অস্ত্র কখনো শান্তি আনবে না by মমতাজউদদীন আহমদ
সেদিন ছিল শুক্রবার। সকালে শুভদিনের শুরু- সামনেই ক্রিসমাসের মহোৎসব। বাবা ছেলেকে স্কুলে রেখে গেলেন। তখন সকাল ৯টা। ছেলে স্কুল থেকে দুপুরে ফিরে বাবার সঙ্গে প্রিয় জিনজার কেক বানাবে। পিতা-পুত্র মজা করে খাবে। জেসি লুই সত্যি খুব মিষ্টি ছেলে, মাত্র ছয় বছর বয়স।
জেসি গাড়িতে আর ঘোড়ায় চড়তে বড় ভালোবাসে। তা নিয়ে বাবা নিল হেসলিনের কত অহংকার! রোজকার মতো আজও ছেলেকে রেখে গেলেন। দুপুরে এসে নিয়ে যাবেন। ঠিক করে রেখেছেন বাপ-বেটা। কিন্তু হলো না। সকাল ৯টা ৩৮ মিনিটে জেসি দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছে।
জেসি নিজে নিজে যায়নি। কুড়ি বছরের যুবক আদম লানজা জেসিকে তার ক্লাসরুমে গুলি করে রক্তে ডুবিয়ে দিল। কেবল জেসি নয়, আরো ১৯টি শিশুকে লানজা এলোপাতাড়ি গুলি করেছে। কুড়িজন নিষ্পাপ সরল ও চমৎকার শিশুকে লানজার গুলিতে মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যেই জীবন দিতে হলো। তারা কেউ এত দ্রুত মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত ছিল না। মৃত্যু কী, মৃত্যুর মানেও তারা বোঝেনি। শিশুরা তো শুধু জীবন চেনে। ঘাতক লানজা শিশু নয়, স্যান্ডিহুক স্কুলের প্রিন্সিপাল হচস্প্রাংকেও গুলি করেছে। নিজ গর্ভধারিণী জননীকেও সকালে হত্যা করেছে। সব শেষে নিজেকেও। মরে গেছে ঘাতক লানজা। নিউ ইয়র্ক থেকে মাত্র ৫০ মাইল দূরে পাশের স্টেট কানেকটিকাটে ঘটেছে এমন শোচনীয় আর নারকীয় ঘটনা। মাত্র সাত-আট মিনিটের মধ্যেই ঘাতক এতসব ভয়ংকর কাজ শেষে নিজেকে হত্যা করে বিদায় নিয়েছে পৃথিবী থেকে।
তার এত ক্ষোভ কেন? গর্ভধারিণী জননীকেও রেহাই দেয়নি। কচি কচি শিশুর বিরুদ্ধে তার কিসের ক্ষোভ? কেন তিনটি মারণাস্ত্র নিয়ে সকালেই ঘর ছেড়ে বের হয়েছে কুড়ি বছর বয়সের তরুণ লানজা। মাটির নিচের বেজমেন্টে একা একা থাকত। সেখানে তালা দিয়ে বন্ধ তার মায়ের মারণাস্ত্র। জননীর বড় নেশা অস্ত্রশেখা। ছেলেকে নিয়ে যেতেন নিশানা ঠিক করার প্রশিক্ষণ নিতে রাইফেল ক্লাবে। জননী শিক্ষয়িত্রী। স্বামীর সঙ্গে বিরোধ, ডিভোর্স হয়ে গেছে। দুই ছেলে রাইনা ও আদমকে নিয়ে একা থাকেন। মনে মনে দারুণ ক্ষোভ স্বামীর ওপর।
