নির্মমতা-নৃশংসতা-মানবিক মূল্যবোধও জাগিয়ে তুলতে হবে by আবু সাঈদ খান
অপরাধীর যদি উপরতলায় যোগাযোগ থাকে, অর্থ থাকে, তবে খুন-ধর্ষণ-বদমায়েশি করে ছাড়া পাওয়া যায়। দৈবাৎ শাস্তি হলে রাষ্ট্রপতির ফরমানে এমন শাস্তি মওকুফ হওয়ার রেওয়াজও রয়েছে। এর আগে খুনের দায়ে অভিযুক্ত লক্ষ্মীপুরের সন্ত্রাসী তাহেরপুত্র বিপ্লব রাষ্ট্রপতির ক্ষমা পেয়েছে।
বিএনপির শাসনামলেও আলোচিত খুনি ঝিন্টুকে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শন করা হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে সব শাসকের ভূমিকা এক। এভাবে ক্ষমা প্রদর্শন আইনের শাসনের ক্ষেত্রে বড় হুমকি
দেশ এগোচ্ছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা এসেছে, শিক্ষাক্ষেত্রেও এগিয়েছি আমরা। ব্যবসা-বাণিজ্য-বিনিয়োগে অগ্রগতি লক্ষণীয়। প্রবৃদ্ধি সন্তোষজনক। সামাজিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে তরুণদের অংশগ্রহণ এখন সহজেই চোখে পড়ে। দেশের দামাল ছেলেমেয়েরা এভারেস্টের চূড়ায় উড়িয়েছে জাতির পতাকা। সব ক্ষেত্রেই তারুণ্যের পদচারণা, অদম্য সাহস আর মেধার পরাকাষ্ঠা, অর্জনের প্রতিযোগিতা। এ সবকিছুই আমাদের আশাবাদী করে। কিন্তু সবই কি ইতিবাচক? নেতিবাচক রাজনীতি চর্চার বাইরেও একের পর এক ঘটে যাওয়া নৃশংস ঘটনা, নির্মমতা, বর্বরতা, অমানবিকতা আমাদের কেবল ব্যথিতই করে না, হতাশায় মুহ্যমান করে তোলে।
দু'দিন আগে খোদ রাজধানীর তোপখানায় এক ঘরে বৃদ্ধা মায়ের হাত-পা-মুখ বেঁধে রেখে অন্য ঘরে তার মেয়ে নিশাত বানুকে নির্মমভাবে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। সাইদুর রহমান তার প্রেমিকা সুস্মিতাকে কী নৃশংসভাবে হত্যা করে টুকরো টুকরো করেছে তা বর্ণনা করার মতো নয়। এ নিবন্ধ যখন লিখছি, তখন সংবাদপত্রে দেখলাম দিন-দুপুরে সিলেটের দলইপাড়া গ্রামে এক দাদি ও নাতনির খুন হওয়ার মর্মান্তিক ঘটনা। প্রায় প্রতিদিনই সংবাদপত্রে, বৈদ্যুতিন মাধ্যমে এমন নৃশংস ঘটনার খবর প্রচারিত হচ্ছে। এমন বর্বরতার ঘটনা অতীতেও ঘটেছে, কিন্তু তা এখন মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। তার চেয়ে বড় কথা, নৃশংস হত্যাকাণ্ডগুলোর কোনো প্রতিকার হচ্ছে না। কে করবে? রাষ্ট্র নির্বিকার। সমাজ ফুঁসে উঠছে না। সবকিছুই যেন গা সওয়া। এর আগে হত্যা-খুনের ঘটনায় পুলিশি যে তৎপরতা দেখা যেত, এখন তা হয় না। প্রতিবাদ-বিক্ষোভ তেমনটা আর দেখা যায় না। আমরা যেন ধরে নিয়েছি যে, এমন ঘটনা ঘটবেই।
