ভিন্নমত-প্রস্তাবিত বাজেট এবং শেয়ারবাজার by আবু আহমেদ
সরকার কথায় শেয়ারবাজারের প্রতি দুই বছর ধরে অনেক আন্তরিকতা দেখিয়ে আসছে। কিন্তু শেয়ারবাজারের পক্ষে বাস্তব কর্মপন্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে হয় বিভ্রান্তিতে ভোগে, নতুবা একবার কিছু দিয়ে পরে প্রত্যাহার করে নেয়। গত দুই বছরে পুঁজি হারানো ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের বিক্ষোভের মুখে শেয়ারবাজারের ইস্যুগুলো সংসদসহ সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পর্যন্ত আলোচিত হয়েছে।
আশা করা হয়েছিল, বিষয়গুলোর ব্যাপারে সরকারের সব পর্যায়ে স্বচ্ছ ধারণা তৈরি হয়েছে। কিন্তু আমরা দেখি সরকার এই লক্ষ্যে যখন কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে তখন খুব সম্ভবত ভুলের ভিত্তিতে নিতে গিয়ে তা শেয়ারবাজারের পক্ষে কোনো কাজে আসছে না। এই যে অর্থমন্ত্রী মহোদয় বড় গলায় বাজেট বক্তৃতায় শেয়ারবাজারের জন্য আরো কিছু প্রণোদনা ঘোষণা করলেন, সেগুলো বাজারকে সামগ্রিকভাবে কোনো অবস্থানে নিতে সহায়তা করবে কি না, তা একবার ভেবে দেখা দরকার। এখানে ঘোষিত তিনটি প্রণোদনা নিয়ে কিছু আলোকপাত করতে চাই। একটি হলো, কোনো কম্পানি তার ইক্যুইটি মূলধনের (Equity Capital) ২০ শতাংশ বাজারে ছাড়লে প্রথম বছর করপোরেট আয়করের ওপর ১০ শতাংশ ছাড় পাবে। এটি ইতিবাচক। এতে পরিবারকেন্দ্রিক কম্পানিগুলো IPOতে আসতে উৎসাহী হবে। কিন্তু এই প্রণোদনা বহুজাতিক কম্পানিগুলোর বাজারে আসার ক্ষেত্রে কোনো কাজ দেবে না। তাদের ক্ষেত্রে একটু ভিন্ন কায়দায় প্রণোদনা দিলে বাজার ও অর্থনীতির জন্য ভালো হতো। যেমন তাদের ক্ষেত্রে Equity-র ১০ শতাংশ ছাড়লেও চলবে এবং তারাও ট্যাক্সের সুবিধাটা পেতে পারবে। কারণ কোনো বহুজাতিক কম্পানি তাদের ২০ শতাংশ Equity Off-Load করে বাজারে আসতে চাইবে না। এটা করলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের মেজরিটি শেয়ারহোল্ডিং ডাইলিউট (Majority Shareholding Dilute) হয়ে যাবে। সরকার কি অনেক দেন-দরবার করেও ইউনিলিভারকে (Uniliver) বাজারে আনতে পেরেছে? কেন পারেনি? লিভার হিসাব করে দেখেছে ওচঙতে গেলে তাদের লাভ হবে না। এমনকি ইউনিলিভার বাংলাদেশ সরকারের শেয়ারহোল্ডিংয়ের একটা অংশকেও বাজারে আসতে দেয়নি। এসব বিষয় কি প্রধানমন্ত্রী এবং সংসদ সদস্যরা জানেন? আমার বোধ হলো, জানেন না। জানলে জনস্বার্থে বহুজাতিক কম্পানিগুলোকে শেয়ারবাজারে আসতে বাধ্য করতেন। দুই নম্বরের কথিত প্রণোদনা হলো পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত ডিভিডেন্ড আয় (Dividend Income) করমুক্ত রাখা হয়েছে। এতে কত লোক উপকৃত হবে? সংখ্যায় অনেকেই হবেন। তবে শেয়ারবাজারের যাঁরা প্রাণ, সেই মধ্যম শ্রেণীর বিনিয়োগকারীরা কোনো উপকার পাবেন না। তাঁদের জন্য পাঁচ হাজার টাকার করমুক্তি তেমন কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়। কত টাকা বিনিয়োগ করলে পাঁচ হাজার টাকা ডিভিডেন্ড পাওয়া যায়? আমার হিসাব মতে, দুই-তিন লাখ টাকা বিনিয়োগ করলেও পাঁচ হাজার টাকা ডিভিডেন্ড পাওয়া যায়। এসব বিনিয়োগকারীর অধিকাংশই আগে থেকেই আয়করের আওতায় নেই। তাদের TIN নম্বরও নেই। তারা এখন যে সুবিধাটা পাবে সেটা হলো, আগে উৎসে কর ১০ শতাংশ কেটে রাখা হতো। এখন পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত কোনো কর্তন করা হবে না। কিন্তু এই সুবিধা শেয়ারবাজারকে কতটুকু সহায়তা করবে? মন্ত্রী মহোদয়ের উচিত ছিল ২৫ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত এই সুবিধা দেওয়া; যেটা ১৯৯৬-এর শেয়ার কেলেঙ্কারি ও বাজার ধসের পর দেওয়া হয়েছিল। ২৫ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত ডিভিডেন্ড আয়কে করমুক্ত করা হলে অনেকে যেমন বড় মূলধন নিয়ে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে উৎসাহ পেত, অন্যদিকে বর্তমানের মধ্যম পুঁজির বিনিয়োগকারীরাও উপকৃত হতো। উল্লেখ্য, মধ্যম শ্রেণীর বিনিয়োগকারীরা, যাদের বিনিয়োগ ৩০ থেকে ৫০ লাখ টাকা বা তারও বেশি, তাদের TIN নম্বর আছে এবং তারা ইতিমধ্যেই করের আওতায় আছে। শেয়ারবাজারের জন্য দুটো অতিগুরুত্বপূর্ণ প্রণোদনার কৃতিত্ব আমাদের দুজন প্রয়াত অর্থমন্ত্রীর। মরহুম কিবরিয়া সাহেব ঘোষণা করেছিলেন, যেসব কম্পানি ২০ শতাংশ বা তারও বেশি ডিভিডেন্ড দেবে সেসব কম্পানিকে তাদের দেয় করপোরেট আয়ের ওপর রিবেট (Rebate) দেওয়া হবে। আর সেই পদক্ষেপ, আমার জানামতে, এখনো বহাল আছে। আর অনেক কৃতিত্বের অধিকারী মরহুম সাইফুর রহমান এক ঘোষণাতেই লিমিটেড ব্যাংক ও মার্কেটে তালিকাভুক্ত কম্পানিগুলোর করপোরেট ইনকাম ট্যাক্স ৩৫ শতাংশ থেকে ২৭.৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছিলেন। এই দুজন অর্থমন্ত্রী এমন সময় এসব পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, যখন আমাদের শেয়ারবাজার অর্থনীতির জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ ছিল না এবং যখন বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বড়জোর ছয়-সাত লাখ ছিল। ওই দুটো পদক্ষেপ কম্পানিগুলোকে একদিকে IPO ছাড়তে যেমন উৎসাহ জুগিয়েছিল, অন্যদিকে তারা বেশি ডিভিডেন্ড ঘোষণা করে ট্যাক্স রিবেটের সুযোগ নিতেও উৎসাহ বোধ করেছিল। বর্তমান অর্থমন্ত্রীও প্রণোদনা দিতে আগ্রহী, তবে কিভাবে দেবেন সে ব্যাপারে সঠিক পন্থাটি যেন খুঁজে পাচ্ছেন না। শেয়ারবাজারের জন্য প্রণোদনা হতে হবে ওই রকম, যেগুলো লাখ লাখ অতি সাধারণ বিনিয়োগকারীর পক্ষে যায়। প্রস্তাবিত বাজেটে তৃতীয় প্রণোদনা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে ঋণ বিক্রি করে এমন মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর আয়ের ওপর ৫ শতাংশ কর হ্রাস। আমি বিনয়ের সঙ্গে একটা প্রশ্ন এই ক্ষেত্রে করতে চাই, ওই হ্রাসের কারণে কারা উপকৃত হবে? নিশ্চয়ই মার্চেন্ট ব্যাংকের মালিকরা। মার্চেন্ট ব্যাংকের মালিক কারা? আমার জানামতে, অধিকাংশ মার্চেন্ট ব্যাংকের মালিক হলেন ব্রোকার বা স্টক এক্সচেঞ্জের সদস্য। তাঁরা যদি তাঁদের আয়ের ওপর ৫ শতাংশ কম কর দেন তাহলে লাখ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী কিভাবে উপকৃত হবে? আশা করি, অর্থমন্ত্রী মহোদয় বিষয়টা ভেবে দেখবেন। শেয়ারবাজার এবং সেই সঙ্গে লাখ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী উপকৃত হতো যদি এই প্রণোদনাটা ব্যাংকিং কম্পানিগুলোকে দেওয়া হতো। এমনকি ব্যাংকিং কম্পানিগুলোকে ২-৩ শতাংশ কর হ্রাস প্রাপ্তির সুবিধা দিলে তাদের বার্ষিক ডিভিডেন্ড বা মুনাফা ঘোষণা করার ক্ষমতা অনেক বেড়ে যেত।
আজকে শেয়ারবাজার এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। পুরো বাজার আস্থাহীনতায় ভুগছে। আমি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, গত বছর যখন বর্তমান অর্থমন্ত্রী সংসদে বাজেট ঘোষণা করছিলেন তখন শেয়ারবাজারের সূচক পাঁচ হাজার থেকে বেড়ে ছয় হাজার ৭০০ পর্যন্ত পেঁৗছেছে। আর আজকে সেই সূচক পাঁচ হাজারের নিচে। কেন এমন হচ্ছে একবার ভেবে দেখুন। অবশ্য শেয়ারবাজারের ইস্যুগুলো পুরো ম্যাক্রো ইকোনমিক ম্যানেজমেন্টের সঙ্গেও জড়িত। এ ক্ষেত্রে সরকার অব্যাহত দুর্বলতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। কেন অর্থনীতির মূল সূচকগুলো নিম্নগামী?
লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
আজকে শেয়ারবাজার এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। পুরো বাজার আস্থাহীনতায় ভুগছে। আমি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, গত বছর যখন বর্তমান অর্থমন্ত্রী সংসদে বাজেট ঘোষণা করছিলেন তখন শেয়ারবাজারের সূচক পাঁচ হাজার থেকে বেড়ে ছয় হাজার ৭০০ পর্যন্ত পেঁৗছেছে। আর আজকে সেই সূচক পাঁচ হাজারের নিচে। কেন এমন হচ্ছে একবার ভেবে দেখুন। অবশ্য শেয়ারবাজারের ইস্যুগুলো পুরো ম্যাক্রো ইকোনমিক ম্যানেজমেন্টের সঙ্গেও জড়িত। এ ক্ষেত্রে সরকার অব্যাহত দুর্বলতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। কেন অর্থনীতির মূল সূচকগুলো নিম্নগামী?
লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
No comments