প্রবাসে ওরা টাকার মেশিন ২ ॥ জিডিপির অক্সিজেন, সব খাত ছাড়িয়ে একচ্ছত্র আধিপত্য by শাহ্ আলম খান
অর্ধ দশক ধরে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের প্রভাবে এ দেশের প্রায় কাবু অর্থনীতিকে দানবের শক্তির মতোই সোজা ও স্থিতিশীল রেখেছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স।
বিশ্ব অর্থনীতিতে যখন চরম মন্দা দেশীয় অর্থনীতিতে তখন রেমিটেন্সই একমাত্র সুসংবাদ। দিনে দিনে এর ভিত্তি আরও মজবুত হয়েছে। তাই সাম্প্রতিক অভ্যন্তরীণ আর্থিক গতিধারার সব ক্ষেত্রেই এখন এই দানবের একচ্ছত্র আধিপত্য চলছে।অর্থনীতির মানদণ্ড নির্ণায়ক বিভিন্ন সূচকের অবদান পর্যালোচনায় দেখা গেছে, রেমিটেন্স এখন শুধু পরিবারকেন্দ্রিক গণ্ডর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। জাতীয় আমদানিতে যে ব্যয় হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য রক্ষায় প্রবাসীদের সঞ্চিত বৈদেশিক মুদ্রা থেকেই তা পরিশোধ হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভে যে স্ফীতি ও বাণিজ্যিক ব্যাংকিংয়ের সচল কর্মকান্ড এবং নতুন শাখা সম্প্রসারণের অন্যতম নির্ণায়ক বিবেচিত হচ্ছে এই রেমিটেন্স। এছাড়া সরকারের রাজস্ব আয় ও মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি, ভারণ-পোষণ ও ভোগ-বিলাস আর শিক্ষা ও চিকিৎসাতেও রয়েছে অর্থনীতির এই নিয়ামকের বীরদর্প উপস্থিতি। যা রাষ্ট্রকেন্দ্রিক অর্থনীতিকে সার্বিকভাবে প্রভাবিত করে চলেছে।
রেমিটেন্সের এ অবদানের কথা স্বীকার করা হয়েছে সরকারের মধ্যমেয়াদী সামষ্টিক অর্থনীতির পূর্বাভাসেও (এমটিএমএফ)। এতে দাবি করা হয়েছে, সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং দারিদ্র্য নিরসনে বহুবিধ প্রচেষ্টার কল্যাণে এদেশে যে অগ্রগতি হয়েছে, এর নেপথ্যে আনুপাতিক অংশিদারিত্বের দাবিদার এই রেমিটেন্স। ইউএনডিপির মানবসম্পদ উন্নয়ন সূচকে ২০০৯ সালের তুলনায় ২০১২ সাল শেষে বাংলাদেশের যে অবস্থান ও উন্নতি তাতেও নিয়ামক হিসেবে রয়েছে রেমিটেন্স। এছাড়া জাতীয় মাথা গণনা অনুপাতে দারিদ্র্য ১৯৯১ সালের তুলনায় প্রায় ২০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হ্রাস, নিরাপদ পানি ব্যবহারের সুযোগ বৃদ্ধি, প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তি বৃদ্ধি এবং শিশুমৃত্যুহার হ্রাসেও রেমিটেন্সের অবদান অনস্বীকার্য।
এ ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রী ডা. দীপু মনি জানান, দেশে উন্নয়নের যত লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে তার সব খাতেই প্রবাসীদের বৈদেশিক মুদ্রা অবদান রেখেছে। এ ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের দেশ পরিচালনায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট খাতের মধ্যে কাক্সিক্ষত সমন্বয়ের কারণেই এই অর্জন সম্ভব হয়েছে।
ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন বলেন, প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিটেন্সের কল্যাণেই বাংলাদেশ আজ এ অবস্থায় পৌঁছেছে।
আর তাই সরকারী পরিসংখ্যান ও বেসরকারী বিভিন্ন সংস্থার হিসাবে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) এককভাবে শুধু রেমিটেন্সের অবদানই ১০ শতাংশের বেশি বলে বিবেচিত হচ্ছে।
বেসরকারী গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, বর্তমানে দেশে বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (এফডিআই) যা আসছে, তার ৬-৭ গুণ বেশি আসছে রেমিটেন্স। এ বিষয়ে সংস্থাটির (সিপিডি) অনারারি ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বিশ্ব অর্থনীতির দুর্বল প্রেক্ষাপট ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অবদান বিবেচনায় রেমিটেন্সকে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) লাইফলাইন কিংবা অক্সিজেন হিসেবেই আখ্যা দিয়েছেন।
