নিহত ও সাতজন গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘দুপুরে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে দুজন ও সন্ধ্যায় গুলিবিদ্ধ হয়ে একজন মারা গেছেন। এঁদের মধ্যে দুজন শিবিরের সঙ্গে যুক্ত বলে জেনেছি। অন্যজন সাধারণ ব্যবসায়ী।’ তিনি জানান, সন্ধ্যা সাতটার পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। রাত থেকে শহরে পুলিশ-র্যাবের পাশাপাশি বিজিবির সদস্যদের টহল শুরু হয়েছে।
হরতাল চলাকালে বগুড়া ছাড়া ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য জেলায় ৬৭টি যান ভাঙচুর ও ১৩টিতে অগ্নিসংযোগ করেন জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা।
গত বুধবার ঢাকায় সমাবেশ করার অনুমতি না দেওয়ায় সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা এবং ঢাকা ও চট্টগ্রামে বেলা দুইটা পর্যন্ত এই হরতাল ডাকে জামায়াত। এ হরতালে বিএনপি ছাড়াও ১৮ দলীয় জোটের আরও কয়েকটি দল সমর্থন জানায়।
বগুড়ায় ১৫ মিনিটে দুজন নিহত: প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র জানায়, দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বগুড়া শহরের ফুলবাড়ী মহিলা কলেজের সামনে ছাত্রলীগের সঙ্গে শিবিরের নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষ বাধে। শিবিরের নেতা আবু রুহানিকে ছাত্রলীগের কর্মীরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে জখম করেন। তাঁকে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকেরা মৃত ঘোষণা করেন। ওই সংঘর্ষে আহত হন শিবিরের আরও তিন কর্মী।
রুহানি বগুড়া সদরের এরুলিয়া মণ্ডলপাড়া গ্রামের আবু বক্কর সিদ্দিকের ছেলে ও সরকারি আজিজুল হক কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক (সম্মান) তৃতীয় বর্ষের ছাত্র।
পুলিশ জানায়, ওই ঘটনার ১৫ মিনিট পর বেলা পৌনে একটার দিকে শহরের সাবগ্রামে দ্বিতীয় বাইপাসে ছাত্রলীগের সঙ্গে শিবিরের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া হয়। তখন ওই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় ব্যবসায়ী মিজানুরকে কুপিয়ে জখম করা হয়। তাঁকে জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকেরা মৃত ঘোষণা করেন।
প্রত্যক্ষদর্শী সাবগ্রাম বাজারের মুদি দোকানি গৌরচন্দ্র প্রথম আলোকে বলেন, বাজারে পিকেটিং বা সংঘর্ষ হয়নি। মিজানুর বাসা থেকে হেঁটে সাবগ্রাম বাজারের দিকে আসছিলেন। এ সময় ১৫-২০ জন সন্ত্রাসী তাঁকে কুপিয়ে ও ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায়।
পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ: প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিকেল সাড়ে চারটার দিকে শহরের গোহাইল এলাকা থেকে জামায়াত-শিবিরের বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মী লাঠিসোঁটা ও ব্যাগ নিয়ে সাতমাথার দিকে আসতে থাকেন। সাতমাথার কাছে তাঁরা পুলিশকে লক্ষ্য করে অনবরত ককটেল ছোড়েন। জবাবে পুলিশও কাঁদানে গ্যাসের শেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। তবে উপর্যুপরি ককটেল বিস্ফোরণের মুখে পুলিশ পিছু হটে কবি নজরুল ইসলাম সড়কের মাঝে চলে আসে। পরে পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল ও রাবার বুলেট ছুড়ে জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের হটিয়ে দেয়।
ছাত্রাবাসে আগুন, গুলিবিনিময়: সন্ধ্যা ছয়টার দিকে শহরের স্টেশন রোডের সরকারি আজিজুল হক কলেজের সামনে জুয়েল ভিলা নামের একটি বেসরকারি ছাত্রাবাসে অগ্নিসংযোগ করেন শিবিরের নেতা-কর্মীরা। সেখানে ছাত্রলীগের কর্মীরা থাকতেন বলে স্থানীয় লোকজন জানান।
