জাতীয় নির্বাচন- সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ জরুরি by এম সাখাওয়াত হোসেন
একটি সুষ্ঠু নির্বাচন গণতন্ত্রের ভিত, যার মাধ্যমে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। নির্বাচনই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া এবং পালাবদলের একমাত্র স্বীকৃত পন্থা। কাজেই নির্বাচন অবশ্যই হতে হবে অবাধ এবং ইচ্ছুক সব প্রার্থীর অংশগ্রহণে।
সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের দায়িত্ব একটি গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচন ব্যবস্থাপনা সংস্থার। এই সংস্থার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো নির্বাচনের পরিবেশ এবং সব প্রার্থীর জন্য নির্বাচনের উপযোগী সমতলক্ষেত্র তৈরি করা। এ ক্ষেত্রে বহু উপাদানের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি হলো নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ ও পুনর্নির্ধারণ করা। কাজটি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে সংবিধানে দেশের নির্বাচন ব্যবস্থাপনা সংস্থা নির্বাচন কমিশনে যে কয়টি অবশ্য করণীয় কর্তব্যের উল্লেখ রয়েছে, তার মধ্যে একটি সীমানা নির্ধারণ। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১৯ (১)(গ)-এ উল্লিখিত রয়েছে, ‘সংসদ নির্বাচনের জন্য নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ করিবেন।’ এই সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনের প্রক্রিয়া ইত্যাদি উল্লেখ করে ১৯৭৬ সালে জারি করা হয় ‘দ্য ডিলিমিটেশন অব কনস্টিলেন্সিস অর্ডিন্যান্স, ১৯৯৬’। এই অধ্যাদেশের অধীনেই এ পর্যন্ত বাংলাদেশের সংসদীয় আসনগুলো পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে। এই অর্ডিন্যান্সে উল্লিখিত হয়েছে যে প্রতি আদমশুমারির পরিপ্রেক্ষিতে এবং প্রতি সংসদীয় নির্বাচনের আগে সীমানা পুনর্নির্ধারণ করতে হবে। কাজেই সীমানা নির্ধারণে জনসংখ্যার বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
যেহেতু বিশ্বের সব গণতান্ত্রিক দেশের মতোই বাংলাদেশেও সংসদীয় আসনসংখ্যা সংবিধান দ্বারা নির্ধারিত—আমাদের সংবিধানে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের জন্য ৩০০ আসন নির্ধারিত আছে। প্রতিটি আসন ভৌগোলিক সীমানা দ্বারা নির্ধারিত। প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ওই এলাকার জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করেন, যদিও জনগণের মধ্যে সবাই ভোটার হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন না।
এই ভৌগোলিক এলাকাই গুণসমষ্টির প্রেক্ষাপটে পরিবর্তিত হয়ে থাকে। সংবিধান দ্বারা নির্ধারিত আসনসংখ্যা পরিবর্তনযোগ্য নয় বলেই এই ব্যবস্থা। প্রতিবেশী ভারতে প্রতি আদমশুমারির আগেই ওই দেশের সংবিধানের আওতায় ভারতীয় ‘লোকসভা’ আইন দ্বারা আলাদা কমিশন গঠন করে থাকে সীমানা পুনর্নির্ধারণের কাজ সম্পন্ন করার জন্য। এই কমিশন স্বাধীনভাবে সীমানা পুনর্নির্ধারণ করার পর নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনকে ফলাফল হস্তান্তর করে। নির্বাচন কমিশন এই কমিশনকে সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করে মাত্র। ভারতীয় গণতান্ত্রিক ধারায় সীমানা পুনর্নির্ধারণ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ওই দেশের