ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-সুবর্ণ জয়ন্তীর বছরেই মহত্তম অর্জন by আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক
বাংলাদেশের যা কিছু শ্রেষ্ঠ অর্জন, এর সবকিছুর সঙ্গেই রয়েছে আমাদের অতি প্রিয় জাতীয় গৌরবের প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্টতা। আমরা একুশের মাস ফেব্রুয়ারি অতিক্রম করে আজ ১ মার্চ স্বাধীনতার মাসে পদার্পণ করেছি। এ মাসেই আমাদের স্বাধীনতার ৪০তম বছর পূর্ণ হচ্ছে।
৬৩ বছর আগে ১৯৪৮ সালের এই মার্চেই উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার চক্রান্তের বিরুদ্ধে কার্জন হল অঙ্গন 'না, না, না' ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয়েছিল। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে প্রতিদিন সক্রিয় ছিল আমাদের প্রিয় ক্যাম্পাস; ছাত্রছাত্রী-শিক্ষক-কর্মচারী সবাই সক্রিয়।
আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করে বাঙালিদের দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করলে এ প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরাই জানিয়ে দেয়, এমনটি হওয়ার নয়। বাষট্টি ও চৌষট্টির শিক্ষা আন্দোলনের কেন্দ্র ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বিজ্ঞানভিত্তিক গণমুখী শিক্ষা চাই_ এ দাবি ছাত্রসমাজের পক্ষ থেকে তুলে ধরেন এ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছাত্রনেতারা। ঊনসত্তরের ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানকে ধরে নেওয়া হয় একাত্তরের স্বাধীনতা আন্দোলনের ড্রেস রিহার্সাল। ওই উত্তাল বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসের প্রতিটি দিন গোটা দেশের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। 'জয় বাংলা' রণধ্বনির পাশাপাশি এ ক্যাম্পাসের মধুর ক্যান্টিন ও বটতলাতেই ছাত্রছাত্রীরা 'পিন্ডি না ঢাকা' এবং 'পদ্মা-মেঘনা-যমুনা তোমার আমার ঠিকানা' স্লোগান তোলে। একাত্তরের ১ মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করলে এর প্রতিবাদে স্বাধীনতার আওয়াজ তুলে প্রথম মিছিলটি বের হয়েছির মধুর ক্যান্টিন থেকে। পরের দিন বটতলায় উত্তোলন করা হয় স্বাধীন দেশের পতাকা। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার পর এ পতাকাকেই আমাদের নির্বাচিত নেতৃত্ব জাতীয় পতাকা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেন। বিশ্বে এ এক অনন্য নজির। স্বাধীনতার জন্য 'যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা' করার জন্য ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর অবিনাশী আহ্বান দেশবাসী শুনতে পায় ক্যাম্পাসের অদূরেই তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান থেকে। তিনি পরিণত হন জাতীয় আকাঙ্ক্ষার প্রতীকে। তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে ৯ মার্চ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থানে শুরু হয় সামরিক প্রশিক্ষণ_ যাতে অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও অংশ নিতে থাকে এবং দ্রুতই তা ব্যাপক উদ্দীপনা সৃষ্টি করে ছড়িয়ে পড়ে শহর-বন্দর-গ্রামে। এ সময়ে বিপুলসংখ্যক ছাত্রী অস্ত্র চালনার শিক্ষা গ্রহণ করে এবং তা সর্বসাধারণের জন্য অশেষ অনুপ্রেরণার কারণ হয়ে ওঠে।
