আইন থাকলেও আইন নেই by এ এম এম শওকত আলী
অন্যান্য দেশের অবস্থা জানা নেই। তবে বাংলাদেশে অনেক ক্ষেত্রেই একটি বিষয় দৃশ্যমান। আইন থাকলেও আইন নেই। এর উৎস মূলত দুটি। এক. আইন না জানা। দুই. আইন জানা সত্ত্বেও তা প্রতিনিয়তই মানা হয় না। যানচালকসহ পথচারীদের দৃষ্টিভঙ্গিই তা প্রমাণ করে। অন্য কোনো প্রমাণের প্রয়োজন নেই।
অন্যদিকে ১৯৯৬ এবং সাম্প্রতিককালে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির জন্য দায়ী ব্যক্তিদের আইন-আদালতের সম্মুখীন করা হয়নি। এ বিষয়টি জোরালোভাবে বাজেট আলোচনায় উল্লেখ করা হয়। শেয়ারবাজার বিনিয়োগের একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। এটি ছোট-বড় সবার জন্যই। শেয়ারবাজারের অস্থিরতার কারণে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা নিঃস্ব হয়েছে। তবে শেয়ারে বিনিয়োগ করলে যে সব সময়ই লাভবান হওয়া যাবে, সে নিশ্চয়তা পৃথিবীর কোনো বাজারই দিতে পারবে না। কিন্তু ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা যে বারবার নিঃস্ব হবে- এ কথাও মেনে নেওয়া যায় না। যে কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, তা হলো- একটি ধ্রুব সত্য কথা। আইন থাকলেও আইন নেই। এ কারণে অনেকেই আইনের ভয়ে ভীত নয়।
শেয়ারবাজারের বাইরেও বিনিয়োগের অন্যান্য ক্ষেত্র রয়েছে। যেমন ব্যবসা-বাণিজ্য। আশুলিয়ার সব রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানা মালিকরা বন্ধ করে দিয়েছেন। কারণ শ্রমিকদের ক্রমাগত অসন্তোষ এবং সহিংস আচরণ। এ ক্ষেত্রে আইনের যে প্রয়োগ হয় না তা নয়। তবে এর ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য যে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তা অনস্বীকার্য। এ বিষয়ে কিছুদিন আগে মার্কিন রাষ্ট্রদূত সাবধান বাণী উচ্চারণ করেছিলেন। কিন্তু এ সত্ত্বেও না মালিক, না শ্রমিক বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত সংস্থা কোনো নিবারণমূলক পদক্ষেপ আগে নিতে সক্ষম হয়নি। মালিক দুষবে শ্রমিককে, শ্রমিক মালিককে এবং দুই পক্ষকেই হয়তো দুষবে অন্যরা। কিন্তু কোনো স্থায়ী সমাধান আজ পর্যন্ত হয়নি। হয়তো হবেও না।
সার ব্যবস্থাপনা আইন ২০০৬ এখনো আছে। এ আইনের বিধান অনুযায়ী যেসব সারের বিনির্দেশ সরকার এখনো অনুমোদন করেনি, এমন সব সার বা সারজাতীয় দ্রব্যের অনুমোদনের জন্য সরকার নির্ধারিত পরীক্ষাগারে পরীক্ষিত হওয়ার পর মাঠপর্যায়েও এর প্রায়োগিক সাফল্য যাচাই করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের প্রায় সব দেশেই এ ধরনের বিধান রয়েছে। উদ্দেশ্য ভূমির স্বাস্থ্য রক্ষা। অজানা ও অপরীক্ষিত কোনো সারে যদি ক্ষতিকর কোনো পদার্থ থাকে, তা জমির স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। ২০০৬ সালের আইনে জৈব সার প্রাথমিক প্রস্তাবে অন্তর্ভুক্ত করা হলেও তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ এ প্রস্তাব অনুমোদন করেনি। এ কথা হয়তো তখন মন্ত্রিপরিষদকে বলা হয়নি যে পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উৎপাদিত জৈব সার আইনের নিয়ন্ত্রণভুক্ত।