জনসংখ্যার বহুসংখ্যক উপজাতি এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থাকায় তাদের জন্য কিছু নির্ধারিত সীমানা রয়েছে। অপর দিকে, বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে জনসংখ্যার ভিত্তিতে আসন পুনর্নির্ধারণ করতে হয়। কাজটি জটিল বলেই এই ব্যবস্থা। অবশ্য আমাদের দেশে এত জটিলতা নেই, যে কারণে কাজটি নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বে দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশে সংবিধান রচিত হয় ১৯৭২ সালে এবং প্রথম আদমশুমারি অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৪ সালে। এরপর ১৯৮১ সাল থেকে ১০ বছর পর পর আদমশুমারি হয়, কিন্তু নির্বাচন কমিশনের তথ্য মোতাবেক ১৯৮৪ সালে প্রথম ব্যাপকভাবে সংসদীয় আসন জনসংখ্যার ভিত্তিতে পুনর্নির্ধারিত হয়েছিল। এরপর শুধু যৎসামান্য রদবদল ছাড়া সীমানা পুনর্নির্ধারণের কাজটি করা হয়নি। এর পরের পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছিল ২০০১ সালের আদমশুমারির ওপর ভিত্তি করে ২০০৮ সালে। ২০০১ সালে আদমশুমারির কাজ শেষ হলেও রাজনৈতিক সরকারের মেয়াদকালে রিপোর্ট আকারে প্রকাশিত হয়নি, যে কাজটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৭ সালে সম্পন্ন করলে নির্বাচন কমিশন ২০০৮ সালে প্রায় ২৪ বছর পর চূড়ান্তভাবে সীমানা পুনর্নির্ধারণ করলে ৮৮টি আসনের ভৌগোলিক সীমানায় রদবদল হয়। জনসংখ্যা অনুপাতে কোনো কোনো জেলায় আসন কমাতে এবং কোনো কোনো জেলায় আসন বাড়াতে হয়েছিল। কাজটি সহজ ছিল না। বিষয়টি রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট থেকেও যথেষ্ট স্পর্শকাতর হয়ে উঠেছিল।
সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ করতে গিয়ে তৎকালীন নির্বাচন কমিশনের যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল, তার ওপর ভিত্তি করে ১৯৭৬ সালের অধ্যাদেশের কিছু পরিবর্তনের সুপারিশ করা হয়েছিল। ওই সুপারিশ আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর পর পুনরায় বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মতামতের জন্য ফেরত পাঠালেও অধ্যাবধি এরপর কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে তথ্য পাওয়া যায়নি। ইতিমধ্যে ২০১১ সালের আদমশুমারির ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। জনসংখ্যা ঠিক করা হয়েছে ১৫ কোটি ৮৫ লাখ ৭০ হাজার ৫৩৫ (জুলাই ২০১১)। ঢাকা জেলায় ৪ শতাংশ হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় এক কোটি ২০ লাখের ওপরে দাঁড়িয়েছে। তেমনি চট্টগ্রাম, খুলনাসহ অন্যান্য শহরেও জনসংখ্যা বেড়েছে। উল্লেখ্য, ২০০১ সালের আদমশুমারিতে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল ১২ কোটি ৪৩ লাখ ৫৫ হাজার ২৬৩ এবং ঢাকা জেলার ৮৫ লাখ ১১ হাজার ২২৮।
এই জনসংখ্যার ওপর ভিত্তি করে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কাল, সীমানা পুনর্নির্ধারণের সাংবিধানিক এই দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনকে পালন করতে হবে। এই দায়িত্ব যদি বিদ্যমান অধ্যাদেশের আওতায় পালন করতে হয়, তাহলে বহু ধরনের বিপত্তির মুখে পড়তে হবে। তবে যে বিষয়ে আলোচনার আগে কেন এই পুনর্নির্ধারণ প্রয়োজন, তার অতি সংক্ষেপ বিবরণ দেওয়া প্রয়োজন।
