সংসদে তোপের মুখে স্বাস্থ্য ও শিৰা মন্ত্রী- আমলা-ডিজির ওপর নিয়ন্ত্রণ না থাকার অভিযোগ তুললেন দলীয় এমপিরাই
সরকারী নিয়োগ, এমপিওভুক্তিসহ নানা ইসু্যতে সোমবার দলীয় এমপিরা স্বাস্থ্য ও শিৰামন্ত্রীর কঠোর সমালোচনা করেছেন। বিশেষ করে স্বাস্থ্য সহকারী নিয়োগ নিয়ে রীতিমতো তোপের মুখে পড়তে হয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. আফম রম্নহুল হককে।
অধিকাংশ এমপির অভিযোগ, আমলাদের কারসাজিতে পরীৰার নামে আওয়ামী লীগ নয়, বিএনপি-জামায়াত সমর্থকরাই চাকরি পাচ্ছে। এৰেত্রে আমলা-ডিজিদের ওপর মন্ত্রীদের নিয়ন্ত্রণ নেই। জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনিয়ম, দুর্নীতির উর্ধে থেকে আইন মেনে কাজ করার জন্য দলীয় সংসদ সদস্যদের প্রতি আবারও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। বলেছেন, কারোর বিরম্নদ্ধে কোন ধরনের অনিয়ম, দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে তা সহ্য করা হবে না। কেউ আইনের উর্ধে ওঠার চেষ্টা করলে তা বরদাশত করা হবে না। সরকারী চাকরিসহ কোন বিষয়েই অনিয়ম সহ্য করা হবে না। বিএনপি-জামায়াত জোটের মতো সরকারী নিয়োগে দলীয়করণে মহাজোট সরকার বিশ্বাস করে না। নিয়ম মেনে মেধার ভিত্তিতেই সর্বৰেত্রে নিয়োগ হবে।নবম জাতীয় সংসদের এক বছর পূর্তি উপলৰে সোমবার আওয়ামী লীগের জরম্নরী সংসদীয় দলের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী এ হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন বলে সভা সূত্রে জানা গেছে। সূত্র জানায়, দলীয় সংসদ সদস্যদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, বিএনপি বিপুল বিজয় নিয়ে ৰমতায় এসেছিল, কিন্তু দুবর্ৃত্ত হয়ে বিদায় নিয়েছে। আমরা সে ধরনের কোন নজির সৃষ্টি করতে চাই না। তাই দলের কোন এমপির বিরম্নদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতি বা বড় কোন অভিযোগ বরদাশত করা হবে না। দলীয় এমপিসহ সহযোগী সংগঠনের উদ্দেশে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে তিনি বলেন, আইন সবার জন্য সমান। কেউ-ই আইনের উর্ধে নয়। তাই কেউ যাতে আইনের উর্ধে ওঠার চেষ্টা না করে। করলে ৰমা করা হবে না।
বেলা ৩টায় সংসদ ভবনের নবম তলার সরকারী দলের সভাকৰে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের সভায় সভাপতিত্ব করেন দলের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সভায় সরকারী চাকরিতে দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়োগ, এমপিদের শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানি, ১৫ কোটি টাকা থোক বরাদ্দ নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করেন দলীয় সংসদ সদস্যরা। তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে স্বাস্থ্য সহকারী নিয়োগ এবং এমপিওভুক্তি নিয়ে দলীয় সংসদ সদস্যদের তোপের মুখে পড়তে হয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও শিৰামন্ত্রীকে। এ নিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. আফম রম্নহুল হক নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা দিতে উঠলে এমপিদের প্রতিবাদের মুখে বক্তব্য অসম্পন্ন রেখেই তাঁকে বসে পড়তে হয়। কৃষি মন্ত্রণালয়ের জামায়াত সমর্থকদের নিয়োগ নিয়েও দু'একজন সাংসদ ৰোভ প্রকাশ করেন বলে জানা গেছে।
সভাসূত্র জানায়, দলীয় সংসদ সদস্যদের সতর্ক করে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিরোধী বিএনপি ও জামায়াত ঘাঁপটি মেরে বসে আছে। সুযোগ পেলেই সরকারবিরোধী আন্দোলন করার চেষ্টা করবে। এজন্য দলের প্রতিটি নেতাকর্মীকে সতর্ক থাকতে হবে, দলকে তৃণমূল পর্যায়ে শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে হবে। তিনি প্রতিটি সংসদীয় এলাকায় এমপিদের অনুকূলে বরাদ্দকৃত ১৫ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প ঠিকমতো বাসত্মবায়নের নির্দেশ দেন।
