বিশেষ সাক্ষাৎকার- দুর্নীতির চেয়েও বড় সমস্যা উন্নয়নমুখী শাসনের অভাব by মুশতাক হুসাইন খান
ড. মুশতাক হুসাইন খান লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের (সোয়াস) অর্থনীতির অধ্যাপক। তিনি জাতিসংঘের কমিটি অব এক্সপার্টস অন পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের সদস্য।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে স্নাতক করে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। কয়েক বছর সেখানেই শিক্ষকতা করেন। উন্নয়ন, সুশাসন, দুর্নীতি ও অর্থনৈতিক সক্ষমতা বিষয়ে তাঁর গবেষণা আন্তর্জাতিক গুরুত্ব অর্জন করেছে। দরিদ্র দেশগুলোর অর্থনীতি, দক্ষিণ এশীয় উন্নয়ন, দুর্নীতি ও উন্নয়ন, রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা তাঁর গবেষণার বিষয়। দুর্নীতি দমন ও সুশাসন বিষয়ে তিনি ব্রেটন উডস প্রতিষ্ঠান তথা বিশ্বব্যাংক ও এডিবির ধারণার সমালোচক। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো: রেন্টস, রেন্ট-সিকিং অ্যান্ড ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট, স্টেট ফেইলিউর ইন উইক স্টেটস এবং স্টেট বিল্ডিং ইন প্যালেস্টাইন।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফারুক ওয়াসিফ
প্রথম আলো বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় উন্নতির প্রধান বাধা দুর্নীতি, না ভুল নীতি?
মুশতাক হুসাইন খান দুর্নীতি আমাদের প্রধান সমস্যা নয়। আমরা সবাই চাই গণতন্ত্র জবাবদিহিমূলক হোক, দুর্নীতি একেবারে শূন্য হয়ে যাক, সম্পত্তিস্বত্ব (প্রপার্টি রাইটস) টেকসই হোক, আইনের শাসন বাধাহীন হোক। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এসব শর্ত বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়, তাই এগুলো এখানে প্রযোজ্য নয়। যা সম্ভব সেদিকে নজর না দিয়ে অসম্ভবের দিকে আমরা অনেক সময় ব্যয় করছি। গত জরুরি অবস্থার দুই বছরে এর নামে অনেক ক্ষতি হয়েছে। মোটা দাগে বলতে গেলে, মাথাপিছু আয় বছরে ৮ থেকে ১০ হাজার ডলার হওয়ার আগে কোথাও সুশাসন আসেনি। আমাদের সামাজিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা রূপান্তরের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। আমরা প্রাক্-পুঁজিবাদী অর্থনীতি থেকে পুঁজিবাদের দিকে যাচ্ছি। এই বিবর্তনের কালে কোনো কিছুই স্থিতিশীল হয় না। আমি যদি উন্নত পুঁজিবাদী দেশের আইনকানুন, বিধিব্যবস্থা কায়েম করতে চাই, সেটা কাজ করবে না। নৈরাজ্য দেখা দেবে। উন্নত দেশে মানুষ কেন আইন মানে? কারণ, কোনো উপায় সেখানে নেই। কিন্তু এখানে আপনি আইন মানলেও কাজ হচ্ছে না, আইনের বাইরেও কাজ হচ্ছে না। কারণটা কাঠামোগত। তাই ডিম আগে না মুরগি আগে, উন্নয়ন আগে না সুশাসন আগে, সেই তর্ক করে লাভ নেই।
প্রথম আলো বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা কী বলে?
মুশতাক খান জাপান, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ড—এই দেশগুলোর কোনোটাই সুশাসনের পরীক্ষায় পাস করবে না। এসব দেশে দুর্নীতি অনেক বেশি ছিল, আইনের শাসন ছিল না, সম্পত্তিস্বত্ব দুর্বল ছিল, জবাবদিহি ছিল না। তার পরও কিন্তু এরা দ্রুত উন্নতি করেছে। তার মানে সুশাসন এখানে নির্ধারক নয়। বরং তাদের অন্য একধরনের শাসন ছিল, যাকে আমি উন্নয়নমুখী শাসন বা ডেভেলপমেন্টাল গভর্নেন্স বলি। এটা কিন্তু গুড গভর্নেন্স নয়। চীনে, দক্ষিণ কোরিয়ায় খুবই শক্তিশালী উন্নয়নমুখী শাসন ছিল। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও আমাদের সেটাই প্রয়োজন।
প্রথম আলো এসব দেশের উন্নতির প্রথম যুগে তো মুক্তবাজার ছিল না। তাদের বেলায় বাজার ও রাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্ক কেমন ছিল?