ড. দেবপ্রিয় জানান, সার্বিক বিশ্ব পরিস্থিতি যেভাবে এগোচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে অদূরভবিষ্যতে আরও ভঙ্গুরদশায় পরিণত হতে পারে বিশ্ব অর্থনীতি। এর প্রভাব পড়ছে স্বল্পোন্নত বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও। বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) একেবারেই সতেজ হচ্ছে না। রফতানি আয় বাড়লেও সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আমদানি ব্যয়ও। এ ক্ষেত্রে বাণিজ্যকারী দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্য নেতিবাচক হওয়ায় নিট আয়ের ধারাবাহিকতা কমছেই। এতদসত্ত্বেও বিশ্ব বাণিজ্যের দুর্বল পরিস্থিতির ভেতরে অর্থনীতির উর্ধগতির ধারাবাহিকতা রক্ষায় রেমিটেন্স প্রবাহ ব্যাপক ভূমিকা রেখে চলেছে।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা দাবি করছেন, বিশ্ব অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে অধিকাংশ দেশের অর্থনীতি যখন নড়বড়ে, বিশেষত স্বল্পোন্নত দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি যখন প্রায় তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে, এই অবস্থায় শুধু রেমিটেন্সকেন্দ্রিক অর্থনীতির কল্যাণে বাংলাদেশ বিস্ময়কর অর্থনৈতিক সাফল্য ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ড. আতিউর রহমান জানান, গত চার বছর ধরেই গড়ে ৬.৩ শতাংশ হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হচ্ছে বাংলাদেশের। বর্তমানে ১৩ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি স্ফীত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে আমরা লেনদেন ভারসাম্যের স্থিতিশীলতা দৃঢ় করতে সমর্থ হয়েছি। ড. আতিউর রহমানের মতে, বৈদেশিক মুদ্রার এই স্ফীত রিজার্ভ সৃষ্টিতে সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছে প্রবাসী বাংলাদেশীদের প্রেরিত কষ্টার্জিত রেমিটেন্স।
অপরদিকে একক খাত হিসেবে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ক্ষেত্রে পণ্য রফতানি খাত সবার শীর্ষে অবস্থান করলেও জাতীয় অর্থনীতিতে এ খাতের মূল্য সংযোজনের হার তুলনামূলকভাবে কম বলেই দাবি করছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, প্রতিবছর পণ্য রফতানি বাবদ আমরা যে বৈদেশিক মুদ্রা পাই এর অধিকাংশই আবার শিল্পের কাঁচামাল এবং মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে ব্যয় হয়ে যায়। কিন্তু প্রবাসী আয়ের প্রায় পুরোটাই জাতীয় অর্থনীতিতে মূল্য সংযোজন করছে।
অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও কাক্সিক্ষত জিডিপি অর্জনে রেমিটেন্সের গুরুত্ব সম্পর্কে ২০১২ সালে এলডিসিভুক্ত দেশগুলোর জন্য আঙ্কটাডের সর্বশেষ প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্ব অর্থনীতির বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে একমাত্র রেমিটেন্সই বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বড় ধরনের সঙ্কট থেকে নিরাপদ দূরত্বে রাখতে সক্ষম হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে রেমিটেন্সকেই স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। আর বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট সম্পর্কে জানানো হয়েছে, দেশটিতে সম্প্রতি প্রবাসীদের আয় অভাবনীয়হারে বাড়ছে। এরই ধারাবহিকতায় এলডিসিভুক্ত ৪৮টি দেশ বিশ্ব শ্রমবাজার থেকে যে পরিমাণ রেমিটেন্স আহরণ করছে, এককভাবে তার ৪৪ শতাংশই আহরণ করছে বাংলাদেশ। ২০০০ সালের হিসাবেও দেশটির রেমিটেন্স আহরণের পরিমাণ ছিল ৩১ শতাংশের মতো।
এ ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, আগামীর অর্থনীতিতে রফতানি আয় ও সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের অবদানকে ছাড়িয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রেমিটেন্সই হয়ে উঠবে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। শুধু শিক্ষার স্বল্পতা, ভাষা জ্ঞানের অভাব দূর, দক্ষতা বৃদ্ধি ও প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে মানবসম্পদ উন্নয়নের মাধ্যমে জনশক্তি রফতানি বাড়াতে পারলে বাংলাদেশ হবে বিশ্ব রেমিটেন্স আয়কারী অন্যতম অপ্রতিদ্বন্দী দেশ।