সংসদীয় আসন পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে প্রায় সব সংসদীয় আসনে যত দূর সম্ভব জনসংখ্যার সমতা আনার চেষ্টা থাকে। অতীতে প্রভাবশালী রাজনীতিবিদেরা স্বীয় সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণে প্রভাব খাটিয়ে যত দূর সম্ভব জনসংখ্যা কম রেখেছেন, অপর দিকে ওই একই জেলায় অন্য আসনগুলোতে জনসংখ্যা কয়েক গুণ বেশি ছিল। কাজেই আনুপাতিক হারে ভোটারও কম ছিল। উদাহরণস্বরূপ: অতীতে একটি ছোট আসনে ২০-৫০ হাজার ভোটার যুক্ত হয়েছেন, অথচ ওই একই জেলায় এক লাখের ওপরে ভোট পেয়ে নির্বাচিত হওয়ার নজিরও রয়েছে। পার্শ্ববর্তী আসন থেকে শুধু ভোটারসংখ্যার অসমতার কারণে নির্বাচিত হতে পারেনি।
দু-একটি উদাহরণ টানলে বিষয়টি সহজ হবে। ২০০৮ সালের সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণের আগে ঢাকা জেলার দোহার উপজেলা নিয়ে গঠিত ঢাকা-১-এর ভোটারসংখ্যা ছিল এক লাখ ৬৬ হাজার ৮৬২, অপর দিকে একই জেলার ভৌগোলিক সীমানায় অবস্থিত ঢাকা-১১-এর ভোটারসংখ্যা ছিল আট লাখ ৪৭ হাজার ২৬৩। সাধারণত জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ ভোটার হয়ে থাকেন। ঢাকার নিকটবর্তী জেলা টাঙ্গাইলের একটি আসন টাঙ্গাইল-৫-এর ভোটারসংখ্যা ছিল পাঁচ লাখ চার হাজার ৭৩০; অথচ লাগোয়া আসন টাঙ্গাইল-৬-এর ভোটারসংখ্যা ছিল দুই লাখ ২১ হাজার ৫৪৩। অন্যান্য আসনে এ ধরনের বৈষম্য বিদ্যমান ছিল। এ ধরনের বৈষম্য কোনো বিশেষ ব্যক্তি অথবা দলের প্রভাবের কারণে সুবিধাজনক পরিস্থিতি তৈরির জন্য করা হয়েছিল।
২০০৮ সালে এসব বৈষম্য দূর করতে প্রচলিত পদ্ধতি মোট জনসংখ্যাকে ৩০০ আসন দ্বারা বিভাজন করে জাতীয় জনসংখ্যা কোটা চার লাখ ১৪ হাজার ৫১৭ নির্ধারণ করা হয়েছিল। জেলার আসন দিয়ে সম্পূর্ণ জেলার জনসংখ্যাকে বিভাজিত করলে পাওয়া যাবে জেলা জনসংখ্যার কোটা। এই মান বিবেচনায় নিয়ে কম-বেশি ২৫ শতাংশের মধ্যেই ওই জেলার আসন সমন্বয় করা হয়েছে। এ কারণে চূড়ান্তভাবে মাত্র ৮৪ আসনে সীমানা রদবদল হয়েছিল।
স্মরণযোগ্য, মে ২০০১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী শুধু ঢাকা জেলাতেই জনসংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশি, যে কারণে সীমানা পুনর্নির্ধারণ এবং জনসংখ্যার ভিত্তিতে আসন পুনর্নির্ধারণ করতে গিয়ে ঢাকা জেলায় সাতটি আসন বাড়িয়ে পূর্বতন ১৩ থেকে ২০টিতে উন্নীত করতে হয়েছিল। এর মধ্যে শুধু ঢাকা শহরেই ১৬টি আসন বরাদ্দ করতে হয়েছিল, যা পূর্বতন আসনের দ্বিগুণের বেশি। একই কারণে চট্টগ্রাম শহরে একটি আসন বাড়িয়ে তিনটি করা হয়েছিল। বিভিন্ন কারণে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ আরও দু-একটি শহরে অভ্যন্তরীণ স্থানান্তর অব্যাহত থাকায় প্রতিবছর জনসংখ্যা বাড়ছে। শুধু ঢাকা জেলাতেই প্রতিবছর ৪ শতাংশ মানুষ বাড়ছে। হয়তো এদের সিংহভাগই ঢাকার ভোটার নন, তবে আদমশুমারির আওতায় ঢাকা জেলার বাসিন্দা বলে বিবেচিত।
ওপরের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ধারণা করা যায়, ২০১১ সালে আদমশুমারিতে ঢাকা জেলার জনসংখ্যা আগের তুলনায় ৩৫ লাখ বেড়েছে। সে ক্ষেত্রে ঢাকা শহরের জন্য অতিরিক্ত দুই থেকে তিনটি আসনের প্রয়োজন হবে এবং ঢাকা জেলার আসনসংখ্যা বাড়বে তিনটি। কারণ, এবারের জাতীয় জনসংখ্যা কোটা দাঁড়াবে পাঁচ লাখ ২৮ হাজার ৫৬৮ দশমিক ৪৫। স্বভাবতই এই বাড়তি আসন পুনর্বিন্যাস করতে গিয়ে অতিরিক্ত আসন প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে কমিয়ে ঢাকা জেলায় যোগ করতে হবে। ঢাকা শহর ছাড়া অন্যান্য শহরে তেমন না হলেও চট্টগ্রাম শহরেও জনসংখ্যা বেড়েছে, যার চাপ পড়বে সীমানা পুনর্নির্ধারণে।