মুশতাক খান ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইউরোপে শিল্প-পুঁজিবাদের শুরুর সময় বাজার অর্থনীতির মধ্যে দিয়েই প্রযুক্তিগত উন্নয়নের চাপ এসেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমরা দেখলাম, বিশ্ব অর্থনৈতিক-ব্যবস্থা দারুণভাবে পাল্টে গেছে। ইউরোপীয় শিল্প পুঁজিবাদের সঙ্গে আমাদের ব্যবধান বেড়ে গেছে। আমাদের শ্রমের মূল্য শূন্যের কোঠায় চলে এলেও উৎপাদন ক্ষমতার ঘাটতির জন্য আমরা বিশ্ববাজারে টিকতে পারব না, পারছি না। শুধু বাজার অর্থনীতি ও সস্তা শ্রম দিয়ে হচ্ছে না। যাঁরা সুশাসনের কথা বলেন, তাঁরা মনে করেন আইনের শাসন, সম্পত্তির অধিকার এবং বাজার অর্থনীতি থাকলেই সস্তা শ্রমের টানে পুঁজি এখানে আসবে। আর সেই পুঁজি বিনিয়োগের মাধ্যমে আমাদের উন্নতি হবে। জাপান, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া ও চীন শুধু বাজারের ওপর নির্ভর করে সফল হয়নি। উন্নত দেশের শিল্পের সঙ্গে স্থানীয় শিল্প প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা অর্জনের আগের একটি সময় সেখানে রাষ্ট্রের সরাসরি ভূমিকা ছিল। উন্নয়নমুখী শাসনের এটাও শর্ত। রাষ্ট্র বললে রাজনীতির কথাটাও চলে আসবে। রাজনীতি কী করে? বাজারের মাধ্যমে যে সম্পদের লেনদেন চলছে, তার ভারসাম্যহীনতা সমাজে অস্থিতিশীলতা তৈরি করে। তখন সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য রাজনীতির হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয়। যদি বাজার আপনাআপনি এই স্থিতিশীলতা রাখতে পারত, তাহলে রাজনীতির মাধ্যমে সম্পদের পুনর্বণ্টনের কর্মসূচি নেওয়ার প্রয়োজন হতো না।
প্রথম আলো আপনি পোশাকশিল্প নিয়ে কাজ করেছেন। বাংলাদেশের অল্প কটি সাফল্যের শিক্ষা কী?
মুশতাক খান বাংলাদেশ, ভারত, থাইল্যান্ড, তানজানিয়াসহ কয়েকটি দেশের ওপর গবেষণায় আমি দেখেছি, বাংলাদেশের গার্মেন্ট খাত, ভারতে ওষুধ ও গাড়িশিল্প, থাইল্যান্ডে ইলেকট্রনিকসসহ আরও কয়েকটি খাতের বিকাশ মুক্তবাজার অর্থনীতির নিয়মে বোঝা যাবে না। প্রতিটি ক্ষেত্রে কয়েকটি সৌভাগ্যদায়ী দুর্ঘটনা ঘটেছিল, যার ফলে কিছু সুযোগ তৈরি হয়েছিল এবং তারা ‘করতে করতে শেখার’ ব্যাপারটি ঘটাতে পেরেছিল। সে সময়ের রাষ্ট্র ও সরকার সেখানে ধাত্রীর ভূমিকায় ছিল। এই অস্বাভাবিক সাফল্য হতো না ওই বিশেষ সুযোগ ছাড়া। তিন-চার বছর কোটামুক্ত অবস্থার পর আমেরিকা দেখল, বাংলাদেশ গার্মেন্টে পটু হয়ে গেছে, অতএব কোটা বসিয়ে দিল। কিন্তু তত দিনে বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে গেছে। এই সুযোগ দরকার ছিল খুব অল্প সময়ের জন্য, কিন্তু তা অপরিহার্য ছিল। মুক্তবাজার অর্থনীতির সমর্থকেরা বলেন, এই সাফল্য মুক্তবাজারের। আমি কিন্তু উল্টোটা শিখছি। বাজার আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু ওই সুযোগ, যোগাযোগ ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া সফলতা আসত না।
প্রথম আলো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া উন্নয়নমুখী শাসন কীভাবে সম্ভব?
মুশতাক খান একটা অগ্রসর অর্থনীতির দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা কীভাবে টিকে থাকে? সেখানে আয়ের ৩৫-৫০ শতাংশ সরকার কর হিসেবে নিয়ে যাচ্ছে এবং এর বেশির ভাগই আবার জনগণের নানান অংশের মধ্যে পুনর্বণ্টিত হচ্ছে। এত বিপুল করের অর্থ কীভাবে পুনর্বণ্টিত হবে, তা নিয়ে সেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা হয়। সেই উদ্দেশ্যেই ইশতেহার রচিত হয় এবং লোকে সংসদে যান। রাজনীতি ও গণতন্ত্র সেখানে এই পুনর্বণ্টনের বিষয় ছাড়া আর কিছু নয়।
