বর্ষসেরা ব্যক্তিত্ব ওবামা নন, মালালা by সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ
বিশ্বখ্যাত ইংরেজি সাময়িকী টাইম ২০১২ সালের সর্বশেষ সংখ্যায় পারসন অব দ্য ইয়ার হিসেবে পাঁচটি নাম উল্লেখ করেছে। বাংলায় আমরা বর্ষসেরা ব্যক্তি হিসেবে উল্লেখ করতে পারি। প্রথমেই রয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার নাম।
দ্বিতীয় স্থানে পাকিস্তানের সোয়াতের কিশোরী মালালা ইউসুফজাই, তৃতীয় অবস্থান অ্যাপলের সিইও টিম কুক, চতুর্থ স্থান দখল করেছেন মিসরের রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ মুরসি এবং পঞ্চম স্থান কর্না পদার্থবিজ্ঞানী (Particle Physicist) ফাবিওলা জিয়ানোটি (Fabiola Gianotil)। পাঁচজনের ভেতর দুজন নারী অর্থাৎ দ্বিতীয় এবং পঞ্চম ব্যক্তি। তবে মালালা ১৫ বছরের কিশোরী। এই পাঁচ ব্যক্তিত্ব নিজ নিজ অবস্থানে অনন্য এবং অসাধারণ; তা নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই। কিন্তু ক্রমিক অবস্থান নিয়ে দ্বিমত পোষণের সুযোগ রয়েছে। এমনকি এ কথা বলা চলে যে এই বিচারে পত্রিকার পক্ষপাতিত্ব রয়েছে। পশ্চিমা বিশ্বের তিনটি ইংরেজি সাপ্তাহিকের সঙ্গে আমরা খুবই পরিচিত। এই তিনটি হলো টাইম, নিউজ উইক এবং দি ইকোনমিস্ট। সবচেয়ে বেশি পুরনো হলো দি ইকোনমিস্ট। পত্রিকাটিতে অর্থনৈতিক বিষয়ের ওপর অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়, অবশ্য রাজনৈতিক, শিল্পকলা- এসব সম্পর্কেও কম গুরুত্ব নেই। টাইম ও নিউজ উইক মূলত সংবাদভিত্তিক। অবশ্য অন্যান্য বিষয়ও থাকে। টাইম এবং নিউজ উইকের ভেতর তীব্র প্রতিযোগিতা চলছে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ, তাৎপর্যপূর্ণ ও রহস্যময় সংবাদ কে কার আগে পরিবেশন করতে পারে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, টাইম ও নিউজ উইকের জন্মস্থান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং দি ইকোনমিস্টের যুক্তরাজ্যে। ৮০ বছর পর নিউজ উইকের সর্বশেষ মুদ্রিত সংখ্যা বের হলো ২০১২ সালের ৩১ ডিসেম্বর। ডিজিটাল ভার্সন থাকছে। যা-ই হোক এসব পত্রিকা প্রতিবছর বর্ষ শেষে সেরা ব্যক্তিত্ব এবং নানা ঘটনা নিয়ে লিখে থাকে। তবে ব্যাপকভাবে অতীত ইতিহাস এবং ঘটনা ও ব্যক্তিত্ব নিয়ে লেখালেখি হয়েছিল মিলেনিয়াম সংখ্যায়, যখন আমরা নতুন মিলিনিয়ামে প্রবেশ করি। সে সময় গত শতাব্দীতে যেসব ব্যক্তিত্বের প্রভাবে উল্লেখযোগ্য তথা তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটেছিল, তাদের উল্লেখ ছিল। কিন্তু বিস্ময়ের বিষয় হলো বঙ্গবন্ধুর নাম ছিল না। অথচ তাঁর নেতৃত্বে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়, তাঁর পরিচালিত অহিংস এবং অসহযোগ আন্দোলন মহাত্মা গান্ধীর আন্দোলনকে ম্লান করেছে। বঙ্গবন্ধুর নামটি নীতিগত কারণে আসেনি। প্রথমত, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি তৎকালীন মার্কিন প্রশাসনের অনুমোদন ছিল না; দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের চূড়ান্ত বিজয় অর্জনে ইন্দো-সোভিয়েত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তবে ব্যক্তিগতভাবে পশ্চিমা অনেক সাংবাদিকের কাছে কৃতজ্ঞ। তাঁরা প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরেছিলেন, যা বিশ্ব জনমত গড়ে তুলতে সাহায্য করে। এ ছাড়া এই নিউজ উইকের একটি সংখ্যায় (সম্ভবত আগস্ট '৭১) লেখা হয়েছিল যে পূর্ব পাকিস্তান অবশিষ্ট পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হবে, তা শুধু সময়ের ব্যাপার।
