নিঃসঙ্গ বলদর্পী এক আমেরিকা by এম আবদুল হাফিজ
যুক্তরাষ্ট্র নিজকে বিশ্ব মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের চ্যাম্পিয়ন আখ্যায়িত করে; কিন্তু তার অন্যের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার নীতি ও প্রবণতা তাবৎ বিশ্বে যা নিখুঁতভাবে নিয়ে এসেছে তা শুধুই ধ্বংস, দুর্ভোগ, স্বেচ্ছাচার এবং নৈরাজ্য।
অন্যের ব্যাপারে হস্তক্ষেপের মার্কিন ভূমিকা এতটাই শক্তিশালী এবং জবরদস্তিপূর্ণ যে, তার হস্তক্ষেপের কর্তৃত্বসূচক মুকুটে অন্য কারও ভাগ বসানোর সুযোগ নেই। যারাই ওয়াশিংটনকে প্রভু, বিধাতা ও আইনের অবতার করেছে, তারাই শেষ পর্যন্ত তাদের রাষ্ট্র ও সমাজের ধ্বংস ডেকে এনেছে। তারা যদি কোনো ব্যক্তিবিশেষ হয়, সেই ব্যক্তি গণতান্ত্রিক আমেরিকার স্বৈরাচারী মিত্র বলে পরিগণিত হবে। তারা যদি আমেরিকার হস্তক্ষেপে ক্ষমতা পায়, তা সামরিক হস্তক্ষেপ বা বেসামরিক হস্তক্ষেপ হোক, তাদের ঐশ্বর্য উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে যখন তাদের দেশ ও জনগণের সম্পদ বিলুপ্ত হবে। তা কোনো সাধারণ বিলোপ সাধন নয়, তা হবে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের দিকে স্বচ্ছন্দ ধাবন। এই ব্যক্তিবিশেষকে কখনও তাদের কৃতকর্মের জন্য তলব করা হবে না।
১৯৮৬ সালে ফার্দিনান্দ মার্কোস যখন দেশ থেকে বিতাড়িত হন, ফিলিপিনো ওই স্বৈরশাসক ৭ হাজার ৫০০ টন স্বর্ণোপার্জনের ভাগ্য গড়েছিলেন। লায়লা অ্যাবলেসি, তিউনিসিয়ার স্বৈরশাসক বেন আলির হেয়ার ড্রেসার স্ত্রী স্বেচ্ছানির্বাচনে ১.৫ টন স্বর্ণপিণ্ড নিয়ে উড়াল দেন। সাবেক স্বৈরশাসক হোসনি মোবারকের সম্ভাব্য উত্তরাধিকারী সন্তান জামাল মোবারক যখন হিথরোতে পেঁৗছেন তখন তার ব্যক্তিগত অ্যাটাচে কেসের সংখ্যা ছিল ৯৭টি। মোবারকের ব্যক্তিগত অর্থ ছিল আনুমানিক ৭০ বিলিয়ন ডলার। সেগুলো নিরাপদে অপসারণ করতে নাকি এক উড়োজাহাজ ইঞ্জিন চালনা অবস্থায় অপেক্ষমাণ থাকত। শুধু এরাই নয়, মার্কিন অনুগ্রহ এবং সমর্থনপুষ্ট আরও অনেকে আরব বিশ্বে বিভিন্ন সময়ে গজিয়ে উঠেছে। মার্কিনিদের সঙ্গে শুধু টার্মস অব লয়্যালটি ঠিক থাকলেই হলো। যুক্তরাষ্ট্র কালেভদ্রে উপযুক্ত মজুরি তার স্থানীয় মজদুরদের দিতে কিপটেমি করে। কারণ ওরা ঠিকই জানে যে, ওদের প্রাপ্যের তুলনায় নিক্ষেপিত দান চিনেবাদামসদৃশ।
আশির দশকে ওয়াশিংটন রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের এক অভিনব মেকানিজমের উদ্ভাবন করেছিল। বিশ্বজুড়ে এর প্রয়োগকে মার্কিনিরা নাম দিয়েছিল 'গণতন্ত্রের সুস্বাস্থ্য বিধান'। সে সময়ে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের জন্য এটা ছিল বহুল প্রচলিত গুঞ্জন। গণতন্ত্রের উন্নতি বর্ধনের এই ধারা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য তার অনুকূলে সরকারি এবং বেসরকারি সংগঠন, থিংকট্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং বেসরকারি করপোরেশনগুলোকে সুবিন্যস্ত করেছিল।
বিশেষ করে ইউএস এইড এবং স্টেট ডিপার্টমেন্টের কতিপয় অন্য শাখাকে বিলিয়ন বিলিয়ন বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল কতকটা 'দুর্বল, অসহায় এবং নিঃসম্বল'দের বিলিয়ে দেওয়ার জন্য। এই অর্থের কিছুটা বণ্টন হতো সরাসরি এবং কিছু অর্থ বণ্টনের ব্যবস্থা থাকত ন্যাশনাল এনডোমেন্ট ফর ডেমোক্রেসির হাতে। নিউইয়র্ক টাইমসের বর্ণনায় এটি ছিল ১৯৮৩ সালে রিগ্যান প্রশাসন কর্তৃক সৃষ্ট আধাসরকারি ফাউন্ডেশন, যা ফেডারেল তহবিলের মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার খরচ করত কমিউনিজমবিরোধী বেসরকারি কূটনৈতিক তৎপরতায়।
রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের ব্যয় বর্তায় আংশিকভাবে কিন্তু প্রধানত ইউএস-এইড এবং ন্যাশনাল এনডোমেন্ট ফর ডেমোক্রেসির ওপর। অন্য যেসব সংগঠন ইউএস-এইডের প্রাপক যেমন_ সেন্টার ফর ডেমোক্রেসি বা ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউটের কর্তৃত্বের আওতায় নানা সংগঠন এবং রাষ্ট্রীয় ও বিরাষ্ট্রীয় সত্তারা একাঙ্গীভূত হয়ে একটি জটিল ও বৃহদাকার বহু মিলিয়ন ডলারের রাজনৈতিক সংস্কার নেটওয়ার্কের উৎপত্তি ঘটাত।
আশ্চর্য নয় যে, অনেকেই এই মার্কিন বৈদেশিক নীতিকে আক্রমণাত্মক, অসংবেদী এবং উদ্ভেদী ভাবে। অনেকে আবার এই নীতিকে ভণ্ডামি এবং বাছাই করা নৈতিকতার ওপর দণ্ডায়মান দেখে। পাকিস্তানে নিযুক্ত অন্যতম মার্কিন কূটনীতিক ডেভিস রেমন্ডের ঘটনায় তা প্রকাশ্যে উঠে এসেছে। এখন মনে হয়, নাইন-ইলেভেনের হামলা যুক্তরাষ্ট্রে হঠাৎ লব্ধ সৌভাগ্যের মতোই এসেছে। এ অসাধারণ ঘটনা বুশ প্রশাসনের জন্য অনেক অপদেবতা, যার অন্তর্ভুক্ত ছিল আল কায়দা এবং পাকিস্তানে পারমাণবিক বোমা। এরই মধ্য দিয়ে এসেছিল তথাকথিত সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ, যা নাকি আমেরিকার বিশ্ব আধিপত্যের সর্বশেষ পন্থা।
ইরাক আক্রমণের মধ্য দিয়ে মার্কিন এ উদ্যোগটির উদ্দেশ্য সামরিক পন্থায় মধ্যপ্রাচ্যের একটি রূপান্তর নিজের ও ইসরায়েলের জন্য ঘটানো। তিন ট্রিলিয়ন ব্যয়ের এ যুদ্ধে সেই মার্কিন আশা পূর্ণ হয়নি। এতে শুধু লাভ হয়েছে ইরানের এবং বেড়েছে যুক্তরাষ্ট্রেরই বিক্ষত হওয়ার জন্য উন্মুক্ততা। তার প্রমাণ আফগানিস্তান। আফগানিস্তানে মার্কিন অ্যাডভেঞ্চার, যার ব্যয় প্রতি সৈনিকে বছরে ১ মিলিয়ন ডলার, তা আসলেই মার্কিনিদের জন্য বিকট নিশাস্বপ্নে পরিণত হয়েছে_ চাই তারা তা স্বীকার করুক বা না করুক। স্নায়ুবৈকল্যে অবসাদগ্রস্ত মার্কিনিরা এখন পরিস্থিতি সামলাতে ভাড়া করা ঠিকা যোদ্ধা ব্ল্যাকওয়াটারদের এবং ডেভিড রেমন্ডদের মতো ইয়াংকিদের মাঠে নামিয়েছে। এসব কিছু মিলিয়ে ওরা এখন পাকিস্তানের স্থিতিশীলতাও বিনষ্ট করতে বসেছে।