২০১২ সালে বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে রেমিটেন্সের গুরুত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে, তৈরি পোশাক ররফতানির পাশাপাশি রেমিটেন্সের প্রবাহ বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে সমৃদ্ধ করেছে। অদূর ভবিষ্যতে আরও উচ্চহারে রেমিটেন্স বৃদ্ধির সম্ভাবনার পূর্বাভবাসও দেয়া হয়েছে ওই প্রতিবেদনে।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আবুল বারকাতের মতে, বর্তমানে বিশ্বে রেমিটেন্স গ্রহণকারী তৃতীয় দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। আর এই রেমিটেন্সই এ দেশের গ্রামীণ ও পারিবারিক অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে সর্বাপেক্ষা ভূমিকা রাখছে।
সঙ্গতকারণেই সরকার, দেশী-বিদেশী শীর্ষ প্রতিষ্ঠান ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত এবং বিশ্ব শ্রমবাজারে বাংলাদেশের অবস্থান, শ্রমশক্তির ক্রমবর্ধমান সংখ্যা ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের বিচারে রেমিটেন্সকেই দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
ইতোমধ্যে রেমিটেন্সকে সরকারের বৈদেশিক আয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম খাত হিসেবে গণনা করা হচ্ছে। আগামীর অর্থনৈতিক উন্নয়নেও সরকারের নীতিনির্ধারকদের প্রবাসী আয়কে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হচ্ছে। অন্যদিকে পরিবর্তিত শ্রমশক্তির সরবরাহবাজার হিসেবে বাংলাদেশও দিনদিন অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছে। বিশ্ব পরিস্থিতিতে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের জন্য উচ্চ রেমিটেন্স আহরণের পথও প্রশস্ত হচ্ছে।
এ বিষয়ে খোদ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত আশা প্রকাশ করে বলেছেন, বর্তমানে প্রতিবছর ৫ লাখ শ্রমশক্তি বিদেশে রফতানি হচ্ছে। আগামী পাঁচ বছরে এই হার দ্বিগুণ হয়ে ১০ লাখে উন্নীত হবে। এতে দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি রেমিটেন্সও দ্বিগুণ পর্যায়ে উন্নীত হবে। বর্তমানে অর্জিত রেমিটেন্সের হার বছরে ১৪ বিলিয়ন ডলার বলে তিনি জানান।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিস) গবেষণা প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, এখন পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যেই সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বাংলাদেশী কর্মী শ্রমশক্তি বিক্রি করছে। কিন্তু এখনও সেখানে আরও নতুন নতুন কাজের ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। সম্প্রতি সৌদি আরবে ৪ হাজার কোটি টাকার জ্বালানি, বন্দরসহ লজিস্টিক কাজের জন্য নতুন শ্রমশক্তি রফতানির উৎস তৈরি হয়েছে। শত বিলিয়ন সৌদি রিয়াল ব্যয়ে সেখানে শিক্ষা ও যাতায়াত খাতে নতুন নতুন প্রকল্প নেয়া হচ্ছে। কাতারে ২৫ বিলিয়ন ডলারের মেট্রো ও রেল প্রকল্পে কাজের সুযোগ রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশী কর্মীরাই বেশি প্রাধান্য পাবে। তবে এসব শ্রমবাজার ধরতে সরকারকে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানোরও পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
ওদিকে ‘অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় বৈদেশিক কর্মসংস্থান’ প্রসঙ্গে ড. আবুল বারকাত জানান, সরকারী হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে বাংলাদেশে ১৪ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি রেমিটেন্স আসছে। কিন্তু গবেষণা অনুযায়ী ও আমার জানা মতে, রেমিটেন্সের পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ। অর্থাৎ ২৫ থেকে ২৮ বিলিয়ন ডলার। যেগুলো হুন্ডি, ধার করে নেয়া, বন্ধুদের মাধ্যমেসহ বিভিন্ন অবৈধ পথে আসছে।
বাড়তি রেমিটেন্স প্রবাহের ফলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে এর প্রভাব সম্পর্কে ড. দেবপ্রিয় বলেন, খানা পর্যায়ে এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি।
No comments