২০০৭ সালে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) পরামর্শে আবার জৈব সারকে আইনের নিয়ন্ত্রণের প্রস্তাব পেশ করে। অনুমোদনও দেওয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৮ সালে আইনের আওতাভুক্ত করা হয়। জৈব সারসংক্রান্ত বিনির্দেশও গেজেটে প্রকাশ করা হয়। আইনের বিধান অনুযায়ী বিনির্দেশ জারি হওয়ার পর জৈব সারের মাঠপর্যায়ে কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু এ সত্ত্বেও এ বিধান আজ পর্যন্ত অমান্যই করা হচ্ছে। ফলে প্রথমে সরকার নির্ধারিত পরীক্ষাগারে পরীক্ষা ও পরে মাঠপর্যায়ে পরীক্ষা করার ব্যবস্থা অক্ষুণ্ন রাখা হয়েছে। ফলে একজন বিনিয়োগকারীকে দুই থেকে তিন বছর অপেক্ষা করতে হয় চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য। আশার কথা এই যে সম্প্রতি কৃষি মন্ত্রণালয় এ বিষয়টি জানার পর একটি টেকনিক্যাল কমিটির মাধ্যমে আইন সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে।
পক্ষান্তরে এটাও বলা যায়, আইনের বিধান সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট সবাইকে অবহিত করে মাঠপর্যায়ে পরীক্ষা না করার আদেশ দিলেই অন্তত এ ক্ষেত্রে সংস্কারের কোনো প্রয়োজন হবে না। তবে অনুমোদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত কিছু সংস্থা এখনো ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে মাঠপর্যায়ে পরীক্ষা করা নিতান্তই আবশ্যক বলে মনে করে। এ জন্য বিষয়টি এখন সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনার পালা শুরু হয়েছে। এর মধ্যে বেশির ভাগ সংস্থা এ ভ্রান্তি দূর করার পক্ষে প্রাথমিকভাবে মত প্রকাশ করেছে। শুরু হয়েছে চূড়ান্ত আলোচনা পর্ব। তবে আইনের অন্যান্য বিধানও সংস্কারের প্রয়োজন বলে এখন অনেকেই স্বীকার করেছেন। কৃষি মন্ত্রণালয়ের টেকনিক্যাল কমিটিকে সহায়তার জন্য আইএফডিসির একটি বিশেষজ্ঞ দল কাজ শুরু করেছে। আশা করা যায়, আগামী অক্টোবর বা নভেম্বরের মধ্যে টেকনিক্যাল কমিটি এ-সংক্রান্ত সুপারিশ প্রণয়নে সক্ষম হবে।
আইনের অন্যান্য বিধানের সংস্কারের ক্ষেত্র একাধিক। মূল উদ্দেশ্য অনুমোদন প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা পরিহার করা। এ ক্ষেত্রগুলোর আলোচনা প্রয়োজন। পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে প্রাথমিক আবেদনের পর বিনিয়োগকারীকে বহুবিধ, অনেক ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় ধাপ অতিক্রম করতে হয়। এক. প্রাথমিক আবেদনের সঙ্গে উদ্যোক্তাকে নিজস্ব উদ্যোগে নমুনা পরীক্ষা করে নিবন্ধন কর্তৃপক্ষকে দিতে হয়। দুই. এরপর নির্ধারিত ফরমের আবেদন পরীক্ষার পর আবেদনকারীর কারখানা এক কর্মকর্তা পরিদর্শন করে একটি প্রতিবেদন কর্তৃপক্ষকে পাঠাবেন। বিধি অনুযায়ী এ প্রতিবেদন অনূর্ধ্ব ৬০ দিনের মধ্যে দাখিল করতে হবে। এত দিন কেন প্রয়োজন? এর সোজা উত্তর- কারখানা পরিদর্শনের কাজ ছাড়াও সংশ্লিষ্ট পরিদর্শকের আরো অনেক কাজ আছে। অবশ্যই আছে। কিন্তু এর জন্য সময় ৬০ দিন? শেষ পর্যন্ত প্রাথমিক আলোচনায় নিবন্ধন কর্তৃপক্ষ সময়সীমা ৩০ দিন করার জন্য সম্মতি প্রদান করেছে।
