মিসরে ত্রিশক্তির টাগ অব ওয়ার আল আহরাম উইকলি থেকে অনুবাদ : by এনামুল হক
এক জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে মিসরের রাজনীতি। সেখানে চলছে ত্রিশক্তির টানাপোড়েন। একদিকে ব্রাদারহুডের নেতৃত্বে ইসলামী শক্তিগুলোর কোয়ালিশন, অন্যদিকে উদারপন্থী ও সেক্যুলার শক্তিগুলোর ঐক্যজোট।
আরেকপ্রান্তে আছে মিসরের শক্তিশালী সেনাবাহিনী। ইসলামী জোট আর সেক্যুলার জোটের দ্বন্দ্ব সুতীব্র এবং সহজে মিটবার নয়। তেমনি সেনাবাহিনীর সঙ্গে ব্রাদারহুডের বিরোধও আজ আর গোপন নয়। এই ত্রিশক্তির টাগ অব ওয়ারের দিকেই এখন সকলের দৃষ্টি ব্রাদারহুড-সালাফি অশুভ আঁতাতমিসরে নতুন সংবিধানের ওপর গণভোট অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে সেদেশের রাজনৈতিক শক্তিগুলোর এক বড় ধরনের মেরুকরণ ঘটে গেছে। একদিকে ১৯টি রাজনৈতিক দল ও গ্রুপের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে কোয়ালিশন অব ইসলামিস্ট ফোর্সেস (সিআইএফ) বা ইসলামী শক্তিজোট। অন্যদিকে গণতন্ত্রী, সেক্যুলার উদারপন্থী ও মডারেটদের নিয়ে গড়ে উঠেছে আরেক জোট ন্যাশনাল স্যালভেশন ফ্রন্ট। এই দুই জোটের মধ্যে টানাপোড়েন মিসরের রাজনীতির আগামীদিনের গতিধারা নির্ধারণ করবে।
ইসলামী জোটের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ফ্রিডম এ্যান্ড জাস্টিস পার্টি, কনস্ট্রাকশন এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি, দি নূর পার্টি, আল ওয়াসাত পার্টি, সালাফিস্ট কলিং, সালাফিস্ট ফ্রন্ট, আসালা এবং ইসলাহ পার্টি। আনুষ্ঠানিক কোয়ালিশন সিআইএফ-এর চেয়ে বড় কথা হলো মুসলিম ব্রাদারহুড (ফ্রিডম এ্যান্ড জাস্টিস পার্টি) ও সালাফিরা এখানে নতুন করে একজোট হয়েছে। বেশ কয়েক মাস পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন এবং একে অন্যের কাছ থেকে দূরে সরে থাকার ও স্বতন্ত্রভাবে কাজ করার চেষ্টা চালানোর পর এরা আবার ঐক্যবদ্ধ হলো। এরা এখন একই সুরে কথা বলছে। তারা বেশ কয়েকবার প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসির প্রতি জোরালো সমর্থন ঘোষণা করেছে এবং বিরোধী জোটকে অভিন্ন শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে। অর্থাৎ মিসরের রাজনীতি দুটো পরিষ্কারভাবে ভাগ হয়ে গেছে। একদিকে রয়েছে ইসলামপন্থী জোট, অন্যদিকে আছে অ-ইসলামপন্থী জোট।
এই জোট রচনার উদ্দেশ্য নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়ে গেছে। সংবিধান গণভোটে অনুমোদিত হবার দু’মাসের মধ্যে পার্লামেন্ট নির্বাচন হবে। সে পর্যন্ত নিজেদের ঐক্য ধরে রাখতে চায় ইসলামপন্থীরা। আরেকটা উদ্দেশ্য থাকতে পারে। তাহলো এর মাধ্যমে মুসলিম ব্রাদারহুডকে রাজনীতি ও ধর্ম এই উভয় প্রশ্নে মধ্যপন্থী ভূমিকা থেকে সরিয়ে এনে আরও রক্ষণশীল করে তোলা। ঐক্যপন্থীদের বক্তব্য হলো উদারপন্থী ও সেক্যুলার শক্তিগুলো একজন নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের পতন ঘটাতে চায়। সেই লক্ষ্যে তারা একজোট বেঁধেছে। এদের প্রতিহত করা দরকার।