প্রতিকারের দায় কার_ রাষ্ট্র ও সমাজ উভয়েরই। তবে আইনানুগ পদক্ষেপ নিতে হবে রাষ্ট্রকেই। কিন্তু রাষ্ট্র কতটুকু সক্রিয়! সব হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে মামলা হয়, পুলিশ অপরাধীদের গ্রেফতারও করে। কিন্তু আইনের ফাঁকফোকর গলে অপরাধীরা ছাড়া পেয়ে যায়। প্রতিপক্ষ দুর্বল হলে মামলা নেওয়া হয় না, এমনভাবে মামলা সাজানো হয় যাতে অপরাধীদের শাস্তি না হয়। তোপখানার নিশাত হত্যাকাণ্ডে পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, মা খালেদা বানু আসামিদের নাম উল্লেখ করলেও পুলিশের তথ্য বিবরণীতে (এফআইআর) আসামির ছকে তাদের নাম নেই। শুধু তাই নয়, অভিযুক্তদের জিজ্ঞাসাবাদের পর থানা থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এসব ঘটনা থেকে অপরাধীদের শাস্তির ব্যাপারে যে কেউ সন্দিহান হয়ে উঠবেন। প্রতিনিয়ত এমন অনেক ঘটনাই ঘটছে যেগুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের সংশ্লিষ্টতা নেই। ফলে রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর প্রশ্ন সেখানে ওঠে না। তবুও দেখা যায়, অনেকক্ষেত্রেই পুলিশ অপরাধীদের ছাড়া পাওয়ার রাস্তা করে দেয়। পুলিশের এই মনোভাবের পেছনে যে বড় ধরনের দুর্নীতি কাজ করে তা বলাইবাহুল্য।
অপরাধীর যদি উপরতলায় যোগাযোগ থাকে, অর্থ থাকে, তবে খুন-ধর্ষণ-বদমায়েশি করে ছাড়া পাওয়া যায়। দৈবাৎ শাস্তি হলে রাষ্ট্রপতির ফরমানে এমন শাস্তি মওকুফ হওয়ার রেওয়াজও রয়েছে। এর আগে খুনের দায়ে অভিযুক্ত লক্ষ্মীপুরের সন্ত্রাসী তাহেরপুত্র বিপ্লব রাষ্ট্রপতির ক্ষমা পেয়েছে। বিএনপির শাসনামলেও আলোচিত খুনি ঝিন্টুকে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শন করা হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে সব শাসকের ভূমিকা এক। এভাবে ক্ষমা প্রদর্শন আইনের শাসনের ক্ষেত্রে বড় হুমকি।
আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কাজ হচ্ছে জনকল্যাণ। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রসঙ্গ নাই-বা তুললাম, ইউরোপ-আমেরিকার ধনবাদী রাষ্ট্রগুলো নাগরিকদের শিক্ষা-স্বাস্থ্যসেবার দায়িত্ব নেয়। শিক্ষা শেষে কাজের ব্যবস্থা করে দেয়, চাকরি দিতে না পারলে বেকার ভাতা দেয়। বলতে গেলে আমাদের রাষ্ট্রের এমন দায় নেই। সংবিধানে সমাজতন্ত্র লিপিবদ্ধ করা হলেও রাষ্ট্র জনগণের শিক্ষা-স্বাস্থ্যের দায় থেকে ক্রমেই সরে যাচ্ছে। কাজ দিতে না পারলে বেকার ভাতা দেবে এমনটা ভাবছে না। জনগণের মধ্যেও তা নিয়ে তেমন আকাঙ্ক্ষা জন্মায়নি। তবে রাষ্ট্র জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দেবে, অপরাধীদের শাস্তি হবে, নির্মমতার অবসানে রাষ্ট্র কার্যকর ভূমিকা রাখবে_ এমনটি আশা করে দেশের জনগণ। এটি আইনের শাসনের প্রাথমিক শর্ত।
এখানে একদা পাকিস্তান রাষ্ট্র ছিল, ভিন দেশিদের হাতে ক্ষমতা ছিল। আমরা সুন্দর জীবনের প্রত্যাশায় সেই রাষ্ট্র বদলেছি। সার্বভৌম বাংলাদেশ গড়েছি। এখন শাসকরা দেশের লোক, জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে যদি তারা জনস্বার্থ না দেখেন, জনগণের জানমালের নিরাপত্তা না দিতে পারেন, তবে সে দুঃখ আমরা কাকে জানাব!