ছেলেদের চলাফেরার দিকে ততখানি নজর নেই। ছেলেরা কী ভাবছে, কী করছে তার দিকে তেমন মনোযোগ নেই মায়ের। মা থাকেন স্কুল নিয়ে। লানজা মাকে কাছে পায় না। একা একা গুমরে মরে। কেন মা আর দশটি শিশুর জন্য এত সময় দেন। এমনি ক্ষোভ ছিল হয়তো আদমের মনেও। বিরূপ মন তার। ঠিকমতো খায় না। মায়ের সঙ্গে সম্পর্কের দূরত্ব। একাকিত্বের শূন্যতায় যুবক আদম ক্রোধে অস্থির হয়। সেই ক্রোধই কি শিশুহত্যার জন্য দায়ী! যে স্কুলের কাজ মাকে নিয়ে গেছে তার কাছ থেকে দূরে, সেই স্কুলের দিকে ঘৃণা ও ক্রোধ। সঠিক কারণ জানা যায়নি, তবে এমনটা হতে পারে বলে অনুমান করছেন অনুসন্ধানকারীরা।
স্কুলের নাম স্যান্ডিহুক। ১৯৫৬ সালের স্কুল। ৭০০ শিশু এই স্কুলের শিক্ষার্থী। প্রিন্সিপাল হচস্প্রাং অভিজ্ঞতায় মজবুত। কানেকটিকাট স্টেটের হার্টফোর্ড অংশের নিউটাউনের এক প্রাইমারি স্কুলের নাম স্যান্ডিহুক। কিন্ডারগার্টেন থেকে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষাদানের ব্যবস্থা। নিউটাউন যদিও নাম; কিন্তু স্যান্ডিহুক নীরব-নির্জন। ছিমছাম সবুজে ঘেরা গ্রাম। বড় বেশি বিত্তবানদের জায়গা নয় নিউটাউন। মধ্যবিত্তরাই এখানে বাস করেন। তাঁদের ছেলেমেয়েরাই স্কুলের শিক্ষার্থী। শহরের কৃত্রিম ছাড়া ছাড়া জীবন নয় নিউটাউন। একে অন্যকে চেনে আর জানে। সমব্যথী একে অন্যের। বন্ধুত্ব ও সৌহার্দ্য সবার মধ্যে। কিন্তু এমন নির্জন-নীরব গ্রামে একাকিত্বের নীরব যন্ত্রণা আছে। আধুনিক জীবনের বিলাসিতার সবটাই মধুমাখা নয়। ঘরে ঘরে জনে জনে যে নীরব যন্ত্রণার বাসা, তার থেকে মুক্ত নয় নির্জন গ্রামের আনন্দময় বাস। আদমের মা ন্যান্সির মনেও ক্রোধ ছিল, শূন্যতা ছিল। স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদের তীব্র যন্ত্রণা ও ক্রোধ তো ছিলই। সে যন্ত্রণার রোগ লেগেছে তার সন্তানের মধ্যে। বড় ছেলে আগেই এ কষ্ট থেকে দ্রুত সরে গেছে।
এখন আছে আদম লানজা। তার আছে একাকিত্বের কষ্ট। কারো সঙ্গে কথা বলে না, জননীর সঙ্গেও না। একা একা থাকে, কিভাবে কী করে মায়ের ওদিকে খেয়ালই নেই। এ রোগী ভয়ংকর রোগী। জননী যত নিজের ক্রোধ দূরে রাখার জন্য স্কুল নিয়ে ব্যস্ত, ততই মায়ের অভাব পুত্র আদমকে উন্মাদ করে। এমন উন্মাদনা কেবল আদমের নয়। এই যন্ত্রণা গোটা আমেরিকায়। সব আছে ইউরোপে আর যুক্তরাষ্ট্রে। কিন্তু মনের শান্তি ও সুখ নেই। বিচ্ছিন্ন একেকজন। যতই শান্তির কথা বলে, মনোরম পৃথিবীর স্বপ্ন দেখে; কিন্তু পারিবারিক সুখ ও শান্তি নেই। সব আলগা, সব অশান্ত। সবাই