কূটনৈতিক পাড়া সরগরম, বছর জুড়ে ১৬২ পার্টি by মান্নান মারুফ
রাজনৈতিক পরিস্থিতি, পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রূপরেখা ও যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে ২০১২ সালে কূটনৈতিক পাড়া ছিল সরগরম। তবে প্রকাশ্য বৈঠক, প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলীয় নেতার সঙ্গে কূটনীতিকদের সৌজন্য সাক্ষাৎ
আর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখার চেয়ে পর্দার আড়ালের কূটনৈতিক তৎপরতা ছিল ঢের বেশি।তবে বছরের শেষ নাগাদ যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াত নেতাদের পক্ষে তুরস্কের দূতিয়ালি নতুন আলোচনার জন্ম দেয়।
বিদায়ী বছরে রাজনীতিক ও কূটনৈতিকদের ১৬২টি পার্টি আয়োজন করা হয় বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো।
কখনো কূটনীতিক, আবার কখনো রাজনৈতিক দলের সদস্যরা এসব পার্টি আয়োজন করেন।
এগুলোর মধ্যে গুলশান এলাকার হোটেলে ৯৭টি, কুটনৈতিকদের বাসায় ২৩টি, রাজনীতিকদের বাসায় ১৭ টি এবং ব্যাবসায়ীদের বাসায় ২৫টি পার্টি হয়।
বড়দিন, জম্মদিন, ন্যাশনাল ডে, নববর্ষ আর বিভিন্ন ব্যক্তিগত উপলক্ষে এসব পার্টি দেওয়া হলেও রাজনৈতিক আলোচনাই মূল বিষয় হয়ে ওঠে।
পার্টিগুলোতে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি, আগামী জাতীয় সংসদ নিবার্চন ও যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।
কূটনৈতিক সূত্র জানায়, অধিকাংশ পার্টিতেই বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির নেতারা উপস্থিত ছিলেন। সরকারের মন্ত্রী ও উপদেষ্টাদেরও দেখা গেছে এসব অনুষ্ঠানে।
যে জামায়াতকে নিয়ে বাইরে এতো রাজনৈতিক যুদ্ধ, সেই জামায়াতের নেতারাও ছিলেন এমন অনেক পার্টিতে।
বছরের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকগুলোর মধ্যে অক্টোবর মাসে আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ, আব্দুল জলিল, কাজী জাফরুল্লাহ ও মহিউদ্দিন খান আলমগীরের সঙ্গে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বৈঠক, ৬ নভেম্বর মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বাসায় ভারতীয় হাইকমিশনারের দু’ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক, ৭ নভেম্বর চীনের রাষ্ট্রদূতের বাসায় মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বৈঠক ও ৮ নভেম্বর ভারতীয় হাই কমিশনার এবং মার্কিন রাষ্ট্রদূতের গুলশানের ৮৬ নম্বর রোডের এক বাড়িতে হওয়া বৈঠক রয়েছে।
এছাড়া সম্প্রতি জার্মান কূটনীতিকদের বাসায় যান আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ। তিনি সেখানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কূটনীতিকদের যুদ্ধাপরাধের বিচারের স্বচ্ছতার বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন।
এছাড়া ২২ ডিসেম্বর ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের বাসায় একটি পার্টিতে যোগ দেন সাংবাদিক রাজনীতিক, কূটনীতিক, শিক্ষাবিদ ও ব্যাবসায়ীরা।এ পার্টিতে জাতীয় পার্টির আনিসুল ইসলাম মাহমুদও ছিলেন।
বড় দিন উপলক্ষে ২০ ডিসেম্বর মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বাসায় একটি পার্টিতে যোগ দেন বিএনপির বেশ ক’জন সিনিয়র নেতা। এ পার্টিতে আরো ছিলেন বর্তমান সরকারের মন্ত্রী ও উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, জামায়াতের ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক, কূটনীতিক ও ব্যবসায়ীরা।