সমাজে নির্মমতা যে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে তা নিরসনে কঠোর আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার বিকল্প নেই। তবে সেটাই শেষ কথা নয়। এর পেছনের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, মনস্তাত্তি্বক কারণও রয়েছে। মানুষ হিংসাপ্রবণ, নৃশংস হয়ে ওঠার পেছনে সামাজিক-সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ও ক্রিয়াশীল।
একদা রাষ্ট্র ছিল না। সমাজই মানুষের নিরাপত্তা বিধান করেছে। এমনকি সুলতানি-মোগল-নবাবী আমলে রাষ্ট্র ছিল হনুজ দূরঅস্ত। শাসক ও রাজনীতি নিয়ে মানুষের খুব বেশি ভাবনা ছিল না। ব্রিটিশ আমলেও রাষ্ট্রের কাছে মানুষের প্রত্যাশা ছিল সামান্য। আমাদের সমাজ ছিল সদাজাগ্রত। সমাজই জনজীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করত। তখন সমাজে অসহায়-দুর্বলের খানিকটা নিরাপত্তা ছিল। কিছু মূল্যবোধ ছিল, যা নির্মমতা-নির্দয়তার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করত। সেই সমাজ ভেঙে যাচ্ছে। সঙ্গত কারণেই সামন্ত অর্থনীতির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা সমাজের পরিবর্তন হবে। অর্থনৈতিক নতুন ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গেই নতুন সমাজ গড়ে উঠবে। উঠছেও। কিন্তু সেই সমাজ কি মানবিক মূল্যবোধে চালিত হবে না?
আমাদের সমাজে যে সততা, ন্যায়পরায়ণতা, সহমর্মিতা, কর্তব্যপরায়ণতা প্রভৃতি মানবিক গুণ ছিল, তা ধারণ করেই তো নতুন সমাজ গড়ে উঠবে। সেই সঙ্গে মানবাধিকার, নারী অধিকারসহ আরও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বিকশিত হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখছি যে, মানবিক মূল্যবোধগুলোর অপমৃত্যু ঘটছে। এই মানবিক মূল্যবোধগুলো জাগিয়ে তুলতে আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যমের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। আমরা দেখছি, শিক্ষিত নর-নারীরা ক্রমেই আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে। সামাজিক দায় নিতে তারা অনীহ। এ দৃশ্য প্রায়ই চোখে পড়ে_ দুর্ঘটনায় আহত নর-নারী চিৎকার করছে রাস্তায়। গাড়িতে চড়া ভদ্রলোকরা কাচ তুলে তাকিয়ে দেখে নিজ গন্তব্যে ছুটছে। তাকে হাসপাতালে নেওয়া, পুলিশকে জানানোর দায়িত্ব পালন করছে রিকশা-অটোরিকশার চালক কিংবা অতি সাধারণ পথচারী। অতি শিক্ষিতজন প্রতিবেশীর বিপদে পাশে দাঁড়াচ্ছে না, সবকিছু থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকছে। যে শিক্ষা মানুষ হতে শেখায় না, সেই শিক্ষা কতটুকু যৌক্তিক? সমাজে নৈতিক শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে। মনে রাখতে হবে, যে জাতি নৈতিক-মানবিক গুণে গুণান্বিত নয়, সে জাতির সাহস, মেধা সবকিছু থাকা সত্ত্বেও সুশৃঙ্খল জাতিতে পরিণত হতে পারে না।
নৈতিকতা সম্পর্কে একটি ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত। এটি যেন কেবল ধর্মীয় ব্যাপার। সততা, মানবিকতা, সেবার প্রসঙ্গগুলো যেন পারলৌকিক লক্ষ্য অর্জনের নিমিত্তমাত্র। আসলে সামাজিক শান্তি ও শৃঙ্খলার প্রয়োজনেও জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে সততা, সহমর্মিতা, কর্তব্যপরায়ণতাসহ মানবিক গুণাবলি থাকা জরুরি। নারী-পুরুষ সবার মধ্যে এমন মূল্যবোধ জাগাতে হবে_ যাতে অসৎ, দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসীদের মানুষ ঘৃণা করবে, শান্তিপ্রিয় ও সৎ ব্যক্তিরা হবে সম্মানিত। এই শিক্ষায় যদি আমরা নতুন প্রজন্মকে শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে না পারি, তবে এ জাতি উচ্ছৃঙ্খল জাতিতে পরিণত হবে। সর্বক্ষেত্রে নৃশংসতাবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে।