২০০৮ সালে সীমানা পুনর্নির্ধারণ করতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল, বিশেষ করে ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো বড় শহরে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার ভিত্তিতে আসনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপ এড়াতে, তারই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৬ সালের অধ্যাদেশে কিছু মৌলিক পরিবর্তন আনার সুপারিশ করা হয়েছিল এবং আইনের আওতায় বিধিতে ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো শহর ও জেলার আসনসংখ্যা স্থায়ীভাবে সীমিত করার সুপারিশ করা হয়েছিল। তা ছাড়া, সীমানা পুনর্নির্ধারণের কাজকে আরও গতিশীল করতে বেশ কিছু পরিবর্তনের সুপারিশও করা হয়েছিল বিদ্যমান অধ্যাদেশে (Ordinance No´V of 1976)।
শুধু ঢাকা জেলার চাহিদা এবং দুটি বিভাগে আসন বাড়াতে গিয়ে কমাতে হয়েছিল কয়েকটি জেলার আসনসংখ্যা। স্বভাবতই ওই আসন কমাতে এক দিকে যেমন রাজনীতিবিদদের, অপর দিকে রাজনীতি-সচেতন জনগণের মনঃকষ্টের কারণ হয়েছিল। যেহেতু বিভিন্ন কারণে সীমানা পুনর্নির্ধারণের কাজটি অব্যাহতভাবে করা সম্ভব হয়নি, সেহেতু ২০০৮ সালে বেশ জটিল পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল। এসব প্রেক্ষাপটে অধ্যাদেশের পরিবর্তন জরুরি হয়ে পড়েছিল।
আমি মনে করি, সীমানা পুনর্নির্ধারণ করতে গিয়ে ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতেও যেখানে সিটি করপোরেশনের অস্তিত্ব রয়েছে, সেই সব শহর এলাকায় সংসদীয় আসন স্থায়ীভাবে সীমিত রাখা উচিত। অন্যথায় প্রতিবার সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণের সময় এসব শহরে আসন বাড়াতে হবে আর ক্ষতিগ্রস্ত হবে প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগণ এবং ওই অঞ্চলের রাজনীতিবিদেরা। সীমানা পুনর্নির্ধারণ নির্বাচন কমিশনের শুধু সাংবিধানিক দায়িত্বই নয়, বরং নৈতিক দায়িত্বও বটে। নির্বাচন সুষ্ঠু করতে হলে এবং সব প্রার্থীর জন্য সমতলক্ষেত্র তৈরি করতে হলে এ কাজের বিকল্প নেই। যেহেতু জনসংখ্যার প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, সেহেতু কাজটি যত দ্রুত সম্পন্ন করা যায়, সেই প্রচেষ্টা বাঞ্ছনীয়। আশা করি, নির্বাচন কমিশন এ ক্ষেত্রে সঠিক পদক্ষেপ নেবে।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন (অব.): সাবেক নির্বাচন কমিশনার, কলাম লেখক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।
যেহেতু বিশ্বের সব গণতান্ত্রিক দেশের মতোই বাংলাদেশেও সংসদীয় আসনসংখ্যা সংবিধান দ্বারা নির্ধারিত—আমাদের সংবিধানে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের জন্য ৩০০ আসন নির্ধারিত আছে। প্রতিটি আসন ভৌগোলিক সীমানা দ্বারা নির্ধারিত। প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ওই এলাকার জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করেন, যদিও জনগণের মধ্যে সবাই ভোটার হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন না।
