তাজউদ্দীন আহমদের পর সৈয়দ আশরাফ by মিজানুর রহমান খান
বঙ্গবন্ধু
শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ পরাস্ত হলো, অথচ সেই কঠিন সত্য আওয়ামী লীগ
উচ্চারণ পর্যন্ত করছে না। সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়
থেকে সরিয়ে দেওয়ার ঘটনা ‘অপসারণ’ হিসেবে প্রতীয়মান না হলে কথা ছিল। কিন্তু
জনগণের কাছে এটা পরিষ্কার করা হয়েছে যে মন্ত্রিত্ব বেশি মর্যাদাসম্পন্ন।
দলের সাধারণ সম্পাদকের পদ মন্ত্রিত্বের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ। একজন কথিতমতে
‘নিষ্ক্রিয়’ হয়ে পড়া ব্যক্তিকে দলের সাধারণ সম্পাদকের পদে রাখা চলে।
কিন্তু মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে রাখা চলে না।
যত দূর জেনেছি মন্ত্রিসভার বৈঠকে তিনি কখনো গরহাজির ছিলেন না, বরং তাঁর সব বিষয়েই সক্রিয় ও বুদ্ধিদীপ্ত অংশগ্রহণ ছিল। সুতরাং মন্ত্রিসভার বৈঠকে যেখানে প্রধানত আইন প্রণয়ন ও নীতিনির্ধারণী বিষয় এজেন্ডা হিসেবে থাকে এবং তাঁকে কখনো মন্ত্রিসভা বৈঠক কামাই করতেও দেখা যায়নি। অফিস কামাই করাটা অন্যান্য মন্ত্রীদের সঙ্গে তুলনা করলে তাঁর নম্বর নিশ্চয় কাটা পড়বে। তবে মন্ত্রী হিসেবে তিনি সর্বদা তদবিরকারী বাহিনীকে এড়িয়েছেন।
একেবারে গোড়ার দিকের একটি শোনা ঘটনা। নতুন মন্ত্রী হিসেবে অফিসে গেছেন। চীনা রাষ্ট্রদূত এসেছেন দেখা করতে। নেতা-কর্মী, সমর্থক ও তদবিরকারীরা সেদিন এক অদ্ভুত কাণ্ড করলেন।হুড়মুড় করে তাঁরা দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়েছিলেন। প্রাণহানির আশঙ্কায় সন্ত্রস্ত রাষ্ট্রদূত মন্ত্রীর বাথরুমে আশ্রয় নিতে যাচ্ছিলেন। এই ঘটনাটি সচিবালয়ে অফিস করার ব্যাপারে তাঁর মধ্যে অনীহা এনে দিতে পারে। অবশ্য এটাও যুক্তি যে, মন্ত্রণালয়ের কাজ কখনো জমে থাকেনি। তার মানে সব প্রকার ফাইলেই তাঁর দস্তখত মিলেছে। তবু আশা করে এসে যাঁরা দেখা পাননি, তাঁদের হতাশ হওয়ার কারণ থাকবে।
তাই বলে কখনো এমন ঘটেনি যে, সচিবেরা তাঁকে হ্যারিকেন হাতে খুঁজেছেন। তিনি যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কোয়ার্টার হিসেবে তৈরি করা তাঁর ২১ বেইলি রোডের প্রাচীন বাসভবন, যার ছাদ থেকে পলেস্তারা খসে দু–একবার তাঁর মাথায়ও পড়েছিল বলে শুনেছিলাম, সেখানে বসে সবই করেন কিংবা তাঁর পতাকাবাহী গাড়িতে বসেও করেন, তাহলেও তাঁকে ‘নিষ্ক্রিয়’ বা অকর্মার ঢেঁকি বলা যাবে না। বাড়ি ও গাড়ি দুটোতেই যে পতাকা ওড়ে, তার অন্যতম মূল কারণ কিন্তু এটাই যে, একজন মন্ত্রীর অফিস বলতে কেবলই নির্দিষ্ট করে দেওয়া কোনো একটি স্থানমাত্র নয়। কাজের জন্য পতাকা, পতাকার জন্য কাজ নয়। অবশ্য গত ছয় বছরে তিনি অন্য যে কারও চেয়ে মন্ত্রিসভা বৈঠকের একজন প্রাণবন্ত আলোচনাকারী ছিলেন কি না, সেটা তাঁর বিচক্ষণ সহকর্মীরাই বলতে পারবেন।