তিন. পরবর্তী ধাপ হলো, নির্ধারিত পরীক্ষাগারের নমুনা পরীক্ষা। এ জন্য পরিদর্শকের প্রতিবেদন ও প্রাসঙ্গিক বক্তব্য যাচাই করবে সার-সংক্রান্ত টেকনিক্যাল উপকমিটি। এ উপকমিটি বিএআরসিতে কাজ করে। উপকমিটি নমুনা পরীক্ষার জন্য সভা আহ্বান করবে। নির্ধারিত দিনে সভা হওয়ার আগে কমিটির এক ডজনেরও অধিক সদস্যকে পরিদর্শকের প্রতিবেদনের অনুলিপি পাঠাতে হবে। আহূত সভায় সিদ্ধান্তের পর কমিটির অন্তত দুইজন সদস্য সংশ্লিষ্ট কারখানার দুটি নমুনা সংগ্রহ করবেন। এগুলোকে তিনটি নির্ধারিত পরীক্ষাগারে পাঠাতে হবে। তিনটির মধ্যে দুটি পরীক্ষাগারের ফলাফল এক ও অভিন্ন হলে উপকমিটি আবার সভা আহ্বান করবে। সভার সুপারিশ মন্ত্রণালয়ের সার অনুমোদন কমিটিতে পাঠাতে হবে। এ কমিটিই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।
চার. কমিটির এ সিদ্ধান্ত পাওয়ার পর আবার আবেদনকারীকে মাঠপর্যায়ে পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহের বিষয়টি জ্ঞাত করবে। নমুনা ফসলভেদে সংশ্লিষ্ট কৃষি গবেষণা সংস্থায় পাঠানো হয়। অন্তত দুটি ফসলের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। অথবা একই ফসলের দুটি ভিন্ন ক্ষেত্রে বা মাঠে। গবেষণা সংস্থা পরীক্ষার ফলাফল উপকমিটিতে পাঠানোর পর উপকমিটি আবার সভা করবে। সভার সুপারিশ আবার মন্ত্রণালয়ের কমিটিতে অনুমোদনের জন্য পাঠাতে হবে।
পাঁচ. সচিবের সুবিধা অনুযায়ী এ কমিটি সভা করবে। সভার গৃহীত সিদ্ধান্ত ইতিবাচক হলে নিবন্ধনের জন্য গেজেটে প্রকাশ করা হবে। গেজেট প্রকাশের পর নিবন্ধন কর্তৃপক্ষ আবার উদ্যোক্তাকে নির্ধারিত ছকে আবেদন করার নির্দেশ প্রদান করবে। এরপর অনূর্ধ্ব ১৫ দিনের মধ্যে সার নিবন্ধনের সনদ উদ্যোক্তাকে দেওয়া হবে। জামানত ফি পাঁচ হাজার টাকা। নিবন্ধন ফিও পাঁচ হাজার টাকা। জামানত কেন? এর যৌক্তিকতা এখনো কেউ দিতে পারেনি।
বলা নিষ্প্রয়োজন যে প্রতিটি ধাপে কিছু উপধাপ রয়েছে, যার জন্য অনুমোদন প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা এড়ানো সম্ভব নয়। ২০১১ থেকে আবার আরেকটি অযৌক্তিক ধাপ এর সঙ্গে যুক্ত হয়। একবার ৩০টি সারের সুপারিশ একই সভায় উপস্থাপিত হলে সিদ্ধান্ত হয় যে ৩০টি কারখানা উপসচিবের নিম্নে নয় এমন কর্মকর্তার নেতৃত্বাধীন তিনটি কমিটি পরিদর্শন করে প্রতিবেদন দাখিল করবে। শোনা যায়, এ ধরনের সিদ্ধান্তের কারণ এসব কারখানার অস্তিত্ব ও সক্ষমতা যাচাই। সাময়িকভাবে গৃহীত এ সিদ্ধান্তই এখন আইন, যদিও আইনে বা বিধিতে এ ধরনের কোনো বিধানই নেই।