অসুস্থ। মনের রোগ সবার। এমন নৃশংস ঘটনা, এমন ভয়াবহ মৃত্যুর ঘটনা আরো ঘটেছে। কাগজে সেসব হত্যার খবর পেলাম। ১৯২৭ সালে এক খুনি মেরেছে একটি শিশুসহ আরো চারজনকে। ১৯২১ সালে এক খুনি মেরেছে ২১ জনকে। খুনি ২০০৬ সালে ১০ কিশোরীকে খুন করেছে। ১৯৯৮ সালে পাঁচটি শিশুকে মেরেছে খেলার মাঠে। ২০০৫ সালে ১৬ বছরের খুনি পাঁচ শিশু আর দুই কিশোরীকে মেরেছে। ১৯৯৮ সালে মাত্র ১২-১৩ বছরের এক খুনি মেরেছে চার কিশোরী ও শিক্ষককে। একটা সাধারণ লক্ষণ হলো, প্রতিটি ক্ষেত্রে খুনি নিজেকেও খুন করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিদিন ৩৪ জন খুন হয় মারণাস্ত্র দিয়ে। সেই হিসাবে ছয় মাসে যত লোক মারা গেছে, তত সৈনিক মারা যায়নি ইরাক ও আফগানিস্তানের যুদ্ধে। কেবল যুক্তরাষ্ট্র নয়, দুনিয়ার সবখানে (বাংলাদেশসহ) মানুষ খুন করার নেশা জেগে উঠেছে।
আমেরিকায় রব উঠেছে, মারণাস্ত্র বিক্রি বন্ধ করো, আর এভাবে মরতে চাই না, আর শিশুদের এভাবে মৃত্যু দেখতে চাই না। কিন্তু অস্ত্র ব্যবসায়ীরা কি এ দাবি মেনে নেবে? তাদের তো আছে লাভের নেশা। আর আছে ক্ষমতার অহংকার।
প্রেসিডেন্ট ওবামা শিশুদের এমন মৃত্যুর সংবাদ শুনে অঝোরে কেঁদেছেন। ওবামার কান্না রাজনৈতিক কান্না নয়। কনিষ্ঠ কন্যাকে বুকে নিয়ে বাবা ওবামা কান্নায় ব্যাকুল হয়েছেন, জাতির উদ্দেশে বলেছেন, 'যারা মারা গেল, তারা প্রায় সবাই শিশু। সুন্দর, নিষ্পাপ কচি কচি শিশু, পাঁচ-দশ বছরের চমৎকার শিশু। হায়রে! তাদের ছিল পূর্ণ জীবনের স্বপ্ন। জন্মোৎসবের আনন্দ, গ্র্যাজুয়েট হওয়ার তৃষ্ণা। বিয়ে হবে, সুন্দর সংসার হবে, কত কী! সব শেষ হয়ে গেল নির্মম ঘাতকের গুলিতে। আমাদের হৃদয় আজ শোকাতুর। মা-বাবা, বোন আর কাজিনদের কথা মনে পড়ছে। কত গভীর শোকের সঙ্গে তারা বাস করছে! এই মরণের বিরুদ্ধে, এই মারণাস্ত্র ব্যবহারের বিরুদ্ধে আমি অবশ্যই অর্থবহ কিছু করব, তা-ই বলে রাখলাম।'
ওবামা তো চাইছেন অস্ত্রের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে! কিন্তু বিপক্ষীয় মুনাফাবাজ অস্ত্র ব্যবসায়ী ও খুন-রাহাজানিপ্রিয় একটা বিশেষ শ্রেণী কি মার্কিন দেশে সহজে শান্তি আনতে দেবে!
এক ভীতসন্ত্রস্ত মা বলেছেন, সব ছেড়ে এসে বাসা বেঁধেছি সম্পূর্ণ নিরাপদ ও নীরব গ্রাম এই নিউটাউনে। এখানেও দেখি মৃত্যুর হাহাকার। তবে কোথায় যাব, কোথায় নিরাপদ স্থান আছে গোটা যুক্তরাষ্ট্রে?