আমাদের পাঁচ থেকে সাত শ ডলারের জিডিপির পুরোটাই সেনাবাহিনীর আর আমলা-কর্মচারীদের বেতনের পেছনে ব্যয় হয়ে যায়। বিনিয়োগ ও অবকাঠামো নির্মাণের জন্য পয়সা থাকে না। সেটা হয় ঋণ নিয়ে বা সাহায্যের টাকায়। তাহলে করের টাকার পুনর্বণ্টন করছি কোথায়? আমি কিসের জোরে ক্ষমতায় থাকব? আমার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা কোথা থেকে আসবে? গরিব দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা সংসদের মাধ্যমে সম্পদের পুনর্বণ্টনের মাধ্যমে আসে না। যে কারণে পুনর্বণ্টনের রাজনীতি তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে আসে বাজেটের বাইরে থেকে, দুর্নীতির মাধ্যমে। ক্ষমতায় এলে আমাকে সামাজিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করতে হবে। সেটা করব কী দিয়ে? টাকা তো নেই। তখন আমি দেশের সব গুন্ডা-মাস্তান তথা উগ্র প্রকৃতির লোকগুলোকে কিনে ফেলব। আমরা এক পার্টি গুন্ডা-মাস্তান-গডফাদারদের কিনে ফেলব। আরেক পার্টিও তার মতো সশস্ত্র ক্ষমতা কিনবে। কেউ যদি বেশি দাম চায়, তাহলে তাকে বলব চলে যাও। সে তখন অন্য দলে যাবে। বা তাকে আমি র্যা ব দিয়ে মেরে ফেলব। আমার কাজ হচ্ছে, এসব গুন্ডা-মাস্তানদের ঠান্ডা রাখার মাধ্যমে সমাজকেও ঠান্ডা রাখব। স্থিতিশীলতা থাকছে যেহেতু মাস্তান ও গডফাদারদের টাকা বানাতে সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। হিসাবটা হচ্ছে, স্বল্পতম টাকায় সর্বোচ্চ পরিমাণ সশস্ত্র ক্ষমতা কেনা। এ জন্যই সুযোগ-সুবিধার বিনিময়ে রাজনীতিতে লোক কেনাবেচা চলে। এটা ভারত-পাকিস্তান-নাইজেরিয়া সবখানেই হচ্ছে। একে আমি বলছি ক্লায়েন্টেলিস্ট পলিটিকস বা পৃষ্ঠপোষণের রাজনীতি।
প্রথম আলো অনেকে এই পৃষ্ঠপোষণের রাজনীতিকেই দুর্নীতির কারণ বলে মনে করেন।
মুশতাক খান বিভিন্ন ধরনের পৃষ্ঠপোষণের রাজনীতি আছে। দেখার বিষয় হচ্ছে, এই পৃষ্ঠপোষণের রাজনীতির সাংগঠনিক রূপ কী? চীনে আছে একদলীয় শাসন, ভারতে ও বাংলাদেশে বহুদলীয় শাসন। এর বাইরে আছে সামরিক শাসন বা বিদেশি শাসন। উন্নয়ন হবে কি হবে না, তা এই ধরনগুলোর ওপর নির্ভর করে। ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের দুটি প্রধান পার্টির দুর্নীতি আমাদের ছাপিয়ে যাবে। দুজনেই ক্ষমতায় এসে প্রতিপক্ষকে হয়রানি করে জেলে ভরে। কিন্তু এই রাজ্যের প্রবৃদ্ধি ৮-৯ শতাংশ একটানা। সবচেয়ে বিদেশি বিনিয়োগ আসে সেখানে। অবকাঠামো উন্নয়নে ভারতের মধ্যে সেরা। জ্বালানি শক্তি উৎপাদন আমাদের থেকে তিন গুণ বেশি অথচ জনসংখ্যা অর্ধেক। কেন তারা পারছে? এর উত্তর হলো, তারা তাদের পৃষ্ঠপোষণের রাজনীতিটাকে নতুন করে সাজিয়েছে। তাদের মধ্যে ন্যূনতম সমঝোতা হয়েছে যে আমি যদি তোমাকে ধ্বংস করি, তাহলে তুমিও আমাকে ধ্বংস করবে। তাতে দুজনেরই ক্ষতি। এখন তারা পালা করে পাঁচ বছর পরপর টাকা বানানোর সমঝোতায় পৌঁছেছে। এই সমঝোতা পরের ধাপ হলো, আমলাতন্ত্রের কিছু ক্ষেত্র যেমন, অবকাঠামো নির্মাণ, শক্তি উৎপাদন ইত্যাদিকে তারা দুর্নীতিমুক্ত করে দিয়েছে। তারা বুঝেছে, যদি বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ে, রাস্তাঘাটের উন্নতি হয় তাহলে দুজনেরই লাভ। টাকা বানাতে চাইলে আমরা অন্য জায়গায় বানাব। তাদের আমলারা কারিগরিভাবে দক্ষ। দলের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ আছে। নিচের সারির বা ক্ষমতার কাছাকাছি কেউ উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারে না। তাই পৃষ্ঠপোষণের রাজনীতিরও খারাপ-ভালো আছে। আমাদের এই শিক্ষাগুলো নিতে হবে।
প্রথম আলো কিন্তু এখানে কেন এ ধরনের সমঝোতা হতে পারছে না?
মুশতাক খান আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব দুর্বল হয়ে গেছে। তারা আর তাদের লোকদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। পদ্মা সেতুর কথাই ধরুন, দলের লোকদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার জন্য অনেক বিরাট ক্ষতি হয়ে গেল। অথচ এটার সুফল আমাদের জন্য অনেক মিলিয়ন ডলারের হতো। দলের জন্যও নির্বাচন জেতা সহজ হতো। আমাদের দুটি দলের ভেতরে শৃঙ্খলা নেই। আমাদের তো সফল পৃষ্ঠপোষণের রাজনীতি থেকে শিখতে হবে। সুশাসনের রাজনীতি থেকে আমরা কিছু শিখতে পারব না। এখন রাজনীতি অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে। নতুন নতুন লোক আসছে রাজনীতিতে, যারা নিয়ন্ত্রণে থাকছে না। নতুন গণতন্ত্রে রাজনীতি ও রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে। লুটপাটের শক্তি দল ও রাষ্ট্রে প্রধান হয়ে উঠছে। উৎপাদন ও বিনিয়োগের মাধ্যমে পুঁজি গঠনের সুযোগ কমে যাচ্ছে।
প্রথম আলো কিন্তু আমাদের ক্ষমতাবান শ্রেণীগুলোর মধ্যকার অন্তর্বিরোধ ও অস্থিতিশীলতার পরিবেশে সুদূরপ্রসারী কোনো গঠনমূলক ভূমিকা পালন কী সম্ভব?