এই ভৌগোলিক এলাকাই গুণসমষ্টির প্রেক্ষাপটে পরিবর্তিত হয়ে থাকে। সংবিধান দ্বারা নির্ধারিত আসনসংখ্যা পরিবর্তনযোগ্য নয় বলেই এই ব্যবস্থা। প্রতিবেশী ভারতে প্রতি আদমশুমারির আগেই ওই দেশের সংবিধানের আওতায় ভারতীয় ‘লোকসভা’ আইন দ্বারা আলাদা কমিশন গঠন করে থাকে সীমানা পুনর্নির্ধারণের কাজ সম্পন্ন করার জন্য। এই কমিশন স্বাধীনভাবে সীমানা পুনর্নির্ধারণ করার পর নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনকে ফলাফল হস্তান্তর করে। নির্বাচন কমিশন এই কমিশনকে সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করে মাত্র। ভারতীয় গণতান্ত্রিক ধারায় সীমানা পুনর্নির্ধারণ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ওই দেশের জনসংখ্যার বহুসংখ্যক উপজাতি এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থাকায় তাদের জন্য কিছু নির্ধারিত সীমানা রয়েছে। অপর দিকে, বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে জনসংখ্যার ভিত্তিতে আসন পুনর্নির্ধারণ করতে হয়। কাজটি জটিল বলেই এই ব্যবস্থা। অবশ্য আমাদের দেশে এত জটিলতা নেই, যে কারণে কাজটি নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বে দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশে সংবিধান রচিত হয় ১৯৭২ সালে এবং প্রথম আদমশুমারি অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৪ সালে। এরপর ১৯৮১ সাল থেকে ১০ বছর পর পর আদমশুমারি হয়, কিন্তু নির্বাচন কমিশনের তথ্য মোতাবেক ১৯৮৪ সালে প্রথম ব্যাপকভাবে সংসদীয় আসন জনসংখ্যার ভিত্তিতে পুনর্নির্ধারিত হয়েছিল। এরপর শুধু যৎসামান্য রদবদল ছাড়া সীমানা পুনর্নির্ধারণের কাজটি করা হয়নি। এর পরের পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছিল ২০০১ সালের আদমশুমারির ওপর ভিত্তি করে ২০০৮ সালে। ২০০১ সালে আদমশুমারির কাজ শেষ হলেও রাজনৈতিক সরকারের মেয়াদকালে রিপোর্ট আকারে প্রকাশিত হয়নি, যে কাজটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৭ সালে সম্পন্ন করলে নির্বাচন কমিশন ২০০৮ সালে প্রায় ২৪ বছর পর চূড়ান্তভাবে সীমানা পুনর্নির্ধারণ করলে ৮৮টি আসনের ভৌগোলিক সীমানায় রদবদল হয়। জনসংখ্যা অনুপাতে কোনো কোনো জেলায় আসন কমাতে এবং কোনো কোনো জেলায় আসন বাড়াতে হয়েছিল। কাজটি সহজ ছিল না। বিষয়টি রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট থেকেও যথেষ্ট স্পর্শকাতর হয়ে উঠেছিল।
সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ করতে গিয়ে তৎকালীন নির্বাচন কমিশনের যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল, তার ওপর ভিত্তি করে ১৯৭৬ সালের অধ্যাদেশের কিছু পরিবর্তনের সুপারিশ করা হয়েছিল। ওই সুপারিশ আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর পর পুনরায় বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মতামতের জন্য ফেরত পাঠালেও অধ্যাবধি এরপর কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে তথ্য পাওয়া যায়নি। ইতিমধ্যে ২০১১ সালের আদমশুমারির ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। জনসংখ্যা ঠিক করা হয়েছে ১৫ কোটি ৮৫ লাখ ৭০ হাজার ৫৩৫ (জুলাই ২০১১)। ঢাকা জেলায় ৪ শতাংশ হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় এক কোটি ২০ লাখের ওপরে দাঁড়িয়েছে। তেমনি চট্টগ্রাম, খুলনাসহ অন্যান্য শহরেও জনসংখ্যা বেড়েছে। উল্লেখ্য, ২০০১ সালের আদমশুমারিতে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল ১২ কোটি ৪৩ লাখ ৫৫ হাজার ২৬৩ এবং ঢাকা জেলার ৮৫ লাখ ১১ হাজার ২২৮।