২৫ মার্চ পাকিস্তানের সেনাবাহিনী তাদের বর্বর সামরিক পরিকল্পনা অপারেশন সার্চলাইট বাস্তবায়ন করতে গিয়ে প্রথম আঘাতের জন্য পিলখানা ইপিআর সদর দফতর এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইনের পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বেছে নেওয়ার মধ্যে তাই বিস্ময়ের কিছু ছিল না। তারা সম্ভাব্য প্রতিরোধ কেন্দ্রগুলো ধ্বংস করতে চেয়েছে এবং এ জন্য নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। সুবর্ণ জয়ন্তীর বছরে আমাদের প্রিয় প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে জেনোসাইড বা গণহত্যার এপিসেন্টার। তবে সামরিক জান্তার হিসাবে ভুল ছিল মৌলিক। ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত আমাদের এ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের শুধু পুঁথিগত জ্ঞান আহরণ নয়, পূর্ণাঙ্গ মানুষ হয়ে ওঠার শিক্ষাও দেওয়া হয়। এ শিক্ষা তাদের প্রতিনিয়ত দেশমাতৃকার প্রয়োজনে সর্বোচ্চ ত্যাগের বিনিময়ে হলেও সাড়া প্রদানে অনুপ্রেরণা জোগায়। সভ্যতা ও মানবতার আহ্বানে তাল মিলিয়ে চলতে তারা কখনও পিছপা হয়নি, হবেও না। এ কারণেই ২৫ মার্চের পর অতি দ্রুত দেশব্যাপী প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। দলে দলে ছাত্র-তরুণরা মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করে এবং বাংলাদেশ ভূখণ্ডকে হানাদার বাহিনীর জন্য অসহনীয় করে তোলে।
আমাদের শিক্ষার্থীদের সর্বদা অন্ধকার দূর করে আলোক শিখা প্রজ্বলনের শিক্ষা দেওয়া হয়। প্রকৃতির অন্ধকার নয়, বরং মনোজগতের অন্ধকার দূর করার জন্য নিরলস কাজ করে যাওয়ার শিক্ষাই ছাত্রছাত্রীরা নয় দশক ধরে পাচ্ছে। ১৯৭১ সাল ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবর্ণ জয়ন্তীর বছর। এমন গৌরবের বছরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী শুধু এ প্রতিষ্ঠান নয়, সত্য ও সুন্দরকে চিরতরে স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু এ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীরা স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেই এ স্মরণীয় বার্ষিকী উদযাপন করেছে।
শুধু একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ নয়, দেশের যে কোনো কঠিন সময়েই সত্য উচ্চারিত হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। যত বাধা-বিঘ্ন আসুক, আমরা পিছু হটে যাইনি। কখনও শিক্ষকরা এগিয়ে এসেছেন, কখনও শিক্ষার্থীরা। আবার সম্মিলিতভাবেও তারা ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দিয়েছেন।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এটাও জানত, যেমন জানত তাদের এদেশীয় দোসররা। একাত্তরের বিজয়লগ্নে বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা বাস্তবায়নের এটাই ছিল মূল কারণ। যারা জ্ঞানের মশাল জ্বালাতে জানেন, তাদের নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছে তারা। স্বাধীন দেশে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের হত্যাকাণ্ড তো এরই ধারাবাহিকতা। ২০০৭ সালে গণতন্ত্র বিপন্ন করার চেষ্টাও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সামরিক কর্তৃপক্ষ ছাত্রদের পাশাপাশি শিক্ষকদেরও নানাভাবে নিগৃহীত করে। শুধু কারাবন্দি করে নয়, বরেণ্য শিক্ষকদের রিমান্ডে নিয়ে দিনের পর দিন নির্যাতন চালানো হয়। তাদের নামে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়। গণমাধ্যমে চরিত্র হননের চেষ্টা চলে। কিন্তু সব অপচেষ্টা ব্যর্থ করে দেন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা।
এ প্রতিষ্ঠানকে শুধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষার মধ্যে সীমিত রাখার একটি প্রস্তাব একসময়ে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হচ্ছিল। কিন্তু প্রথম উপাচার্য পি জে হারটগ জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখার উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষার ওপর জোর দেন এবং সেটাই সবাই মেনে নেয়। তিনি চেয়েছেন, পিছিয়ে থাকা এ এলাকার উন্নয়নে যেন ঢাকা বিশ্ব নেতৃত্ব প্রদান করতে সক্ষম হয়। গত নয় দশকের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি, শুধু রাজনৈতিক নয়, শিক্ষা-সংস্কৃতির বিকাশেও এ প্রতিষ্ঠানের রয়েছে অনন্য ভূমিকা। বিশেষ করে ১৯৭১ থেকে ২০১১ পর্যন্ত সময়কাল আমাদের জন্য বিবেচিত হয়েছে সম্ভাবনা বাস্তবায়নের কাল হিসেবে। এ প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা ও গবেষণা করেছেন অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বোস। মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইনের সঙ্গে তার নাম যুক্ত হয়ে রয়েছে বোস-আইনস্টাইন তত্ত্বের কারণে। পরিসংখ্যান বিজ্ঞানকে অনেক এগিয়ে নিয়েছেন অধ্যাপক মোতাহার হোসেন। জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সাহিত্যসাধনা করেছেন এ ক্যাম্পাসে থেকেই। ষাটের দশকে আমাদের ভূখণ্ডের প্রতি পাকিস্তানের শাসকদের অর্থনৈতিক বৈষম্যমূলক নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন ঢাকা বিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের বরেণ্য কয়েকজন শিক্ষক। তারা 'দুই অর্থনীতি' সবার সামনে স্পষ্ট করে দেন এবং শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে জনগণকে সচেতন করে তুলতে থাকেন। রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গেও তারা যোগসূত্র স্থাপন করতে সক্ষম হন। আমরা জানি, যে কোনো রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক তত্ত্ব যখন জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে, তখন তা প্রচণ্ড শক্তি অর্জন করে। ষাটের দশকে আমাদের অর্থনীতি বিভাগের পণ্ডিতদের গবেষণাকাজ জাতীয় প্রত্যাশা পূরণে সক্ষম হয় এবং খুব দ্রুতই তা আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মনোযোগ আকর্ষণ করে। তিনি নিজের অনন্য দূরদর্শী ক্ষমতায় একই ধরনের সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন। এভাবেই রচিত হয় আমাদের মহান স্বাধীনতার মতাদর্শগত ভিত্তি। বঙ্গবন্ধুর কথা ও কাজে মূর্ত হয়ে উঠতে থাকে জনপ্রত্যাশা এবং তার পেছনে আমাদের এ প্রিয় প্রতিষ্ঠানের অবদানও ইতিহাসের মূল্যবান উপাদান হয়ে রয়েছে।
আমরা এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাছে এ শিক্ষাও পেয়েছি যে, কেবল ঐহিত্য ও সুনামের ছায়াতলে থাকলেই জাতীয় অগ্রগতি ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত হয় না। বরং নব নব উদ্ভাবন ও আবিষ্কারে প্রতিষ্ঠানকে পুষ্ট করে যেতে হয়। গত চার দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ কাজটি করে চলেছে সাধ্যের সবটুকু উজাড় করে দিয়ে। আমাদের বিভাগ ও অনুষদ সংখ্যা বেড়েছে, ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক বেড়েছে। কিন্তু সবচেয়ে লক্ষণীয় যে, পরিবর্তন তা হচ্ছে যুগের সঙ্গে প্রাণবন্তভাবে এগিয়ে চলার ক্ষমতা। উদাহরণ হিসেবে আমি পাটের জিনরহস্য উন্মোচনের গবেষণার কথা বলতে পারি। সোনালি আঁশ যেন কালের গর্ভে হারিয়ে যেতে বসেছিল। কিন্তু আমাদের প্রাণরসায়ন ও অনুবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. হাসিনা খান বিশিষ্ট বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলমের সঙ্গে মিলিতভাবে এ গবেষণা পরিচালনা করেন এবং তা গোটা বিশ্বে কৃষি বিজ্ঞানে বড় ধরনের বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ড হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। এ গবেষণা সম্পাদন এবং এর বাস্তব প্রয়োগে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ব্যক্তিগতভাবে এবং তার সরকার সর্বতোভাবে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। এর ফলে পাট, পাটচাষি ও পাটশিল্পের যুগান্তকারী উন্নয়ন ঘটবে বলে আশা করা যায়। মৌলিক গবেষণার আরও অনেক ক্ষেত্রে এ ধরনের সহযোগিতা চালু রয়েছে এবং তা ক্রমে প্রসারিত ও গভীরতর হতে থাকবে তাতে সন্দেহ নেই। গণমুখী শিক্ষানীতির স্লোগানও আমাদের এ প্রতিষ্ঠান থেকে প্রথমে ধ্বনিত হয়েছিল। বর্তমান সরকার তার চূড়ান্ত রূপ প্রদান করেছে। স্বাধীনতার ৪০তম বছরে এ নীতি বাস্তবায়নে বড় ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে আমার বিশ্বাস। এ নীতি আমাদের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ উপস্থাপন করবে এবং আমরা এর সঙ্গে মানিয়ে নিতে অবশ্যই সক্ষম হবো।