যুক্তরাষ্ট্রের ঘরে ঘরে আতঙ্ক। ঘরের শিশু গেছে স্কুলে, যথাসময়ে স্কুলের বাস যদি না আসে, মায়েদের বুক কেঁপে ওঠে- না জানি কী হয়েছে, কেমন আছে তাঁর শিশুসন্তান! স্কুল থেকে টেলিফোন এলেই মায়েদের কাঁপন শুরু হয়ে যায়- তবে কী সংবাদ এলো? কোনো অঘটন নয় তো!
এমন আতঙ্ক, এমন অনিশ্চয়তা নিয়ে যে আমেরিকা এগিয়ে চলেছে, তাতে ঘরে ঘরে মানসিক অস্থিরতার রোগীর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই যাবে। স্বাভাবিক সহজ সমাজ কেমন করে নির্মাণ করবেন যুদ্ধপ্রিয় সমরনায়করা। অস্ত্রের সহজলভ্যতা আর যথেচ্ছ ব্যবহারের বিরুদ্ধে এখনই যদি প্রশাসন কঠোর না হয়, তাহলে বিদেশে কেন, স্বদেশেই মার্কিনদের ঘরে ঘরে যুদ্ধ অনিবার্য। হত্যা-খুনের নেশা মাদক নেশার চেয়েও মারাত্মক হতে পারে। এখনই সতর্ক হওয়ার অনিবার্য সময়।
এই মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতর আমেরিকায় মা-বাবা কেবল নয়, সারা পৃথিবীতে জীবনের অনিশ্চয়তা। বাংলাদেশেও দিন দিন মৃত্যুর শঙ্কা জেগে উঠেছে। সবাই আতঙ্কে আছে। কখন অযাচিত মৃত্যু এসে হানা দেয়। শান্তির পৃথিবী একটা মিরেজ মাত্র হয়ে থাকবে ভবিষ্যতে।
দেখলাম, প্রেসিডেন্ট ওবামা দ্রুত অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইন পাস করাতে উদ্যোগ নিয়েছেন। সবাইকে ঢালাওভাবে অস্ত্র কিনতে দেওয়া হবে না। তার আগে নানা জিজ্ঞাসা ও পরীক্ষা করা হবে।
আমাদের দেশেও অস্ত্রের সহজলভ্যতা ও ব্যবহার আরো কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এখন কথায় কথায় খুন আর গোলাগুলি চলছে। ভালো নয়, কিছুতেই ভালো নয়। অস্ত্র কখনো শান্তি আনবে না।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও নাট্যব্যক্তিত্ব
জেসি নিজে নিজে যায়নি। কুড়ি বছরের যুবক আদম লানজা জেসিকে তার ক্লাসরুমে গুলি করে রক্তে ডুবিয়ে দিল। কেবল জেসি নয়, আরো ১৯টি শিশুকে লানজা এলোপাতাড়ি গুলি করেছে। কুড়িজন নিষ্পাপ সরল ও চমৎকার শিশুকে লানজার গুলিতে মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যেই জীবন দিতে হলো। তারা কেউ এত দ্রুত মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত ছিল না। মৃত্যু কী, মৃত্যুর মানেও তারা বোঝেনি। শিশুরা তো শুধু জীবন চেনে। ঘাতক লানজা শিশু নয়, স্যান্ডিহুক স্কুলের প্রিন্সিপাল হচস্প্রাংকেও গুলি করেছে। নিজ গর্ভধারিণী জননীকেও সকালে হত্যা করেছে। সব শেষে নিজেকেও। মরে গেছে ঘাতক লানজা। নিউ ইয়র্ক থেকে মাত্র ৫০ মাইল দূরে পাশের স্টেট কানেকটিকাটে ঘটেছে এমন শোচনীয় আর নারকীয় ঘটনা। মাত্র সাত-আট মিনিটের মধ্যেই ঘাতক এতসব ভয়ংকর কাজ শেষে নিজেকে হত্যা করে বিদায় নিয়েছে পৃথিবী থেকে।