এর আগের দিন ১৯ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা, মন্ত্রী, ব্যবসায়ী, মার্কিন রাষ্ট্রদূত একটি বৈঠক করেন গুলশানের এক হোটেলে। একই দিন জাপানের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠক করেন আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ।
তার ঠিক আগের দিন ১৮ ডিসেম্বর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা তপন চৌধুরীর বাসায় এক অনুষ্ঠনে যোগ দেন আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সেক্রেটারি অবুল কালাম আজাদ, ব্যরিস্টার ফজলে নুর তাপস এমপি, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোরশেদ খানসহ বেশ কয়েকজন কূটনীতিক।
১৭ ডিসেম্বর ভুটানের রাষ্ট্রদূতের এক পার্টিতে যোগ দেন শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. তোফিক ই ইলাহী, ড. মশিউর রহমান, বিএনপি নেতা ড. আবদুল মঈন খান, শমশের মোবিন চৌধুরী, এনাম আহমেদ চৌধুরী প্রমুখ রাজনীতিক। ছিলেন রেহমান সোবহান ও ফারুক সোবহানসহ বেশ কয়েকটি দেশের কূটনীতিকও।
এদিকে ১০ ডিসেম্বর ব্যবসায়ী আব্দুল আউয়াল মিন্টুর বাসায় এক পার্টিতে ব্যাবসায়ী, কূটনৈতিক, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতা ছাড়াও কয়েকজন শিক্ষক ও ব্যবসায়ী যোগ দেন।
সবকিছু মিলিয়ে এ বছর কূটনৈতিক পাড়া ছিল খুবই সরগরম।
এছাড়া গত ২০ ডিসেম্বর তুরস্কের সাবেক স্টেট মিনিস্টার লুতফুইসিনজনের নেতৃত্বে ১৪ সদস্যের এক প্রতিনিধি দল টুরিস্ট ভিসায় বাংলাদেশ সফরে এসে জামায়াতের পক্ষে ব্যাপক দূতিয়ালি করে।
রাজধানীর বনানীতে ইনোটেল নামক হোটেলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র তাদের নামে বুকিং দেন।
২১ ডিসেম্বর রাত ৮টা থেকে ১০ পর্যন্ত প্রতিনিধি দলটি গুলশানের এক হোটেলে যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য আটক জামায়াত নেতাদের আইনজীবী ব্যারিস্টার মুন্সী আহসান কবীর, অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম, অ্যাডভোকেট জসিম উদ্দিন, অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম, অ্যাডভোকেট সাজ্জাদ হোসেন, অ্যাডভোকেট আবদুর রহমান, অ্যাডভোকেট সিদ্দিকুর রহমানসহ অন্তত ১৫ জন আইনজীবীর সঙ্গে বৈঠক করেন।
২২ ডিসেম্বর সকালে তুর্কি প্রতিনিধি দলটি বৈঠক করে বিএনপি নেতাদের সঙ্গে। সকাল সাড়ে ১০টা থেকে পৌনে দুই ঘণ্টাব্যাপী বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ের এ বৈঠকে বিএনপির পক্ষে অংশ নেন দলের ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা রিয়াজ রহমান ও সাবিহ উদ্দিন আহমেদ।
এরপর দুপুর ২টা থেকে সাড়ে ৪টা পর্যন্ত তুরস্কের প্রতিনিধি দলটি জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে তার কার্যালয়ে বৈঠকে বসে। এ বৈঠকে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে আটক জামায়াত নেতা মীর কাশেম আলীর ছেলে ব্যারিস্টার আরমানসহ আরো ৭/৮জন ছিলেন।
তুর্কি প্রতিনিধি দলটির সঙ্গে সবশেষ বৈঠকটি হয় আইন ও শালিস কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার একজন সাক্ষী অ্যাডভোকেট সুলতানা কামালের। রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত এই বৈঠকটি হয়।
No comments