বারাক ওবামা দ্বিতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এ নজির কম নয়। গত শতাব্দীতে ছয়জন প্রেসিডেন্ট দুবার করে নির্বাচিত হয়েছেন। এর ভেতর ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট তো চারবার নির্বাচিত হয়েছেন। তখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলছিল। এখানে উল্লেখ্য, দুবারের বেশি প্রেসিডেন্ট থাকা যাবে না, এটিতে কোনো সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা প্রথম ছিল না। ১৯৫১ সালে সংশোধনী এনে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা আনা হয় যে দুবারের বেশি এই পদে থাকা যাবে না। বারাক ওবামা পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী এবং সম্পদশালী রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। তাঁর অনেক যোগ্যতা ও দক্ষতা। তাঁকে নিয়ে বলার কিছু নেই। আমরা শ্রদ্ধা করি। কিন্তু তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর দক্ষতা ও যোগ্যতা দেখাতে সব সময় অনুকূল পরিবেশ পেয়েছেন। একটি সুশিক্ষিত জাতির গঠনমূলক সমালোচনা এবং সহযোগিতা পেয়েছেন কাজ করার জন্য। তাঁর বিপরীতে আমরা মালালার অবস্থানটা বিচার করি। প্রথমত, ১৫ বছরের একটি কিশোরী। মালালার আবাসভূমি পাকিস্তানি তালেবানরা দখল করে নেওয়া নারীদের প্রতি তালেবানদের দৃষ্টিভঙ্গি কী, তা তো সবার জানা। মেয়েরা মূর্খ হয়ে ঘরে থাকবে। দাসীগিরি করবে, আর পুরুষের প্রয়োজন মেটাবে। ঘরের বাইরে যদি কখনো আসতে হয়, তাহলে আপাদমস্তক মুড়িয়ে কারো সঙ্গে বেরোবে। আফগানিস্তানে তালেবান শাসন কায়েমের পর সব নারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়। চরম প্রতিকূল অবস্থাতে মালালা অটল ছিল তার শিক্ষা চালিয়ে যাওয়ার জন্য। খোলাখুলি সে বক্তব্য রেখেছিল যে তালেবানদের কোনো অধিকার নেই তাকে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করার। এটা কত বড় দুঃসাহস। সে তো নিরাপত্তা বাহিনী নিয়ে চলে না। তার ওপর ভয়াবহ আঘাত আসে গত বছরের ৯ অক্টোবর। যখন সে বাসে স্কুল থেকে ফিরছিল, তখন তালেবানরা তার নাম ধরে ডেকে শনাক্ত করে মাথায় গুলি করে। তারা চেয়েছিল ওর কণ্ঠস্বর চিরতরে স্তব্ধ করে দিতে। বরং ফল হয়েছে উল্টো। গোটা বিশ্বে তার কণ্ঠস্বর ছড়িয়ে পড়েছে। আজ মালালা মানে এক প্রতিবাদী এবং চরম সাহসী কণ্ঠস্বর। গোটা বিশ্বের নারীদের জাগিয়ে তোলার প্রেরণা সে। সর্বত্র দাবি উঠেছে, তাকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হোক।
টাইম পত্রিকায় অবশ্য মালালার অসীম সাহসিকতা এবং দৃঢ় সংকল্পের কথা বলা হয়েছে। তবে এ রকম যুক্তি দেখানো হয়েছে যে তার এই কম বয়সে জীবন-মৃত্যুর সংগ্রামে এত দৃঢ়তা দেখানো পুরোপুরি সম্ভব নয়। তার বাবা জিয়াউদ্দিন ইউসুফজাইয়ের ভূমিকা রয়েছে মনস্তাত্ত্বিকভাবে তার দৃঢ় সংকল্প তৈরির জন্য। কথাটা আংশিক সত্যতা পায়। তার অন্তর্নিহিত অনুভূতি কাজ না করলে চেতনায় ততটা বিকাশ সম্ভব নয়। এই বয়সে দুঃসাহস দেখানো কিংবা তীব্র অনুভূতি দেখানোর দৃষ্টান্ত রয়েছে তার। যারা অ্যানে ফ্রাঙ্কের ডায়েরি পড়েছে, তারা কি বিস্মিত হবে না যে নাজিদের হাতে প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর আশঙ্কা করা সত্ত্বেও কী রকম অনুভূতি ব্যক্ত করে মেয়েটি ডায়েরিটি লিখেছে। অতএব মালালাকে খাটো করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। আমরা চাই, সে শতভাগ আরোগ্য লাভ করুক। আমরা মনে করি, টাইম আরেকটু উদার হতে পারত। মালালাকে এক নম্বর অবস্থানে নিয়ে
আসতে পারত।
সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন জাতিসংঘের বিশেষ দূত হিসেবে global education-এর জন্য কাজ করছেন। তিনি ১০ নভেম্বরকে 'মালালা দিবস' হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন এবং বিশ্বের পাঁচ কোটি মেয়ে যারা স্কুলে যেতে পারছে না তাদের জন্য এটি হবে প্রেরণা লাভের দিবস। মালালার প্রেরণা এবং আদর্শ আজ আর একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বব্যাপী। এর চেয়ে বেশি কিছু বলার
আছে কি?