তার এত ক্ষোভ কেন? গর্ভধারিণী জননীকেও রেহাই দেয়নি। কচি কচি শিশুর বিরুদ্ধে তার কিসের ক্ষোভ? কেন তিনটি মারণাস্ত্র নিয়ে সকালেই ঘর ছেড়ে বের হয়েছে কুড়ি বছর বয়সের তরুণ লানজা। মাটির নিচের বেজমেন্টে একা একা থাকত। সেখানে তালা দিয়ে বন্ধ তার মায়ের মারণাস্ত্র। জননীর বড় নেশা অস্ত্রশেখা। ছেলেকে নিয়ে যেতেন নিশানা ঠিক করার প্রশিক্ষণ নিতে রাইফেল ক্লাবে। জননী শিক্ষয়িত্রী। স্বামীর সঙ্গে বিরোধ, ডিভোর্স হয়ে গেছে। দুই ছেলে রাইনা ও আদমকে নিয়ে একা থাকেন। মনে মনে দারুণ ক্ষোভ স্বামীর ওপর।
ছেলেদের চলাফেরার দিকে ততখানি নজর নেই। ছেলেরা কী ভাবছে, কী করছে তার দিকে তেমন মনোযোগ নেই মায়ের। মা থাকেন স্কুল নিয়ে। লানজা মাকে কাছে পায় না। একা একা গুমরে মরে। কেন মা আর দশটি শিশুর জন্য এত সময় দেন। এমনি ক্ষোভ ছিল হয়তো আদমের মনেও। বিরূপ মন তার। ঠিকমতো খায় না। মায়ের সঙ্গে সম্পর্কের দূরত্ব। একাকিত্বের শূন্যতায় যুবক আদম ক্রোধে অস্থির হয়। সেই ক্রোধই কি শিশুহত্যার জন্য দায়ী! যে স্কুলের কাজ মাকে নিয়ে গেছে তার কাছ থেকে দূরে, সেই স্কুলের দিকে ঘৃণা ও ক্রোধ। সঠিক কারণ জানা যায়নি, তবে এমনটা হতে পারে বলে অনুমান করছেন অনুসন্ধানকারীরা।
স্কুলের নাম স্যান্ডিহুক। ১৯৫৬ সালের স্কুল। ৭০০ শিশু এই স্কুলের শিক্ষার্থী। প্রিন্সিপাল হচস্প্রাং অভিজ্ঞতায় মজবুত। কানেকটিকাট স্টেটের হার্টফোর্ড অংশের নিউটাউনের এক প্রাইমারি স্কুলের নাম স্যান্ডিহুক। কিন্ডারগার্টেন থেকে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষাদানের ব্যবস্থা। নিউটাউন যদিও নাম; কিন্তু স্যান্ডিহুক নীরব-নির্জন। ছিমছাম সবুজে ঘেরা গ্রাম। বড় বেশি বিত্তবানদের জায়গা নয় নিউটাউন। মধ্যবিত্তরাই এখানে বাস করেন। তাঁদের ছেলেমেয়েরাই স্কুলের শিক্ষার্থী। শহরের কৃত্রিম ছাড়া ছাড়া জীবন নয় নিউটাউন। একে অন্যকে চেনে আর জানে। সমব্যথী একে অন্যের। বন্ধুত্ব ও সৌহার্দ্য সবার মধ্যে। কিন্তু এমন নির্জন-নীরব গ্রামে একাকিত্বের নীরব যন্ত্রণা আছে। আধুনিক জীবনের বিলাসিতার সবটাই মধুমাখা নয়। ঘরে ঘরে জনে জনে যে নীরব যন্ত্রণার বাসা, তার থেকে মুক্ত নয় নির্জন গ্রামের আনন্দময় বাস। আদমের মা ন্যান্সির মনেও ক্রোধ ছিল, শূন্যতা ছিল। স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদের তীব্র যন্ত্রণা ও ক্রোধ তো ছিলই। সে যন্ত্রণার রোগ লেগেছে তার সন্তানের মধ্যে। বড় ছেলে আগেই এ কষ্ট থেকে দ্রুত সরে গেছে।