বঙ্গবন্ধু পঞ্চাশের দশকে প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রীর পদ থেকে সুচিন্তিতভাবে ইস্তফা দিয়ে দলের সাধারণ সম্পাদকের পদ নিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দলকে সুসংগঠিত করেছিলেন আর সেই দলের কারণেই ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বাঙালিদের পক্ষে পাকিস্তানি কাঠামোর ভেতরে থেকেই একাত্তরের ২৫ মার্চের আগে ‘জনগণের অংশগ্রহণমূলক’ সরকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছিল। তাঁর সাফল্যের নিয়ামক শক্তি বন্দুক ছিল না, ভয় পাইয়ে দেওয়ার জন্য কোনো ধরনের পেটোয়া বাহিনী ছিল না, ছিল আওয়ামী লীগের সাচ্চা সাংগঠনিক শক্তি।সেদিন আওয়ামী লীগ যতটা উদার হতে পেরেছিল, এখন ততটাই সংকীর্ণ, ব্যক্তির প্রতি শর্তহীন আনুগত্যই যেন শেষ কথা।আজ আওয়ামী লীগের অবস্থা এতটাই করুণ যে তারা সেই ঐতিহ্য স্মরণে আনতেও দ্বিধান্বিত, ভীত। সুতরাং কয়েক সপ্তাহ পরে লন্ডন প্রত্যাগত একজন সৈয়দ আশরাফকে আমরা গণতান্ত্রিকভাবে সংগঠন গোছাতে অতীব তৎপর হতে দেখব, তা ভাবতে পারলে খুশি হতাম। যদিও ওবায়দুল কাদের এই সিদ্ধান্তকে যথার্থতা দিতে বলেছেন, হয়তো নেত্রী ভেবেছেন তিনি দলের জন্য এখন বেশি সময় দেবেন, সে জন্য এটা করা হয়েছে, আসলে এর ভিত্তি পলকা। কারণ, ক্ষমতাসীনদের কেউ প্রকাশ্যে অনুশোচনা করেন না যে দলটি অগোছালো, দুর্দশাগ্রস্ত এবং বিএনপির সাংগঠনিক রুগ্ণদশার সঙ্গে বহুলাংশে তুলনীয়। ছাত্রলীগ সন্ত্রাস করে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেয় কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ অত্যন্ত সীমিত।
এই আওয়ামী লীগ উনসত্তরের আওয়ামী লীগ নয়। এখন দলের শক্তি সরকার চালায় না। সরকারি শক্তি দল চালায়। সুযোগসন্ধানী একশ্রেণির রাজনীতিক এবং আমলতন্ত্রশাসিত একটি ব্যবস্থা আওয়ামী লীগকে পরিচালনা করছে। অনেকের মতে, গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রভাব অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে নাকি কম নয়। আওয়ামী লীগের বিবেকবান ও সচেতন অংশ বড় বেশি সংখ্যালঘু এবং কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। এই ধারণা সঠিক হলে সৈয়দ আশরাফ আর জিল্লুর রহমান হতে পারবেন কি? আগামী ডিসেম্বরে তিনি তৃতীয় মেয়াদে সাধারণ সম্পাদক পদে থাকবেন নাকি তাঁকে যেতেই হবে? তিনি সোহেল তাজ হতে চাইবেন না, রাজনীতিতে পথ না হারানোটা তাঁর জন্য চ্যালেঞ্জ। তাঁকে শেখ হাসিনারও দরকার পড়বে।
সংসদীয় গণতন্ত্রে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী একটি সম্মানজনক রীতি। সেই রীতি অনুযায়ী তাঁর কর্মচাঞ্চল্য দেখলে আমরা খুশি হব। কখনো ঘটেনি বলে নিরাশ হতে চাই না, কিন্তু অহেতুক নতুন আশার জাল বোনাও কাজের কথা নয়। ২০১০ সালে ব্রিটিশ সাংসদ ব্যারোনেস ভার্সি যখন ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির চেয়ারম্যান ছিলেন, তখন তাঁকে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী পদেও রাখা হয়। দলের চেয়ারম্যান যাতে মন্ত্রিসভায় অংশ নিতে পারেন, সে জন্য দলের চেয়ারম্যানকে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী পদে রাখাটা ব্রিটেনে একটি কনভেনশন হিসেবে গড়ে উেঠছে। বাংলাদেশ তার তথাকথিত ওয়েস্টমিনস্টার মডেলের গণতন্ত্রচর্চার কোন স্তরে পৌঁছালে তবে দলের চেয়ারম্যান যেকোনো অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীই হতে চাইবেন না, কেবল দপ্তরবিহীন মন্ত্রী হলেই তাঁর পোষাবে, তা আমার মতো হয়তো অনেকেই কল্পনা করতে পারবেন না।