আমাদের পিছিয়ে পড়া সমাজকে এগিয়ে নেওয়ার কাজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে নেতৃত্বের প্রত্যাশায় অস্বাভাবিকতা ছিল না। প্রথম থেকেই উচ্চশিক্ষার মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা এ প্রতিষ্ঠানকে বেছে নিতে থাকে। শিক্ষাজীবন শেষে তারা সমাজের বিভিন্ন অঙ্গনে ছড়িয়ে পড়ছে এবং শুধু দৈনন্দিন কাজ পরিচালনা কিংবা চাকরির জন্যই কাজ করা নয়, দেশ ও দশকে দিয়ে চলেছে আরও বেশি কিছু। আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে দেখতে পাই এ প্রতিষ্ঠানের সাবেক শিক্ষার্থীদের নিরঙ্কুশ প্রাধান্য। চার দশকের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্য ও সংসদ সদস্যদের তালিকা হাতে নিয়ে বসলে আমরা দেখব, এককভাবে আর কোনো প্রতিষ্ঠানের সাবেক ছাত্রছাত্রীরা এর ধারেকাছেও নেই। শুধু রাজনীতিবিদ নয়, বিভিন্ন পেশায় তারা রয়েছেন। প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীতেও তারা মেধা ও যোগ্যতার গুণে স্থান করে নিচ্ছেন। এ প্রতিষ্ঠান তাদের এমন দায়িত্ব পালনের জন্যই যোগ্য করে তুলতে পারছে, সেটা নিঃসন্দেহে গর্বের বিষয়। এসব ছাত্রছাত্রী যেখানেই কাজ করুন না কেন তাদের ভাবনায় থাকে দেশের উন্নতি, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধি। ব্যক্তিগত জীবনের সাফল্য অর্জনের বিষয়টি অবশ্যই তাদের কাছে গুরুত্ব পাবে, কিন্তু তার চেয়েও বড় হয়ে ওঠে দেশের দাবি।
বিশ্ববাসীরও দাবি রয়েছে এ প্রতিষ্ঠানের প্রতি। আমাদের অনেক সাবেক ছাত্রছাত্রী উন্নত বিশ্বে ছড়িয়ে রয়েছেন এবং তাদের কাজ আলো ছড়াচ্ছে। একই সঙ্গে তাদের ভাবনায় রয়েছে নিজের প্রিয় এ প্রতিষ্ঠান এবং এখানের কাজ গতিশীল ও উচ্চমানসম্পন্ন করে তোলার জন্যও তাদের আন্তরিক সহায়তা আমরা পেয়ে চলেছি। এসব সাবেক শিক্ষার্থী এবং বর্তমানের সব ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকরা এ বিষয়ে সচেতন যে, আমাদের প্রতিষ্ঠানকে বিশ্বমানের করে গড়ে তুলতে হবে। পাকিস্তান আমল এবং বাংলাদেশে সামরিক স্বৈরশাসনের সময়ে আমরা বৈরী পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছি অসম সাহসিকতায়। তবে এখন আমাদের সামনে রয়েছে স্বাধীনতার স্বপ্নপূরণের বিশাল কর্মযজ্ঞ। এতেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে নেতৃত্ব প্রদান করে যেতে হবে। আমরা শিক্ষার্থীদের প্রতিনিয়ত এ শিক্ষা দিই যে, জ্ঞান শুধু নিজের আরাম-আয়েশ বাড়ানোর জন্য নয়। প্রত্যেকটি মানুষেরই স্বাভাবিক প্রত্যাশা যে অর্জিত শিক্ষা কর্মজীবন সুন্দর ও মসৃণ করায় সহায়ক হয়ে উঠবে। তবে মূল কথা হচ্ছে, এ শিক্ষা কাজে লাগিয়ে সমাজ থেকে কতটা অন্ধকার দূর করতে পারছি, দেশকে কতটা এগিয়ে নিতে পারছি। আমাদের প্রিয় প্রতিষ্ঠান ভাষা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে, স্বাধীন দেশের পতাকা প্রথম উত্তোলন করার গৌরব বহন করছে। দেশকে হানাদার বাহিনীর কবলমুক্ত করার জন্য আমাদের অনেক ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক ও কর্মচারী লড়েছেন বীরের মতো। এমন দ্যুতি ছড়ানো ভূমিকা আমরা ধরে রাখবই। এ কাজে বাধা আসতে পারে, কিন্তু তা অতিক্রম করার মন্ত্র তো আমাদের জানাই আছে। মাত্র ১০ বছর পর ২০২১ সালে আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালিত হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবর্ণ জয়ন্তীর বছরে আমরা প্রিয় মাতৃভূমির জন্য সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত উপহার এনেছি_ স্বাধীনতা। আমাদের সামনে রয়েছে ভিশন-২০২১। দেশের সুবর্ণ জয়ন্তীর বছরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পালন করবে শতবর্ষ। ওই বছরে দেশের জন্য নির্দিষ্ট এ লক্ষ্য অর্জনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে প্রত্যাশা অনেক এবং শত শহীদের রক্তে বিধৌত এ প্রিয় অঙ্গনের সঙ্গে যুক্ত সবার আন্তরিক ও একনিষ্ঠ কর্মপ্রয়াসে তা পূরণ হবেই।
আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক : উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করে বাঙালিদের দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করলে এ প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরাই জানিয়ে দেয়, এমনটি হওয়ার নয়। বাষট্টি ও চৌষট্টির শিক্ষা আন্দোলনের কেন্দ্র ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বিজ্ঞানভিত্তিক গণমুখী শিক্ষা চাই_ এ দাবি ছাত্রসমাজের পক্ষ থেকে তুলে ধরেন এ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছাত্রনেতারা। ঊনসত্তরের ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানকে ধরে নেওয়া হয় একাত্তরের স্বাধীনতা আন্দোলনের ড্রেস রিহার্সাল। ওই উত্তাল বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসের প্রতিটি দিন গোটা দেশের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। 'জয় বাংলা' রণধ্বনির পাশাপাশি এ ক্যাম্পাসের মধুর ক্যান্টিন ও বটতলাতেই ছাত্রছাত্রীরা 'পিন্ডি না ঢাকা' এবং 'পদ্মা-মেঘনা-যমুনা তোমার আমার ঠিকানা' স্লোগান তোলে। একাত্তরের ১ মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করলে এর প্রতিবাদে স্বাধীনতার আওয়াজ তুলে প্রথম মিছিলটি বের হয়েছির মধুর ক্যান্টিন থেকে। পরের দিন বটতলায় উত্তোলন করা হয় স্বাধীন দেশের পতাকা। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার পর এ পতাকাকেই আমাদের নির্বাচিত নেতৃত্ব জাতীয় পতাকা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেন। বিশ্বে এ এক অনন্য নজির। স্বাধীনতার জন্য 'যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা' করার জন্য ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর অবিনাশী আহ্বান দেশবাসী শুনতে পায় ক্যাম্পাসের অদূরেই তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান থেকে। তিনি পরিণত হন জাতীয় আকাঙ্ক্ষার প্রতীকে। তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে ৯ মার্চ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থানে শুরু হয় সামরিক প্রশিক্ষণ_ যাতে অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও অংশ নিতে থাকে এবং দ্রুতই তা ব্যাপক উদ্দীপনা সৃষ্টি করে ছড়িয়ে পড়ে শহর-বন্দর-গ্রামে। এ সময়ে বিপুলসংখ্যক ছাত্রী অস্ত্র চালনার শিক্ষা গ্রহণ করে এবং তা সর্বসাধারণের জন্য অশেষ অনুপ্রেরণার কারণ হয়ে ওঠে।
২৫ মার্চ পাকিস্তানের সেনাবাহিনী তাদের বর্বর সামরিক পরিকল্পনা অপারেশন সার্চলাইট বাস্তবায়ন করতে গিয়ে প্রথম আঘাতের জন্য পিলখানা ইপিআর সদর দফতর এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইনের পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বেছে নেওয়ার মধ্যে তাই বিস্ময়ের কিছু ছিল না। তারা সম্ভাব্য প্রতিরোধ কেন্দ্রগুলো ধ্বংস করতে চেয়েছে এবং এ জন্য নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। সুবর্ণ জয়ন্তীর বছরে আমাদের প্রিয় প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে জেনোসাইড বা গণহত্যার এপিসেন্টার। তবে সামরিক জান্তার হিসাবে ভুল ছিল মৌলিক। ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত আমাদের এ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের শুধু পুঁথিগত জ্ঞান আহরণ নয়, পূর্ণাঙ্গ মানুষ হয়ে ওঠার শিক্ষাও দেওয়া হয়। এ শিক্ষা তাদের প্রতিনিয়ত দেশমাতৃকার প্রয়োজনে সর্বোচ্চ ত্যাগের বিনিময়ে হলেও সাড়া প্রদানে অনুপ্রেরণা জোগায়। সভ্যতা ও মানবতার আহ্বানে তাল মিলিয়ে চলতে তারা কখনও পিছপা হয়নি, হবেও না। এ কারণেই ২৫ মার্চের পর অতি দ্রুত দেশব্যাপী প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। দলে দলে ছাত্র-তরুণরা মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করে এবং বাংলাদেশ ভূখণ্ডকে হানাদার বাহিনীর জন্য অসহনীয় করে তোলে।
