গ্রাম আদালত-নিগ্রহ নয়, ন্যায্য সালিশি
ছোটখাটো বিরোধের অনানুষ্ঠানিক নিষ্পত্তির যে ধারা আমাদের সমাজে আবহমানকাল থেকেই রয়েছে, তাকে আনুষ্ঠানিক অবয়ব প্রদানের প্রচেষ্টাকে আমরা সাধুবাদ জানাই। এ সংক্রান্ত প্রকল্পের সাফল্য ও সম্প্রসারণ সামাজিক ন্যায্যতা ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় সরকারের অঙ্গীকারের প্রতি মানুষকে নিঃসন্দেহে আস্থাশীল করে তুলবে।
একই সঙ্গে এর অপব্যবহারের ব্যাপারে সতর্কতাও ব্যক্ত করতে চাই। গ্রাম আদালত যাতে বহুল পরিচিত 'গ্রাম্য মোড়লী' বিচার ব্যবস্থায় পরিণত না হয়, সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্টরা সতর্ক থাকবেন বলে প্রত্যাশা। রাজধানীতে অনুষ্ঠিত গ্রাম আদালত সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীও হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন যে পুরনো ব্যবস্থার নতুন এই সংস্কারে কুসংস্কার ও গোঁড়ামি যেন প্রশ্রয় না পায়। বস্তুত অনানুষ্ঠানিক বিচার ব্যবস্থার তিক্ত এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে মর্মান্তিক অভিজ্ঞতাই এর আইনি কাঠামো অনিবার্য করে তুলেছে। অস্বীকার করা যাবে না যে, আইন আদালতের বিস্তৃতির আগে গ্রামীণ এই বিচার ব্যবস্থা মানুষের ভরসাস্থল ছিল। কিন্তু কালের বিবর্তনে তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রভাবশালীদের প্রহসনযন্ত্রে পরিণত হতে থাকে। প্রজ্ঞা, বিবেচনা ও স্বচ্ছতার বদলে প্রাধান্য পেতে থাকে ধর্মান্ধতা, স্বার্থ ও স্বজনপ্রীতি। বিশেষ করে সামাজিক অনুশাসনের নামে তথাকথিত ফতোয়া জারি করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে নানাবিধ নিগ্রহের হার বেড়েই চলছিল। মৌলভীবাজারের ছাতকছড়ার নুরজাহানসহ আরও অনেক নির্যাতিত নারীর প্রাণহানি গ্রাম্য সালিশ ও ফতোয়ার বিরুদ্ধে অনির্বাণ প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে আছে। ২০০৯ সালে চালু 'বাংলাদেশ গ্রাম আদালত' প্রকল্প পর্যালোচনায় আয়োজিত দু'দিনব্যাপী সম্মেলনের সংবাদ রোববার সমকালের যে স্থানে ছাপা হয়েছে, তার নিচেই রয়েছে এমন আরেকটি দুর্ভাগ্যজনক নজির। প্রত্যন্ত গ্রাম নয়; রাজধানীর উপকণ্ঠ ধামরাইয়ে গ্রাম্য সালিশের একতরফা সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে আত্মহত্যা করেছেন এক গৃহবধূ। পরীক্ষামূলকভাবে ৩৫০টি ইউনিয়নে পরিচালিত গ্রাম আদালত যদি স্থানীয় বিচার ব্যবস্থার হৃত গৌরব ফিরিয়ে আনতে না পারে, তাহলে মুক্তির মন্দিরের সোপানতলে এসব প্রাণের বলিদান বৃথাই যাবে। আনুষ্ঠানিক আদালতে যেভাবে মামলার পাহাড় জমছে; সামান্য বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য মানুষকে যেভাবে বছরের পর বছর হয়রানি হতে হচ্ছে, তাতে করে এ ধরনের ব্যবস্থা চালুর বিকল্পও নেই। প্রধানমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও জনসেবা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এ ব্যবস্থা জনপ্রতিনিধিদের জন্যও এক অপূর্ব সুযোগ। আমরা আশা করি, ইউনিয়ন পরিষদে প্রতিনিধিত্বকারী ব্যক্তিরা এই সুযোগ কাজে লাগাবেন। স্থানীয় বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। অনুষ্ঠানে এলজিআরডিমন্ত্রীর এ বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমতের অবকাশ নেই যে সালিশের নামে সামাজিক নিগ্রহ সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ করতে হবে। কিন্তু এটাও সত্য, ফরিয়াদ জানানোর উপযুক্ত ব্যবস্থাই হতে পারে নেতিবাচক মানসিকতার সমাজপতিদের অন্যায় প্রতিহত করার প্রথম হাতিয়ার। এটা উৎসাহব্যঞ্জক যে, ১৯৭৬ সালে প্রণীত ও ২০০৬ সালে সংশোধিত গ্রাম আদালত আইনটি সরকার কার্যকর করার উদ্যোগ নিয়েছে। এই আশাও সুদূরপরাহত হতে পারে না যে, পাইলট প্রকল্পটি সাফল্যের সঙ্গেই সম্পন্ন হবে। সম্মেলনে উপস্থিত ইউনিয়ন প্রতিনিধিরা তাদের অভিজ্ঞতা থেকে যেসব সুপারিশ করবেন, তা সংশ্লিষ্টরা আমলে নেবেন নিশ্চয়ই। প্রকল্প এলাকার বাইরে চার হাজারের বেশি ইউনিয়নেও সরকার গ্রাম আদালত চালুর যে উদ্যোগ নিয়েছে, সীমিত পর্যায়ের এই অভিজ্ঞতা বৃহত্তর সে পরিসরেও পাথেয় হয়ে থাকবে।
No comments