একই সময়ে পুলিশ ও র্যাব সদস্যরা শিবির-নিয়ন্ত্রিত জামিলনগর ঘিরে ফেলেন। শিবিরের নেতা-কর্মীরা তাঁদের দিকে ককটেল নিক্ষেপ করেন। জবাবে পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল ও রাবার বুলেট ছোড়ে। সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত এ অবস্থা চলে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, জামিলনগরের বিভিন্ন বাড়ি থেকে শিবিরের নেতা-কর্মীরা পুলিশ-র্যাবের দিকে গুলি ছোড়েন। এই সংঘর্ষে আটজন গুলিবিদ্ধ হন। তাঁদের হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকেরা আবদুল্লাহ নামের শিবিরের এক কর্মীকে মৃত ঘোষণা করেন।
সন্ধ্যা সাতটার দিকে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা শহরে জামায়াত-শিবিরবিরোধী বিক্ষোভ মিছিল করেন। এতে সাতমাথাসহ আশপাশের এলাকায় আবার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
শিবিরের নেতা আবু রুহানিকে হত্যার প্রতিবাদে সন্ধ্যা ছয়টা থেকে এরুলিয়ায় বগুড়া-সান্তাহার সড়ক অবরোধ করেন স্থানীয় লোকজন। পরে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
পুলিশকে পিটুনি: সকাল পৌনে আটটার দিকে বগুড়া উপশহর বাজার এলাকায় হরতাল পালনের সময় পুলিশ শিবিরের দুই কর্মীকে আটক করে গাড়িতে তোলার চেষ্টা করে। তাঁদের ছিনিয়ে নিতে শিবিরের কর্মীরা লাঠি দিয়ে দুই পুলিশকে পেটান। এর মধ্যে এক পুলিশের রাইফেল কেড়ে নিয়ে তা দিয়েই তাঁকে পেটানো হয়। অতিরিক্ত পুলিশ এলে শিবিরের কর্মীরা অস্ত্রটি ৫০ গজ দূরে ফেলে পালিয়ে যান।
এ ছাড়া সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বগুড়া-ঢাকা মহাসড়কের বেতগাড়ীতে ১৫টি ও শহরের কলোনি এলাকায় তিনটি যানবাহন ভাঙচুর করেন শিবিরের কর্মীরা।
পাল্টাপাল্টি দাবি: বগুড়া জেলা ছাত্রশিবিরের প্রচার ও আন্দোলন সম্পাদক মিজানুর রহমান অভিযোগ করেন, ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে জামায়াতের কর্মী মিজানুর রহমান ও শিবিরের আজিজুল কলেজ পুরোনো ভবন শাখার সভাপতি আবু রুহানিকে হত্যা করেছেন।
অভিযোগ অস্বীকার করে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আলী আল রাজী বলেন, ‘হরতাল চলাকালে সাবগ্রামে সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে শিবিরের ওপর হামলা চালায়। ওই লোকজনের হামলায় এক ব্যবসায়ী মারা গেছেন। ফুলবাড়ীতে আমাদের কোনো ছেলে যায়নি। শিবির নিজেরাই এই ঘটনা ঘটিয়ে আন্দোলন শক্ত করতে চাইছে।’
‘মিজানুর নিরীহ ব্যবসায়ী’: নিহত ব্যবসায়ী মিজানুরের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা জেলায়। সাবগ্রামের মাস্টারপাড়ায় ভাড়া বাসায় থাকতেন। তিনি সাবগ্রাম বাজারে পোলট্রি ও হ্যাচারির ব্যবসা করতেন। বিকেলে ওই বাড়িতে গেলে বাড়ির মালিক আজিজুল হক বলেন, মিজানুর প্রায় তিন বছর ধরে তাঁর বাসায় আছেন। তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন না। তিনি নিরীহ প্রকৃতির ছিলেন।
একই কথা বলেন সাবগ্রাম বাজারের হ্যাচারি ও পোলট্রি খাদ্য ব্যবসায়ী সাইদুল ইসলামও।
মিজানুরের এক শিশুসন্তান রয়েছে। তাঁর স্ত্রী হালিমা বেগম বলেন, তাঁর স্বামী রাজনীতি করতেন না। তিনি দুপুরে বাসা থেকে হেঁটে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে যাচ্ছিলেন।
বগুড়ার পুলিশ সুপার বলেন, ‘মিজানুরের ওপর চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে পরিকল্পিতভাবে খুন করে কেউ রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির চেষ্টা করছে বলে প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।’