মুশতাক খান আমরা এখনো রূপান্তরকাল পার করিনি। আমাদের উদীয়মান পুঁজিবাদীরা অর্থের দিক থেকে, সংখ্যার দিক থেকে, রাজনৈতিক ক্ষমতার দিক থেকে এই সমাজের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। এটাকে একধরনের পৃষ্ঠপোষণমূলক ব্যবস্থা বলছি। অর্থাৎ ক্ষমতায় থাকতে হলে মধ্যবর্তী শ্রেণী যারা—যেমন, ধনী কৃষক, শিক্ষিত শহুরে মধ্যবিত্ত, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়া শিক্ষিত অংশ, মধ্য-কৃষক এদের খুশি করে চলতে হচ্ছে। এরা জনগণের বড় অংশকে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখে। তৃতীয় দুনিয়ার সর্বত্র এটা দেখা যায়। আমাদের ধরন হলো, এখানে এরা জমাট বাঁধেনি। এর ভেতর থেকে আদিম লুণ্ঠনের পথে একটা কোটিপতি শ্রেণী বেরিয়ে এসেছে। ওপরতলায় যারা এই পদ্ধতিতে পুঁজিপতি হয়েছে, তাদের মধ্যে অদ্যাবধি দেশ চালানো নিয়ে কোনো সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ভারতেও এই সমস্যা রয়েছে। কিন্তু ভারতে স্থায়ী একটা আমলাতন্ত্র আছে, যারা দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়ায় বিকশিত হয়েছে। এই আমলাতন্ত্র রাষ্ট্রীয় নীতিকে এমন স্থায়ী মাত্রা দিয়েছে যে এক দলের সরকার অন্য দলের সরকারের সব কর্মসূচি বাতিল করে দিতে পারে না। এটাকে কিন্তু সুশাসনের সঙ্গে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। সত্যিকার অর্থে যদি রাজনৈতিক দুর্নীতি কমাতে চাই, তাহলে আমাদের সম্পদের পুনর্বণ্টনের বিকল্প উৎস ও পথ বের করতে হবে।
প্রথম আলো এ মুহূর্তে তাহলে আমাদের করণীয় কী?
মুশতাক খান অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা, নীতি ও কৌশল ঠিক করতে হবে। প্রবৃদ্ধি আরও ২ শতাংশ বাড়াতে বিপুল পরিবর্তন ঘটাতে হবে। অর্থনীতি পুরোটাই লুটপাটের দিকে চলে গেলে টাকা বিদেশে চলে যাবে, উৎপাদনে বিনিয়োজিত করা যাবে না। গার্মেন্ট শিল্পের মতো করে ইলেকট্রনিক শিল্পগুচ্ছ তৈরির দিকে যেতে হবে। তার জন্য নতুন প্রযুক্তি আনতে হবে। গার্মেন্ট খাতে প্রশিক্ষিত লোক তখন ইলেকট্রনিক খাতে আসবে। প্রথম দু-তিনটি কারখানায় সম্মিলিত উদ্যোগে সফলতা এলে তার অজস্র অনুকরণ হবে। গার্মেন্ট খাতেও এটাই হয়েছিল। সুতরাংশিল্পনীতি ঠিক করতে হবে, সৃষ্টি করতে হবে শিল্পপার্ক। দরকার অধিকতর দক্ষ রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা, যেখানে সর্বোচ্চ নেতৃত্ব রাজনৈতিক সদিচ্ছা, দক্ষতা ও দূরদর্শিতা নিয়েসব বাধা দূর করবে। দুই দলকে এর জন্য একটা সমঝোতায়আসতেই হবে। কিছু কিছু লক্ষ্যভিত্তিক বিনিয়োগ লাগবে। তার জন্যরাজনৈতিক নিষ্ঠাবান নজরদারি দরকার। এভাবে চলতে পারলে নতুন আরও দুই-তিনটি খাত বেরিয়েআসবে। বড় লক্ষ্যের দরকার নেই, নতুন দুই-তিনটি পাওয়ার স্টেশন আর দুই-তিনটি খাতের বিকাশ চাই।
দুর্নীতি একেবারে দূর করতে হলে দুর্নীতিকেন্দ্রিক রাজনীতিটাই উন্নয়নকেন্দ্রিক রাজনীতি দিয়ে বদলে ফেলতে হবে। তার জন্য কী ধরনের স্লোগান দরকার, কী ধরনের প্রতিষ্ঠান করব, কী ধরনের রাষ্ট্র গড়ব—সেগুলো স্পষ্ট করতে হবে। এ জন্য পার্টিগুলোকে পুনর্গঠিত করতে হবে। তাদের উন্নয়নমুখী করতে হবে। তার জন্য সফলতার কাহিনিগুলো থেকে শিখতে হবে এবং জানতে হবে যে বাংলাদেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক বন্দোবস্তের মধ্যে কোন মডেল বেশি কার্যকর। রাজনীতিবিদদের নিজেদের স্বার্থেই এই উপলব্ধিতে আসতে হবে। সেই উপলব্ধিটাকেই বলছি উন্নয়নমুখী শাসনের নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের শর্ত।
প্রথম আলো আপনাকে ধন্যবাদ।
মুশতাক খান ধন্যবাদ।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফারুক ওয়াসিফ
প্রথম আলো বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় উন্নতির প্রধান বাধা দুর্নীতি, না ভুল নীতি?
