ভোটার তালিকায় জেন্ডার গ্যাপ বাড়ল কেন? by বদিউল আলম মজুমদার

অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের অন্যতম পূর্বশর্ত হলো একটি বিশ্বাসযোগ্য ভোটার তালিকা। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন যথাসময়ে অনুষ্ঠিত না হওয়ার একটি বড় কারণ ছিল ভোটার তালিকায় প্রায় সোয়া কোটি ভুতুড়ে ভোটারের অন্তর্ভুক্তির অভিযোগ। বিষয়টি উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়ায় এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ভোটার তালিকা সংশোধন করে তা নির্ভুল করার নির্দেশ দেন।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বে গঠিত নির্বাচন কমিশন ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা তৈরি করে। তালিকাট তৈরির পর তার সঠিকতা যাচাইয়ের জন্য নির্বাচন কমিশন ইউএনডিপির সহায়তায় একটি অডিটের আয়োজন করে। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন ফর ইলেক্টোরাল সিস্টেমস (আইএফইএস) তালিকাটিকে ৯৯ শতাংশ নির্ভুল বলে প্রত্যায়িত করে। সেই তালিকা অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট ভোটারের সংখ্যা ছিল ৮ কোটি ১০ লাখ ৫৮ হাজার ৬৯৮। এর মধ্যে নারী ভোটার ছিল ৪ কোটি ১২ লাখ ৩৬ হাজার ১৪৯ এবং পুরুষ ভোটার ৩ কোটি ৯৮ লাখ ২২ হাজার ৫৪৯। অর্থাৎ ওই তালিকা অনুযায়ী নারী ভোটার ছিল পুরুষ ভোটার থেকে ১৪ লাখ ১৩ হাজার ৬০০ বেশি এবং ভোটার তালিকায় নারী-পুরুষের পার্থক্য বা ‘জেন্ডার-গ্যাপ’ ছিল +১ দশমিক ৭৪ শতাংশ।
নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইট থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে পুনর্গঠিত নির্বাচন কমিশনের অধীনে ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার পর ভোটারের সংখ্যা দাঁড়ায় ৯ কোটি ১৯ লাখ ৮০ হাজার ৫৩১। এর মধ্যে নারী ভোটার ৪ কোটি ৫৮ লাখ ৪৪ হাজার ৫৬৬ এবং পুরুষ ভোটার ৪ কোটি ৬১ লাখ ৩৫ হাজার ৯৬৫। অর্থাৎ ২০১৩ সালের তালিকা অনুযায়ী, নারী ভোটার ছিল পুরুষ ভোটার থেকে ২ লাখ ৯১ হাজার ৩৯৯ কম এবং জেন্ডার গ্যাপ ০.৩২ শতাংশ।
নির্বাচন কমিশন ২০১৪ সালের মে থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার পরবর্তী উদ্যোগ নেয়। গত ২ জানুয়ারি একটি খসড়া সাপ্লিমেন্টারি তালিকা প্রকাশ করে এবং ২২ জানুয়ারির মধ্যে এটি সংশোধনের সময়সীমা নির্ধারণ করে দেয়। খসড়া তালিকা অনুযায়ী নতুন ভোটারের সংখ্যা দাঁড়ায় পাঁচ লাখের কিছু বেশি এবং জেন্ডার গ্যাপ -১১ দশমিক ৬৭ শতাংশ।
পরবর্তী সময়ে গত ১ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন কমিশন হালনাগাদের একটি সারসংক্ষেপ ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে। সারসংক্ষেপ অনুযায়ী, ২০১৪ সালের হালনাগাদ শেষে চূড়ান্ত ভোটারসংখ্যা দাঁড়ায় মোট ৯ কোটি ৬১ লাখ ৯৮ হাজার ৬৫২, যার মধ্যে নারী ভোটার ৪ কোটি ৭৭ লাখ ৪৭ হাজার ১০ এবং পুরুষ ভোটার ৪ কোটি ৮৪ লাখ ৫১ হাজার ৬৪২। অর্থাৎ সর্বশেষ তালিকা অনুযায়ী, নারী ভোটারের সংখ্যা পুরুষ ভোটারের তুলনায় ৭ লাখ ৪ হাজার ৬৩২ কম এবং জেন্ডার গ্যাপ -০.৭৪ শতাংশ।
কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সারসংক্ষেপ থেকে দেখা যায় যে নভেম্বর ২০১৪ পর্যন্ত নতুন ভোটারের সংখ্যা বেড়েছে ৪৬ লাখ ৯৫ হাজার ৬৫০। এর মধ্যে নারী ভোটার হলো ২০ লাখ ৬৬ হাজার ১৪৪ এবং পুরুষ ভোটার ২৬ লাখ ২৯ হাজার ৫০৬। অর্থাৎ সর্বশেষ চূড়ান্ত তালিকা অনুযায়ী, নতুন ভোটারের মধ্যে নারী ভোটারের সংখ্যা পুরুষ ভোটার থেকে ৫ লাখ ৬৩ হাজার ৩৬২ জন কম এবং জেন্ডার গ্যাপ -১২ শতাংশ। লক্ষণীয়, চূড়ান্ত ভোটার তালিকায় জেন্ডার গ্যাপ কিছুটা বেড়েছে।
নতুন ভোটারদের মধ্যে জেন্ডার গ্যাপের তাৎপর্য পুরোপুরি অনুধাবন করার জন্য জেলাভিত্তিক তথ্য বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। দুর্ভাগ্যবশত, কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সারসংক্ষেপের সঙ্গে জেলাভিত্তিক নতুন ভোটারের তথ্য প্রকাশ করা হয়নি এবং আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিকভাবে যোগাযোগ করেও কমিশন থেকে এসব তথ্য সংগ্রহ করা যায়নি। তবে ১ জানুয়ারি প্রকাশিত খসড়া সাপ্লিমেন্টারি তালিকার সঙ্গে জেলাওয়ারি নারী-পুরুষ ভোটারের বিভাজন পাওয়া যায়—যে ক্ষেত্রে জেন্ডার গ্যাপ কিছুটা কম—এবং তা থেকে ডেন্ডার গ্যাপের প্রকটতা আরও সুস্পষ্ট হয়।
খসড়া তালিকা অনুযায়ী, আমাদের মোট ৬৪টি জেলার মধ্যে আটটি জেলায় জেন্ডার গ্যাপ ৫ শতাংশের নিচে, ২৮টি জেলায় ৫ থেকে ১০ শতাংশের মধ্যে, নয়টি জেলায় ১০ থেকে ১৫ শতাংশের মধ্যে, ১১টি জেলায় ১৫ থেকে ২০ শতাংশের মধ্যে, চারটি জেলায় ২০ থেকে ২৫ শতাংশের মধ্যে, দুটি জেলায় ২৫ থেকে ৩০ শতাংশের মধ্যে, একটি জেলায় ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশের মধ্যে, এবং একটি জেলায় ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশের মধ্যে।
সবচেয়ে বড় জেন্ডার গ্যাপ হলো ফেনীতে, যা মাইনাস ৩৫ দশমিক ৩ শতাংশ। এরপর লক্ষ্মীপুরের মাইনাস ৩০ দশমিক ৮২ শতাংশ, নোয়াখালীতে মাইনাস ২৬ দশমিক ৪৪, চাঁদপুরে মাইনাস ২৫ দশমিক ৭২, কুমিল্লায় মাইনাস ২৩ দশমিক ৪, কক্সবাজারে মাইনাস ২২ দশমিক ৫৮ এবং ভোলায় মাইনাস ২০ দশমিক ৮৪ শতাংশ।
সবচেয়ে কম জেন্ডার গ্যাপ ঢাকায়, যা মাইনাস ২ দশমিক ১ শতাংশ। এরপর খুলনায় মাইনাস ২ দশমিক ৬৪ শতাংশ, গাইবান্ধায় মাইনাস ২ দশমিক ৯২, রংপুরে মাইনাস ৪ দশমিক শূন্য ২, শেরপুরে মাইনাস ৪ দশমিক ০৮, বগুড়ায় মাইনাস ৪ দশমিক ২৬, পঞ্চগড়ে মাইনাস ৪ দশমিক ৪২ এবং খাগড়াছড়িতে মাইনাস ৪ দশমিক ৫৪ শতাংশ।
উপরিউক্ত তথ্য থেকে নতুন ভোটারদের মধ্যে জেন্ডার গ্যাপের কোনো সুস্পষ্ট প্যাটার্ন লক্ষ করা যায় না। একমাত্র বৃহত্তর নোয়াখালীর তিনটি জেলায় এবং বৃহত্তর কুমিল্লার দুটি জেলায় উচ্চ হারে জেন্ডার গ্যাপ দেখা যায়। কী কারণে তা ঘটেছে, যার ফলে নারীরা ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন, সেই ব্যাখ্যা দাবি করার অধিকার জনগণের রয়েছে এবং কমিশন তা প্রদান করবে বলে আমরা আশা করি।
ভোটার তালিকা নিয়ে আরেকটি সমস্যা হলো, বাংলাদেশের জনসংখ্যায় নারী-পুরুষের যে বিভাজন, তার সঙ্গে ভোটার তালিকায়, বিশেষত নতুন ভোটারদের মধ্যকার দৃশ্যমান জেন্ডার গ্যাপের কোনো রূপ মিল নেই। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, বাংলাদেশে পুরুষ-নারীর অনুপাত বা জেন্ডার রেশিও ১০০ দশমিক ৩। অর্থাৎ আমাদের দেশে পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা প্রায় কাছাকাছি। তাই ভোটার তালিকায় নতুন ভোটারদের মধ্যে নারী-পুরুষের মধ্যে যে মাইনাস ১২ শতাংশ জেন্ডার গ্যাপ দেখা যায়, তার যৌক্তিকতা প্রশ্নবিদ্ধ।
ভোটার তালিকায় শুধু নারী-পুরুষের বিভাজনের বিশ্বাসযোগ্যতাই প্রশ্নবিদ্ধ নয়, ভোটার বৃদ্ধির হারের সঙ্গে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের সংগতি নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। গত ছয় বছরে—২০০৮ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত গড় বার্ষিক ভোটার বৃদ্ধির হার ছিল ৩ দশমিক ১১ শতাংশ। আর গত বছর যাঁরা নতুন ভোটার হয়েছেন, তাঁদের জন্ম ১৮ বছর আগে এবং তখন আমাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ১ দশমিক ৮০ শতাংশের কম। এ ধরনের অসংগতি ভোটার তালিকার সঠিকতা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি না করে পারে না।
বস্তুত, ভোটার তালিকার হালনাগাদ, তথা সঠিকতা নিয়ে ইতিমধ্যে গুরুতর বিতর্ক বিরাজ করছে। এ ব্যাপারে গণমাধ্যমে অনেক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। যুগান্তর-এর (২৬ জানুয়ারি ২০১৫) এক প্রতিবেদন অনুযায়ী: ‘ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রম নিয়ে অভিযোগের অন্ত নেই। তথ্য সংগ্রহকারীরা অনেক বাড়িতেই যাননি। বাড়ি বাড়ি না গিয়েই পাড়া-মহল্লার প্রভাবশালী ও পরিচিতদের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করেছেন কেউ কেউ। রাজধানীসহ জেলা ও উপজেলার বিভিন্ন এলাকার তথ্য সংগ্রহকারীদের দেখা পাননি ভোটার হতে ইচ্ছুক অসংখ্য মানুষ। বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহের বিধান থাকলেও অনেক তথ্য সংগ্রহকারী এ বিধানের তোয়াক্কাও করেননি। এ ছাড়া ভোটার তালিকা হালনাগাদে চালানো হয়নি পর্যাপ্ত প্রচার-প্রচারণা।’ প্রসঙ্গত, বর্তমান লেখকের বাড়িতেও কোনো তথ্য সংগ্রহকারী আসেননি।
পরিশেষে, নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান এবং এর দায়িত্ব সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে কার্যকর করা। এ লক্ষ্যে সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদ কমিশনকে চারটি সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব দিয়েছে, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত সংসদ নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা প্রণয়ন। এসব দায়িত্ব পালনের লক্ষ্যে কমিশনকে অগাধ ক্ষমতাও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কমিশন যেন তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারছে না, বরং পক্ষপাতদুষ্ট আচরণের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছে। এমনকি ভোটার তালিকা হালনাগাদেও বিতর্ক এড়ানো যায়নি, যার বিরূপ প্রভাব আগামী নির্বাচনে পড়তে বাধ্য।
তাই আমরা মনে করি, জরুরি ভিত্তিতে আমাদের বর্তমান ভোটার তালিকার একটি নিরপেক্ষ অডিটের আয়োজন করা আবশ্যক, যাতে সময় থাকতেই ভোটার তালিকা যথাযথভাবে সংশোধন করে এর বিশ্বাসযোগ্যতা নিশ্চিত করা যায়।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)।

No comments

Powered by Blogger.