গত কয়েক বছরে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার গবেষণায় রাসায়নিক সারের পাশাপাশি জৈব সারের ব্যবহার কৃষিজমির স্বাস্থ্যরক্ষাসহ অধিক ফসল ফলানোর বিষয়টি স্বীকৃত। অথচ আইনি জটিলতার জন্য এ ক্ষেত্রে তেমন অগ্রগতি এখনো হয়নি। ব্রির সাম্প্রতিক এক প্রকাশনায় মুরগির বিষ্ঠা সরাসরি ব্যবহারের সুপারিশ রয়েছে। গবেষকদের কাছ থেকে জানা গেছে, এ পর্যন্ত নিবন্ধনের জন্য যে ৪০টিরও বেশি নমুনা মাঠপর্যায়ে পরীক্ষা করা হয়েছে, এর মধ্যে একটিও ক্ষতিকর বা অসফলতার কারণে প্রত্যাখ্যান করা হয়নি। এ কারণে গবেষকদের মধ্যে অনেকেই স্বীকার করেন যে মাঠপর্যায়ে পরীক্ষার কোনো যুক্তি নেই।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
শেয়ারবাজারের বাইরেও বিনিয়োগের অন্যান্য ক্ষেত্র রয়েছে। যেমন ব্যবসা-বাণিজ্য। আশুলিয়ার সব রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানা মালিকরা বন্ধ করে দিয়েছেন। কারণ শ্রমিকদের ক্রমাগত অসন্তোষ এবং সহিংস আচরণ। এ ক্ষেত্রে আইনের যে প্রয়োগ হয় না তা নয়। তবে এর ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য যে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তা অনস্বীকার্য। এ বিষয়ে কিছুদিন আগে মার্কিন রাষ্ট্রদূত সাবধান বাণী উচ্চারণ করেছিলেন। কিন্তু এ সত্ত্বেও না মালিক, না শ্রমিক বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত সংস্থা কোনো নিবারণমূলক পদক্ষেপ আগে নিতে সক্ষম হয়নি। মালিক দুষবে শ্রমিককে, শ্রমিক মালিককে এবং দুই পক্ষকেই হয়তো দুষবে অন্যরা। কিন্তু কোনো স্থায়ী সমাধান আজ পর্যন্ত হয়নি। হয়তো হবেও না।
সার ব্যবস্থাপনা আইন ২০০৬ এখনো আছে। এ আইনের বিধান অনুযায়ী যেসব সারের বিনির্দেশ সরকার এখনো অনুমোদন করেনি, এমন সব সার বা সারজাতীয় দ্রব্যের অনুমোদনের জন্য সরকার নির্ধারিত পরীক্ষাগারে পরীক্ষিত হওয়ার পর মাঠপর্যায়েও এর প্রায়োগিক সাফল্য যাচাই করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের প্রায় সব দেশেই এ ধরনের বিধান রয়েছে। উদ্দেশ্য ভূমির স্বাস্থ্য রক্ষা। অজানা ও অপরীক্ষিত কোনো সারে যদি ক্ষতিকর কোনো পদার্থ থাকে, তা জমির স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। ২০০৬ সালের আইনে জৈব সার প্রাথমিক প্রস্তাবে অন্তর্ভুক্ত করা হলেও তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ এ প্রস্তাব অনুমোদন করেনি। এ কথা হয়তো তখন মন্ত্রিপরিষদকে বলা হয়নি যে পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উৎপাদিত জৈব সার আইনের নিয়ন্ত্রণভুক্ত।
২০০৭ সালে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) পরামর্শে আবার জৈব সারকে আইনের নিয়ন্ত্রণের প্রস্তাব পেশ করে। অনুমোদনও দেওয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৮ সালে আইনের আওতাভুক্ত করা হয়। জৈব সারসংক্রান্ত বিনির্দেশও গেজেটে প্রকাশ করা হয়। আইনের বিধান অনুযায়ী বিনির্দেশ জারি হওয়ার পর জৈব সারের মাঠপর্যায়ে কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু এ সত্ত্বেও এ বিধান আজ পর্যন্ত অমান্যই করা হচ্ছে। ফলে প্রথমে সরকার নির্ধারিত পরীক্ষাগারে পরীক্ষা ও পরে মাঠপর্যায়ে পরীক্ষা করার ব্যবস্থা অক্ষুণ্ন রাখা হয়েছে। ফলে একজন বিনিয়োগকারীকে দুই থেকে তিন বছর অপেক্ষা করতে হয় চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য। আশার কথা এই যে সম্প্রতি কৃষি মন্ত্রণালয় এ বিষয়টি জানার পর একটি টেকনিক্যাল কমিটির মাধ্যমে আইন সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে।
পক্ষান্তরে এটাও বলা যায়, আইনের বিধান সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট সবাইকে অবহিত করে মাঠপর্যায়ে পরীক্ষা না করার আদেশ দিলেই অন্তত এ ক্ষেত্রে সংস্কারের কোনো প্রয়োজন হবে না। তবে অনুমোদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত কিছু সংস্থা এখনো ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে মাঠপর্যায়ে পরীক্ষা করা নিতান্তই আবশ্যক বলে মনে করে। এ জন্য বিষয়টি এখন সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনার পালা শুরু হয়েছে। এর মধ্যে বেশির ভাগ সংস্থা এ ভ্রান্তি দূর করার পক্ষে প্রাথমিকভাবে মত প্রকাশ করেছে। শুরু হয়েছে চূড়ান্ত আলোচনা পর্ব। তবে আইনের অন্যান্য বিধানও সংস্কারের প্রয়োজন বলে এখন অনেকেই স্বীকার করেছেন। কৃষি মন্ত্রণালয়ের টেকনিক্যাল কমিটিকে সহায়তার জন্য আইএফডিসির একটি বিশেষজ্ঞ দল কাজ শুরু করেছে। আশা করা যায়, আগামী অক্টোবর বা নভেম্বরের মধ্যে টেকনিক্যাল কমিটি এ-সংক্রান্ত সুপারিশ প্রণয়নে সক্ষম হবে।
আইনের অন্যান্য বিধানের সংস্কারের ক্ষেত্র একাধিক। মূল উদ্দেশ্য অনুমোদন প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা পরিহার করা। এ ক্ষেত্রগুলোর আলোচনা প্রয়োজন। পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে প্রাথমিক আবেদনের পর বিনিয়োগকারীকে বহুবিধ, অনেক ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় ধাপ অতিক্রম করতে হয়। এক. প্রাথমিক আবেদনের সঙ্গে উদ্যোক্তাকে নিজস্ব উদ্যোগে নমুনা পরীক্ষা করে নিবন্ধন কর্তৃপক্ষকে দিতে হয়। দুই. এরপর নির্ধারিত ফরমের আবেদন পরীক্ষার পর আবেদনকারীর কারখানা এক কর্মকর্তা পরিদর্শন করে একটি প্রতিবেদন কর্তৃপক্ষকে পাঠাবেন। বিধি অনুযায়ী এ প্রতিবেদন অনূর্ধ্ব ৬০ দিনের মধ্যে দাখিল করতে হবে। এত দিন কেন প্রয়োজন? এর সোজা উত্তর- কারখানা পরিদর্শনের কাজ ছাড়াও সংশ্লিষ্ট পরিদর্শকের আরো অনেক কাজ আছে। অবশ্যই আছে। কিন্তু এর জন্য সময় ৬০ দিন? শেষ পর্যন্ত প্রাথমিক আলোচনায় নিবন্ধন কর্তৃপক্ষ সময়সীমা ৩০ দিন করার জন্য সম্মতি প্রদান করেছে।
