নগর-নিসর্গ- হাতিরঝিলের গাছপালা: তিন নিসর্গীর মত by মশিউল আলম
২ জানুয়ারি ঢাকা মহানগরের হাতিরঝিল জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে। ঝিলের পাশ দিয়ে ১৭ কিলোমিটার সড়কপথ ও আট কিলোমিটার ফুটপাত নিয়ে সমন্বিত হাতিরঝিল প্রকল্পটি বিশাল। এতে চারটি সেতু আর চারটি ওভারপাসও আছে।
যানবাহন ও মানুষের চলাচলের অবকাঠামো হিসেবে এই প্রকল্প যতটা সুবিধা যোগ করবে, তার চেয়ে বেশি যোগ হওয়ার কথা সৌন্দর্য। হাতিরঝিল তাত্ত্বিকভাবে অত্যন্ত নয়নাভিরাম একটি মহাপ্রকল্প। এর ভৌত অবকাঠামোগুলোর অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে থাকবে পানি ও গাছপালা। প্রত্যাশা এমন যে, ঝিলে পানি থাকবে সারা বছর, সে পানি বুড়িগঙ্গার মতো দূষিত হবে না। সেই পানিতে জলকেলি করবে হাঁস ও অন্যান্য জলচর পাখি; শীতকালে অতিথি পাখিদেরও দেখা মিলতে পারে।
হাতিরঝিল প্রকল্পের গাছপালা সম্পর্কে বিশেষ রকমের ঔৎসুক্য বোধ করেন বৃক্ষসখা দ্বিজেন শর্মা। প্রায় চার দশক আগে শ্যামলী নিসর্গ নামের একটি বই লিখে তিনি প্রকাশ করেছেন গাছপালার প্রতি তাঁর ভালোবাসা ও দৃষ্টিভঙ্গির কথা। বৃক্ষের পরিচয়মূলক সচিত্র সে বইটি উদ্ভিদবিজ্ঞানের শিক্ষক বা গবেষকের তৈরি একটা সমীক্ষা হিসেবেই সীমাবদ্ধ থেকে যেতে পারত, কিন্তু তা হয়নি। বইটির দীর্ঘ ভূমিকায় তাঁর বিজ্ঞানমনস্কতাকে ছাপিয়ে গেছে তাঁর নান্দনিক মন। প্রকৃতির সৌন্দর্যই তাঁর প্রধান আকর্ষণ। নগরের নিসর্গ নিয়েও তাঁর ভাবনার অন্ত নেই। অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপে প্রায়-দিশাহারা ঢাকা মহানগরের হাতিরঝিল সমন্বিত প্রকল্পের মতো সুবিশাল এক আয়োজনের কথা যখন তিনি প্রথম শোনেন, তখন বেশ উৎসাহিত বোধ করেন। প্রকল্পটির আর্কিটেকচারাল কনসালটেন্সির কাজ পেয়েছিল যে প্রতিষ্ঠান, সেই কনসালটিং ফার্মের লোকজনের সঙ্গে একপর্যায়ে তাঁর যোগাযোগ ঘটিয়ে দেন বাংলাদেশের একমাত্র ল্যান্ডস্কেপ আর্কিটেক্ট, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক খন্দকার হাসিবুল কবির। ঝিলের পাড়ের ভূমি, জলভাগের মধ্যকার নকশা, কোন অংশে কী ধরনের গাছ লাগানো হবে—এসব সম্পর্কে তাঁরা ওই প্রতিষ্ঠানটিকে পরামর্শ দিয়েছিলেন।
তারপর অনেক দিন চলে গেছে। কী গাছপালা লাগানো হয়েছে বা হচ্ছে, সে সম্পর্কে বিশদ জানা যায় না। হাতিরঝিলের বৃক্ষরোপণ নিয়ে খবরের কাগজে নানা কথা লেখা হয়, অধিকাংশই অপ্রীতিকর সংবাদ। প্রকল্পটি উদ্বোধন হওয়ার অল্প কয়েক দিন আগে দ্বিজেন শর্মা স্থির করলেন, পুরো এলাকাটি ঘুরে দেখবেন। রীতিমতো একটা সমীক্ষা চালাবেন হাতিরঝিল প্রকল্পে বৃক্ষরোপণের ওপর। তাঁর সঙ্গে জুটলেন স্থপতি মুশতাক কাদরি, যাঁর পেশা দালানকোঠার নকশা