সে কারণে আইনের শাসনের পাশাপাশি মানবিক-নৈতিকতা বিকাশের বিষয়টি আজ বিবেচনাযোগ্য। আর রাষ্ট্র যখন আইনের শাসন কায়েম করে না, অপরাধীদের শাস্তি দেয় না, তখন রাষ্ট্রকে তা বাধ্য করার ক্ষেত্রে নাগরিকদের দায় অপরিসীম। নাগরিক সমাজকে ফয়সালা করতে হবে যে, রাষ্ট্রের অন্যায় খবরদারিতে চলবে নাকি রাষ্ট্রযন্ত্রকে তারা বদলাবে। রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর প্রহরা না থাকলে তা হয়ে ওঠে আরও নিপীড়ক, ক্ষমতাধরদের ক্রীড়নক। তাই সচেতন নাগরিক সমাজকেই সব অন্যায় রুখে দাঁড়াতে হবে, আইনের শাসনের বিকাশেও ভূমিকা রাখতে হবে।
আবু সাঈদ খান :সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com
দেশ এগোচ্ছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা এসেছে, শিক্ষাক্ষেত্রেও এগিয়েছি আমরা। ব্যবসা-বাণিজ্য-বিনিয়োগে অগ্রগতি লক্ষণীয়। প্রবৃদ্ধি সন্তোষজনক। সামাজিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে তরুণদের অংশগ্রহণ এখন সহজেই চোখে পড়ে। দেশের দামাল ছেলেমেয়েরা এভারেস্টের চূড়ায় উড়িয়েছে জাতির পতাকা। সব ক্ষেত্রেই তারুণ্যের পদচারণা, অদম্য সাহস আর মেধার পরাকাষ্ঠা, অর্জনের প্রতিযোগিতা। এ সবকিছুই আমাদের আশাবাদী করে। কিন্তু সবই কি ইতিবাচক? নেতিবাচক রাজনীতি চর্চার বাইরেও একের পর এক ঘটে যাওয়া নৃশংস ঘটনা, নির্মমতা, বর্বরতা, অমানবিকতা আমাদের কেবল ব্যথিতই করে না, হতাশায় মুহ্যমান করে তোলে।
দু'দিন আগে খোদ রাজধানীর তোপখানায় এক ঘরে বৃদ্ধা মায়ের হাত-পা-মুখ বেঁধে রেখে অন্য ঘরে তার মেয়ে নিশাত বানুকে নির্মমভাবে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। সাইদুর রহমান তার প্রেমিকা সুস্মিতাকে কী নৃশংসভাবে হত্যা করে টুকরো টুকরো করেছে তা বর্ণনা করার মতো নয়। এ নিবন্ধ যখন লিখছি, তখন সংবাদপত্রে দেখলাম দিন-দুপুরে সিলেটের দলইপাড়া গ্রামে এক দাদি ও নাতনির খুন হওয়ার মর্মান্তিক ঘটনা। প্রায় প্রতিদিনই সংবাদপত্রে, বৈদ্যুতিন মাধ্যমে এমন নৃশংস ঘটনার খবর প্রচারিত হচ্ছে। এমন বর্বরতার ঘটনা অতীতেও ঘটেছে, কিন্তু তা এখন মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। তার চেয়ে বড় কথা, নৃশংস হত্যাকাণ্ডগুলোর কোনো প্রতিকার হচ্ছে না। কে করবে? রাষ্ট্র নির্বিকার। সমাজ ফুঁসে উঠছে না। সবকিছুই যেন গা সওয়া। এর আগে হত্যা-খুনের ঘটনায় পুলিশি যে তৎপরতা দেখা যেত, এখন তা হয় না। প্রতিবাদ-বিক্ষোভ তেমনটা আর দেখা যায় না। আমরা যেন ধরে নিয়েছি যে, এমন ঘটনা ঘটবেই।
প্রতিকারের দায় কার_ রাষ্ট্র ও সমাজ উভয়েরই। তবে আইনানুগ পদক্ষেপ নিতে হবে রাষ্ট্রকেই। কিন্তু রাষ্ট্র কতটুকু সক্রিয়! সব হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে মামলা হয়, পুলিশ অপরাধীদের গ্রেফতারও করে। কিন্তু আইনের ফাঁকফোকর গলে অপরাধীরা ছাড়া পেয়ে যায়। প্রতিপক্ষ দুর্বল হলে মামলা নেওয়া হয় না, এমনভাবে মামলা সাজানো হয় যাতে অপরাধীদের শাস্তি না হয়। তোপখানার নিশাত হত্যাকাণ্ডে পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, মা খালেদা বানু আসামিদের নাম উল্লেখ করলেও পুলিশের তথ্য বিবরণীতে (এফআইআর) আসামির ছকে তাদের নাম নেই। শুধু তাই নয়, অভিযুক্তদের জিজ্ঞাসাবাদের পর থানা থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এসব ঘটনা থেকে অপরাধীদের শাস্তির ব্যাপারে যে কেউ সন্দিহান হয়ে উঠবেন। প্রতিনিয়ত এমন অনেক ঘটনাই ঘটছে যেগুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের সংশ্লিষ্টতা নেই। ফলে রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর প্রশ্ন সেখানে ওঠে না। তবুও দেখা যায়, অনেকক্ষেত্রেই পুলিশ অপরাধীদের ছাড়া পাওয়ার রাস্তা করে দেয়। পুলিশের এই মনোভাবের পেছনে যে বড় ধরনের দুর্নীতি কাজ করে তা বলাইবাহুল্য।