গত ৮ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত হবার পর ইসলামী জোট সংবিধান প্রশ্নে গণভোট অনুষ্ঠানের পিছনে সর্বশক্তি নিয়োগ করে। তাদের সুর ছিল আক্রমণাত্মক। তারা এই বলে হুমকি দেয় যে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ও অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান রক্ষার জন্য তাদের সামনে সব পথ খোলা আছে।
সংবিধান প্রশ্নে গণভোটে হ্যাঁ ভোট ও না ভোটের মধ্যে পার্থক্য যথসামান্য। তা সত্ত্বেও হ্যাঁ ভোটের জয়কে ইসলামপন্থীরা তাদের এজেন্ডার পক্ষে বিজয় বলে দাবি করছে এবং বলছে যে, সব নিজেদের হাতে তুলে নেয়ার গণরায় তারা পেয়ে গেছে।
উল্লেখ করা যেতে পারে ইসলামী জোট সিআইফের প্রধান হলেন মুসলিম ব্রাদারহুডের ডেপুটি সুপ্রীম গাইড খয়রাত আল শাতের। জোট এমন এক সময় গঠিত হয় যখন বিরোধীদের ভাষায় ইসলামপন্থীদের জনপ্রিয়তা সর্বকালের সর্বনিম্ন বিন্দুতে নেমে এসেছে। তাছাড়া ব্রাদারহুডের ওপর জনগণের আস্থারও ঘাটতি দেখা দিয়েছে। জোটের প্রধান ব্রাদারহুডের হলেও এখানে সালাফিদের প্রাধান্য সুস্পষ্ট। কারণ বেশিরভাগ শরিক দলই সালাফিপন্থী। এই সালাফিপন্থীদের ওপর নির্ভরতার কারণে সমাজের বৃহত্তর অংশগুলোর মধ্যে ব্রাদারহুডের অবস্থান ক্ষুণœ হবে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন। জনৈক পর্যবেক্ষকের মতে ব্রাদারহুড-সালাফি জোটের পুনরুজ্জীবন থেকে বুঝা যায় যে, সমাজের বৃহত্তর অংশ থেকে ব্রাদারহুড উত্তরোত্তর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে এবং যখন রাজনীতি ও ধর্মীয় প্রশ্নে তাদের মধ্যপন্থী ভূমিকা জনগণের কাছে প্রত্যাশিত হয়ে উঠেছিল তখন তারা অধিকতর রক্ষণশীল পথ বেছে নিয়েছে। উদারপন্থী ও সেক্যুলার ও অইসলামী শক্তিগুলোর সঙ্গে ব্রাদারহুডের ভঙ্গুরপ্রবণ একটা জোট ছিল। ব্রাদারহুড সেটাকে বজায় রাখতে পারেনি। এই ব্যর্থতাই তাদের ঠেলে দিয়েছে সালাফিদের সঙ্গে জোট রচনায়। এটা এক ধরনের সুবিধাবাদ। এই সুবিধাবাদী ভূমিকা তাদের আরও জনবিচ্ছিন্ন করে ফেলবে।
পূর্ব অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে এ ধরনের জোট রচনার মধ্য দিয়ে একটা সুসংহত ও অটুট ঐক্য গড়ে ওঠেনি যার প্রতিফলন ঘটবে অভিন্ন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে। কেন সে ধরনের ঐক্য হয়নি? জনৈক সালাফি নেতার মতে, ব্রাদারহুড সর্বদাই অন্যান্য শরিককে কোণঠাসা করে রাখার চেষ্টা করেছে এবং সালাফিদের গোলযোগ সৃষ্টিকারী হিসেবে চিহ্নিত করার প্রয়াস পেয়েছে। তাই আগের জোটগুলো অটুট থাকেনি। তাছাড়া সালাফি-ব্রাদারহুড বিরোধও মাঝে মাঝে প্রকাশ হয়ে পড়েছে। প্রথম দফা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সালাফিদের নিজস্ব প্রার্থী ছিল। দ্বিতীয় দফায় তারা ক্ষমতাসীন আহমদ শফিকের সঙ্গে একটা সমঝোতায় আসে। ব্রাদারহুড প্রার্থী মোহাম্মদ মুরসি নির্বাচিত হওয়ার পর নতুন মন্ত্রিসভা গঠিত হলে সালাফিদের তাতে তেমন ভাগ দেয়া হয়নি। যেমন সালাফি নূর পার্টি অনুযোগ করে যে তাদের পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের মতো লঘু গুরুত্বপূর্ণ দফতর দেয়া হয়েছে। সালাফিরা মুরসির সমর্থনে ব্রাদারহুড আয়োজিত অনেক সমাবেশে যায়নি।