তৈরি করা, আর নেশা গাছপালা। আমাকেও ডাকলেন দ্বিজেন শর্মা: তাঁদের জরিপকর্ম সরেজমিনে দেখেশুনে একটা লেখা তৈরি করব। এক শুক্রবার সকাল ১০টায় আমরা জড়ো হলাম হাতিরঝিলের সবচেয়ে পশ্চিম অংশে, এফডিসির দক্ষিণে রাস্তার পাশে। ওইখানে হাতিরঝিলকে বিভক্ত করেছে মগবাজার থেকে মহাখালীর দিকে যাওয়ার বড় সড়কটি। কেডস, টি-শার্ট ও লেনিন টুপি মাথায় দ্বিজেন শর্মা রাস্তার ধারে প্রথমেই লক্ষ করলেন দুজন মানুষ গাছ লাগানোর জন্য গর্ত খুঁড়ছেন। দুটি গর্তের মাঝখানের দূরত্ব ফুট পাঁচেক দেখে তিনি তাঁদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘এত ঘন করে গাছ লাগাচ্ছেন কেন?’ বেচারা দুজন পরস্পরের মুখের দিকে চাইলেন, দ্বিজেন শর্মার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলেন না। আমরা লক্ষ করলাম, বড় বড় জাতের অনেক গাছ লাগানো হয়েছে, কিন্তু সেগুলোর মাঝখানের দূরত্ব বেশ কম। আরও পরের দিকে আমরা যখন পুরো প্রকল্প এলাকাটি ঘুরে দেখি, তখনো একই বিষয় লক্ষ করি।
একসময় দ্বিজেন শর্মা বললেন, এই সমস্যা কেবল হাতিরঝিলেই নয়, ধানমন্ডি লেকে এবং ঢাকা শহরের অন্যান্য জায়গায়ও। তিনি বললেন, ‘আমাদের জন্য গাছ লাগানোর আদর্শ মডেল হলো ১৯০৮ থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত রমনা গ্রিনে প্রাউডলকের গাছ লাগানোর মডেলটি। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তা আর অনুসরণ করা হয়নি। বরং মিন্টো রোড ও হেয়ার রোডে পেল্টোফোরাম ও জারুলের মিশ্র বীথি এবং পাদাউকের একক বীথির মাঝখানে লাগানো হয়ে প্রচুর মেহগনি।’
আমি জানতে চাইলাম, কেন এটা করা হয়েছে? পরিকল্পিতভাবেই কি করা হয়েছে? দ্বিজেন শর্মার মন্তব্য: কাজটা কোনো বোদ্ধার নয়, অদক্ষ বাগানকর্মীদের। এমনটা হয়েছে অজ্ঞতা থেকে। ‘এই অজ্ঞতা আমাদের গ্রাস করে ফেলেছে। এবং দেখা যাচ্ছে, হাতিরঝিলেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি।’
হাতিরঝিলে অবশ্য মেহগনির দেখা মিলল না। কিন্তু দ্বিজেন শর্মা ও মুশতাক কাদরি একই সঙ্গে লক্ষ করলেন, প্রকল্পের সব অংশেই দুটি গাছের মাঝখানের দূরত্ব নির্ধারণ এবং গাছের গড়ন ও ফুল নির্বাচনের বিষয়টি মোটেই আমলে নেওয়া হয়নি। দ্বিজেন শর্মা বললেন, ‘অচিরেই পুরো এলাকাটি সৌন্দর্যহীন একটা জঙ্গলে পরিণত হবে।’
রেললাইনের পাশে কয়েকটি তালগাছ দেখিয়ে মুশতাক কাদরি বললেন, এই অঞ্চলে একসময় অনেক তালগাছ ছিল। এ গাছ এই মাটির আপন। ঝিলের এই অংশে তালগাছ লাগানো যেত। দ্বিজেন শর্মা যোগ করলেন, লেকের পাড়ে দেশি পাম, তাল, নারকেল ও খেজুরগাছ লাগালে লেকের সৌন্দর্য সবার জন্য উন্মুক্ত থাকত। কিন্তু আমরা ঘুরে ঘুরে দেখতে পেলাম, অনেক জায়গায় লেকের ধারে লাগানো হয়েছে