লেখক : সাবেক সরকারি কর্মকর্তা
বারাক ওবামা দ্বিতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এ নজির কম নয়। গত শতাব্দীতে ছয়জন প্রেসিডেন্ট দুবার করে নির্বাচিত হয়েছেন। এর ভেতর ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট তো চারবার নির্বাচিত হয়েছেন। তখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলছিল। এখানে উল্লেখ্য, দুবারের বেশি প্রেসিডেন্ট থাকা যাবে না, এটিতে কোনো সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা প্রথম ছিল না। ১৯৫১ সালে সংশোধনী এনে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা আনা হয় যে দুবারের বেশি এই পদে থাকা যাবে না। বারাক ওবামা পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী এবং সম্পদশালী রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। তাঁর অনেক যোগ্যতা ও দক্ষতা। তাঁকে নিয়ে বলার কিছু নেই। আমরা শ্রদ্ধা করি। কিন্তু তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর দক্ষতা ও যোগ্যতা দেখাতে সব সময় অনুকূল পরিবেশ পেয়েছেন। একটি সুশিক্ষিত জাতির গঠনমূলক সমালোচনা এবং সহযোগিতা পেয়েছেন কাজ করার জন্য। তাঁর বিপরীতে আমরা মালালার অবস্থানটা বিচার করি। প্রথমত, ১৫ বছরের একটি কিশোরী। মালালার আবাসভূমি পাকিস্তানি তালেবানরা দখল করে নেওয়া নারীদের প্রতি তালেবানদের দৃষ্টিভঙ্গি কী, তা তো সবার জানা। মেয়েরা মূর্খ হয়ে ঘরে থাকবে। দাসীগিরি করবে, আর পুরুষের প্রয়োজন মেটাবে। ঘরের বাইরে যদি কখনো আসতে হয়, তাহলে আপাদমস্তক মুড়িয়ে কারো সঙ্গে বেরোবে। আফগানিস্তানে তালেবান শাসন কায়েমের পর সব নারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়। চরম প্রতিকূল অবস্থাতে মালালা অটল ছিল তার শিক্ষা চালিয়ে যাওয়ার জন্য। খোলাখুলি সে বক্তব্য রেখেছিল যে তালেবানদের কোনো অধিকার নেই তাকে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করার। এটা কত বড় দুঃসাহস। সে তো নিরাপত্তা বাহিনী নিয়ে চলে না। তার ওপর ভয়াবহ আঘাত আসে গত বছরের ৯ অক্টোবর। যখন সে বাসে স্কুল থেকে ফিরছিল, তখন তালেবানরা তার নাম ধরে ডেকে শনাক্ত করে মাথায় গুলি করে। তারা চেয়েছিল ওর কণ্ঠস্বর চিরতরে স্তব্ধ করে দিতে। বরং ফল হয়েছে উল্টো। গোটা বিশ্বে তার কণ্ঠস্বর ছড়িয়ে পড়েছে। আজ মালালা মানে এক প্রতিবাদী এবং চরম সাহসী কণ্ঠস্বর। গোটা বিশ্বের নারীদের জাগিয়ে তোলার প্রেরণা সে। সর্বত্র দাবি উঠেছে, তাকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হোক।
টাইম পত্রিকায় অবশ্য মালালার অসীম সাহসিকতা এবং দৃঢ় সংকল্পের কথা বলা হয়েছে। তবে এ রকম যুক্তি দেখানো হয়েছে যে তার এই কম বয়সে জীবন-মৃত্যুর সংগ্রামে এত দৃঢ়তা দেখানো পুরোপুরি সম্ভব নয়। তার বাবা জিয়াউদ্দিন ইউসুফজাইয়ের ভূমিকা রয়েছে মনস্তাত্ত্বিকভাবে তার দৃঢ় সংকল্প তৈরির জন্য। কথাটা আংশিক সত্যতা পায়। তার অন্তর্নিহিত অনুভূতি কাজ না করলে চেতনায় ততটা বিকাশ সম্ভব নয়। এই বয়সে দুঃসাহস দেখানো কিংবা তীব্র অনুভূতি দেখানোর দৃষ্টান্ত রয়েছে তার। যারা অ্যানে ফ্রাঙ্কের ডায়েরি পড়েছে, তারা কি বিস্মিত হবে না যে নাজিদের হাতে প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর আশঙ্কা করা সত্ত্বেও কী রকম অনুভূতি ব্যক্ত করে মেয়েটি ডায়েরিটি লিখেছে। অতএব মালালাকে খাটো করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। আমরা চাই, সে শতভাগ আরোগ্য লাভ করুক। আমরা মনে করি, টাইম আরেকটু উদার হতে পারত। মালালাকে এক নম্বর অবস্থানে নিয়ে
আসতে পারত।
সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন জাতিসংঘের বিশেষ দূত হিসেবে global education-এর জন্য কাজ করছেন। তিনি ১০ নভেম্বরকে 'মালালা দিবস' হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন এবং বিশ্বের পাঁচ কোটি মেয়ে যারা স্কুলে যেতে পারছে না তাদের জন্য এটি হবে প্রেরণা লাভের দিবস। মালালার প্রেরণা এবং আদর্শ আজ আর একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বব্যাপী। এর চেয়ে বেশি কিছু বলার
আছে কি?
লেখক : সাবেক সরকারি কর্মকর্তা
No comments