সূত্র জানায়, বৈঠকের শুরম্নতেই প্রারম্ভিক বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এতে তিনি দলীয় সংসদ সদস্যদের নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় রাজনৈতিক ও সাংগঠনিকভাবে তৎপর থাকার নির্দেশ দেন। বিরোধী দল যাতে আন্দোলনের কোন ইসু্য সৃষ্টি করতে না পারে সে ব্যাপারেও সবাইকে সতর্ক থাকতে বলেন। এছাড়া বিভিন্ন বিষয়ে তোফায়েল আহমেদ, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, স্বাস্থ্যমন্ত্রী আফম রম্নহুল হক, হুইপ আসম ফিরোজ, এ্যাডভোকেট ফজলে রাবি্ব মিয়া, আতিউর রহমান আতিক, জয়নাল আবেদীন, মাহবুব আরা গিনিসহ মোট ৮ সংসদ সদস্য বক্তব্য রাখেন।
সোমবার ছিল অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের ৭৬তম জন্মদিন। বিষয়টি আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা তোফায়েল আহমেদ বৈঠকে অবহিত করলে প্রধানমন্ত্রীসহ সকল সংসদ সদস্য হাততালি দিয়ে অর্থমন্ত্রীকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানান। এ উপল েবৈঠকে সবাইকে মিষ্টিমুখ করিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি দুষ্টুমির ছলে বলে ওঠেন, অর্থমন্ত্রীর বয়স ৭৬ থেকে ২৬-২৭ হয়েছে। এই বক্তব্যে সবাই একযোগে হেসে ওঠেন। এছাড়া বৈঠকে এমপিদের নানা অভিযোগ-দাবির বিষয়ে জবাব দেন প্রধানমন্ত্রী।
সভাসূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা তোফায়েল আহমেদ প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর নিয়ে বিরোধী দলের অপপ্রচারের বিষয়টি উলেস্নখ করে দু'দেশের মধ্যে সম্পাদিত সমঝোতার যৌথ ইশতেহার নিয়ে সংসদে একদিন সাধারণ আলোচনার প্রসত্মাব দেন। প্রধানমন্ত্রী তাতে সম্মতি জানিয়ে বলেন, এই অধিবেশনেরই যে কোন একদিন এটা নিয়ে আলোচনা হতে পারে।
সূত্র জানায়, সভায় স্বাস্থ্য, শিৰা ও কৃষি মন্ত্রণালয়ে সরকারী নিয়োগ নিয়ে একাধিক সংসদ সদস্য ৰোভ প্রকাশ করেন। সবচেয়ে বেশি তোপের মুখে পড়তে হয় স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে। তোফায়েল আহমেদসহ অনেক সংসদ সদস্যই স্বাস্থ্যখাতে স্বাস্থ্য সহকারী নিয়োগ নিয়ে ৰোভ প্রকাশ করে বলেন, প্রশাসনে ঘাঁপটি মেরে থাকা বিএনপি-জামায়াত জোটের নিয়োগকৃত দলীয় আমলারা সরকারকে ব্যর্থ করতে নানা ষড়যন্ত্র করছে। স্বাস্থ্য সহকারী পদে বিএনপি-জামায়াত জোটের লোকেরাই অধিক নিয়োগ পেয়েছে। আওয়ামী লীগের মেধাবীরাও নিয়োগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
এ ব্যাপারে স্বাস্থ্যমন্ত্রীও বিষয়টি সমর্থন করে বক্তব্য রাখার জন্য দাঁড়ালে এমপিরা সমস্বরে প্রতিবাদ জানাতে থাকেন। এছাড়া এমপিওভুক্তি এবং এই মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন গুরম্নত্বপূর্ণ স্থানে দলের লোকের পরিবর্তে অন্য রাজনৈতিক দলের মনোভাবাপন্নদের ভাল ভাল পোস্টিং দেয়া হচ্ছে উলেস্নখ করে শিৰামন্ত্রীর সমালোচনা করেন। এছাড়া কৃষি মন্ত্রণালয়ের অনেক স্থানে এখনও জামায়াতের লোকজন বহাল তবিয়তে রয়েছে অভিযোগ করে ক'জন এমপির অভিযোগ, অনেক মন্ত্রীর নিয়োগের ব্যাপারে তাঁদের অধসত্মন আমলা ও ডিজিদের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই। এই সুযোগে বিএনপি-জামায়াত জোটের দলীয় আমলারা নানাভাবেই স্যাবোটাজ করছে। সাংসদ মাহবুব আরা গিনি এমনও অভিযোগ করেন, তাঁর নির্বাচনী এলাকায় লিখিত পরীৰা না দিয়েও স্বাস্থ্য সহকারী পদে নিয়োগ পেয়েছে। এমপিরা দ্রম্নতগতিতে এই তিন মন্ত্রণালয়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করার দাবি জানান।