অনেক ঝোপালো গাছ—কৃষ্ণচূড়া, বকুল, হিজল ইত্যাদি। এবং দ্বিজেন শর্মার মতে, সেগুলো লাগানো হয়েছে বড়ই বেখাপ বিন্যাসে। পানির কাছে লাগানো হয়েছে ঝোপালো গাছ, তারপর দ্বিতীয় সারিতে মহার্ঘ বিদেশি পাম, যা বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে কিনে আনা হয়েছে বিদেশ থেকে। কৃষ্ণচূড়া, বকুল, হিজল ইত্যাদি ঝোপালো গাছের সারিতে কোথাও কোথাও টগর দেখে দ্বিজেন শর্মার মন্তব্য: ‘বড়ই হাস্যকর।’
রামপুরার দিকে যেতে এক জায়গায় চোখে পড়ল এক সারি ক্যাসুরিনা বা পবন-ঝাউ। দ্বিজেন শর্মা বললেন, ‘এ তো উপকূলের বাসিন্দা। উপকূলে খোলা সমুদ্র আর উন্মুক্ত আকাশের পটভূমিতে একে যত আকর্ষণীয় লাগে ঢাকায় ততটা হবে না।’ একটা বিষয় লক্ষ করার মতো, বিদেশি পাম ও ক্যাসুরিনাসহ অনেক গাছ লাগানো হয়েছে, যেগুলো এই দেশে পাওয়া যায় না, বিদেশ থেকে কিনে আনতে হয়। ল্যান্ডস্কেপ আর্কিটেক্ট হাসিবুল কবির মনে করেন, বিদেশ থেকে একটিও গাছ আমদানি করার প্রয়োজন ছিল না। এখানেই ঝিলের বিভিন্ন অংশের আদি বাসিন্দা গাছগাছালিদের খোঁজ বের করে, সেগুলোকে পুনঃস্থাপন করাই যথেষ্ট ছিল। কোথাও হয়তো এক টুকরো বাঁশঝাড় ছিল, কোথাও ছিল একটা বরইগাছ।
প্রায় পুরো প্রকল্প এলাকাই আমরা গাড়ি নিয়ে ঘুরে দেখলাম। শেষের দিকে দ্বিজেন শর্মা বললেন, ‘একটা বিষয় খেয়াল করো, ফলের গাছ লাগানো হয়নি। পুরো হাতিরঝিলে কোনো ফলগাছ নেই।’ পাখি ও গরিব কিশোর-কিশোরীদের জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেন তিনি। হাতিরঝিল প্রকল্পে যাঁরা গাছ লাগানোর পরিকল্পনা করেছেন, তাঁরা তাদের কথা মনে রাখেননি। তাঁর মতে, এই প্রকল্পে অন্তত কুড়ি শতাংশ সাধারণ ফলের গাছ লাগানো উচিত ছিল। লাগানো যেত দেশি জাতের আম, কালোজাম, বুনোজাম, আমলকী, আমড়া, জলপাই, কামরাঙা ইত্যাদি গাছ।
দ্বিজেন শর্মা, মুশতাক কাদরি ও হাসিবুল কবির—তিনজনই মনে করেন, হাতিরঝিলের বৃক্ষরোপণে ভুলের অন্ত নেই। আগে থেকেই একটি নীতিমালা তৈরি করে তা অনুসরণ করা হলে এতটা ভুল হতো না। লেকের পাড়ের ধরন অনুযায়ী বিভিন্ন গাছের সমাবেশ বা বিন্যাস (কৃষ্ণচূড়া, পেল্টোফোরাম, লাল সোনাইল, জারুল), সাধারণ ফলের গাছের সংখ্যা, দেশি গাছের প্রাধান্য, একটি গাছ থেকে অন্য গাছের দূরত্ব ইত্যাদি বিষয়ে পরিকল্পনা নিয়ে গাছ লাগানো উচিত ছিল। দ্বিজেন শর্মার মতে, এই সাধারণ বিষয়গুলো জানা না থাকলে এ রকম বড় প্রকল্পে গাছ লাগানো যায় না।