মুশতাক হুসাইন খান দুর্নীতি আমাদের প্রধান সমস্যা নয়। আমরা সবাই চাই গণতন্ত্র জবাবদিহিমূলক হোক, দুর্নীতি একেবারে শূন্য হয়ে যাক, সম্পত্তিস্বত্ব (প্রপার্টি রাইটস) টেকসই হোক, আইনের শাসন বাধাহীন হোক। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এসব শর্ত বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়, তাই এগুলো এখানে প্রযোজ্য নয়। যা সম্ভব সেদিকে নজর না দিয়ে অসম্ভবের দিকে আমরা অনেক সময় ব্যয় করছি। গত জরুরি অবস্থার দুই বছরে এর নামে অনেক ক্ষতি হয়েছে। মোটা দাগে বলতে গেলে, মাথাপিছু আয় বছরে ৮ থেকে ১০ হাজার ডলার হওয়ার আগে কোথাও সুশাসন আসেনি। আমাদের সামাজিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা রূপান্তরের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। আমরা প্রাক্-পুঁজিবাদী অর্থনীতি থেকে পুঁজিবাদের দিকে যাচ্ছি। এই বিবর্তনের কালে কোনো কিছুই স্থিতিশীল হয় না। আমি যদি উন্নত পুঁজিবাদী দেশের আইনকানুন, বিধিব্যবস্থা কায়েম করতে চাই, সেটা কাজ করবে না। নৈরাজ্য দেখা দেবে। উন্নত দেশে মানুষ কেন আইন মানে? কারণ, কোনো উপায় সেখানে নেই। কিন্তু এখানে আপনি আইন মানলেও কাজ হচ্ছে না, আইনের বাইরেও কাজ হচ্ছে না। কারণটা কাঠামোগত। তাই ডিম আগে না মুরগি আগে, উন্নয়ন আগে না সুশাসন আগে, সেই তর্ক করে লাভ নেই।
প্রথম আলো বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা কী বলে?
মুশতাক খান জাপান, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ড—এই দেশগুলোর কোনোটাই সুশাসনের পরীক্ষায় পাস করবে না। এসব দেশে দুর্নীতি অনেক বেশি ছিল, আইনের শাসন ছিল না, সম্পত্তিস্বত্ব দুর্বল ছিল, জবাবদিহি ছিল না। তার পরও কিন্তু এরা দ্রুত উন্নতি করেছে। তার মানে সুশাসন এখানে নির্ধারক নয়। বরং তাদের অন্য একধরনের শাসন ছিল, যাকে আমি উন্নয়নমুখী শাসন বা ডেভেলপমেন্টাল গভর্নেন্স বলি। এটা কিন্তু গুড গভর্নেন্স নয়। চীনে, দক্ষিণ কোরিয়ায় খুবই শক্তিশালী উন্নয়নমুখী শাসন ছিল। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও আমাদের সেটাই প্রয়োজন।
প্রথম আলো এসব দেশের উন্নতির প্রথম যুগে তো মুক্তবাজার ছিল না। তাদের বেলায় বাজার ও রাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্ক কেমন ছিল?
মুশতাক খান ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইউরোপে শিল্প-পুঁজিবাদের শুরুর সময় বাজার অর্থনীতির মধ্যে দিয়েই প্রযুক্তিগত উন্নয়নের চাপ এসেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমরা দেখলাম, বিশ্ব অর্থনৈতিক-ব্যবস্থা দারুণভাবে পাল্টে গেছে। ইউরোপীয় শিল্প পুঁজিবাদের সঙ্গে আমাদের ব্যবধান বেড়ে গেছে। আমাদের শ্রমের মূল্য শূন্যের কোঠায় চলে এলেও উৎপাদন ক্ষমতার ঘাটতির জন্য আমরা বিশ্ববাজারে টিকতে পারব না, পারছি না। শুধু বাজার অর্থনীতি ও সস্তা শ্রম দিয়ে হচ্ছে না। যাঁরা সুশাসনের কথা বলেন, তাঁরা মনে করেন আইনের শাসন, সম্পত্তির অধিকার এবং বাজার অর্থনীতি থাকলেই সস্তা শ্রমের টানে পুঁজি এখানে আসবে। আর সেই পুঁজি বিনিয়োগের মাধ্যমে আমাদের উন্নতি হবে। জাপান, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া ও চীন শুধু বাজারের ওপর নির্ভর করে সফল হয়নি। উন্নত দেশের শিল্পের সঙ্গে স্থানীয় শিল্প প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা অর্জনের আগের একটি সময় সেখানে রাষ্ট্রের সরাসরি ভূমিকা ছিল। উন্নয়নমুখী শাসনের এটাও শর্ত। রাষ্ট্র বললে রাজনীতির কথাটাও চলে আসবে। রাজনীতি কী করে? বাজারের মাধ্যমে যে সম্পদের লেনদেন চলছে, তার ভারসাম্যহীনতা সমাজে অস্থিতিশীলতা তৈরি করে। তখন সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য রাজনীতির হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয়। যদি বাজার আপনাআপনি এই স্থিতিশীলতা রাখতে পারত, তাহলে রাজনীতির মাধ্যমে সম্পদের পুনর্বণ্টনের কর্মসূচি নেওয়ার প্রয়োজন হতো না।
প্রথম আলো আপনি পোশাকশিল্প নিয়ে কাজ করেছেন। বাংলাদেশের অল্প কটি সাফল্যের শিক্ষা কী?
