সারা হোসেনের অন্য ভুবন by কাজী সুমন

১৯৮৮ সাল। বাংলাদেশে তখন ভয়াবহ বন্যা। সে সময় দেশে ফিরেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সারা হোসেন। কাছ থেকে বন্যার ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখার জন্য চলে যান মাদারীপুরে। সেখানে থাকেন তিন মাস। বন্যাপীড়িত মানুষদের সাহায্য-সহযোগিতা করেন। অসহায় মানুষদের করুণ অবস্থা তার মনের ভেতর প্রচ- রকম নাড়া দেয়। তখনই সিদ্ধান্ত নেন বিলাসী জীবন ছেড়ে কাজ করবেন বঞ্চিত মানুষের পক্ষে। সারা হোসেনের মা অক্সফোর্ড ডিগ্রিধারী ড. হামিদা হোসেনও ছিলেন একই পথের পথিক। স্বাধীনতার পর নির্যাতিত নারীদের পক্ষে কাজ করেছেন। আশির দশকে নারী ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য গঠন করেছিলেন ‘আইন ও সালিশ কেন্দ্র’। বিনা পারিশ্রমিকে সহায়তা দিতেন অসহায় মানুষদের। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে গবেষণার মাধ্যমে কর্মসংস্থানের পথ খুঁজে বের করে দিতেন। মায়ের মানবসেবার মহান পেশায় পথ চলতে শুরু করেন সারাহ হোসেন। ১৯৮৯ সালের শেষদিকে অক্সফোর্ডের পড়া শেষে নানা সুযোগ-সুবিধার মোহ ছেড়ে ফিরে আসেন নিজের দেশে। যোগ দেন ইশতিয়াক আহমেদ ল’ ফার্মে। দেশব্যাপী তখন স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে। ৯০-এর দিকে এরশাদ সরকারের পতন হয়। এরপর শুরু হয় এরশাদের বিচার। ওই বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন। ওই ল’ ফার্মে কাজ করার সময় বিভিন্ন আইন ও সালিশ কেন্দ্রসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের সঙ্গে জড়িত হন তিনি। তখন তার ল’ ফার্মের সহকর্মীরা তাকে কাজ করার সুযোগ দেন। কেউ বলেননি কেন চেম্বার বড় করছো না। কেন টাকা নিচ্ছো না। এক পর্যায়ে যোগ দেন বাবা প্রখ্যাত আইনজীবী ড. কামাল হোসেনের ল’ ফার্মে। সেখানে প্র্যাকটিস শুরু করেন। ওই ফার্মে বড় বড় মামলা আসায় তার জন্য কাজ করা সহজ হয়ে যায়। তবে নিজের মেয়ে বলে কোন কিছুতে ছাড় দেননি বাংলাদেশের অন্যতম সংবিধান প্রণেতা ড. কামাল হোসেন। এরপর নিজের কাজের পরিধি ঠিক করে নেন তিনি। মানুষের পারিবারিক সমস্যা ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) গঠন হয়। মানুষের জনস্বার্থে মামলা করে সংগঠনটি। তখনই অনেক বড় সুযোগ তৈরি হলো। ব্লাস্টের মামলায় বিনা পারিশ্রমিকে আইনি সহায়তা দেয়া শুরু করেন তিনি। সেক্ষেত্রে আদালত থেকেও অনেক সহযোগিতা পান। তখন লিঙ্গবৈষম্য, ফতোয়া, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যৌন হয়রানির ঘটনা প্রকট ছিল। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০০-এর বেশি যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটলেও কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পায়নি। এসব জনস্বার্থ বিষয় নিয়ে মামলা করেন তিনি। এছাড়া গার্মেন্ট শ্রমিকদের অধিকার নিয়েও কাজ করেন। রানা প্লাজা, তাজরিন ফ্যাশনসসহ বিভিন্ন দুর্ঘটনার শিকার শ্রমিকদের আইনি সহায়তা দেন। শিশু, কয়েদি ও প্রতিবন্ধীদের অধিকার নিয়ে মামলা করেন। বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- ও গুমের বিরুদ্ধে সরব ছিলেন তিনি। ২৫ বছর আগের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে সারাহ হোসেন বলেন, আগে ইন্টারনেট শব্দটির সঙ্গে মানুষ পরিচিত ছিল না। এখন ইন্টারনেট হওয়ায় নিত্যনতুন সমস্যা তৈরি হচ্ছে। কেউ ফেসবুকে লাইক দিলেও তার বিরুদ্ধে মামলা করা হচ্ছে। আদালত থেকেও এসব বিষয় উসকে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু ২৫ বছর আগে তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে ফতোয়া দেয়া