কর্মসূচি নেই, কারাগার আছে by কাফি কামাল

রাজপথের আন্দোলন কর্মসূচিতে নেই বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। কর্মসূচির বদলে ধীরে চলো নীতিতে সংগঠন গোছানোর দিকে মনোযোগী বিএনপি। কিন্তু থেমে নেই বিরোধী নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা-হামলা ও গ্রেপ্তার প্রক্রিয়া। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও গ্রেপ্তার করছেন বিরোধী নেতাকর্মীদের। তাদের বেশির ভাগকেই গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে নাশকতার ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায়। পাশাপাশি নতুন অভিযোগ আনা হচ্ছে মাদকের। এছাড়া অপহরণ-হামলা-হত্যার ঘটনাও থামছে না। এমনকি ঈদের দিনও দুর্বৃত্তদের হামলায় মারা গেছেন যুবদলের এক তৃণমূল নেতা। ঈদের এক সপ্তাহ আগ থেকে চলছে এমন পরিস্থিতি। এদিকে ঢাকা ও চট্টগ্রাম তিন সিটি নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে তিন মাসের টানা অবরোধ কর্মসূচি থেকে বেরিয়ে আসে বিরোধী জোট। কিন্তু ততদিনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন দলের সিনিয়র নেতাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। ঘরছাড়া হন হাজারো নেতাকর্মী-সমর্থক। দীর্ঘদিন ধরেই আত্মগোপনে দিন কাটছে হাজার হাজার নেতাকর্মীর। কেন্দ্রীয় নেতাদের কেউ কেউ জামিনে মুক্তি পেলেও জামিন প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হচ্ছে শীর্ষস্থানীয় নেতাদের। উচ্চ আদালতের জামিন আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে যাচ্ছে সরকার। সব মিলিয়ে টানা অবরোধ কর্মসূচির জের টানছে বিরোধী জোটের নেতাকর্মীরা। এমন পরিস্থিতিতে ফের আন্দোলনের যাওয়ার আগে দল গোছানোর কথা জানিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন ও ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতা খালেদা জিয়া। ঈদের দিন কূটনীতিক ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় শেষে তিনি সাংবাদিকদের এমন মনোভাবের কথা জানান। খালেদা জিয়া বলেছেন, দল পুনর্গঠন করে বিএনপি আবার শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে নামবে। বিএনপি’র আন্দোলন হবে জনগণের কল্যাণে এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে। বিএনপির একাধিক নেতা জানান, আন্দোলনের সময় প্রশাসনকে সর্বোচ্চভাবে ব্যবহার করেছে সরকার। এখন দল পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে জেনে গ্রেপ্তারের মাধ্যমে প্রতিবদ্ধকতার সৃষ্টি করছে। এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতিমধ্যেই জানিয়েছেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে দ্রুত বিচারের আওতায় আনার জন্য ঈদের পর বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হবে। এছাড়া ঈদের ছুটি শেষে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ছয়টি মামলার শুনানির তারিখ ধার্য রয়েছে আদালতে। এর মধ্যে দুদকের দায়ের করা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলা দুটির সাক্ষ্য গ্রহণের শুনানির নির্ধারিত দিন ২৩শে জুলাই।