মুশতাক খান বাংলাদেশ, ভারত, থাইল্যান্ড, তানজানিয়াসহ কয়েকটি দেশের ওপর গবেষণায় আমি দেখেছি, বাংলাদেশের গার্মেন্ট খাত, ভারতে ওষুধ ও গাড়িশিল্প, থাইল্যান্ডে ইলেকট্রনিকসসহ আরও কয়েকটি খাতের বিকাশ মুক্তবাজার অর্থনীতির নিয়মে বোঝা যাবে না। প্রতিটি ক্ষেত্রে কয়েকটি সৌভাগ্যদায়ী দুর্ঘটনা ঘটেছিল, যার ফলে কিছু সুযোগ তৈরি হয়েছিল এবং তারা ‘করতে করতে শেখার’ ব্যাপারটি ঘটাতে পেরেছিল। সে সময়ের রাষ্ট্র ও সরকার সেখানে ধাত্রীর ভূমিকায় ছিল। এই অস্বাভাবিক সাফল্য হতো না ওই বিশেষ সুযোগ ছাড়া। তিন-চার বছর কোটামুক্ত অবস্থার পর আমেরিকা দেখল, বাংলাদেশ গার্মেন্টে পটু হয়ে গেছে, অতএব কোটা বসিয়ে দিল। কিন্তু তত দিনে বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে গেছে। এই সুযোগ দরকার ছিল খুব অল্প সময়ের জন্য, কিন্তু তা অপরিহার্য ছিল। মুক্তবাজার অর্থনীতির সমর্থকেরা বলেন, এই সাফল্য মুক্তবাজারের। আমি কিন্তু উল্টোটা শিখছি। বাজার আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু ওই সুযোগ, যোগাযোগ ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া সফলতা আসত না।
প্রথম আলো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া উন্নয়নমুখী শাসন কীভাবে সম্ভব?
মুশতাক খান একটা অগ্রসর অর্থনীতির দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা কীভাবে টিকে থাকে? সেখানে আয়ের ৩৫-৫০ শতাংশ সরকার কর হিসেবে নিয়ে যাচ্ছে এবং এর বেশির ভাগই আবার জনগণের নানান অংশের মধ্যে পুনর্বণ্টিত হচ্ছে। এত বিপুল করের অর্থ কীভাবে পুনর্বণ্টিত হবে, তা নিয়ে সেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা হয়। সেই উদ্দেশ্যেই ইশতেহার রচিত হয় এবং লোকে সংসদে যান। রাজনীতি ও গণতন্ত্র সেখানে এই পুনর্বণ্টনের বিষয় ছাড়া আর কিছু নয়।
আমাদের পাঁচ থেকে সাত শ ডলারের জিডিপির পুরোটাই সেনাবাহিনীর আর আমলা-কর্মচারীদের বেতনের পেছনে ব্যয় হয়ে যায়। বিনিয়োগ ও অবকাঠামো নির্মাণের জন্য পয়সা থাকে না। সেটা হয় ঋণ নিয়ে বা সাহায্যের টাকায়। তাহলে করের টাকার পুনর্বণ্টন করছি কোথায়? আমি কিসের জোরে ক্ষমতায় থাকব? আমার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা কোথা থেকে আসবে? গরিব দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা সংসদের মাধ্যমে সম্পদের পুনর্বণ্টনের মাধ্যমে আসে না। যে কারণে পুনর্বণ্টনের রাজনীতি তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে আসে বাজেটের বাইরে থেকে, দুর্নীতির মাধ্যমে। ক্ষমতায় এলে আমাকে সামাজিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করতে হবে। সেটা করব কী দিয়ে? টাকা তো নেই। তখন আমি দেশের সব গুন্ডা-মাস্তান তথা উগ্র প্রকৃতির লোকগুলোকে কিনে ফেলব। আমরা এক পার্টি গুন্ডা-মাস্তান-গডফাদারদের কিনে ফেলব। আরেক পার্টিও তার মতো সশস্ত্র ক্ষমতা কিনবে। কেউ যদি বেশি দাম চায়, তাহলে তাকে বলব চলে যাও। সে তখন অন্য দলে যাবে। বা তাকে আমি র্যা ব দিয়ে মেরে ফেলব। আমার কাজ হচ্ছে, এসব গুন্ডা-মাস্তানদের ঠান্ডা রাখার মাধ্যমে সমাজকেও ঠান্ডা রাখব। স্থিতিশীলতা থাকছে যেহেতু মাস্তান ও গডফাদারদের টাকা বানাতে সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। হিসাবটা হচ্ছে, স্বল্পতম টাকায় সর্বোচ্চ পরিমাণ সশস্ত্র ক্ষমতা কেনা। এ জন্যই সুযোগ-সুবিধার বিনিময়ে রাজনীতিতে লোক কেনাবেচা চলে। এটা ভারত-পাকিস্তান-নাইজেরিয়া সবখানেই হচ্ছে। একে আমি বলছি ক্লায়েন্টেলিস্ট পলিটিকস বা পৃষ্ঠপোষণের রাজনীতি।