হলো। তার মু-ু নেয়ার জন্য পুরস্কার ঘোষণা দেয়া হলো। তখন আদালতে তার পক্ষে মামলা করে সহায়তা পেয়েছি। আদালত তাকে জামিনও দিয়েছেন। এরপর তিনি নিরাপদে দেশত্যাগ করতে পেরেছেন। এরপর ২০০৭ সালের দিকে কার্টুনিস্ট আরিফুর রহমানের বিরুদ্ধে একইভাবে ফতোয়া দেয়া হলো। জেলখানায়ও তার ওপর হামলা হলো। দুর্ভাগ্যজনকভাবে রাষ্ট্রপক্ষ থেকেও তার বিরুদ্ধে উসকানি দেয়া হলো। শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের পরে ব্লগারদের ওপর প্রতিনিয়ত হামলা হচ্ছে। এফআইআর লেখার সময় পুলিশের পক্ষ থেকে এমনভাবে বলা হচ্ছে যেন তারা নাস্তিক। কিন্তু বাংলাদেশের আইনে নাস্তিক হওয়া অপরাধ নয়। তাই এখন নিরাপত্তার বিষয়টি বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাষ্ট্রের কাছে এই বিষয়গুলো নিশ্চিত করার প্রত্যাশা করেন তিনি। ভবিষ্যতে মুক্তিযোদ্ধাদের অধিকার ও মূল্যবোধ নিয়ে কাজ করতে চান। এছাড়া সম্প্রতি যেসব ব্লগার খুন হয়েছেন তাদের পরিবারকে সহায়তা দিতে চান। পরমত সহিষ্ণুতা, মানুষের বাকস্বাধীনতা ও যুক্তিতর্কের স্বাধীনতা নিশ্চিতের জন্য কাজ করতে চান। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ দেশী-বিদেশী বিভিন্ন সংগঠন থেকে নানা পুরস্কার ও সম্মাননাও পেয়েছেন তিনি। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ থেকে ‘অনন্যা টপটেন অ্যাওয়ার্ড’, হিউম্যান রাইটস অ্যাওয়ার্ড, এশিয়া ২১ ফেলো, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফেলো পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি। নিজের কাজের সফলতা হিসেবে সারাহ হোসেন মনে করেন, ধারণা ছিল আইনজীবীরা শুধু রাজনৈতিক আন্দোলনে ভূমিকা রাখবেন সামাজিক সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখতে পারেন, এ ধারণা সাধারণ মানুষের ছিল না। বর্তমানে সেই জায়গায় কাজ করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। অনেক সংগঠন ও ব্যক্তি এ বিষয় নিয়ে কাজ করছেন। অক্সফোর্ডে অধ্যয়নকালেই দক্ষিণ এশিয়ার শিক্ষার্থীদের নিয়ে একটি সংগঠন করেছিলেন সারাহ হোসেন। তখন উপমহাদেশের শিক্ষার্থীদের নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করতেন ওই সংগঠন থেকে। তাদের সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতেন। বর্তমানে তিনি আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী কমিটির সদস্য। এছাড়া ব্লাস্ট-এর অবৈতনিক নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। লিগ্যাল এইড অ্যান্ড মেডিটেশন সেন্টারের নির্বাহী কমিটির সদস্য, ইন্টারন্যাশনাল ল’ অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য তিনি। ড. কামাল হোসেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসেরও অংশীদার তিনি। আইনজীবী বাবা তাকে সব সময় একটি শিক্ষা দিয়েছেন। কামাল হোসেনের কাছে কোন মামলা নিয়ে গেলে সূক্ষ্মভাবে বিষয়টি দেখেন এবং গভীরভাবে বুঝেন। তারপর কাজের সিদ্ধান্ত নেন। এছাড়া বাবা কোনদিন কোন কিছুতে জোর করেননি। অগাধ স্বাধীনতা দিয়েছেন মেয়েকে। ১৯৮৯ সালে অক্সফোর্ডে পড়াকালেই বৃটিশ বংশোদ্ভূত ডেভিড বার্গম্যানের সঙ্গে পরিচয় হয়। বার্গম্যান তখন লন্ডনের বার্মিংহাম ইউনিভার্সিটিতে পড়তেন। পরিচয়ের দীর্ঘ ১১ বছর পর তার সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন সারাহ হোসেন। বার্গম্যান ঢাকায় ইংরেজি দৈনিকে সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত। সারাহ হোসেনের এক ছেলে ও এক মেয়ে সন্তান রয়েছে। সন্তানরা রাজধানীর একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়াশোনা করছেন।

No comments

Powered by Blogger.