ভারত উপমহাদেশে এই পদকে মর্যাদাপূর্ণ হিসেবে গড়ে তোলা হয়নি। এই পদে রাখা মানে কাউকে খাটো করে রাখা। চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় ও আরেক স্বপক্ষত্যাগী বাঙালি মাহমুদ আলী রাষ্ট্রদূত কেবল নন, বিভিন্ন সরকার উতরিয়ে তাঁরা আমৃত্যু দপ্তরবিহীন মন্ত্রীও ছিলেন, সেই ১৯৭১ সালের পর থেকে, পাকিস্তানের প্রতি অনুগত থাকার পুরস্কার। এখন দুজনই প্রয়াত। ইসলামাবাদে ত্রিদিব রায় আমাকে বলেছিলেন, তাঁরা দুজন পাকিস্তানের পতাকা উড়িয়ে চলেন। কিন্তু মন্ত্রিসভার বৈঠকে তাঁরা অংশ নেন না। ১৯৫৭ সালে জওহরলাল নেহরু কৃষ্ণ মেননকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী করার আগের এক বছর তাঁকে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী করে রাখেন। মেননের জন্য সেটা মর্যাদাপূর্ণ ছিল। কিন্তু ২০০৫ সালে সাদ্দাম সরকারের তেল কেলেঙ্কারির বিষয়ে পল ভলকার কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী নটবর সিং পদত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন। তিনি পদত্যাগে রাজি না হলে মনমোহন সিং তাঁকে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী করেছিলেন। অাওয়ামী লীগ সভানেত্রীর অত্যন্ত বিশ্বস্ত সৈয়দ আশরাফ পদত্যাগ করার সুযোগ নেননি বা তাঁকে সে সুযোগ দেওয়া হয়নি, তিনি দপ্তর থেকে অপসারিত হয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরীর সম্পাদিত অবজারভার-এ খবর পড়লাম, আওয়ামী লীগের অনেকে এ ঘটনায় অশনিসংকেত দেখছেন। তাঁরা তাজউদ্দীন আহমদ উপাখ্যান স্মরণ করছেন। এটা পড়ে আমার মনে পড়ল হ্যামলেটের সেই উক্তি: ‘সামথিং ইজ রটেন ইন দ্য স্টেট অব ডেনমার্ক।’
কথিত নিষ্ক্রিয়তা বনাম দুর্নীতিগ্রস্ততার মধ্যে কোনটি বেশি ক্ষতিকর? যদি হঠাৎ জিরো টলারেন্স দেখানোর নীতি গ্রহণ করার ইচ্ছে জাগে, তাহলে কোনো রাষ্ট্রে কোনটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ অগ্রাধিকার পাবে? নিষ্ক্রিয়তা নাকি দুর্নীতিগ্রস্ততা? কোনটি বেশি হতাশাগ্রস্ত নাগরিকদের মনে আশা জাগাবে, কাঙ্ক্ষিত বলে গণ্য হবে? বাংলাদেশ বার্তা রটিয়েছে যে দুর্নীতিগ্রস্ততার চেয়ে নিষ্ক্রিয়তাই বেশি ক্ষতিকর। তবে কী বার্তা জনগণের কাছে গেছে সেটা যদি এক বাক্যে বলতে হয়, তাহলে আমি কিশোরগঞ্জের চা দোকানির উক্তি ধার করব। ‘হুনুইন, ভালা মানুষের ভাত নাই।’ সম্প্রতি সৈয়দ আশরাফ কিশোরগঞ্জ শহরে খড়মপট্টিতে তাঁর চাচার রংচটা একতলা টিনশেড ভবনে দুরাত কাটিয়ে এসেছেন। এটি তাঁর নির্বাচনী এলাকা হলেও শহরে তাঁর বাড়ি নেই (ঢাকাতেও বাড়ি নেই), পুলিশ গার্ড অব অনার দিতে এসে বিফল মনোরথে ফিরে গেছে। নেতা-কর্মীরা ভিড় করেননি। মোটরসাইকেলের হর্নে পথঘাট চকিত হয়নি। কেউ স্লোগান তোলেনি। বর্তমান আওয়ামী লীগের এ রকম একজন সাধারণ সম্পাদক সত্যি বেমানান!