প্রথম আলো অনেকে এই পৃষ্ঠপোষণের রাজনীতিকেই দুর্নীতির কারণ বলে মনে করেন।
মুশতাক খান বিভিন্ন ধরনের পৃষ্ঠপোষণের রাজনীতি আছে। দেখার বিষয় হচ্ছে, এই পৃষ্ঠপোষণের রাজনীতির সাংগঠনিক রূপ কী? চীনে আছে একদলীয় শাসন, ভারতে ও বাংলাদেশে বহুদলীয় শাসন। এর বাইরে আছে সামরিক শাসন বা বিদেশি শাসন। উন্নয়ন হবে কি হবে না, তা এই ধরনগুলোর ওপর নির্ভর করে। ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের দুটি প্রধান পার্টির দুর্নীতি আমাদের ছাপিয়ে যাবে। দুজনেই ক্ষমতায় এসে প্রতিপক্ষকে হয়রানি করে জেলে ভরে। কিন্তু এই রাজ্যের প্রবৃদ্ধি ৮-৯ শতাংশ একটানা। সবচেয়ে বিদেশি বিনিয়োগ আসে সেখানে। অবকাঠামো উন্নয়নে ভারতের মধ্যে সেরা। জ্বালানি শক্তি উৎপাদন আমাদের থেকে তিন গুণ বেশি অথচ জনসংখ্যা অর্ধেক। কেন তারা পারছে? এর উত্তর হলো, তারা তাদের পৃষ্ঠপোষণের রাজনীতিটাকে নতুন করে সাজিয়েছে। তাদের মধ্যে ন্যূনতম সমঝোতা হয়েছে যে আমি যদি তোমাকে ধ্বংস করি, তাহলে তুমিও আমাকে ধ্বংস করবে। তাতে দুজনেরই ক্ষতি। এখন তারা পালা করে পাঁচ বছর পরপর টাকা বানানোর সমঝোতায় পৌঁছেছে। এই সমঝোতা পরের ধাপ হলো, আমলাতন্ত্রের কিছু ক্ষেত্র যেমন, অবকাঠামো নির্মাণ, শক্তি উৎপাদন ইত্যাদিকে তারা দুর্নীতিমুক্ত করে দিয়েছে। তারা বুঝেছে, যদি বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ে, রাস্তাঘাটের উন্নতি হয় তাহলে দুজনেরই লাভ। টাকা বানাতে চাইলে আমরা অন্য জায়গায় বানাব। তাদের আমলারা কারিগরিভাবে দক্ষ। দলের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ আছে। নিচের সারির বা ক্ষমতার কাছাকাছি কেউ উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারে না। তাই পৃষ্ঠপোষণের রাজনীতিরও খারাপ-ভালো আছে। আমাদের এই শিক্ষাগুলো নিতে হবে।
প্রথম আলো কিন্তু এখানে কেন এ ধরনের সমঝোতা হতে পারছে না?
মুশতাক খান আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব দুর্বল হয়ে গেছে। তারা আর তাদের লোকদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। পদ্মা সেতুর কথাই ধরুন, দলের লোকদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার জন্য অনেক বিরাট ক্ষতি হয়ে গেল। অথচ এটার সুফল আমাদের জন্য অনেক মিলিয়ন ডলারের হতো। দলের জন্যও নির্বাচন জেতা সহজ হতো। আমাদের দুটি দলের ভেতরে শৃঙ্খলা নেই। আমাদের তো সফল পৃষ্ঠপোষণের রাজনীতি থেকে শিখতে হবে। সুশাসনের রাজনীতি থেকে আমরা কিছু শিখতে পারব না। এখন রাজনীতি অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে। নতুন নতুন লোক আসছে রাজনীতিতে, যারা নিয়ন্ত্রণে থাকছে না। নতুন গণতন্ত্রে রাজনীতি ও রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে। লুটপাটের শক্তি দল ও রাষ্ট্রে প্রধান হয়ে উঠছে। উৎপাদন ও বিনিয়োগের মাধ্যমে পুঁজি গঠনের সুযোগ কমে যাচ্ছে।
প্রথম আলো কিন্তু আমাদের ক্ষমতাবান শ্রেণীগুলোর মধ্যকার অন্তর্বিরোধ ও অস্থিতিশীলতার পরিবেশে সুদূরপ্রসারী কোনো গঠনমূলক ভূমিকা পালন কী সম্ভব?