তিন. পরবর্তী ধাপ হলো, নির্ধারিত পরীক্ষাগারের নমুনা পরীক্ষা। এ জন্য পরিদর্শকের প্রতিবেদন ও প্রাসঙ্গিক বক্তব্য যাচাই করবে সার-সংক্রান্ত টেকনিক্যাল উপকমিটি। এ উপকমিটি বিএআরসিতে কাজ করে। উপকমিটি নমুনা পরীক্ষার জন্য সভা আহ্বান করবে। নির্ধারিত দিনে সভা হওয়ার আগে কমিটির এক ডজনেরও অধিক সদস্যকে পরিদর্শকের প্রতিবেদনের অনুলিপি পাঠাতে হবে। আহূত সভায় সিদ্ধান্তের পর কমিটির অন্তত দুইজন সদস্য সংশ্লিষ্ট কারখানার দুটি নমুনা সংগ্রহ করবেন। এগুলোকে তিনটি নির্ধারিত পরীক্ষাগারে পাঠাতে হবে। তিনটির মধ্যে দুটি পরীক্ষাগারের ফলাফল এক ও অভিন্ন হলে উপকমিটি আবার সভা আহ্বান করবে। সভার সুপারিশ মন্ত্রণালয়ের সার অনুমোদন কমিটিতে পাঠাতে হবে। এ কমিটিই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।
চার. কমিটির এ সিদ্ধান্ত পাওয়ার পর আবার আবেদনকারীকে মাঠপর্যায়ে পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহের বিষয়টি জ্ঞাত করবে। নমুনা ফসলভেদে সংশ্লিষ্ট কৃষি গবেষণা সংস্থায় পাঠানো হয়। অন্তত দুটি ফসলের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। অথবা একই ফসলের দুটি ভিন্ন ক্ষেত্রে বা মাঠে। গবেষণা সংস্থা পরীক্ষার ফলাফল উপকমিটিতে পাঠানোর পর উপকমিটি আবার সভা করবে। সভার সুপারিশ আবার মন্ত্রণালয়ের কমিটিতে অনুমোদনের জন্য পাঠাতে হবে।
পাঁচ. সচিবের সুবিধা অনুযায়ী এ কমিটি সভা করবে। সভার গৃহীত সিদ্ধান্ত ইতিবাচক হলে নিবন্ধনের জন্য গেজেটে প্রকাশ করা হবে। গেজেট প্রকাশের পর নিবন্ধন কর্তৃপক্ষ আবার উদ্যোক্তাকে নির্ধারিত ছকে আবেদন করার নির্দেশ প্রদান করবে। এরপর অনূর্ধ্ব ১৫ দিনের মধ্যে সার নিবন্ধনের সনদ উদ্যোক্তাকে দেওয়া হবে। জামানত ফি পাঁচ হাজার টাকা। নিবন্ধন ফিও পাঁচ হাজার টাকা। জামানত কেন? এর যৌক্তিকতা এখনো কেউ দিতে পারেনি।
বলা নিষ্প্রয়োজন যে প্রতিটি ধাপে কিছু উপধাপ রয়েছে, যার জন্য অনুমোদন প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা এড়ানো সম্ভব নয়। ২০১১ থেকে আবার আরেকটি অযৌক্তিক ধাপ এর সঙ্গে যুক্ত হয়। একবার ৩০টি সারের সুপারিশ একই সভায় উপস্থাপিত হলে সিদ্ধান্ত হয় যে ৩০টি কারখানা উপসচিবের নিম্নে নয় এমন কর্মকর্তার নেতৃত্বাধীন তিনটি কমিটি পরিদর্শন করে প্রতিবেদন দাখিল করবে। শোনা যায়, এ ধরনের সিদ্ধান্তের কারণ এসব কারখানার অস্তিত্ব ও সক্ষমতা যাচাই। সাময়িকভাবে গৃহীত এ সিদ্ধান্তই এখন আইন, যদিও আইনে বা বিধিতে এ ধরনের কোনো বিধানই নেই।
গত কয়েক বছরে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার গবেষণায় রাসায়নিক সারের পাশাপাশি জৈব সারের ব্যবহার কৃষিজমির স্বাস্থ্যরক্ষাসহ অধিক ফসল ফলানোর বিষয়টি স্বীকৃত। অথচ আইনি জটিলতার জন্য এ ক্ষেত্রে তেমন অগ্রগতি এখনো হয়নি। ব্রির সাম্প্রতিক এক প্রকাশনায় মুরগির বিষ্ঠা সরাসরি ব্যবহারের সুপারিশ রয়েছে। গবেষকদের কাছ থেকে জানা গেছে, এ পর্যন্ত নিবন্ধনের জন্য যে ৪০টিরও বেশি নমুনা মাঠপর্যায়ে পরীক্ষা করা হয়েছে, এর মধ্যে একটিও ক্ষতিকর বা অসফলতার কারণে প্রত্যাখ্যান করা হয়নি। এ কারণে গবেষকদের মধ্যে অনেকেই স্বীকার করেন যে মাঠপর্যায়ে পরীক্ষার কোনো যুক্তি নেই।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
No comments