তবুও মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রবার্ট গেটস এখনও বলেন, বিভিন্ন দেশের সরকার আমাদের সঙ্গে লেনদেন করে; কিন্তু এ জন্য নয় যে তারা আমাদের বিশ্বাস করে। কেউ কেউ তা শুধু ভয়ে করে। এ জন্য করে, তাদের কাছে আমাদের প্রয়োজন। তবে তিনি এও বলেন, আমরা আসলেই অপরিহার্য শক্তি। হতেও পারে, তবে তার চেয়েও সত্যটি একদা উচ্চারণ করেছিলেন কবি এবং ঔপন্যাসিক ডিএইচ লরেন্স, যার কথায় আমেরিকার আত্মার সারসত্তাটিই নির্বিকার, নির্মম এবং অসংবেদী, যা কখনও গলে না।
ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল হাফিজ:সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএসএস ও কলাম লেখক
১৯৮৬ সালে ফার্দিনান্দ মার্কোস যখন দেশ থেকে বিতাড়িত হন, ফিলিপিনো ওই স্বৈরশাসক ৭ হাজার ৫০০ টন স্বর্ণোপার্জনের ভাগ্য গড়েছিলেন। লায়লা অ্যাবলেসি, তিউনিসিয়ার স্বৈরশাসক বেন আলির হেয়ার ড্রেসার স্ত্রী স্বেচ্ছানির্বাচনে ১.৫ টন স্বর্ণপিণ্ড নিয়ে উড়াল দেন। সাবেক স্বৈরশাসক হোসনি মোবারকের সম্ভাব্য উত্তরাধিকারী সন্তান জামাল মোবারক যখন হিথরোতে পেঁৗছেন তখন তার ব্যক্তিগত অ্যাটাচে কেসের সংখ্যা ছিল ৯৭টি। মোবারকের ব্যক্তিগত অর্থ ছিল আনুমানিক ৭০ বিলিয়ন ডলার। সেগুলো নিরাপদে অপসারণ করতে নাকি এক উড়োজাহাজ ইঞ্জিন চালনা অবস্থায় অপেক্ষমাণ থাকত। শুধু এরাই নয়, মার্কিন অনুগ্রহ এবং সমর্থনপুষ্ট আরও অনেকে আরব বিশ্বে বিভিন্ন সময়ে গজিয়ে উঠেছে। মার্কিনিদের সঙ্গে শুধু টার্মস অব লয়্যালটি ঠিক থাকলেই হলো। যুক্তরাষ্ট্র কালেভদ্রে উপযুক্ত মজুরি তার স্থানীয় মজদুরদের দিতে কিপটেমি করে। কারণ ওরা ঠিকই জানে যে, ওদের প্রাপ্যের তুলনায় নিক্ষেপিত দান চিনেবাদামসদৃশ।
আশির দশকে ওয়াশিংটন রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের এক অভিনব মেকানিজমের উদ্ভাবন করেছিল। বিশ্বজুড়ে এর প্রয়োগকে মার্কিনিরা নাম দিয়েছিল 'গণতন্ত্রের সুস্বাস্থ্য বিধান'। সে সময়ে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের জন্য এটা ছিল বহুল প্রচলিত গুঞ্জন। গণতন্ত্রের উন্নতি বর্ধনের এই ধারা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য তার অনুকূলে সরকারি এবং বেসরকারি সংগঠন, থিংকট্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং বেসরকারি করপোরেশনগুলোকে সুবিন্যস্ত করেছিল।
বিশেষ করে ইউএস এইড এবং স্টেট ডিপার্টমেন্টের কতিপয় অন্য শাখাকে বিলিয়ন বিলিয়ন বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল কতকটা 'দুর্বল, অসহায় এবং নিঃসম্বল'দের বিলিয়ে দেওয়ার জন্য। এই অর্থের কিছুটা বণ্টন হতো সরাসরি এবং কিছু অর্থ বণ্টনের ব্যবস্থা থাকত ন্যাশনাল এনডোমেন্ট ফর ডেমোক্রেসির হাতে। নিউইয়র্ক টাইমসের বর্ণনায় এটি ছিল ১৯৮৩ সালে রিগ্যান প্রশাসন কর্তৃক সৃষ্ট আধাসরকারি ফাউন্ডেশন, যা ফেডারেল তহবিলের মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার খরচ করত কমিউনিজমবিরোধী বেসরকারি কূটনৈতিক তৎপরতায়।
রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের ব্যয় বর্তায় আংশিকভাবে কিন্তু প্রধানত ইউএস-এইড এবং ন্যাশনাল এনডোমেন্ট ফর ডেমোক্রেসির ওপর। অন্য যেসব সংগঠন ইউএস-এইডের প্রাপক যেমন_ সেন্টার ফর ডেমোক্রেসি বা ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউটের কর্তৃত্বের আওতায় নানা সংগঠন এবং রাষ্ট্রীয় ও বিরাষ্ট্রীয় সত্তারা একাঙ্গীভূত হয়ে একটি জটিল ও বৃহদাকার বহু মিলিয়ন ডলারের রাজনৈতিক সংস্কার নেটওয়ার্কের উৎপত্তি ঘটাত।
আশ্চর্য নয় যে, অনেকেই এই মার্কিন বৈদেশিক নীতিকে আক্রমণাত্মক, অসংবেদী এবং উদ্ভেদী ভাবে। অনেকে আবার এই নীতিকে ভণ্ডামি এবং বাছাই করা নৈতিকতার ওপর দণ্ডায়মান দেখে। পাকিস্তানে নিযুক্ত অন্যতম মার্কিন কূটনীতিক ডেভিস রেমন্ডের ঘটনায় তা প্রকাশ্যে উঠে এসেছে। এখন মনে হয়, নাইন-ইলেভেনের হামলা যুক্তরাষ্ট্রে হঠাৎ লব্ধ সৌভাগ্যের মতোই এসেছে। এ অসাধারণ ঘটনা বুশ প্রশাসনের জন্য অনেক অপদেবতা, যার অন্তর্ভুক্ত ছিল আল কায়দা এবং পাকিস্তানে পারমাণবিক বোমা। এরই মধ্য দিয়ে এসেছিল তথাকথিত সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ, যা নাকি আমেরিকার বিশ্ব আধিপত্যের সর্বশেষ পন্থা।
ইরাক আক্রমণের মধ্য দিয়ে মার্কিন এ উদ্যোগটির উদ্দেশ্য সামরিক পন্থায় মধ্যপ্রাচ্যের একটি রূপান্তর নিজের ও ইসরায়েলের জন্য ঘটানো। তিন ট্রিলিয়ন ব্যয়ের এ যুদ্ধে সেই মার্কিন আশা পূর্ণ হয়নি। এতে শুধু লাভ হয়েছে ইরানের এবং বেড়েছে যুক্তরাষ্ট্রেরই বিক্ষত হওয়ার জন্য উন্মুক্ততা। তার প্রমাণ আফগানিস্তান। আফগানিস্তানে মার্কিন অ্যাডভেঞ্চার, যার ব্যয় প্রতি সৈনিকে বছরে ১ মিলিয়ন ডলার, তা আসলেই মার্কিনিদের জন্য বিকট নিশাস্বপ্নে পরিণত হয়েছে_ চাই তারা তা স্বীকার করুক বা না করুক। স্নায়ুবৈকল্যে অবসাদগ্রস্ত মার্কিনিরা এখন পরিস্থিতি সামলাতে ভাড়া করা ঠিকা যোদ্ধা ব্ল্যাকওয়াটারদের এবং ডেভিড রেমন্ডদের মতো ইয়াংকিদের মাঠে নামিয়েছে। এসব কিছু মিলিয়ে ওরা এখন পাকিস্তানের স্থিতিশীলতাও বিনষ্ট করতে বসেছে।
তবুও মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রবার্ট গেটস এখনও বলেন, বিভিন্ন দেশের সরকার আমাদের সঙ্গে লেনদেন করে; কিন্তু এ জন্য নয় যে তারা আমাদের বিশ্বাস করে। কেউ কেউ তা শুধু ভয়ে করে। এ জন্য করে, তাদের কাছে আমাদের প্রয়োজন। তবে তিনি এও বলেন, আমরা আসলেই অপরিহার্য শক্তি। হতেও পারে, তবে তার চেয়েও সত্যটি একদা উচ্চারণ করেছিলেন কবি এবং ঔপন্যাসিক ডিএইচ লরেন্স, যার কথায় আমেরিকার আত্মার সারসত্তাটিই নির্বিকার, নির্মম এবং অসংবেদী, যা কখনও গলে না।
ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল হাফিজ:সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএসএস ও কলাম লেখক
No comments