এখন আছে আদম লানজা। তার আছে একাকিত্বের কষ্ট। কারো সঙ্গে কথা বলে না, জননীর সঙ্গেও না। একা একা থাকে, কিভাবে কী করে মায়ের ওদিকে খেয়ালই নেই। এ রোগী ভয়ংকর রোগী। জননী যত নিজের ক্রোধ দূরে রাখার জন্য স্কুল নিয়ে ব্যস্ত, ততই মায়ের অভাব পুত্র আদমকে উন্মাদ করে। এমন উন্মাদনা কেবল আদমের নয়। এই যন্ত্রণা গোটা আমেরিকায়। সব আছে ইউরোপে আর যুক্তরাষ্ট্রে। কিন্তু মনের শান্তি ও সুখ নেই। বিচ্ছিন্ন একেকজন। যতই শান্তির কথা বলে, মনোরম পৃথিবীর স্বপ্ন দেখে; কিন্তু পারিবারিক সুখ ও শান্তি নেই। সব আলগা, সব অশান্ত। সবাই অসুস্থ। মনের রোগ সবার। এমন নৃশংস ঘটনা, এমন ভয়াবহ মৃত্যুর ঘটনা আরো ঘটেছে। কাগজে সেসব হত্যার খবর পেলাম। ১৯২৭ সালে এক খুনি মেরেছে একটি শিশুসহ আরো চারজনকে। ১৯২১ সালে এক খুনি মেরেছে ২১ জনকে। খুনি ২০০৬ সালে ১০ কিশোরীকে খুন করেছে। ১৯৯৮ সালে পাঁচটি শিশুকে মেরেছে খেলার মাঠে। ২০০৫ সালে ১৬ বছরের খুনি পাঁচ শিশু আর দুই কিশোরীকে মেরেছে। ১৯৯৮ সালে মাত্র ১২-১৩ বছরের এক খুনি মেরেছে চার কিশোরী ও শিক্ষককে। একটা সাধারণ লক্ষণ হলো, প্রতিটি ক্ষেত্রে খুনি নিজেকেও খুন করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিদিন ৩৪ জন খুন হয় মারণাস্ত্র দিয়ে। সেই হিসাবে ছয় মাসে যত লোক মারা গেছে, তত সৈনিক মারা যায়নি ইরাক ও আফগানিস্তানের যুদ্ধে। কেবল যুক্তরাষ্ট্র নয়, দুনিয়ার সবখানে (বাংলাদেশসহ) মানুষ খুন করার নেশা জেগে উঠেছে।
আমেরিকায় রব উঠেছে, মারণাস্ত্র বিক্রি বন্ধ করো, আর এভাবে মরতে চাই না, আর শিশুদের এভাবে মৃত্যু দেখতে চাই না। কিন্তু অস্ত্র ব্যবসায়ীরা কি এ দাবি মেনে নেবে? তাদের তো আছে লাভের নেশা। আর আছে ক্ষমতার অহংকার।
প্রেসিডেন্ট ওবামা শিশুদের এমন মৃত্যুর সংবাদ শুনে অঝোরে কেঁদেছেন। ওবামার কান্না রাজনৈতিক কান্না নয়। কনিষ্ঠ কন্যাকে বুকে নিয়ে বাবা ওবামা কান্নায় ব্যাকুল হয়েছেন, জাতির উদ্দেশে বলেছেন, 'যারা মারা গেল, তারা প্রায় সবাই শিশু। সুন্দর, নিষ্পাপ কচি কচি শিশু, পাঁচ-দশ বছরের চমৎকার শিশু। হায়রে! তাদের ছিল পূর্ণ জীবনের স্বপ্ন। জন্মোৎসবের আনন্দ, গ্র্যাজুয়েট হওয়ার তৃষ্ণা। বিয়ে হবে, সুন্দর সংসার হবে, কত কী! সব শেষ হয়ে গেল নির্মম ঘাতকের গুলিতে। আমাদের হৃদয় আজ শোকাতুর। মা-বাবা, বোন আর কাজিনদের কথা মনে পড়ছে। কত গভীর শোকের সঙ্গে তারা বাস করছে! এই মরণের বিরুদ্ধে, এই মারণাস্ত্র ব্যবহারের বিরুদ্ধে আমি অবশ্যই অর্থবহ কিছু করব, তা-ই বলে রাখলাম।'
ওবামা তো চাইছেন অস্ত্রের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে! কিন্তু বিপক্ষীয় মুনাফাবাজ অস্ত্র ব্যবসায়ী ও খুন-রাহাজানিপ্রিয় একটা বিশেষ শ্রেণী কি মার্কিন দেশে সহজে শান্তি আনতে দেবে!