মনে হচ্ছে সৈয়দ আশরাফ বিস্মিত হননি। সিলেটে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেনও যে অনেক দিন ধরেই এ রকম একটা কিছুর সিদ্ধান্তের বিষয় শোনা যাচ্ছিল, সেটাই বাস্তবে ঘটল। ব্রিটেনের লেবার রাজনীতির সক্রিয় কর্মী থাকা সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম আমাদের প্রচলিত বাগাড়ম্বরপূর্ণ রাজনীতির প্রতি বাহ্যত অত্যন্ত নিরাসক্ত ছিলেন, সে কথা বলা যাবে না। কারণ, বহু ক্ষেত্রে তিনি তাঁর দলের পক্ষে অনাবশ্যক সাফাই গেয়েছেন, কোরাসে সুর মিলিয়েছেন। কিন্তু সব তাল মেলাতে পারেননি।
তবু সার্বিক বিচারে তাঁর বড় গুণ মন্ত্রিসভায় হাতে গোনা কয়েকজন, যাঁরা এখনো অপেক্ষাকৃত উঁচু নীতিনৈতিকতার ঝান্ডা তুলে ধরতে সচেষ্ট রয়েছেন, তিনি তাঁদের অন্যতম হিসেবে পরিচিত। তাঁকে ধন্যবাদ জানাই, কারণ কিছু ক্ষেত্রে তিনি প্রতিবাদী হতে চেয়েছেন বলে প্রতীয়মান হয়েছে। তাঁর মন্ত্রণালয়টি দুই দশক ধরে দলীয় রাজনীতির সূতিকাঘর হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। ওই মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বিভিন্ন সংস্থা ও অফিসের বড় বড় পদে কে থাকবেন কে যাবেন, সেটা তিনি গোড়া থেকেই দৃশ্যত প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের হাতে ছেড়ে দিয়েছিলেন। এটা ইঙ্গিত দেয় যে তিনি তাঁর অবচেতনে গোড়া থেকেই আজকের দিনটি সম্পর্কে সতর্ক ছিলেন।
বর্তমান মন্ত্রিসভা বা রাষ্ট্রের বড় পদে টিকে থাকার পয়লা শর্ত শর্তহীন আনুগত্য। সেখানে আশরাফ জনগণের পক্ষে দাঁড়াতে গিয়ে গোলমাল করে ফেলেছেন, ঠিক এমনটাও বলা যাবে না। এখন আমরা কিছুটা আশ্বস্ত হতে পারি, নতুন করে কিছুটা আশাবাদী হতে পারি, যদি অবিলম্বে বিতর্কিত মন্ত্রীদের অপসারণ করা হয়। এই ঘটনার পরে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির দিকে নজর দিতে হবে। সৈয়দ আশরাফকে সরিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নিকটাত্মীয় এলেন। ক্ষমতার বলয় আরও নিরঙ্কুশ হলো। বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত বিশ্বস্ত তাজউদ্দীন আহমদকে কেন অপসারণ অনিবার্য ছিল, তার উত্তর আমরা আজও খুঁজি। তিনি ‘জাতির বৃহত্তর স্বার্থে’ পদত্যাগ করেছিলেন। আমরা সোহেল তাজ উপাখ্যান এড়াতে পারিনি। রক্তের উত্তরাধিকারজনিত এ যেন এক মস্ত গোলকধাঁধা, তাই বুঝি অাশরাফকে রক্তঋণ স্মরণ করিয়ে দিতে হয়েছে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com
যত দূর জেনেছি মন্ত্রিসভার বৈঠকে তিনি কখনো গরহাজির ছিলেন না, বরং তাঁর সব বিষয়েই সক্রিয় ও বুদ্ধিদীপ্ত অংশগ্রহণ ছিল। সুতরাং মন্ত্রিসভার বৈঠকে যেখানে প্রধানত আইন প্রণয়ন ও নীতিনির্ধারণী বিষয় এজেন্ডা হিসেবে থাকে এবং তাঁকে কখনো মন্ত্রিসভা বৈঠক কামাই করতেও দেখা যায়নি। অফিস কামাই করাটা অন্যান্য মন্ত্রীদের সঙ্গে তুলনা করলে তাঁর নম্বর নিশ্চয় কাটা পড়বে। তবে মন্ত্রী হিসেবে তিনি সর্বদা তদবিরকারী বাহিনীকে এড়িয়েছেন।