আমাদের শিক্ষার্থীদের সর্বদা অন্ধকার দূর করে আলোক শিখা প্রজ্বলনের শিক্ষা দেওয়া হয়। প্রকৃতির অন্ধকার নয়, বরং মনোজগতের অন্ধকার দূর করার জন্য নিরলস কাজ করে যাওয়ার শিক্ষাই ছাত্রছাত্রীরা নয় দশক ধরে পাচ্ছে। ১৯৭১ সাল ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবর্ণ জয়ন্তীর বছর। এমন গৌরবের বছরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী শুধু এ প্রতিষ্ঠান নয়, সত্য ও সুন্দরকে চিরতরে স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু এ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীরা স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেই এ স্মরণীয় বার্ষিকী উদযাপন করেছে।
শুধু একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ নয়, দেশের যে কোনো কঠিন সময়েই সত্য উচ্চারিত হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। যত বাধা-বিঘ্ন আসুক, আমরা পিছু হটে যাইনি। কখনও শিক্ষকরা এগিয়ে এসেছেন, কখনও শিক্ষার্থীরা। আবার সম্মিলিতভাবেও তারা ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দিয়েছেন।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এটাও জানত, যেমন জানত তাদের এদেশীয় দোসররা। একাত্তরের বিজয়লগ্নে বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা বাস্তবায়নের এটাই ছিল মূল কারণ। যারা জ্ঞানের মশাল জ্বালাতে জানেন, তাদের নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছে তারা। স্বাধীন দেশে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের হত্যাকাণ্ড তো এরই ধারাবাহিকতা। ২০০৭ সালে গণতন্ত্র বিপন্ন করার চেষ্টাও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সামরিক কর্তৃপক্ষ ছাত্রদের পাশাপাশি শিক্ষকদেরও নানাভাবে নিগৃহীত করে। শুধু কারাবন্দি করে নয়, বরেণ্য শিক্ষকদের রিমান্ডে নিয়ে দিনের পর দিন নির্যাতন চালানো হয়। তাদের নামে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়। গণমাধ্যমে চরিত্র হননের চেষ্টা চলে। কিন্তু সব অপচেষ্টা ব্যর্থ করে দেন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা।
এ প্রতিষ্ঠানকে শুধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষার মধ্যে সীমিত রাখার একটি প্রস্তাব একসময়ে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হচ্ছিল। কিন্তু প্রথম উপাচার্য পি জে হারটগ জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখার উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষার ওপর জোর দেন এবং সেটাই সবাই মেনে নেয়। তিনি চেয়েছেন, পিছিয়ে থাকা এ এলাকার উন্নয়নে যেন ঢাকা বিশ্ব নেতৃত্ব প্রদান করতে সক্ষম হয়। গত নয় দশকের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি, শুধু রাজনৈতিক নয়, শিক্ষা-সংস্কৃতির বিকাশেও এ প্রতিষ্ঠানের রয়েছে অনন্য ভূমিকা। বিশেষ করে ১৯৭১ থেকে ২০১১ পর্যন্ত সময়কাল আমাদের জন্য বিবেচিত হয়েছে সম্ভাবনা বাস্তবায়নের কাল হিসেবে। এ প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা ও গবেষণা করেছেন অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বোস। মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইনের সঙ্গে তার নাম যুক্ত হয়ে রয়েছে বোস-আইনস্টাইন তত্ত্বের কারণে। পরিসংখ্যান বিজ্ঞানকে অনেক এগিয়ে নিয়েছেন অধ্যাপক মোতাহার