এদিকে ঈদের পরদিন ১৯শে জুলাই রাতে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পটুয়াখালীর লেবুখালী ফেরিঘাটে প্রাইভেট কার থেকে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাজীব আহসানসহ ছয়জনকে আটক করে দুমকি থানা পুলিশ। পরে তাদের গাড়ি থেকে ইয়াবা উদ্ধারের অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য আইনে মামলা দায়ের করে পুলিশ। ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সভাপতি রাজীব আহসান ষড়যন্ত্রমূলক গ্রেপ্তার ও অপপ্রচারের শিকার বলে অভিযোগ করে বিএনপি চেয়ারপারসন ও ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতা খালেদা জিয়া বলেছেন, বিরোধী রাজনীতিকে দুর্বল করার অপপ্রয়াসে ছাত্রনেতা রাজীবকে গ্রেপ্তার করার কয়েক ঘণ্টা পর তাকে বহনকারী গাড়িতে মাদক পাওয়ার কথা প্রচার করা হয়। যা রাজনৈতিক কর্মীদের চরিত্রহননের একটি ঘৃণ্য প্রচারণামূলক নাটক ছাড়া আর কিছু নয়। আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন ডেকে সংগঠনটির সভাপতির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারের পর মাদক মামলা দায়েরের ঘটনাকে ‘পরিকল্পিত নাটক’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে ছাত্রদল। এমন অভিযোগ আনার ঘটনায় তারা ‘মর্মাহত’ মন্তব্য করে প্রতিবাদ জানিয়েছে সংগঠনটি। সেই সঙ্গে সারা দেশে দুদিনের বিক্ষোভ কর্মসূচিও দিয়েছে তারা। একইদিন একই সময়ে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসানের রাজধানীর রামপুরার বাসায় অভিযান চালায় পুলিশ। তবে সে সময় বাসায় ছিলেন না তিনি। এছাড়া একইদিন দুপুরে নরসিংদীর শিবপুরে আকরামের গ্রামের বাড়িতেও অভিযান চালায় পুলিশ। রোববার বিকালে গ্রেপ্তার করা হয় মাগুরা জেলা বিএনপির প্রচার সম্পাদক মিজানুর রহমানকে। পুলিশ জানিয়েছে, বিরোধী জোটের অবরোধ চলাকালে গত ২১শে মার্চ সন্ধ্যায় মাগুরা-যশোর সড়কে একটি ট্রাকে পেট্রল বোমা হামলায় ৫ শ্রমিক নিহতের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলাসহ একাধিক নাশকাতার মামলার আসামি মিজানুর রহমান। এদিকে পটুয়াখালীতে মাসুদ মাদবর হত্যাকা-ের ঘটনায় জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি ও পৌর বিএনপির সভাপতি মাকসুদ আহমেদ বায়েজিদ পান্না, জেলা কৃষকদলের সভাপতি আবদুর রব হাওলাদারসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে ২০শে জুলাই সদর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। তবে মামলায় জেলা বিএনপির চার নেতাকে আসামি করার প্রতিবাদ জানিয়ে জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সাবেক পিপি মজিবর রহমান টোটন বলেছেন, এটি একটি পরিকল্পিত মামলা। গ্রামের একটি অনাকাক্সিক্ষত ঘটনাকে কেন্দ্র করে জেলা বিএনপির সিনিয়র নেতাদের আসামি করা ষড়যন্ত্র ছাড়া কিছুই নয়। এর আগে ৩০শে জুন পটুয়াখালী জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এমএ রব মিয়াসহ ৩৬ নেতার বিরুদ্ধে পৃথক দুটি রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করে সদর থানা পুলিশ। অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকায় তাদের বিরুদ্ধে এ মামলা দায়েরের কথা জানায় পুলিশ। তবে জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সাবেক পিপি অ্যাডভোকেট মুুজিবর রহমান টোটন এ মামলাকে ষড়যন্ত্র বলে দাবি করেছেন। কারাগারে আটক গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা প্রফেসর এমএ মান্নানকে আরও একটি মামলায় ২১শে জুলাই শ্যোন অ্যারেস্ট দেখানো হয়েছে। ফলে আগের সবক’টি মামলায় হাইকোর্ট তাকে জামিন দিলেও মুক্তি পাচ্ছেন না তিনি। ১৬ই জুলাই গাজীপুর সদর উপজেলা চেয়ারম্যান ও বিএনপি নেতা অধ্যক্ষ ইজাদুর রহমান মিলনকে আটক করে পুলিশ। এদিকে কারাগারেও আতঙ্ক-আশঙ্কার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন বিএনপি নেতারা। সাম্প্রতিক সময়ে কারাগারে অসুস্থ অবস্থায় বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক এমপি নাসিরউদ্দিন আহমেদ পিন্টু, ডিসিসির সাবেক কমিশনার মুসলেহউদ্দিন আহমেদ কয়েকজন বিএনপি নেতার মৃত্যু হয়েছে।
ওদিকে নাশকতার বিভিন্ন মামলায় হাজির হয়ে জামিন চাইলে ১৩ই জুলাই বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব ও রাজশাহী মহানগর সভাপতি মিজানুর রহমান মিনুকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন রাজশাহী মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। একইভাবে নাশকতার মামলায় হাজির হয়ে জামিনের আবেদন করলে ১৪ই জুলাই খুলনা জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট এসএম শফিকুল আলম মনাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন খুলনার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। রূপসা থানার দু’টি, ফুলতলা ও তেরখাদা থানা দুটিসহ চারটি মামলায় উচ্চ আদালত থেকে চার সপ্তাহের জামিনে ছিলেন মনা। নির্ধারিত দিনে নিম্ন আদালতে হাজির হলে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। একইভাবে নিম্ন আদালত থেকে কারাগারে পাঠানো হয় বিএনপির খুলনা বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম মঞ্জুকে। এদিকে ১১ই জুলাই চাঁপাইনবাবগঞ্জের মোবারকপুর ইউনিয়ন বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে শিবগঞ্জ থানা পুলিশ। কানসাটে পুলিশের ওপর হামলা, গাড়ি পোড়ানোসহ নাশকতার ৮টি মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। রাজধানীর শ্যামপুর ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি আলমগীর হোসেন ওরফে আলমগীর মেম্বারকে চাঁদাবাজির অভিযোগে গ্রেপ্তার করে কদমতলী থানা পুলিশ। ২১শে জুলাই কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলা যুবদল নেতা কামাল উদ্দিন মেম্বারকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ৮ই জুলাই যশোর জেলা ছাত্রদলের অর্থ-সম্পাদক ইমদাদুল হক ইমদাকে বিস্ফোরক আইনের একটি মামলায় আটক করেছে পুলিশ। ২১শে জুলাই গোপালগঞ্জে জেলা যুবদল সভাপতি অ্যাডভোকেট তৌফিকুল ইসলাম, সদর উপজেলা ছাত্রদল সভাপতি মিকাইল ইসলামসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে সদর থানা পুলিশ। তাদের বিরুদ্ধে আনা হয়েছে সরকার বিরোধী কর্মকা-ে চালানোর পরিকল্পনার অভিযোগ। এছাড়া নাশকতা মামলায় যশোরের বাঘারপাড়া পৌরসভার কাউন্সিলর ও বিএনপি নেতা শহিদুল ইসলামকে সোমবার রাতে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এছাড়াও প্রতিদিন দেশের নানা জায়গা থেকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে জামায়াত নেতাকর্মীদের।
ওদিকে ১৫ই জুলাই সিলেটের ওসমানীনগরে উপজেলা ওলামা দলের সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম রিপনের (৩০) রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ১৫ই জুলাই বরিশালের হিজলা উপজেলার ধুলখোলা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ও স্থানীয় বিএনপি নেতা নান্টু বেপারীকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ঈদের পরদিন ১৯শে জুলাই নোয়াখালীর সোনাইমুড়ি উপজেলার আমিশাপাড়া ইউনিয়নে দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হয় হাবিবুর রহমান হাবিব নামে এক যুবদল কর্মী। ঈদের দিন সন্ধ্যায় তার বাড়িতে ঢুকে দুর্বৃত্তরা গুলি করার পর গুরুতর আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু ঘটে। ১৪ জুলাই রাতে বাড়ি ফেরার পথে নওগাঁর সাপাহার উপজেলার ছাত্রদলের প্রচার সম্পাদক রবিউল ইসলাম রুবেলকে অপহরণ করা হয়। এখন পর্যন্ত তার কোন খোঁজ মিলেনি।

No comments

Powered by Blogger.