মুশতাক খান আমরা এখনো রূপান্তরকাল পার করিনি। আমাদের উদীয়মান পুঁজিবাদীরা অর্থের দিক থেকে, সংখ্যার দিক থেকে, রাজনৈতিক ক্ষমতার দিক থেকে এই সমাজের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। এটাকে একধরনের পৃষ্ঠপোষণমূলক ব্যবস্থা বলছি। অর্থাৎ ক্ষমতায় থাকতে হলে মধ্যবর্তী শ্রেণী যারা—যেমন, ধনী কৃষক, শিক্ষিত শহুরে মধ্যবিত্ত, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়া শিক্ষিত অংশ, মধ্য-কৃষক এদের খুশি করে চলতে হচ্ছে। এরা জনগণের বড় অংশকে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখে। তৃতীয় দুনিয়ার সর্বত্র এটা দেখা যায়। আমাদের ধরন হলো, এখানে এরা জমাট বাঁধেনি। এর ভেতর থেকে আদিম লুণ্ঠনের পথে একটা কোটিপতি শ্রেণী বেরিয়ে এসেছে। ওপরতলায় যারা এই পদ্ধতিতে পুঁজিপতি হয়েছে, তাদের মধ্যে অদ্যাবধি দেশ চালানো নিয়ে কোনো সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ভারতেও এই সমস্যা রয়েছে। কিন্তু ভারতে স্থায়ী একটা আমলাতন্ত্র আছে, যারা দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়ায় বিকশিত হয়েছে। এই আমলাতন্ত্র রাষ্ট্রীয় নীতিকে এমন স্থায়ী মাত্রা দিয়েছে যে এক দলের সরকার অন্য দলের সরকারের সব কর্মসূচি বাতিল করে দিতে পারে না। এটাকে কিন্তু সুশাসনের সঙ্গে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। সত্যিকার অর্থে যদি রাজনৈতিক দুর্নীতি কমাতে চাই, তাহলে আমাদের সম্পদের পুনর্বণ্টনের বিকল্প উৎস ও পথ বের করতে হবে।
প্রথম আলো এ মুহূর্তে তাহলে আমাদের করণীয় কী?
মুশতাক খান অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা, নীতি ও কৌশল ঠিক করতে হবে। প্রবৃদ্ধি আরও ২ শতাংশ বাড়াতে বিপুল পরিবর্তন ঘটাতে হবে। অর্থনীতি পুরোটাই লুটপাটের দিকে চলে গেলে টাকা বিদেশে চলে যাবে, উৎপাদনে বিনিয়োজিত করা যাবে না। গার্মেন্ট শিল্পের মতো করে ইলেকট্রনিক শিল্পগুচ্ছ তৈরির দিকে যেতে হবে। তার জন্য নতুন প্রযুক্তি আনতে হবে। গার্মেন্ট খাতে প্রশিক্ষিত লোক তখন ইলেকট্রনিক খাতে আসবে। প্রথম দু-তিনটি কারখানায় সম্মিলিত উদ্যোগে সফলতা এলে তার অজস্র অনুকরণ হবে। গার্মেন্ট খাতেও এটাই হয়েছিল। সুতরাংশিল্পনীতি ঠিক করতে হবে, সৃষ্টি করতে হবে শিল্পপার্ক। দরকার অধিকতর দক্ষ রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা, যেখানে সর্বোচ্চ নেতৃত্ব রাজনৈতিক সদিচ্ছা, দক্ষতা ও দূরদর্শিতা নিয়েসব বাধা দূর করবে। দুই দলকে এর জন্য একটা সমঝোতায়আসতেই হবে। কিছু কিছু লক্ষ্যভিত্তিক বিনিয়োগ লাগবে। তার জন্যরাজনৈতিক নিষ্ঠাবান নজরদারি দরকার। এভাবে চলতে পারলে নতুন আরও দুই-তিনটি খাত বেরিয়েআসবে। বড় লক্ষ্যের দরকার নেই, নতুন দুই-তিনটি পাওয়ার স্টেশন আর দুই-তিনটি খাতের বিকাশ চাই।
দুর্নীতি একেবারে দূর করতে হলে দুর্নীতিকেন্দ্রিক রাজনীতিটাই উন্নয়নকেন্দ্রিক রাজনীতি দিয়ে বদলে ফেলতে হবে। তার জন্য কী ধরনের স্লোগান দরকার, কী ধরনের প্রতিষ্ঠান করব, কী ধরনের রাষ্ট্র গড়ব—সেগুলো স্পষ্ট করতে হবে। এ জন্য পার্টিগুলোকে পুনর্গঠিত করতে হবে। তাদের উন্নয়নমুখী করতে হবে। তার জন্য সফলতার কাহিনিগুলো থেকে শিখতে হবে এবং জানতে হবে যে বাংলাদেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক বন্দোবস্তের মধ্যে কোন মডেল বেশি কার্যকর। রাজনীতিবিদদের নিজেদের স্বার্থেই এই উপলব্ধিতে আসতে হবে। সেই উপলব্ধিটাকেই বলছি উন্নয়নমুখী শাসনের নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের শর্ত।
প্রথম আলো আপনাকে ধন্যবাদ।
মুশতাক খান ধন্যবাদ।
No comments