এই জনসংখ্যার ওপর ভিত্তি করে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কাল, সীমানা পুনর্নির্ধারণের সাংবিধানিক এই দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনকে পালন করতে হবে। এই দায়িত্ব যদি বিদ্যমান অধ্যাদেশের আওতায় পালন করতে হয়, তাহলে বহু ধরনের বিপত্তির মুখে পড়তে হবে। তবে যে বিষয়ে আলোচনার আগে কেন এই পুনর্নির্ধারণ প্রয়োজন, তার অতি সংক্ষেপ বিবরণ দেওয়া প্রয়োজন।
সংসদীয় আসন পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে প্রায় সব সংসদীয় আসনে যত দূর সম্ভব জনসংখ্যার সমতা আনার চেষ্টা থাকে। অতীতে প্রভাবশালী রাজনীতিবিদেরা স্বীয় সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণে প্রভাব খাটিয়ে যত দূর সম্ভব জনসংখ্যা কম রেখেছেন, অপর দিকে ওই একই জেলায় অন্য আসনগুলোতে জনসংখ্যা কয়েক গুণ বেশি ছিল। কাজেই আনুপাতিক হারে ভোটারও কম ছিল। উদাহরণস্বরূপ: অতীতে একটি ছোট আসনে ২০-৫০ হাজার ভোটার যুক্ত হয়েছেন, অথচ ওই একই জেলায় এক লাখের ওপরে ভোট পেয়ে নির্বাচিত হওয়ার নজিরও রয়েছে। পার্শ্ববর্তী আসন থেকে শুধু ভোটারসংখ্যার অসমতার কারণে নির্বাচিত হতে পারেনি।
দু-একটি উদাহরণ টানলে বিষয়টি সহজ হবে। ২০০৮ সালের সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণের আগে ঢাকা জেলার দোহার উপজেলা নিয়ে গঠিত ঢাকা-১-এর ভোটারসংখ্যা ছিল এক লাখ ৬৬ হাজার ৮৬২, অপর দিকে একই জেলার ভৌগোলিক সীমানায় অবস্থিত ঢাকা-১১-এর ভোটারসংখ্যা ছিল আট লাখ ৪৭ হাজার ২৬৩। সাধারণত জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ ভোটার হয়ে থাকেন। ঢাকার নিকটবর্তী জেলা টাঙ্গাইলের একটি আসন টাঙ্গাইল-৫-এর ভোটারসংখ্যা ছিল পাঁচ লাখ চার হাজার ৭৩০; অথচ লাগোয়া আসন টাঙ্গাইল-৬-এর ভোটারসংখ্যা ছিল দুই লাখ ২১ হাজার ৫৪৩। অন্যান্য আসনে এ ধরনের বৈষম্য বিদ্যমান ছিল। এ ধরনের বৈষম্য কোনো বিশেষ ব্যক্তি অথবা দলের প্রভাবের কারণে সুবিধাজনক পরিস্থিতি তৈরির জন্য করা হয়েছিল।
২০০৮ সালে এসব বৈষম্য দূর করতে প্রচলিত পদ্ধতি মোট জনসংখ্যাকে ৩০০ আসন দ্বারা বিভাজন করে জাতীয় জনসংখ্যা কোটা চার লাখ ১৪ হাজার ৫১৭ নির্ধারণ করা হয়েছিল। জেলার আসন দিয়ে সম্পূর্ণ জেলার জনসংখ্যাকে বিভাজিত করলে পাওয়া যাবে জেলা জনসংখ্যার কোটা। এই মান বিবেচনায় নিয়ে কম-বেশি ২৫ শতাংশের মধ্যেই ওই জেলার আসন সমন্বয় করা হয়েছে। এ কারণে চূড়ান্তভাবে মাত্র ৮৪ আসনে সীমানা রদবদল হয়েছিল।
স্মরণযোগ্য, মে ২০০১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী শুধু ঢাকা জেলাতেই জনসংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশি, যে কারণে সীমানা পুনর্নির্ধারণ এবং জনসংখ্যার ভিত্তিতে আসন পুনর্নির্ধারণ করতে গিয়ে ঢাকা জেলায় সাতটি আসন বাড়িয়ে পূর্বতন ১৩ থেকে ২০টিতে উন্নীত করতে হয়েছিল। এর মধ্যে শুধু ঢাকা শহরেই ১৬টি আসন বরাদ্দ করতে হয়েছিল, যা পূর্বতন আসনের দ্বিগুণের বেশি। একই কারণে চট্টগ্রাম শহরে একটি আসন বাড়িয়ে তিনটি করা হয়েছিল। বিভিন্ন কারণে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ আরও দু-একটি শহরে অভ্যন্তরীণ স্থানান্তর অব্যাহত থাকায় প্রতিবছর জনসংখ্যা বাড়ছে। শুধু ঢাকা জেলাতেই প্রতিবছর ৪ শতাংশ মানুষ বাড়ছে। হয়তো এদের সিংহভাগই ঢাকার ভোটার নন, তবে আদমশুমারির আওতায় ঢাকা জেলার বাসিন্দা বলে বিবেচিত।