হোসেন। জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সাহিত্যসাধনা করেছেন এ ক্যাম্পাসে থেকেই। ষাটের দশকে আমাদের ভূখণ্ডের প্রতি পাকিস্তানের শাসকদের অর্থনৈতিক বৈষম্যমূলক নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন ঢাকা বিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের বরেণ্য কয়েকজন শিক্ষক। তারা 'দুই অর্থনীতি' সবার সামনে স্পষ্ট করে দেন এবং শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে জনগণকে সচেতন করে তুলতে থাকেন। রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গেও তারা যোগসূত্র স্থাপন করতে সক্ষম হন। আমরা জানি, যে কোনো রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক তত্ত্ব যখন জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে, তখন তা প্রচণ্ড শক্তি অর্জন করে। ষাটের দশকে আমাদের অর্থনীতি বিভাগের পণ্ডিতদের গবেষণাকাজ জাতীয় প্রত্যাশা পূরণে সক্ষম হয় এবং খুব দ্রুতই তা আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মনোযোগ আকর্ষণ করে। তিনি নিজের অনন্য দূরদর্শী ক্ষমতায় একই ধরনের সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন। এভাবেই রচিত হয় আমাদের মহান স্বাধীনতার মতাদর্শগত ভিত্তি। বঙ্গবন্ধুর কথা ও কাজে মূর্ত হয়ে উঠতে থাকে জনপ্রত্যাশা এবং তার পেছনে আমাদের এ প্রিয় প্রতিষ্ঠানের অবদানও ইতিহাসের মূল্যবান উপাদান হয়ে রয়েছে।
আমরা এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাছে এ শিক্ষাও পেয়েছি যে, কেবল ঐহিত্য ও সুনামের ছায়াতলে থাকলেই জাতীয় অগ্রগতি ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত হয় না। বরং নব নব উদ্ভাবন ও আবিষ্কারে প্রতিষ্ঠানকে পুষ্ট করে যেতে হয়। গত চার দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ কাজটি করে চলেছে সাধ্যের সবটুকু উজাড় করে দিয়ে। আমাদের বিভাগ ও অনুষদ সংখ্যা বেড়েছে, ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক বেড়েছে। কিন্তু সবচেয়ে লক্ষণীয় যে, পরিবর্তন তা হচ্ছে যুগের সঙ্গে প্রাণবন্তভাবে এগিয়ে চলার ক্ষমতা। উদাহরণ হিসেবে আমি পাটের জিনরহস্য উন্মোচনের গবেষণার কথা বলতে পারি। সোনালি আঁশ যেন কালের গর্ভে হারিয়ে যেতে বসেছিল। কিন্তু আমাদের প্রাণরসায়ন ও অনুবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. হাসিনা খান বিশিষ্ট বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলমের সঙ্গে মিলিতভাবে এ গবেষণা পরিচালনা করেন এবং তা গোটা বিশ্বে কৃষি বিজ্ঞানে বড় ধরনের বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ড হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। এ গবেষণা সম্পাদন এবং এর বাস্তব প্রয়োগে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ব্যক্তিগতভাবে এবং তার সরকার সর্বতোভাবে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। এর ফলে পাট, পাটচাষি ও পাটশিল্পের যুগান্তকারী উন্নয়ন ঘটবে বলে আশা করা যায়। মৌলিক গবেষণার আরও অনেক ক্ষেত্রে এ ধরনের সহযোগিতা চালু রয়েছে এবং তা ক্রমে প্রসারিত ও গভীরতর হতে থাকবে তাতে সন্দেহ নেই। গণমুখী শিক্ষানীতির স্লোগানও আমাদের এ প্রতিষ্ঠান থেকে প্রথমে ধ্বনিত হয়েছিল। বর্তমান সরকার তার চূড়ান্ত রূপ প্রদান করেছে। স্বাধীনতার ৪০তম বছরে এ নীতি বাস্তবায়নে বড় ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে আমার বিশ্বাস। এ নীতি আমাদের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ উপস্থাপন করবে এবং আমরা এর সঙ্গে মানিয়ে নিতে অবশ্যই সক্ষম হবো।