একেবারে গোড়ার দিকের একটি শোনা ঘটনা। নতুন মন্ত্রী হিসেবে অফিসে গেছেন। চীনা রাষ্ট্রদূত এসেছেন দেখা করতে। নেতা-কর্মী, সমর্থক ও তদবিরকারীরা সেদিন এক অদ্ভুত কাণ্ড করলেন।হুড়মুড় করে তাঁরা দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়েছিলেন। প্রাণহানির আশঙ্কায় সন্ত্রস্ত রাষ্ট্রদূত মন্ত্রীর বাথরুমে আশ্রয় নিতে যাচ্ছিলেন। এই ঘটনাটি সচিবালয়ে অফিস করার ব্যাপারে তাঁর মধ্যে অনীহা এনে দিতে পারে। অবশ্য এটাও যুক্তি যে, মন্ত্রণালয়ের কাজ কখনো জমে থাকেনি। তার মানে সব প্রকার ফাইলেই তাঁর দস্তখত মিলেছে। তবু আশা করে এসে যাঁরা দেখা পাননি, তাঁদের হতাশ হওয়ার কারণ থাকবে।
তাই বলে কখনো এমন ঘটেনি যে, সচিবেরা তাঁকে হ্যারিকেন হাতে খুঁজেছেন। তিনি যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কোয়ার্টার হিসেবে তৈরি করা তাঁর ২১ বেইলি রোডের প্রাচীন বাসভবন, যার ছাদ থেকে পলেস্তারা খসে দু–একবার তাঁর মাথায়ও পড়েছিল বলে শুনেছিলাম, সেখানে বসে সবই করেন কিংবা তাঁর পতাকাবাহী গাড়িতে বসেও করেন, তাহলেও তাঁকে ‘নিষ্ক্রিয়’ বা অকর্মার ঢেঁকি বলা যাবে না। বাড়ি ও গাড়ি দুটোতেই যে পতাকা ওড়ে, তার অন্যতম মূল কারণ কিন্তু এটাই যে, একজন মন্ত্রীর অফিস বলতে কেবলই নির্দিষ্ট করে দেওয়া কোনো একটি স্থানমাত্র নয়। কাজের জন্য পতাকা, পতাকার জন্য কাজ নয়। অবশ্য গত ছয় বছরে তিনি অন্য যে কারও চেয়ে মন্ত্রিসভা বৈঠকের একজন প্রাণবন্ত আলোচনাকারী ছিলেন কি না, সেটা তাঁর বিচক্ষণ সহকর্মীরাই বলতে পারবেন।
বঙ্গবন্ধু পঞ্চাশের দশকে প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রীর পদ থেকে সুচিন্তিতভাবে ইস্তফা দিয়ে দলের সাধারণ সম্পাদকের পদ নিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দলকে সুসংগঠিত করেছিলেন আর সেই দলের কারণেই ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বাঙালিদের পক্ষে পাকিস্তানি কাঠামোর ভেতরে থেকেই একাত্তরের ২৫ মার্চের আগে ‘জনগণের অংশগ্রহণমূলক’ সরকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছিল। তাঁর সাফল্যের নিয়ামক শক্তি বন্দুক ছিল না, ভয় পাইয়ে দেওয়ার জন্য কোনো ধরনের পেটোয়া বাহিনী ছিল না, ছিল আওয়ামী লীগের সাচ্চা সাংগঠনিক শক্তি।সেদিন আওয়ামী লীগ যতটা উদার হতে পেরেছিল, এখন ততটাই সংকীর্ণ, ব্যক্তির প্রতি শর্তহীন আনুগত্যই যেন শেষ কথা।