ঢাকার চিত্র: আধা বেলা হরতাল চলাকালে রাজধানীর প্রধান সড়কগুলোতে অন্য দিনের তুলনায় যান চলাচল ছিল কম। তবে অবাধে রিকশা চলাচল করেছে। এ সময় রাজধানী থেকে দূরপাল্লার কোনো বাস ছেড়ে যায়নি। রেল ও বিমান যোগাযোগ স্বাভাবিক ছিল। দোকানপাট বেশির ভাগই বন্ধ ছিল। তবে সরকারি দপ্তরগুলো খোলা ছিল।
হরতালের সমর্থনে মিরপুর, শেওড়াপাড়া, আজিমপুর, বাড্ডা, যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, বিশ্বরোড, কাঁচপুর এলাকায় তৎপর ছিলেন জামায়াতের কর্মীরা। তাঁদের প্রতিরোধে সতর্ক ছিল পুলিশ-র্যাবও। এর মধ্যে ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বিশ্বরোড এলাকায় করাতকল থেকে কাঠের গুঁড়ি এনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির চেষ্টা করে পিকেটাররা। পরে রাস্তায় টায়ারে আগুন ধরিয়ে দেন তাঁরা।
সকাল সাতটার দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সানারপাড়ে একটি পণ্যবাহী ট্রাকে আগুন দেন হরতালকারীরা। ছয়টার দিকে যাত্রাবাড়ী মোড়ের চাংপাই রেস্তোরাঁর সামনে ও জুরাইনে দুটি লেগুনায় আগুন দেওয়া হয়। মীরহাজিরবাগে বিআরটিসির একটি বাস ভাঙচুর করা হয়। পুলিশ ধাওয়া দিলে পিকেটাররা পালিয়ে যান।
সকালে আজিমপুরে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা রাস্তায় টায়ার জ্বালিয়ে পিকেটিং করেন। পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়েন তাঁরা। পুলিশ লাঠিপেটা করে তাঁদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় এবং তিনজনকে আটক করে।
সকাল আটটার দিকে মিরপুর অরিজিনাল ১০ নম্বরের কবরস্থানের পাশে বিহারি ক্যাম্প থেকে ১০-১৫ জন যুবক প্রধান সড়কে হরতালের সমর্থনে টায়ারে আগুন জ্বালায় ও দুটি বাস ভাঙচুর করেন। একপর্যায়ে তাঁরা যাত্রীবাহী একটি বাসে অগ্নিসংযোগ করেন। পুলিশ গিয়ে স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় আগুন নেভায়। ওই বাসের চালক বাবুল মিয়া আহত হন।
সকাল সাড়ে ১০টার দিকে পুরানা পল্টন মোড়ের কাছে দুটি ও এর কিছুক্ষণ আগে হাইকোর্টের সামনে কদম ফোয়ারার কাছে চারটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটে। এ দুই জায়গা থেকে পুলিশ চারজনকে আটক করে। সকাল নয়টার দিকে বাংলামোটরে পর পর ছয়টি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটান হরতালকারীরা। পুলিশ সেখান থেকে দুজনকে আটক করে।
হরতালের সমর্থনে কল্যাণপুরে জামায়াতের সাংসদ হামিদুর রহমানের আযাদের নেতৃত্বে মিছিল হয়। ফার্মগেটে শিবিরের আট-নয়জন ঝটিকা মিছিল বের করলে পুলিশ ছত্রভঙ্গ করে দেয় এবং একজনকে আটক করে। সকাল পৌনে সাতটার দিকে মিরপুরের কাজীপাড়ায় হরতালের সমর্থনে মিছিল থেকে পুলিশ চারজনকে আটক করে।
ঢাকা মহানগর পুলিশ জানায়, হরতালের সময় জামায়াত-শিবিরের ২২ জনকে আটক করা হয়েছে। তবে জামায়াতের পক্ষ থেকে ঢাকায় ৬৪ জনসহ সারা দেশে দুই শতাধিক নেতা-কর্মীকে আটক করার দাবি করা হয়।
জামায়াতের বিবৃতি: এক বিবৃতিতে জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম দাবি করেন, বগুড়ায় সরকারের মন্ত্রী, সাংসদ ও দলীয় নেতাদের নির্দেশে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও পুলিশ বগুড়ায় দলের চারজনকে হত্যা করেছে।
হরতাল শেষে অপর এক বিবৃতিতে জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমাদ দাবি করেন, ‘ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগের সশস্ত্র ক্যাডার ও পুলিশের তাণ্ডবের মধ্যেও দেশব্যাপী স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালিত হয়েছে। এর মাধ্যমে জনগণ চলমান ট্রাইব্যুনাল বাতিল করে জামায়াতের নেতাদের মুক্তির পক্ষে রায় দিয়েছে।’
No comments