অপরাধীর যদি উপরতলায় যোগাযোগ থাকে, অর্থ থাকে, তবে খুন-ধর্ষণ-বদমায়েশি করে ছাড়া পাওয়া যায়। দৈবাৎ শাস্তি হলে রাষ্ট্রপতির ফরমানে এমন শাস্তি মওকুফ হওয়ার রেওয়াজও রয়েছে। এর আগে খুনের দায়ে অভিযুক্ত লক্ষ্মীপুরের সন্ত্রাসী তাহেরপুত্র বিপ্লব রাষ্ট্রপতির ক্ষমা পেয়েছে। বিএনপির শাসনামলেও আলোচিত খুনি ঝিন্টুকে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শন করা হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে সব শাসকের ভূমিকা এক। এভাবে ক্ষমা প্রদর্শন আইনের শাসনের ক্ষেত্রে বড় হুমকি।
আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কাজ হচ্ছে জনকল্যাণ। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রসঙ্গ নাই-বা তুললাম, ইউরোপ-আমেরিকার ধনবাদী রাষ্ট্রগুলো নাগরিকদের শিক্ষা-স্বাস্থ্যসেবার দায়িত্ব নেয়। শিক্ষা শেষে কাজের ব্যবস্থা করে দেয়, চাকরি দিতে না পারলে বেকার ভাতা দেয়। বলতে গেলে আমাদের রাষ্ট্রের এমন দায় নেই। সংবিধানে সমাজতন্ত্র লিপিবদ্ধ করা হলেও রাষ্ট্র জনগণের শিক্ষা-স্বাস্থ্যের দায় থেকে ক্রমেই সরে যাচ্ছে। কাজ দিতে না পারলে বেকার ভাতা দেবে এমনটা ভাবছে না। জনগণের মধ্যেও তা নিয়ে তেমন আকাঙ্ক্ষা জন্মায়নি। তবে রাষ্ট্র জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দেবে, অপরাধীদের শাস্তি হবে, নির্মমতার অবসানে রাষ্ট্র কার্যকর ভূমিকা রাখবে_ এমনটি আশা করে দেশের জনগণ। এটি আইনের শাসনের প্রাথমিক শর্ত।
এখানে একদা পাকিস্তান রাষ্ট্র ছিল, ভিন দেশিদের হাতে ক্ষমতা ছিল। আমরা সুন্দর জীবনের প্রত্যাশায় সেই রাষ্ট্র বদলেছি। সার্বভৌম বাংলাদেশ গড়েছি। এখন শাসকরা দেশের লোক, জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে যদি তারা জনস্বার্থ না দেখেন, জনগণের জানমালের নিরাপত্তা না দিতে পারেন, তবে সে দুঃখ আমরা কাকে জানাব!
সমাজে নির্মমতা যে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে তা নিরসনে কঠোর আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার বিকল্প নেই। তবে সেটাই শেষ কথা নয়। এর পেছনের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, মনস্তাত্তি্বক কারণও রয়েছে। মানুষ হিংসাপ্রবণ, নৃশংস হয়ে ওঠার পেছনে সামাজিক-সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ও ক্রিয়াশীল।
একদা রাষ্ট্র ছিল না। সমাজই মানুষের নিরাপত্তা বিধান করেছে। এমনকি সুলতানি-মোগল-নবাবী আমলে রাষ্ট্র ছিল হনুজ দূরঅস্ত। শাসক ও রাজনীতি নিয়ে মানুষের খুব বেশি ভাবনা ছিল না। ব্রিটিশ আমলেও রাষ্ট্রের কাছে মানুষের প্রত্যাশা ছিল সামান্য। আমাদের সমাজ ছিল সদাজাগ্রত। সমাজই জনজীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করত। তখন সমাজে অসহায়-দুর্বলের খানিকটা নিরাপত্তা ছিল। কিছু মূল্যবোধ ছিল, যা নির্মমতা-নির্দয়তার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করত। সেই সমাজ ভেঙে যাচ্ছে। সঙ্গত কারণেই সামন্ত অর্থনীতির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা সমাজের পরিবর্তন হবে। অর্থনৈতিক নতুন ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গেই নতুন সমাজ গড়ে উঠবে। উঠছেও। কিন্তু সেই সমাজ কি মানবিক মূল্যবোধে চালিত হবে না?