ওপরের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ধারণা করা যায়, ২০১১ সালে আদমশুমারিতে ঢাকা জেলার জনসংখ্যা আগের তুলনায় ৩৫ লাখ বেড়েছে। সে ক্ষেত্রে ঢাকা শহরের জন্য অতিরিক্ত দুই থেকে তিনটি আসনের প্রয়োজন হবে এবং ঢাকা জেলার আসনসংখ্যা বাড়বে তিনটি। কারণ, এবারের জাতীয় জনসংখ্যা কোটা দাঁড়াবে পাঁচ লাখ ২৮ হাজার ৫৬৮ দশমিক ৪৫। স্বভাবতই এই বাড়তি আসন পুনর্বিন্যাস করতে গিয়ে অতিরিক্ত আসন প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে কমিয়ে ঢাকা জেলায় যোগ করতে হবে। ঢাকা শহর ছাড়া অন্যান্য শহরে তেমন না হলেও চট্টগ্রাম শহরেও জনসংখ্যা বেড়েছে, যার চাপ পড়বে সীমানা পুনর্নির্ধারণে।
২০০৮ সালে সীমানা পুনর্নির্ধারণ করতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল, বিশেষ করে ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো বড় শহরে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার ভিত্তিতে আসনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপ এড়াতে, তারই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৬ সালের অধ্যাদেশে কিছু মৌলিক পরিবর্তন আনার সুপারিশ করা হয়েছিল এবং আইনের আওতায় বিধিতে ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো শহর ও জেলার আসনসংখ্যা স্থায়ীভাবে সীমিত করার সুপারিশ করা হয়েছিল। তা ছাড়া, সীমানা পুনর্নির্ধারণের কাজকে আরও গতিশীল করতে বেশ কিছু পরিবর্তনের সুপারিশও করা হয়েছিল বিদ্যমান অধ্যাদেশে (Ordinance No´V of 1976)।
শুধু ঢাকা জেলার চাহিদা এবং দুটি বিভাগে আসন বাড়াতে গিয়ে কমাতে হয়েছিল কয়েকটি জেলার আসনসংখ্যা। স্বভাবতই ওই আসন কমাতে এক দিকে যেমন রাজনীতিবিদদের, অপর দিকে রাজনীতি-সচেতন জনগণের মনঃকষ্টের কারণ হয়েছিল। যেহেতু বিভিন্ন কারণে সীমানা পুনর্নির্ধারণের কাজটি অব্যাহতভাবে করা সম্ভব হয়নি, সেহেতু ২০০৮ সালে বেশ জটিল পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল। এসব প্রেক্ষাপটে অধ্যাদেশের পরিবর্তন জরুরি হয়ে পড়েছিল।
আমি মনে করি, সীমানা পুনর্নির্ধারণ করতে গিয়ে ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতেও যেখানে সিটি করপোরেশনের অস্তিত্ব রয়েছে, সেই সব শহর এলাকায় সংসদীয় আসন স্থায়ীভাবে সীমিত রাখা উচিত। অন্যথায় প্রতিবার সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণের সময় এসব শহরে আসন বাড়াতে হবে আর ক্ষতিগ্রস্ত হবে প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগণ এবং ওই অঞ্চলের রাজনীতিবিদেরা। সীমানা পুনর্নির্ধারণ নির্বাচন কমিশনের শুধু সাংবিধানিক দায়িত্বই নয়, বরং নৈতিক দায়িত্বও বটে। নির্বাচন সুষ্ঠু করতে হলে এবং সব প্রার্থীর জন্য সমতলক্ষেত্র তৈরি করতে হলে এ কাজের বিকল্প নেই। যেহেতু জনসংখ্যার প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, সেহেতু কাজটি যত দ্রুত সম্পন্ন করা যায়, সেই প্রচেষ্টা বাঞ্ছনীয়। আশা করি, নির্বাচন কমিশন এ ক্ষেত্রে সঠিক পদক্ষেপ নেবে।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন (অব.): সাবেক নির্বাচন কমিশনার, কলাম লেখক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।
No comments