হাতিরঝিল প্রকল্প যদিও সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে, তবু পুরো প্রকল্পটি এখনো সম্পূর্ণ হয়নি। এখানে গাছ লাগানোয় যেসব ভুলভ্রান্তি ঘটেছে, তা শোধরানোর সুযোগ এখনো আছে বলে মনে করেন দ্বিজেন শর্মা; দুই স্থপতিরও একই মত। লেকের পাড় ধরে বিরাট একটা অংশজুড়ে পুরো বৃক্ষরোপণের প্রকল্পটি পুনর্বিবেচনা করা সম্ভব। ইতিমধ্যে লাগানো গাছগুলোর মধ্যবর্তী ফাঁকা জায়গা ও বিন্যাস পরিবর্তন করাও অসম্ভব নয়। কিন্তু শীতকাল তো গাছ লাগানোর মৌসুম নয়। সে জন্য আগামী বর্ষা পর্যন্ত অপেক্ষা করা যেতে পারে, তখন আবারও গাছ লাগানো যাবে।
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com
হাতিরঝিল প্রকল্পের গাছপালা সম্পর্কে বিশেষ রকমের ঔৎসুক্য বোধ করেন বৃক্ষসখা দ্বিজেন শর্মা। প্রায় চার দশক আগে শ্যামলী নিসর্গ নামের একটি বই লিখে তিনি প্রকাশ করেছেন গাছপালার প্রতি তাঁর ভালোবাসা ও দৃষ্টিভঙ্গির কথা। বৃক্ষের পরিচয়মূলক সচিত্র সে বইটি উদ্ভিদবিজ্ঞানের শিক্ষক বা গবেষকের তৈরি একটা সমীক্ষা হিসেবেই সীমাবদ্ধ থেকে যেতে পারত, কিন্তু তা হয়নি। বইটির দীর্ঘ ভূমিকায় তাঁর বিজ্ঞানমনস্কতাকে ছাপিয়ে গেছে তাঁর নান্দনিক মন। প্রকৃতির সৌন্দর্যই তাঁর প্রধান আকর্ষণ। নগরের নিসর্গ নিয়েও তাঁর ভাবনার অন্ত নেই। অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপে প্রায়-দিশাহারা ঢাকা মহানগরের হাতিরঝিল সমন্বিত প্রকল্পের মতো সুবিশাল এক আয়োজনের কথা যখন তিনি প্রথম শোনেন, তখন বেশ উৎসাহিত বোধ করেন। প্রকল্পটির আর্কিটেকচারাল কনসালটেন্সির কাজ পেয়েছিল যে প্রতিষ্ঠান, সেই কনসালটিং ফার্মের লোকজনের সঙ্গে একপর্যায়ে তাঁর যোগাযোগ ঘটিয়ে দেন বাংলাদেশের একমাত্র ল্যান্ডস্কেপ আর্কিটেক্ট, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক খন্দকার হাসিবুল কবির। ঝিলের পাড়ের ভূমি, জলভাগের মধ্যকার নকশা, কোন অংশে কী ধরনের গাছ লাগানো হবে—এসব সম্পর্কে তাঁরা ওই প্রতিষ্ঠানটিকে পরামর্শ দিয়েছিলেন।
তারপর অনেক দিন চলে গেছে। কী গাছপালা লাগানো হয়েছে বা হচ্ছে, সে সম্পর্কে বিশদ জানা যায় না। হাতিরঝিলের বৃক্ষরোপণ নিয়ে খবরের কাগজে নানা কথা লেখা হয়, অধিকাংশই অপ্রীতিকর সংবাদ। প্রকল্পটি উদ্বোধন হওয়ার অল্প কয়েক দিন আগে দ্বিজেন শর্মা স্থির করলেন, পুরো এলাকাটি ঘুরে দেখবেন। রীতিমতো একটা সমীক্ষা চালাবেন হাতিরঝিল প্রকল্পে বৃক্ষরোপণের ওপর। তাঁর সঙ্গে জুটলেন স্থপতি মুশতাক কাদরি, যাঁর পেশা দালানকোঠার নকশা তৈরি করা, আর নেশা গাছপালা। আমাকেও ডাকলেন দ্বিজেন শর্মা: তাঁদের জরিপকর্ম সরেজমিনে দেখেশুনে একটা লেখা তৈরি করব। এক শুক্রবার সকাল ১০টায় আমরা জড়ো হলাম হাতিরঝিলের সবচেয়ে পশ্চিম অংশে, এফডিসির দক্ষিণে রাস্তার পাশে। ওইখানে হাতিরঝিলকে বিভক্ত করেছে মগবাজার থেকে মহাখালীর দিকে যাওয়ার বড় সড়কটি। কেডস, টি-শার্ট ও লেনিন টুপি মাথায় দ্বিজেন শর্মা রাস্তার ধারে প্রথমেই লক্ষ করলেন দুজন মানুষ গাছ লাগানোর জন্য গর্ত খুঁড়ছেন। দুটি গর্তের মাঝখানের দূরত্ব ফুট পাঁচেক দেখে তিনি তাঁদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘এত ঘন করে গাছ লাগাচ্ছেন কেন?’ বেচারা দুজন পরস্পরের মুখের দিকে চাইলেন, দ্বিজেন শর্মার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলেন না। আমরা লক্ষ করলাম, বড় বড় জাতের অনেক গাছ লাগানো হয়েছে, কিন্তু সেগুলোর মাঝখানের দূরত্ব বেশ কম। আরও পরের দিকে আমরা যখন পুরো প্রকল্প এলাকাটি ঘুরে দেখি, তখনো একই বিষয় লক্ষ করি।
একসময় দ্বিজেন শর্মা বললেন, এই সমস্যা কেবল হাতিরঝিলেই নয়, ধানমন্ডি লেকে এবং ঢাকা শহরের অন্যান্য জায়গায়ও। তিনি বললেন, ‘আমাদের জন্য গাছ লাগানোর আদর্শ মডেল হলো ১৯০৮ থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত রমনা গ্রিনে প্রাউডলকের গাছ লাগানোর মডেলটি। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তা আর অনুসরণ করা হয়নি। বরং মিন্টো রোড ও হেয়ার রোডে পেল্টোফোরাম ও জারুলের মিশ্র বীথি এবং পাদাউকের একক বীথির মাঝখানে লাগানো হয়ে প্রচুর মেহগনি।’
আমি জানতে চাইলাম, কেন এটা করা হয়েছে? পরিকল্পিতভাবেই কি করা হয়েছে? দ্বিজেন শর্মার মন্তব্য: কাজটা কোনো বোদ্ধার নয়, অদক্ষ বাগানকর্মীদের। এমনটা হয়েছে অজ্ঞতা থেকে। ‘এই অজ্ঞতা আমাদের গ্রাস করে ফেলেছে। এবং দেখা যাচ্ছে, হাতিরঝিলেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি।’
হাতিরঝিলে অবশ্য মেহগনির দেখা মিলল না। কিন্তু দ্বিজেন শর্মা ও মুশতাক কাদরি একই সঙ্গে লক্ষ করলেন, প্রকল্পের সব অংশেই দুটি গাছের মাঝখানের দূরত্ব নির্ধারণ এবং গাছের গড়ন ও ফুল নির্বাচনের বিষয়টি মোটেই আমলে নেওয়া হয়নি। দ্বিজেন শর্মা বললেন, ‘অচিরেই পুরো এলাকাটি সৌন্দর্যহীন একটা জঙ্গলে পরিণত হবে।’
রেললাইনের পাশে কয়েকটি তালগাছ দেখিয়ে মুশতাক কাদরি বললেন, এই অঞ্চলে একসময় অনেক তালগাছ ছিল। এ গাছ এই মাটির আপন। ঝিলের এই অংশে তালগাছ লাগানো যেত। দ্বিজেন শর্মা যোগ করলেন, লেকের পাড়ে দেশি পাম, তাল, নারকেল ও খেজুরগাছ লাগালে লেকের সৌন্দর্য সবার জন্য উন্মুক্ত থাকত। কিন্তু আমরা ঘুরে ঘুরে দেখতে পেলাম, অনেক জায়গায় লেকের ধারে লাগানো হয়েছে অনেক ঝোপালো গাছ—কৃষ্ণচূড়া, বকুল, হিজল ইত্যাদি। এবং দ্বিজেন শর্মার মতে, সেগুলো লাগানো হয়েছে বড়ই বেখাপ বিন্যাসে। পানির কাছে লাগানো হয়েছে ঝোপালো গাছ, তারপর দ্বিতীয় সারিতে মহার্ঘ বিদেশি পাম, যা বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে কিনে আনা হয়েছে বিদেশ থেকে। কৃষ্ণচূড়া, বকুল, হিজল ইত্যাদি ঝোপালো গাছের সারিতে কোথাও কোথাও টগর দেখে দ্বিজেন শর্মার মন্তব্য: ‘বড়ই হাস্যকর।’