আজ আওয়ামী লীগের অবস্থা এতটাই করুণ যে তারা সেই ঐতিহ্য স্মরণে আনতেও দ্বিধান্বিত, ভীত। সুতরাং কয়েক সপ্তাহ পরে লন্ডন প্রত্যাগত একজন সৈয়দ আশরাফকে আমরা গণতান্ত্রিকভাবে সংগঠন গোছাতে অতীব তৎপর হতে দেখব, তা ভাবতে পারলে খুশি হতাম। যদিও ওবায়দুল কাদের এই সিদ্ধান্তকে যথার্থতা দিতে বলেছেন, হয়তো নেত্রী ভেবেছেন তিনি দলের জন্য এখন বেশি সময় দেবেন, সে জন্য এটা করা হয়েছে, আসলে এর ভিত্তি পলকা। কারণ, ক্ষমতাসীনদের কেউ প্রকাশ্যে অনুশোচনা করেন না যে দলটি অগোছালো, দুর্দশাগ্রস্ত এবং বিএনপির সাংগঠনিক রুগ্ণদশার সঙ্গে বহুলাংশে তুলনীয়। ছাত্রলীগ সন্ত্রাস করে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেয় কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ অত্যন্ত সীমিত।
এই আওয়ামী লীগ উনসত্তরের আওয়ামী লীগ নয়। এখন দলের শক্তি সরকার চালায় না। সরকারি শক্তি দল চালায়। সুযোগসন্ধানী একশ্রেণির রাজনীতিক এবং আমলতন্ত্রশাসিত একটি ব্যবস্থা আওয়ামী লীগকে পরিচালনা করছে। অনেকের মতে, গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রভাব অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে নাকি কম নয়। আওয়ামী লীগের বিবেকবান ও সচেতন অংশ বড় বেশি সংখ্যালঘু এবং কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। এই ধারণা সঠিক হলে সৈয়দ আশরাফ আর জিল্লুর রহমান হতে পারবেন কি? আগামী ডিসেম্বরে তিনি তৃতীয় মেয়াদে সাধারণ সম্পাদক পদে থাকবেন নাকি তাঁকে যেতেই হবে? তিনি সোহেল তাজ হতে চাইবেন না, রাজনীতিতে পথ না হারানোটা তাঁর জন্য চ্যালেঞ্জ। তাঁকে শেখ হাসিনারও দরকার পড়বে।
সংসদীয় গণতন্ত্রে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী একটি সম্মানজনক রীতি। সেই রীতি অনুযায়ী তাঁর কর্মচাঞ্চল্য দেখলে আমরা খুশি হব। কখনো ঘটেনি বলে নিরাশ হতে চাই না, কিন্তু অহেতুক নতুন আশার জাল বোনাও কাজের কথা নয়। ২০১০ সালে ব্রিটিশ সাংসদ ব্যারোনেস ভার্সি যখন ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির চেয়ারম্যান ছিলেন, তখন তাঁকে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী পদেও রাখা হয়। দলের চেয়ারম্যান যাতে মন্ত্রিসভায় অংশ নিতে পারেন, সে জন্য দলের চেয়ারম্যানকে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী পদে রাখাটা ব্রিটেনে একটি কনভেনশন হিসেবে গড়ে উেঠছে। বাংলাদেশ তার তথাকথিত ওয়েস্টমিনস্টার মডেলের গণতন্ত্রচর্চার কোন স্তরে পৌঁছালে তবে দলের চেয়ারম্যান যেকোনো অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীই হতে চাইবেন না, কেবল দপ্তরবিহীন মন্ত্রী হলেই তাঁর পোষাবে, তা আমার মতো হয়তো অনেকেই কল্পনা করতে পারবেন না।