আমাদের সমাজে যে সততা, ন্যায়পরায়ণতা, সহমর্মিতা, কর্তব্যপরায়ণতা প্রভৃতি মানবিক গুণ ছিল, তা ধারণ করেই তো নতুন সমাজ গড়ে উঠবে। সেই সঙ্গে মানবাধিকার, নারী অধিকারসহ আরও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বিকশিত হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখছি যে, মানবিক মূল্যবোধগুলোর অপমৃত্যু ঘটছে। এই মানবিক মূল্যবোধগুলো জাগিয়ে তুলতে আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যমের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। আমরা দেখছি, শিক্ষিত নর-নারীরা ক্রমেই আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে। সামাজিক দায় নিতে তারা অনীহ। এ দৃশ্য প্রায়ই চোখে পড়ে_ দুর্ঘটনায় আহত নর-নারী চিৎকার করছে রাস্তায়। গাড়িতে চড়া ভদ্রলোকরা কাচ তুলে তাকিয়ে দেখে নিজ গন্তব্যে ছুটছে। তাকে হাসপাতালে নেওয়া, পুলিশকে জানানোর দায়িত্ব পালন করছে রিকশা-অটোরিকশার চালক কিংবা অতি সাধারণ পথচারী। অতি শিক্ষিতজন প্রতিবেশীর বিপদে পাশে দাঁড়াচ্ছে না, সবকিছু থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকছে। যে শিক্ষা মানুষ হতে শেখায় না, সেই শিক্ষা কতটুকু যৌক্তিক? সমাজে নৈতিক শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে। মনে রাখতে হবে, যে জাতি নৈতিক-মানবিক গুণে গুণান্বিত নয়, সে জাতির সাহস, মেধা সবকিছু থাকা সত্ত্বেও সুশৃঙ্খল জাতিতে পরিণত হতে পারে না।
নৈতিকতা সম্পর্কে একটি ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত। এটি যেন কেবল ধর্মীয় ব্যাপার। সততা, মানবিকতা, সেবার প্রসঙ্গগুলো যেন পারলৌকিক লক্ষ্য অর্জনের নিমিত্তমাত্র। আসলে সামাজিক শান্তি ও শৃঙ্খলার প্রয়োজনেও জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে সততা, সহমর্মিতা, কর্তব্যপরায়ণতাসহ মানবিক গুণাবলি থাকা জরুরি। নারী-পুরুষ সবার মধ্যে এমন মূল্যবোধ জাগাতে হবে_ যাতে অসৎ, দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসীদের মানুষ ঘৃণা করবে, শান্তিপ্রিয় ও সৎ ব্যক্তিরা হবে সম্মানিত। এই শিক্ষায় যদি আমরা নতুন প্রজন্মকে শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে না পারি, তবে এ জাতি উচ্ছৃঙ্খল জাতিতে পরিণত হবে। সর্বক্ষেত্রে নৃশংসতাবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে।
সে কারণে আইনের শাসনের পাশাপাশি মানবিক-নৈতিকতা বিকাশের বিষয়টি আজ বিবেচনাযোগ্য। আর রাষ্ট্র যখন আইনের শাসন কায়েম করে না, অপরাধীদের শাস্তি দেয় না, তখন রাষ্ট্রকে তা বাধ্য করার ক্ষেত্রে নাগরিকদের দায় অপরিসীম। নাগরিক সমাজকে ফয়সালা করতে হবে যে, রাষ্ট্রের অন্যায় খবরদারিতে চলবে নাকি রাষ্ট্রযন্ত্রকে তারা বদলাবে। রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর প্রহরা না থাকলে তা হয়ে ওঠে আরও নিপীড়ক, ক্ষমতাধরদের ক্রীড়নক। তাই সচেতন নাগরিক সমাজকেই সব অন্যায় রুখে দাঁড়াতে হবে, আইনের শাসনের বিকাশেও ভূমিকা রাখতে হবে।
আবু সাঈদ খান :সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com
No comments