রামপুরার দিকে যেতে এক জায়গায় চোখে পড়ল এক সারি ক্যাসুরিনা বা পবন-ঝাউ। দ্বিজেন শর্মা বললেন, ‘এ তো উপকূলের বাসিন্দা। উপকূলে খোলা সমুদ্র আর উন্মুক্ত আকাশের পটভূমিতে একে যত আকর্ষণীয় লাগে ঢাকায় ততটা হবে না।’ একটা বিষয় লক্ষ করার মতো, বিদেশি পাম ও ক্যাসুরিনাসহ অনেক গাছ লাগানো হয়েছে, যেগুলো এই দেশে পাওয়া যায় না, বিদেশ থেকে কিনে আনতে হয়। ল্যান্ডস্কেপ আর্কিটেক্ট হাসিবুল কবির মনে করেন, বিদেশ থেকে একটিও গাছ আমদানি করার প্রয়োজন ছিল না। এখানেই ঝিলের বিভিন্ন অংশের আদি বাসিন্দা গাছগাছালিদের খোঁজ বের করে, সেগুলোকে পুনঃস্থাপন করাই যথেষ্ট ছিল। কোথাও হয়তো এক টুকরো বাঁশঝাড় ছিল, কোথাও ছিল একটা বরইগাছ।
প্রায় পুরো প্রকল্প এলাকাই আমরা গাড়ি নিয়ে ঘুরে দেখলাম। শেষের দিকে দ্বিজেন শর্মা বললেন, ‘একটা বিষয় খেয়াল করো, ফলের গাছ লাগানো হয়নি। পুরো হাতিরঝিলে কোনো ফলগাছ নেই।’ পাখি ও গরিব কিশোর-কিশোরীদের জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেন তিনি। হাতিরঝিল প্রকল্পে যাঁরা গাছ লাগানোর পরিকল্পনা করেছেন, তাঁরা তাদের কথা মনে রাখেননি। তাঁর মতে, এই প্রকল্পে অন্তত কুড়ি শতাংশ সাধারণ ফলের গাছ লাগানো উচিত ছিল। লাগানো যেত দেশি জাতের আম, কালোজাম, বুনোজাম, আমলকী, আমড়া, জলপাই, কামরাঙা ইত্যাদি গাছ।
দ্বিজেন শর্মা, মুশতাক কাদরি ও হাসিবুল কবির—তিনজনই মনে করেন, হাতিরঝিলের বৃক্ষরোপণে ভুলের অন্ত নেই। আগে থেকেই একটি নীতিমালা তৈরি করে তা অনুসরণ করা হলে এতটা ভুল হতো না। লেকের পাড়ের ধরন অনুযায়ী বিভিন্ন গাছের সমাবেশ বা বিন্যাস (কৃষ্ণচূড়া, পেল্টোফোরাম, লাল সোনাইল, জারুল), সাধারণ ফলের গাছের সংখ্যা, দেশি গাছের প্রাধান্য, একটি গাছ থেকে অন্য গাছের দূরত্ব ইত্যাদি বিষয়ে পরিকল্পনা নিয়ে গাছ লাগানো উচিত ছিল। দ্বিজেন শর্মার মতে, এই সাধারণ বিষয়গুলো জানা না থাকলে এ রকম বড় প্রকল্পে গাছ লাগানো যায় না।
হাতিরঝিল প্রকল্প যদিও সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে, তবু পুরো প্রকল্পটি এখনো সম্পূর্ণ হয়নি। এখানে গাছ লাগানোয় যেসব ভুলভ্রান্তি ঘটেছে, তা শোধরানোর সুযোগ এখনো আছে বলে মনে করেন দ্বিজেন শর্মা; দুই স্থপতিরও একই মত। লেকের পাড় ধরে বিরাট একটা অংশজুড়ে পুরো বৃক্ষরোপণের প্রকল্পটি পুনর্বিবেচনা করা সম্ভব। ইতিমধ্যে লাগানো গাছগুলোর মধ্যবর্তী ফাঁকা জায়গা ও বিন্যাস পরিবর্তন করাও অসম্ভব নয়। কিন্তু শীতকাল তো গাছ লাগানোর মৌসুম নয়। সে জন্য আগামী বর্ষা পর্যন্ত অপেক্ষা করা যেতে পারে, তখন আবারও গাছ লাগানো যাবে।
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com
No comments