ভারত উপমহাদেশে এই পদকে মর্যাদাপূর্ণ হিসেবে গড়ে তোলা হয়নি। এই পদে রাখা মানে কাউকে খাটো করে রাখা। চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় ও আরেক স্বপক্ষত্যাগী বাঙালি মাহমুদ আলী রাষ্ট্রদূত কেবল নন, বিভিন্ন সরকার উতরিয়ে তাঁরা আমৃত্যু দপ্তরবিহীন মন্ত্রীও ছিলেন, সেই ১৯৭১ সালের পর থেকে, পাকিস্তানের প্রতি অনুগত থাকার পুরস্কার। এখন দুজনই প্রয়াত। ইসলামাবাদে ত্রিদিব রায় আমাকে বলেছিলেন, তাঁরা দুজন পাকিস্তানের পতাকা উড়িয়ে চলেন। কিন্তু মন্ত্রিসভার বৈঠকে তাঁরা অংশ নেন না। ১৯৫৭ সালে জওহরলাল নেহরু কৃষ্ণ মেননকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী করার আগের এক বছর তাঁকে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী করে রাখেন। মেননের জন্য সেটা মর্যাদাপূর্ণ ছিল। কিন্তু ২০০৫ সালে সাদ্দাম সরকারের তেল কেলেঙ্কারির বিষয়ে পল ভলকার কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী নটবর সিং পদত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন। তিনি পদত্যাগে রাজি না হলে মনমোহন সিং তাঁকে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী করেছিলেন। অাওয়ামী লীগ সভানেত্রীর অত্যন্ত বিশ্বস্ত সৈয়দ আশরাফ পদত্যাগ করার সুযোগ নেননি বা তাঁকে সে সুযোগ দেওয়া হয়নি, তিনি দপ্তর থেকে অপসারিত হয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরীর সম্পাদিত অবজারভার-এ খবর পড়লাম, আওয়ামী লীগের অনেকে এ ঘটনায় অশনিসংকেত দেখছেন। তাঁরা তাজউদ্দীন আহমদ উপাখ্যান স্মরণ করছেন। এটা পড়ে আমার মনে পড়ল হ্যামলেটের সেই উক্তি: ‘সামথিং ইজ রটেন ইন দ্য স্টেট অব ডেনমার্ক।’
কথিত নিষ্ক্রিয়তা বনাম দুর্নীতিগ্রস্ততার মধ্যে কোনটি বেশি ক্ষতিকর? যদি হঠাৎ জিরো টলারেন্স দেখানোর নীতি গ্রহণ করার ইচ্ছে জাগে, তাহলে কোনো রাষ্ট্রে কোনটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ অগ্রাধিকার পাবে? নিষ্ক্রিয়তা নাকি দুর্নীতিগ্রস্ততা? কোনটি বেশি হতাশাগ্রস্ত নাগরিকদের মনে আশা জাগাবে, কাঙ্ক্ষিত বলে গণ্য হবে? বাংলাদেশ বার্তা রটিয়েছে যে দুর্নীতিগ্রস্ততার চেয়ে নিষ্ক্রিয়তাই বেশি ক্ষতিকর। তবে কী বার্তা জনগণের কাছে গেছে সেটা যদি এক বাক্যে বলতে হয়, তাহলে আমি কিশোরগঞ্জের চা দোকানির উক্তি ধার করব। ‘হুনুইন, ভালা মানুষের ভাত নাই।’ সম্প্রতি সৈয়দ আশরাফ কিশোরগঞ্জ শহরে খড়মপট্টিতে তাঁর চাচার রংচটা একতলা টিনশেড ভবনে দুরাত কাটিয়ে এসেছেন। এটি তাঁর নির্বাচনী এলাকা হলেও শহরে তাঁর বাড়ি নেই (ঢাকাতেও বাড়ি নেই), পুলিশ গার্ড অব অনার দিতে এসে বিফল মনোরথে ফিরে গেছে। নেতা-কর্মীরা ভিড় করেননি। মোটরসাইকেলের হর্নে পথঘাট চকিত হয়নি। কেউ স্লোগান তোলেনি। বর্তমান আওয়ামী লীগের এ রকম একজন সাধারণ সম্পাদক সত্যি বেমানান!
মনে হচ্ছে সৈয়দ আশরাফ বিস্মিত হননি। সিলেটে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেনও যে অনেক দিন ধরেই এ রকম একটা কিছুর সিদ্ধান্তের বিষয় শোনা যাচ্ছিল, সেটাই বাস্তবে ঘটল। ব্রিটেনের লেবার রাজনীতির সক্রিয় কর্মী থাকা সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম আমাদের প্রচলিত বাগাড়ম্বরপূর্ণ রাজনীতির প্রতি বাহ্যত অত্যন্ত নিরাসক্ত ছিলেন, সে কথা বলা যাবে না। কারণ, বহু ক্ষেত্রে তিনি তাঁর দলের পক্ষে অনাবশ্যক সাফাই গেয়েছেন, কোরাসে সুর মিলিয়েছেন। কিন্তু সব তাল মেলাতে পারেননি।
তবু সার্বিক বিচারে তাঁর বড় গুণ মন্ত্রিসভায় হাতে গোনা কয়েকজন, যাঁরা এখনো অপেক্ষাকৃত উঁচু নীতিনৈতিকতার ঝান্ডা তুলে ধরতে সচেষ্ট রয়েছেন, তিনি তাঁদের অন্যতম হিসেবে পরিচিত। তাঁকে ধন্যবাদ জানাই, কারণ কিছু ক্ষেত্রে তিনি প্রতিবাদী হতে চেয়েছেন বলে প্রতীয়মান হয়েছে। তাঁর মন্ত্রণালয়টি দুই দশক ধরে দলীয় রাজনীতির সূতিকাঘর হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। ওই মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বিভিন্ন সংস্থা ও অফিসের বড় বড় পদে কে থাকবেন কে যাবেন, সেটা তিনি গোড়া থেকেই দৃশ্যত প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের হাতে ছেড়ে দিয়েছিলেন। এটা ইঙ্গিত দেয় যে তিনি তাঁর অবচেতনে গোড়া থেকেই আজকের দিনটি সম্পর্কে সতর্ক ছিলেন।
বর্তমান মন্ত্রিসভা বা রাষ্ট্রের বড় পদে টিকে থাকার পয়লা শর্ত শর্তহীন আনুগত্য। সেখানে আশরাফ জনগণের পক্ষে দাঁড়াতে গিয়ে গোলমাল করে ফেলেছেন, ঠিক এমনটাও বলা যাবে না। এখন আমরা কিছুটা আশ্বস্ত হতে পারি, নতুন করে কিছুটা আশাবাদী হতে পারি, যদি অবিলম্বে বিতর্কিত মন্ত্রীদের অপসারণ করা হয়। এই ঘটনার পরে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির দিকে নজর দিতে হবে। সৈয়দ আশরাফকে সরিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নিকটাত্মীয় এলেন। ক্ষমতার বলয় আরও নিরঙ্কুশ হলো। বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত বিশ্বস্ত তাজউদ্দীন আহমদকে কেন অপসারণ অনিবার্য ছিল, তার উত্তর আমরা আজও খুঁজি। তিনি ‘জাতির বৃহত্তর স্বার্থে’ পদত্যাগ করেছিলেন। আমরা সোহেল তাজ উপাখ্যান এড়াতে পারিনি। রক্তের উত্তরাধিকারজনিত এ যেন এক মস্ত গোলকধাঁধা, তাই বুঝি অাশরাফকে রক্তঋণ স্মরণ করিয়ে দিতে হয়েছে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com
No comments