বৈঠক শেষে একাধিক এমপি জানান, সভায় এমপিদের এসব ৰোভের জবাবে প্রধানমন্ত্রী দৃঢ়কণ্ঠে বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোট যেভাবে দলীয়করণ করে গেছে, এবার তা হবে না। চাকরির ৰেত্রে দলীয় এমপিদের তদবির বাণিজ্য থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়ে বলেন, আইন অনুযায়ী চাকরি হবে। পরীৰায় যারা পাস করবে তারাই নিয়োগ পাবে। দলীয় নেতাকর্মীদের চাকরি দিতে হলে তাদের আরও বেশি করে পড়াশুনা এবং প্রয়োজনে কোচিং করার ব্যবস্থা করার জন্য দলীয় এমপিদের পরামর্শ দিয়ে বলেন, দেশের জনগণ অনেক প্রত্যাশা নিয়ে আমাদের ভোট দিয়েছে। বিএনপি-জামায়াত জোটের মতো কোন খারাপ নজির আমরা সৃষ্টি করতে চাই না।
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলের মিথ্যা প্রচার-প্রপাগান্ডা সম্পর্কে সজাগ থেকে দেশবাসীর সামনে সত্য বিষয়গুলো তুলে ধরতে জনগণের ঘরে ঘরে গিয়ে তাঁদের সুখ-দুঃখের সাথী হওয়ার জন্য দলীয় এমপিদের নির্দেশ দিয়ে বলেন, "বিরোধী দল অপপ্রচার চালাচ্ছে যে মহাজোট সরকার নাকি সারাদেশের মানুষকে চাকরি দেবে। কিন্তু আমরা কোন সময় তা বলিনি। আমরা প্রতি পরিবারে একজনকে অনত্মত কর্মসংস্থান করার কথা বলেছি। জনগণের কাছে গিয়ে এসব সত্য তুলে ধরতে হবে।"
সূত্র জানায়, বিরোধী দলের মিথ্যা প্রচার-প্রপাগান্ডা সম্পর্কে আলোচনাকালে বিডিআর বিদ্রোহের বিষয়টিও উঠে আসে। সভায় প্রশ্ন রেখে বলা হয়, "বিডিআর বিদ্রোহের মাত্র দু'ঘণ্টা আগে খালেদা জিয়াকে ফোন করে ক্যান্টনমেন্টের বাসা থেকে চলে যাওয়ার জন্য বলেছে তারেক জিয়া। এর পরপরই বিরোধী দলীয় নেত্রী ক্যান্টনমেন্টের বাসা ছেড়ে পুরো তিনদিন নিখোঁজ ছিলেন!" প্রশ্ন হচ্ছে, দু'ঘণ্টা আগেই তারেক জিয়া বিডিআর বিদ্রোহের কথা জানল কিভাবে? অথচ বিএনপি-জামায়াত নানাস্থানে অপপ্রচার চালাচ্ছে আওয়ামী লীগই নাকি এটা করেছে। মহাবিজয় নিয়ে ৰমতায় আসার মাত্র দু'মাসের মাথায় এমন ঘটনা ঘটিয়ে নিজের পায়ে কুড়াল মারবে, এটা পাগলেও বিশ্বাস করবে না বলে মনত্মব্য করেন তিনি।
শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানি প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী জানান, নিয়মের মধ্যে সংসদ সদস্যরা শীঘ্রই সর্বাধিক ৩০০ সিসি পর্যনত্ম গাড়ি আমদানির সুযোগ পাবেন। আগের মতো হবে না। বর্তমান মহাজোট সরকার যাতে ক্রেডিবিলিটি (গ্রহণযোগ্যতা) নিয়ে বিদায় নিতে পারে সেদিকে সকল সংসদ সদস্যদের সতর্ক থাকতে হবে। তিনি জানান, সারাদেশে ব্যাপক উন্নয়ন হচ্ছে। সরকারের ঘোষিত বাজেটের ৬ মাসের বাসত্মবায়ন এবং সাফল্য শীঘ্রই জাতির সামনে তুলে ধরা হবে।
সূত্র জানায়, এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানি নিয়ে যা ইচ্ছে তাই হয়েছে। এবার তা হতে দেয়া হবে না। নির্দিষ্ট সিসির গাড়ি আমদানির সুযোগ দেয়া হবে। আর যারা অসচ্ছল তাঁদের ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে গাড়ি আমদানির সুযোগ দেয়া হবে। তবে গত সংসদে যাঁরা শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানি করেছেন, তাঁরা যেন আর গাড়ি আমদানির ব্যাপারে আবেদন না করেন সে ব্যাপারে নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী জনগণের কাছে যেতে এবং তৃণমূল পর্যায়ে দলকে শক্তিশালী করার নির্দেশ দিয়ে বলেন, আগামী ৩০ জুন বর্ধিত সভায় সকল এমপিরা উপস্থিত থাকতে পারবেন। ওই বৈঠকে সাংগঠনিক বিষয়ে সিদ্ধানত্ম হবে। অবশ্যই তৃণমূল নেতাদেরও মূল্যায়ন করা হবে। বিরোধী দলের সম্ভাব্য আন্দোলন মোকাবেলায় দলকে শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে হবে। সরকার সারাদেশে ব্যাপক উন্নয়ন করছে। ৰমতায় থেকে জনগণকে দেয়া সকল প্রতিশ্রম্নতিই বাসত্মবায়ন করব।
No comments