এক ভীতসন্ত্রস্ত মা বলেছেন, সব ছেড়ে এসে বাসা বেঁধেছি সম্পূর্ণ নিরাপদ ও নীরব গ্রাম এই নিউটাউনে। এখানেও দেখি মৃত্যুর হাহাকার। তবে কোথায় যাব, কোথায় নিরাপদ স্থান আছে গোটা যুক্তরাষ্ট্রে?
যুক্তরাষ্ট্রের ঘরে ঘরে আতঙ্ক। ঘরের শিশু গেছে স্কুলে, যথাসময়ে স্কুলের বাস যদি না আসে, মায়েদের বুক কেঁপে ওঠে- না জানি কী হয়েছে, কেমন আছে তাঁর শিশুসন্তান! স্কুল থেকে টেলিফোন এলেই মায়েদের কাঁপন শুরু হয়ে যায়- তবে কী সংবাদ এলো? কোনো অঘটন নয় তো!
এমন আতঙ্ক, এমন অনিশ্চয়তা নিয়ে যে আমেরিকা এগিয়ে চলেছে, তাতে ঘরে ঘরে মানসিক অস্থিরতার রোগীর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই যাবে। স্বাভাবিক সহজ সমাজ কেমন করে নির্মাণ করবেন যুদ্ধপ্রিয় সমরনায়করা। অস্ত্রের সহজলভ্যতা আর যথেচ্ছ ব্যবহারের বিরুদ্ধে এখনই যদি প্রশাসন কঠোর না হয়, তাহলে বিদেশে কেন, স্বদেশেই মার্কিনদের ঘরে ঘরে যুদ্ধ অনিবার্য। হত্যা-খুনের নেশা মাদক নেশার চেয়েও মারাত্মক হতে পারে। এখনই সতর্ক হওয়ার অনিবার্য সময়।
এই মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতর আমেরিকায় মা-বাবা কেবল নয়, সারা পৃথিবীতে জীবনের অনিশ্চয়তা। বাংলাদেশেও দিন দিন মৃত্যুর শঙ্কা জেগে উঠেছে। সবাই আতঙ্কে আছে। কখন অযাচিত মৃত্যু এসে হানা দেয়। শান্তির পৃথিবী একটা মিরেজ মাত্র হয়ে থাকবে ভবিষ্যতে।
দেখলাম, প্রেসিডেন্ট ওবামা দ্রুত অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইন পাস করাতে উদ্যোগ নিয়েছেন। সবাইকে ঢালাওভাবে অস্ত্র কিনতে দেওয়া হবে না। তার আগে নানা জিজ্ঞাসা ও পরীক্ষা করা হবে।
আমাদের দেশেও অস্ত্রের সহজলভ্যতা ও ব্যবহার আরো কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এখন কথায় কথায় খুন আর গোলাগুলি চলছে। ভালো নয়, কিছুতেই ভালো নয়। অস্ত্র কখনো শান্তি আনবে না।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও নাট্যব্যক্তিত্ব
No comments