তবে এবারের ইসলামী জোট নির্বাচনী জোটে পরিণত হবে কিনা সে কথা বলার সময় এখনও আসেনি। নির্বাচনী আইনে কি থাকে তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। তথাপি পার্লামেন্টকে সামনে রেখে একটা ব্যাপকভিত্তিক কোয়ালিশন গঠনের চেষ্টা বিভিন্ন তরফ থেকে চলছে। ইতোমধ্যে ইজিপশিয়ান সালাফিস ফ্রন্টের মুখপাত্র হোসাম কামান জানিয়েছেন যে, এমন চেষ্টার পরিণতি শীঘ্রই চূড়ান্তভাবে জানা যাবে। অন্যদিকে হাজেম সালাহ আবু ইসমাইল যিনি হাজিমুন নামে সর্বাধিক পরিচিত তার নেতৃত্বেও ইসলামী শক্তিগুলোর একটি কোয়ালিশন গঠনের উদ্যোগ চূড়ান্ত রূপ লাভের অপেক্ষায় আছে।
নানা কারণে হাজিমুন নামটি মিসরের বর্তমান রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা ও বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ঠাঁই পেয়েছে। হাজিমুন ও তার সমর্থকরা ইসলামপন্থীদের অনেক বিক্ষোভে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছে যেগুলোর কোন কোনটি সহিংসতায়ও গড়িয়েছে।
ন্যাশনাল স্যালভেশন ফ্রন্ট
মিসরের নানা ধরনের উদারপন্থী, সেক্যুলার, বামপন্থী ও অ-ইসলামী সংগঠনগুলোকে নিয়ে এই ফ্রন্ট গঠিত। ফ্রন্টে সবসুদ্ধ ৩৫টি রাজনৈতিক গ্রুপ অন্তর্গত। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো নাসেরিস্ট পার্টি, ইজিপশিয়ান সোস্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি, ফ্রিডম ইজিপ্ট, ইজিপশিয়ান সোস্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি, ফ্রিডম ইজিপ্ট পার্টি, নিউ ওয়াফদ্ পার্টি, ফ্রি ইজিপশিয়ান পার্টি, ফ্রি ইজিপট পার্টি, ফারমার্স জেনারেল সিন্ডিকেট, কনস্টিটিউশন পার্টি, ইজিপশিয়ান পপুলার কারেন্ট, সোস্যালিস্ট পপুলার এলায়েন্স পার্টি, ন্যাশনাল এ্যাসোসিয়েশন ফর চেঞ্জ, ন্যাশনাল প্রোগ্রেসিভ ইউনিয়নিস্ট পার্টি, ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট পার্টি, কনফারেন্স পার্টি, ডিগনিটি পার্টি, রিফর্ম এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট মিসরুনা পার্টি, সোস্যালিস্ট পার্টি অব ইজিপ্ট, রেভ্যুলিউশনারি সোস্যালিস্ট ইত্যাদি।
মোহাম্মদ আল বারাদি এই ফ্রন্টের অন্যতম সমন্বয়ক। বিগত কয়েক মাসে মিসরে যে বিক্ষোভ আন্দোলন হয়েছে তাতে এই ফ্রন্টেরই প্রধান ভূমিকা ছিল। ফ্রন্টের দাবি ছিল নিজের হাতে সর্বময় ক্ষমতার ব্যবস্থাসংবলিত প্রেসিডেন্ট মুরসির ডিক্রি বাতিল করতে হবে, গণভোট প্রত্যাহার করতে হবে এবং সংবিধান রচনার জন্য একটি নতুন গণপরিষদ গঠন করতে হবে। এর মধ্যে শুধু মুরসির ঘোষিত ডিক্রিটা বাতিল হয়েছে। ফ্রন্ট ঘোষণা করেছে যে, কতিপয় শর্ত পূরণ করা হলে তারা আসন্ন পার্লামেন্ট নির্বাচনে অংশ নেবে।
(বাকি অংশ আগামীকাল)
No comments