থ্রিজি প্রযুক্তি- উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় নতুন সুযোগ by এ এইচ এম কামাল

প্রযুক্তিপণ্য তৈরির শিল্প আমাদের দেশে এখনো বলার মতো করে গড়ে ওঠেনি। তবে প্রযুক্তির ব্যবহার ও প্রসারে আমরা এগিয়ে চলেছি দ্রুত পায়ে। আর সেই সব প্রযুক্তিপণ্য আমাদের মতো করে ব্যবহারের জন্য আমাদের প্রযুক্তিবিদেরা উদ্ভাবন করে চলেছেন নতুন নতুন কায়দা-কানুন, যা মুঠোফোননির্ভর প্রযুক্তি হিসেবেই বিকশিত হচ্ছে।
এই প্রয়াসকে আরও কার্যকর করে তোলার পেছনে সহায়ক হিসেবে কাজ করবে টেলিটকের যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত থ্রিজি প্রযুক্তিকে বরণ। এর মাধ্যমে সারা দেশ আরও এক ধাপ এগোল। আমাদের তথ্যপ্রযুক্তি পেল তার বিকাশের নতুন ক্ষেত্র। এই সুযোগকে দেশ গড়ার কাজে ব্যবহারের জন্য একজন প্রযুক্তিবিদ হিসেবে সরকারের কাছে কয়েকটি প্রস্তাব রাখছি।
১. টেলিটকের থ্রিজি প্রযুক্তি অনেক গতিসম্পন্ন। এর সর্বত্র সংযোগ পুরো জাতির জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। আমাদের দেশের ৩ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে (তথ্যসূত্র: ২০১১, আইটিইউ)। পক্ষান্তরে প্রায় ১০ কোটি (প্রায় ৬৬ শতাংশ) মানুষ মুঠোফোন ব্যবহারে অভ্যস্ত। টেলিটকের থ্রিজি প্রযুক্তির বদৌলতে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৩ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৬৬ শতাংশে উন্নয়ন করা সম্ভব।
২. তা ছাড়াও প্রায় মোট জনসংখ্যার ৬ থেকে ১০ শতাংশই ছেলেমেয়ে, যারা সপ্তম থেকে দ্বাদশ শ্রেণীতে অধ্যয়নরত। তাদের ইন্টারনেটে অভ্যস্ত করতে পারলে এই হার হতে পারে ৭০ শতাংশের বেশি । এই ৬ থেকে ১০ শতাংশ ছেলেমেয়েকে জাতি গঠনের উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য শিক্ষার উপযুক্ত সুযোগ-সুবিধাও জোগান দিতে হবে। কাজটি সহজতর করার জন্য আমার প্রস্তাবটি এমন যে থ্রিজি প্রযুক্তির মাধ্যমে ক্লাস উপকরণগুলোকে মুঠোফোনের আওতায় নিয়ে আসা। এ ক্ষেত্রে সপ্তম থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত সব শ্রেণীর এবং সব বিষয়ের লেকচার স্লাইড তৈরির উদ্যোগ সরকারকেই নিতে হবে। অতঃপর এসব স্লাইডকে কোনো একটা ওয়েব ঠিকানায় রেখে দিতে হবে, যা নিয়ন্ত্রিত হবে শুধুই শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক। এদিকে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের হাতে থ্রিজি প্রযুক্তির মুঠোফোন তো থাকছেই। শিক্ষক শ্রেণীকক্ষে প্রবেশ করেই হাইস্পিড সংযোগের মাধ্যমে সেই নির্ধারিত ওয়েব ঠিকানায় চলে যাবেন। মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরে প্রদর্শিত হতে থাকবে সুবিন্যস্ত পাঠ্যক্রম। বাসায় ফিরে শিক্ষার্থী তার প্রয়োজন অনুসারে আবার একই ওয়েব ঠিকানায় রিভাইস করে নেবে তার ক্লাসের বিষয়বস্তু। তখন গ্রাম, শহর চলবে একই মানে।
৩. আমাদের দেশে চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা যথেষ্ট থাকলেও এর সুফল পাচ্ছে না সাধারণ মানুষ। তবে টেলিটকের থ্রিজি প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে চিকিৎসাসেবাকে গ্রাম পর্যায়ের মানুষের হাতের নাগালে নিয়ে আসা সম্ভব। প্রতিটি হাসপাতালের প্রতিটি বিভাগে একটি করে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর থাকবে। প্রজেক্টরের আউটপুট হবে একটি থ্রিজি সিমের ভিডিও কল। থ্রিজি সিমের নম্বরগুলো হবে বিশেষ সিরিজের যেমন: 01xxxyyyyyz। এখানে xxx হচ্ছে ভেন্ডর কোড যেমন: ৭৭৭, ৯৯৯, ১১১ ইত্যাদি। yyyyy হবে ১০টি হাসপাতালের নম্বর। উদাহরণস্বরূপ ৯৯৯৯৯ হচ্ছে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কোড। আবার z হবে হাসপাতালের ১০টি বিভাগের কোড। আশা করা যায় যে ভেন্ডরদের সঙ্গে কথা বলে এমন সব নম্বর জোগাড় করা সম্ভব। উক্ত বিষয়টি সমাধানের পর করণীয় হচ্ছে বিশিষ্ট এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের শিডিউল বিটিভি, পত্রিকা বা এসএমএসের মাধ্যমে জনসাধারণকে জানিয়ে দেওয়া। এবার গ্রাম পর্যায়ের মানুষ থ্রিজি প্রযুক্তির মাধ্যমে ভিডিও কল করবে তার পছন্দের কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসককে। চিকিৎসক রোগীর লক্ষণ প্রজেক্টর স্ক্রিনে দেখে এবং রোগের বিবরণ শুনে প্রয়োজনীয় প্রায়োগিক সিদ্ধান্ত দেবেন।
৪. থ্রিজির আরও একটি প্রায়োগিক জায়গা হতে পারে সমাজসচেতনতা বৃদ্ধিমূলক প্রচারণায়। কাজটি সফলতার সঙ্গে করার জন্য প্রথমেই উচিত কার্টুনের ছোট ছোট ভিডিও ক্লিপ তৈরি করা। এসব কার্টুন হবে সমাজসচেতনতামূলক, শিশুদের শিক্ষামূলক অথবা তাদের মোটিভেট করার উদ্দেশ্যে তৈরি করা। আবার নির্বাচনের সময়, দেশের দুর্যোগের মুহূর্তে অথবা সরকারি কোনো বিশেষ কাজে জনসাধারণের কাছে বার্তা পৌঁছে দিতে প্রতিবেদনমূলক কার্টুন তৈরি করা যেতে পারে। এ-জাতীয় কার্টুন সরকারি কোনো ওয়েব ঠিকানায় রেখে দেওয়া হবে। অতঃপর সর্বসাধারণ তা সেই ওয়েব ঠিকানা থেকে তাদের থ্রিজি সাপোর্টেড মুঠোফোনে দেখে নেবে। তবে এ ক্ষেত্রে এই নির্ধারিত ওয়েব ঠিকানা ব্রাউজিংয়ে ডেটা ট্রান্সফার রেট শূন্য করা যেতে পারে।
৫. কৃষি বিষয়েও থ্রিজি প্রযুক্তি কাজে লাগানো সম্ভব। কৃষি মন্ত্রণালয়ের এক বা একাধিক সেবাকেন্দ্র থাকবে। সেই সব সেবাকেন্দ্রের জন্য নির্ধারিত নম্বর থাকবে। তখন কৃষকেরা তাঁদের মুঠোফোন থেকে সবজি বা ফসলের রোগ বিষয়ে নির্ধারিত নম্বরে ভিডিও কল করে প্রয়োজনীয় সমাধান চেয়ে নেবেন।
৬. যানজটের কষ্ট লাঘবে অবদান রাখাও এই প্রযুক্তির মাধ্যমে সম্ভব। আর তা পেতে হলে ঢাকার প্রতিটি মোড়ে একটি করে সিসিটিভি ক্যামেরা বা ওয়েব ক্যাম টাইপের ক্যামেরা বসাতে হবে। এমনভাবে বসানো থাকবে যে ক্যামেরার ভিডিও ডেটা একটি থ্রিজি সিম পড়তে পারবে। তখন এই নম্বরে কল করলেই যে কেউ তাঁর মুঠোফোনে সেই মোড়ের ভিডিও দেখতে পাবেন। আর তা দেখেই একজন গাড়িচালক প্রয়োজনে বিকল্প পথে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। তাহলে দৈনিক অনেক কর্মঘণ্টা নষ্ট হওয়া রোধ করা সম্ভব।
৭. অপরাধীকে ধরতেও এই প্রযুক্তি কাজে লাগানো যেতে পারে। ধরা যাক যে পুলিশের একটি বিশেষ নম্বর থেকে একজন সন্ত্রাসীকে কল করা হলো। সন্ত্রাসীর সিম তার অজান্তেই তার অবস্থানের আশপাশের ছবি তুলে পুলিশের সিমে পাঠিয়ে দিল। তখন হয়তো সন্ত্রাসীর অবস্থান সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে। এমন সুবিধা পেতে হলে সিম অপারেটিংয়ে একটি বাড়তি মডিউল (ছোট প্রোগ্রাম) যোগ করতে হবে, যা বিশেষ কিছু নম্বর থেকে কল এলে সিম ওনারের অজান্তেই লাইভ ভিডিও ডেটা সরবরাহ করবে। আর সরকার কর্তৃক ভেন্ডরদের আদেশ করা হলেই তারা এমন ব্যবস্থা নেবে।
উল্লিখিত কয়েকটি থ্রিজি প্রযুক্তির প্রায়োগিক দিক দেশের উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে। কাজেই সরকারের দায়িত্বশীল মহলকে এ ব্যাপারে আন্তরিক হতে হবে। আর একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনে আরও মনোনিবেশ করতে হবে, যেন থ্রিজি প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে দেশ গড়ায় সক্রিয় ভূমিকা রাখা যায়।
এ এইচ এম কামাল: বিভাগীয় প্রধান, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ।
kamal@jkkniu.edu.bd

No comments

Powered by Blogger.