আমাদের পিছিয়ে পড়া সমাজকে এগিয়ে নেওয়ার কাজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে নেতৃত্বের প্রত্যাশায় অস্বাভাবিকতা ছিল না। প্রথম থেকেই উচ্চশিক্ষার মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা এ প্রতিষ্ঠানকে বেছে নিতে থাকে। শিক্ষাজীবন শেষে তারা সমাজের বিভিন্ন অঙ্গনে ছড়িয়ে পড়ছে এবং শুধু দৈনন্দিন কাজ পরিচালনা কিংবা চাকরির জন্যই কাজ করা নয়, দেশ ও দশকে দিয়ে চলেছে আরও বেশি কিছু। আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে দেখতে পাই এ প্রতিষ্ঠানের সাবেক শিক্ষার্থীদের নিরঙ্কুশ প্রাধান্য। চার দশকের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্য ও সংসদ সদস্যদের তালিকা হাতে নিয়ে বসলে আমরা দেখব, এককভাবে আর কোনো প্রতিষ্ঠানের সাবেক ছাত্রছাত্রীরা এর ধারেকাছেও নেই। শুধু রাজনীতিবিদ নয়, বিভিন্ন পেশায় তারা রয়েছেন। প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীতেও তারা মেধা ও যোগ্যতার গুণে স্থান করে নিচ্ছেন। এ প্রতিষ্ঠান তাদের এমন দায়িত্ব পালনের জন্যই যোগ্য করে তুলতে পারছে, সেটা নিঃসন্দেহে গর্বের বিষয়। এসব ছাত্রছাত্রী যেখানেই কাজ করুন না কেন তাদের ভাবনায় থাকে দেশের উন্নতি, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধি। ব্যক্তিগত জীবনের সাফল্য অর্জনের বিষয়টি অবশ্যই তাদের কাছে গুরুত্ব পাবে, কিন্তু তার চেয়েও বড় হয়ে ওঠে দেশের দাবি।
বিশ্ববাসীরও দাবি রয়েছে এ প্রতিষ্ঠানের প্রতি। আমাদের অনেক সাবেক ছাত্রছাত্রী উন্নত বিশ্বে ছড়িয়ে রয়েছেন এবং তাদের কাজ আলো ছড়াচ্ছে। একই সঙ্গে তাদের ভাবনায় রয়েছে নিজের প্রিয় এ প্রতিষ্ঠান এবং এখানের কাজ গতিশীল ও উচ্চমানসম্পন্ন করে তোলার জন্যও তাদের আন্তরিক সহায়তা আমরা পেয়ে চলেছি। এসব সাবেক শিক্ষার্থী এবং বর্তমানের সব ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকরা এ বিষয়ে সচেতন যে, আমাদের প্রতিষ্ঠানকে বিশ্বমানের করে গড়ে তুলতে হবে। পাকিস্তান আমল এবং বাংলাদেশে সামরিক স্বৈরশাসনের সময়ে আমরা বৈরী পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছি অসম সাহসিকতায়। তবে এখন আমাদের সামনে রয়েছে স্বাধীনতার স্বপ্নপূরণের বিশাল কর্মযজ্ঞ। এতেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে নেতৃত্ব প্রদান করে যেতে হবে। আমরা শিক্ষার্থীদের প্রতিনিয়ত এ শিক্ষা দিই যে, জ্ঞান শুধু নিজের আরাম-আয়েশ বাড়ানোর জন্য নয়। প্রত্যেকটি মানুষেরই স্বাভাবিক প্রত্যাশা যে অর্জিত শিক্ষা কর্মজীবন সুন্দর ও মসৃণ করায় সহায়ক হয়ে উঠবে। তবে মূল কথা হচ্ছে, এ শিক্ষা কাজে লাগিয়ে সমাজ থেকে কতটা অন্ধকার দূর করতে পারছি, দেশকে কতটা এগিয়ে নিতে পারছি। আমাদের প্রিয় প্রতিষ্ঠান ভাষা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে, স্বাধীন দেশের পতাকা প্রথম উত্তোলন করার গৌরব বহন করছে। দেশকে হানাদার বাহিনীর কবলমুক্ত করার জন্য আমাদের অনেক ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক ও কর্মচারী লড়েছেন বীরের মতো। এমন দ্যুতি ছড়ানো ভূমিকা আমরা ধরে রাখবই। এ কাজে বাধা আসতে পারে, কিন্তু তা অতিক্রম করার মন্ত্র তো আমাদের জানাই আছে। মাত্র ১০ বছর পর ২০২১ সালে আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালিত হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবর্ণ জয়ন্তীর বছরে আমরা প্রিয় মাতৃভূমির জন্য সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত উপহার এনেছি_ স্বাধীনতা। আমাদের সামনে রয়েছে ভিশন-২০২১। দেশের সুবর্ণ জয়ন্তীর বছরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পালন করবে শতবর্ষ। ওই বছরে দেশের জন্য নির্দিষ্ট এ লক্ষ্য অর্জনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে প্রত্যাশা অনেক এবং শত শহীদের রক্তে বিধৌত এ প্রিয় অঙ্গনের সঙ্গে যুক্ত সবার আন্তরিক ও একনিষ্ঠ কর্মপ্রয়াসে তা পূরণ হবেই।
আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক : উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments