মিলন হত্যার বিচারের দায়িত্ব রাষ্ট্রের by মানসুরা হোসাইন

নোয়াখালীর কিশোর শামছুদ্দিন মিলন হত্যার ঘটনায় জড়িতদের এখনো বিচারের আওতায় আনা সম্ভব বলে মনে করেন সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক ও পুলিশের সাবেক প্রধান নুরুল হুদা। যদিও ৫ লাখ টাকার বিনিময়ে মিলনের পরিবারের সঙ্গে রফা করেছে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা মনে করেন, মিলন হত্যা মামলার বিচার নিশ্চিত করার দায়িত্ব এখন রাষ্ট্রের।
মিলনের মামলা প্রসঙ্গে পুলিশের সাবেক আইজিপি নুরুল হুদা প্রথম আলোকে বলেন, এই ঘটনার সঙ্গে যে পুলিশ সদস্যরা জড়িত ছিলেন তাঁরা অন্য জগৎ থেকে আসেননি। তাঁরা এই পৃথিবীরই বাসিন্দা। দলবদ্ধ উন্মত্ততার সংস্কৃতি দেশে বিরাজমান। যখন কিশোরটিকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে তখন কি সেখানে কোনো বয়স্ক লোক ছিলেন না? তাকে বাঁচাতে কেউ একজন কি এগিয়ে আসতে পারতেন না? তখন সবাই মজা দেখেছেন। পুলিশ সদস্যরাও তাঁদের পবিত্র দায়িত্বের কথা ভুলে গিয়েছিলেন। আগে সামাজিকভাবে মানুষের মধ্যে যে ধরনের নিয়ন্ত্রণ ছিল, তা এখন নেই। সবার মধ্যেই ঢিলেঢালা ভাব চলে এসেছে। রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংগঠন, বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের যে ভূমিকা পালন করার কথা তা করা হচ্ছে না। আইন না মানার সংস্কৃতিও আছে। এই ঘটনায় যে সব অপরাধ করা হয়েছে দণ্ডবিধির মধ্যেই তা সব বলা আছে। সংজ্ঞায়িত করা আছে। সাজার কথাও বলা আছে। দণ্ডবিধিতে পুলিশ সদস্যদের বেলায় ছাড় দেওয়ার কথা বলা হয়নি। তাই এ ঘটনায় দোষীদের বিরুদ্ধে এখনো পদক্ষেপ নেওয়া যায়।
নুরুল হুদা বলেন, দেশে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে সে ক্ষেত্রে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন কি করছে? পুলিশ প্রশাসন কেন যথাযথ ব্যবস্থা নিল না? ঘটনা ঘটার পর গণমাধ্যম প্রতিবেদন প্রকাশ করল, কিন্তু এরপর কেন ফলোআপ প্রতিবেদন প্রকাশ করল না? ৫২ বার আদালত থেকে সময় নিয়ে তদন্ত দীর্ঘায়িত করা হলো অথচ কারও পক্ষ থেকে তা নিয়ে উচ্চবাচ্য করা হলো না। অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য সামাজিক চাপ, সামাজিক ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন আছে।
আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক মনে করেন, বয়স যাই হোক না কেন, এখানে একজন মানুষ খুন হয়েছে। সেই মানুষের মা-বাবা যদি বলেন, তাঁদের এ খুনের বিষয়ে কোনো অভিযোগ নেই তাতে কিচ্ছু এসে যায় না। এটি কোনো জমিজমার মামলা না। এ ঘটনা টাকা দিয়ে মীমাংসারও কোনো বিষয় নয়। পাঁচ লাখ কেন, ৫০০ কোটি টাকা দিয়েও তা সুরাহা করার কোনো সুযোগ নেই। এই কিশোর খুনের ঘটনায় অবশ্যই পুনঃতদন্ত করা জরুরি। ফৌজদারি মামলার কোনো সময়সীমা নেই। পুলিশ প্রশাসনের উঁচু পদে যাঁরা আছেন তাঁদের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা প্রয়োজন।
ছেলের হত্যার বিচার না হওয়া ও সমঝোতা সম্পর্কে মিলনের মা কোহিনুর বেগম বলেছিলেন, ‘সাড়ে তিন বছর ধরে বিচারের আশায় আদালতের বারান্দায় ঘুরেছি। ডিবি পুলিশের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছি। অভিযোগপত্র দেওয়ার কথা বলে কোর্ট থেকে ডিবি পুলিশ ৫২ বার সময় নিয়েও তা দেয়নি। আদালত আর ডিবি পুলিশের কাছে যাতায়াত করতে করতে আরও নিঃস্ব হয়েছি। তাঁরা (পুলিশ) এবং অন্য লোকজনও মামলা নিষ্পত্তি করার জন্য সব সময় চাপ দিয়ে আসছে।’
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী এলিনা খান প্রথম আলোকে বলেন, বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা ও জোরালো নজরদারি না থাকলে একটি মামলা কীভাবে শেষ হয়ে যায় এ ঘটনা তারই প্রমাণ। এ কিশোরের ঘটনায় ভিডিও ফুটেজ আছে। ছবি আছে। বর্তমানের তথ্যপ্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে অনেক কিছুই বের করা সম্ভব। প্রথম আলোর প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, একজনের ১৬৪ ধারার জবানবন্দিও আছে। সাক্ষ্য-আইনে যদি একজন উপযুক্ত সাক্ষীর সাক্ষ্য দিয়ে থাকেন তাই যথেষ্ট। এ ঘটনায় দণ্ডবিধি আইনে দায়িত্ব ও কর্তব্যে অবহেলার জন্য যে বিধান আছে সেই অনুযায়ী তদন্তকারী কর্মকর্তাসহ অন্য যারা দোষীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে দ্রুত মামলা করতে হবে। পত্রিকায় প্রকাশিত ছবিতে দেখা যাচ্ছে কিশোরকে পুলিশের গাড়ি থেকে নামানো হচ্ছে। তাই প্রথমেই দেখতে হবে ওই গাড়িতে কে ছিল। গাড়িতে যাঁরা ছিলেন তাঁরাই দোষী। এই মামলাটিকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য সব ধরনের পরিস্থিতি বিদ্যমান।
চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিলের মাধ্যমে মামলাটি নিষ্পত্তির আগে মিলন হত্যাকাণ্ডে জড়িত হিসেবে সন্দেহভাজন কোম্পানীগঞ্জ থানার তৎকালীন উপপরিদর্শক (এসআই) আকরাম উদ্দিন শেখ পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছেন মিলনের বাবাকে। প্রায় তিন মাস আগে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান ওরফে বাদলের মাধ্যমে ওই টাকা দেওয়া হয়। টাকা দেওয়ার সময় কোম্পানীগঞ্জ থানার বর্তমান ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ সাজেদুর রহমানও উপস্থিত ছিলেন। বর্তমানে বাগেরহাটের ফকিরহাট থানায় কর্মরত এসআই আকরাম উদ্দিন শেখ মামলা নিষ্পত্তির জন্য উপজেলা চেয়ারম্যানের মাধ্যমে মিলনের পরিবারকে পাঁচ লাখ টাকা দেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন প্রথম আলোর কাছে। তিনি বলেন, ‘একটি দুর্ঘটনা ঘটে গেছে, এখন আর কী করা।’
এ ছাড়া ঘটনার পর পুলিশ প্রশাসন অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্তসহ কিছু বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়। কিছুদিন পরে অবশ্য তাঁরা সবাই স্বীয় পদ ফিরে পান। এলিনা খান বলেন, মিলনের দরিদ্র বাবা-মা দীর্ঘদিন লড়াই করেছেন। যাঁদের জনগণকে রক্ষা করার কথা অর্থাৎ পুলিশ ও জনপ্রতিনিধিরাই যদি এক পক্ষ হয়ে যান তখন একটি দরিদ্র পরিবারের পক্ষে লড়াই করা কঠিন। এই বাবা-মা টাকা নিয়ে থাকলে তা নিয়েছেন বাধ্য হয়ে। তাই টাকা নেওয়ার সঙ্গে মামলা পুনরুজ্জীবিত করার ক্ষেত্রে সাংঘর্ষিক হবে না বা কোনো বাধা নেই। বাদী যদি কোনো কারণে হোস্টাইল ডিক্লেয়ার করে তারপরও অন্যান্য সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে রাষ্ট্র নিজেই মামলা পরিচালনা করতে পারে। সব দায়িত্ব রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। আইন কমিশনের সদস্য অধ্যাপক শাহ আলম বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা দেখলে নিজেরই খুব খারাপ লাগে। সমাজ, সংস্কৃতি, মানবতা সব যে কোথায় চলে যাচ্ছে তা বুঝতে পারছি না। সার্বিকভাবে পুরো সমাজে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটছে বলেই মনে হচ্ছে।’
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য আইনজীবী ফাওজিয়া করিম ফিরোজ বলেন, মিলনের মামলাটিকে স্পর্শকাতর মামলা হিসেবে গণ্য করা উচিত। মামলাটি পুনর্বিবেচনার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে আপিল করা প্রয়োজন। মানবাধিকার কমিশনের পক্ষ থেকে সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতা করারও আশ্বাস দেন ফাওজিয়া করিম। অবশ্য হতাশ মিলনের মা-বাবা রাষ্ট্রের কাছে সুবিচার চাননি। তাঁরা বলেছেন, ‘দুনিয়ার আদালতে বিচার পাইনি, আল্লাহর কাছে এর বিচার চাই।’

No comments

Powered by Blogger.