বাণিজ্যিকভাবে শামুক আহরণ হুমকির মুখে জীববৈচিত্র্য by সুব্রত সাহা

গোপালগঞ্জের খাল-বিলসহ বিভিন্ন জলাশয় থেকে বছরের পর বছর ধরে বাণিজ্যিকভাবে শামুক আহরণ করা হচ্ছে। বর্তমানে এসব জলাশয় থেকে প্রতিদিন ১৫ থেকে ২৫টি ট্রাকে করে শামুক সরবরাহ করা হচ্ছে বাগেরহাটসহ দক্ষিণাঞ্চলের চিংড়িঘেরগুলোতে। নির্বিচারে শামুক আহরণের ফলে হুমকির মুখে পড়েছে জীবৈচিত্র্য।


পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যাপকহারে শামুকনিধন জলাভূমির খাদ্য-শৃঙ্খলাও নষ্ট করছে। শামুকের ডিম দেশীয় প্রজাতির মাছের প্রধান খাদ্য। শুকনো মৌসুমে এই শামুকের খোলস জমির অম্লতা কমিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনে। সর্বোপরি নির্বিচারে শামুকনিধনের ফলে মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে জীববৈচিত্র্য।
সরেজমিন ঘুরে ও শামুক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভোর থেকে শুরু করে বেলা ১১টা পর্যন্ত ছোট ছোট নৌকা নিয়ে বাঁশের লাঠির মাথায় নেট দিয়ে গোলাকৃতির ছাঁকনি বানিয়ে জলাধার থেকে এসব শামুক ধরছেন স্থানীয় লোকজন। বিলাঞ্চলের মধ্যেই দুপুরে বসছে ভাসমান শামুকের বাজার। স্থানীয়ভাবে এসব বাজারকে ‘শামুকের গালা’ বলা হয়। এখান থেকে নৌকায় করে ফরিয়ারা এসব শামুক কিনে নিয়ে যান। পরে শামুকগুলো বস্তায় ভরে সড়ক-মহাসড়কের পাশে পাইকারি বিক্রি করা হয়। এই শামুকের সর্বশেষ গন্তব্য বাগেরহাটের ফলাতিতা বাজার। এরপর দক্ষিণাঞ্চলের চিংড়িচাষিরা এই বাজার থেকে শামুক কিনে নিয়ে যান মাছের খাবার হিসেবে। এভাবে দুই দশক ধরে বাণিজ্যিকভাবে শামুক আহরণ করা হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘের (আইইউসিএন) এক জরিপে দেখা গেছে, গোপালগঞ্জের বৃহত্তম জলাধার চান্দা বিলে দেশীয় প্রজাতির মাছ কমে গেছে প্রায় ৪০ শতাংশ। এই বিলের পরিবেশ নিয়ে কর্মরত বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভ্যান্স স্টাডিজের (বিসিএএস) গবেষণা কর্মকর্তা তোফায়েল আহমেঞ্চদ প্রথম আলোকে বলেন, আইইউসিএন ওই জরিপ করে ২০০১ সালেরও আগে। বর্তমানে মাছের সংকট আরও বেশি।
বিসিএএস সূত্রে জানা গেছে, শামুক আহরণের প্রবণতা চান্দা বিলে সবচেয়ে বেশি। ১০ হাজার হেক্টর আয়তনের এই বিল ছাড়াও জেলায় আরও শতাধিক বিল, বাঁওড় এবং কয়েক শ খাল রয়েছে। এসব জলাশয় মধুমতী নদীর সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত। এসব জলাশয়ে জোয়ার-ভাটার পানি প্রবেশ করে। এ কারণে শামুক ও মাছের বিশাল আধার ছিল এই জলাশয়গুলো। কিন্তু বিলাঞ্চলের মানুষ শামুক ধরাকে পেশা হিসেবে বেছে নেওয়ায় জীববৈচিত্র্য বিনষ্ট হচ্ছে। তাদের হিসাবে বর্তমানে বিল এলাকার প্রায় ১০ হাজার মানুষ শামুক ধরে জীবিকা নির্বাহ করে।
চান্দা বিলে গিয়ে দেখে গেছে, বিলের মধ্যে ছোট ছোট নৌকা নিয়ে প্রায় অর্ধশত মানুষ শামুক ধরছেন। তাদের একজন দীনবন্ধু বিশ্বাস। তিনি জানালেন, ১৫ বছর ধরে তিনি শ্রাবণ থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত শামুক ধরেন। মিন্টু বিশ্বাস (২৬) বলেন, গড়ে প্রতিদিন যে শামুক ধরেন, তাতে ৪০০ টাকা আয় হয়। তিনি বলেন, ‘বিলে যখন শাপলা হয়, শাপলা তুলি। শুকনায় জমিতে শ্রম বিক্রি করি। বর্ষা মৌসুমই আমাদের আশীর্বাদ। আগে বিলে মাছ ছিল। মাছ ধরতাম। এখন মাছ নেই।’ নৌকার মাঝি ত্রিনাথ রায় (৬০) বলেন, প্রায় ৩৫ বছর ধরে তিনি এই বিলে নৌকা চালান। শীতের সময় আগে অনেক পাখি আসত। খাবার না থাকায় এখন আর পাখি আসে না।
বিসিএএসের রিসার্চ ফেলো সরদার শফিকুল আলম বলেন, বিলাঞ্চলের পাখিদের মধ্যে ঘুঘু, বক, পানকৌড়ি, ইঁদুর, সাপ ও মাছ শামুকের ওপর নির্ভরশীল। ব্যাপকহারে শামুক ধরে ফেলার কারণে জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। বিলে এরই মধ্যে মাছ কমে গেছে। শামুকের ডিম মাছের অন্যতম খাবার। শামুক বিলের কচুরি পচা ও অন্যান্য লতাপতা খেয়ে বেঁচে থাকে। এ কারণে পানিও পরিষ্কার থাকে। শুকনার সময় মারা যাওয়া শামুকের খোলস মাটির সঙ্গে মিশে অম্লতা নষ্ট করে। ফলে জমির উৎপাদনক্ষমতা বাড়ে। শামুকনিধন রোধে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে জানান তিনি।

No comments

Powered by Blogger.