প্রতিবেশীকে নিয়ে বিকাশের নীতিতে বিশ্বাসী চীন -প্রথম আলো কার্যালয়ে চীনা রাষ্ট্রদূত

চীনের রাষ্ট্রদূত মা মিংচিয়াং
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ‘প্রতিবেশীকে সঙ্গে নিয়ে বিকশিত হও’—এই দর্শনে বিশ্বাসী চীন। এ ধারণার মূলে রয়েছে প্রতিবেশী সমৃদ্ধ না হলে নিরাপদ থাকা যায় না। তাই প্রতিবেশীকে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত করার পাশাপাশি তাদের দক্ষতা বাড়ানোর ওপর চীন গুরুত্ব দিয়ে থাকে। কাজেই বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চলে চীনের বিনিয়োগ হলে বাংলাদেশের সমৃদ্ধি আসবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত মা মিংচিয়াং গতকাল সোমবার দুপুরে প্রথম আলো কার্যালয়ে জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে এসব কথা বলেন। আলোচনা সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান।
চীনের রাষ্ট্রদূত তাঁর সূচনা বক্তৃতায় বলেন, দুই দেশ এ বছর কূটনৈতিক সম্পর্কের চার দশক পালন করলেও সম্পর্কটা কয়েক হাজার বছরের। মুন্সিগঞ্জের পুরাকীর্তি সে সাক্ষ্যই বহন করছে। সম্পর্কের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের অংশীদারত্ব নিবিড় করতে চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কেছিয়াং এ বছর ঢাকায় আসছেন। তাঁর এ সফরের আগে বাংলাদেশে আসবেন চীনের বাণিজ্যমন্ত্রী গাউ হুচেং।
বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্কের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরতে গিয়ে মা মিংচিয়াং অতীশ দীপঙ্করের প্রসঙ্গ টানেন। তাঁর চীন সফরের পর বাংলাদেশে পুরাকীর্তি নিদর্শনের কথা জানা যায়। মুন্সিগঞ্জে পুরাকীর্তির নিদর্শন খননে চীন আর্থিক সহায়তা দিয়েছে।
দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের বিপুল বৈষম্য যা চীনের পক্ষে আছে, তার উল্লেখ করে মা মিংচিয়াং বলেন, ‘কীভাবে এই বৈষম্য কমানো যায়, তা নিয়ে আমরা কাজ করছি। তবে বাংলাদেশের চেয়ে চীনের পণ্য রপ্তানির ভান্ডারটা সমৃদ্ধ। তাই বাংলাদেশে বিনিয়োগের ওপর আমরা বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছি। বাংলাদেশে চীনের বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার জন্য চট্টগ্রামে ৭৭৪ একর জমি বরাদ্দ করা হয়েছে। এতে জমি পেতে ইতিমধ্যেই চীনের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। আমরা চীনের একটি শিল্পপার্ককে বাংলাদেশে নিয়ে আসার পরিকল্পনা করছি।’
বাংলাদেশে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। বন্দর নির্মাণে চীনেরও আগ্রহ রয়েছে। বর্তমানে এটি কোন পর্যায়ে আছে, জানতে চাইলে মা মিংচিয়াং বলেন, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে বাংলাদেশ। বঙ্গোপসাগরে কোনো গভীর সমুদ্রবন্দর না থাকায় পণ্য রপ্তানির জন্য বাংলাদেশকে সিঙ্গাপুর ও শ্রীলঙ্কার ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। এতে সময় ও টাকা খরচ বেশি হচ্ছে। তাই বাংলাদেশের অর্থনীতির স্বার্থেই গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, ‘যেহেতু বাংলাদেশের প্রকল্প, তাই কোন দেশ এটা করল, তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না।’ কারণ, যেকোনো বাণিজ্যিক প্রকল্পে টাকার বিনিময়ে ব্যবহারের সুযোগ পাওয়া যায়। তবে এটা ঠিক যে চীনের কোনো প্রতিষ্ঠান এ কাজ পেলে সানন্দে গ্রহণ করবে।
সাধারণত বাংলাদেশ চীন থেকে সমরাস্ত্র সংগ্রহ করে থাকে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অন্য দেশ থেকেও বাংলাদেশ সমরাস্ত্র কিনছে। বেইজিং এ বিষয়টিকে কীভাবে দেখে—জানতে চাইলে মা মিংচিয়াং বলেন, ‘আমি তো মনে করি, এখন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা উন্নত হয়েছে বলে বিভিন্ন দেশ থেকে সমরাস্ত্র কেনা হচ্ছে। একটি সার্বভৌম দেশের কোনো বিষয়ে এককভাবে একটি দেশের ওপর নির্ভরশীল থাকাটা ঠিক নয়। বন্ধু হিসেবে মনে করি, বিভিন্ন উৎস থেকে সমরাস্ত্র সংগ্রহ করাটা বাংলাদেশের জন্য ভালো হলে তাতে আমরাও খুশি।’
দুই দেশের কৌশলগত সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন আসেনি উল্লেখ করে চীনের রাষ্ট্রদূত বলেন, এ সম্পর্ক প্রতিনিয়ত নিবিড় হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বেশ নিবিড় হয়েছে। সেই সঙ্গে জাপান, যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠতা বাড়ছে। এ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, সব দেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকাটাকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আদর্শ হিসেবে দেখা হয়। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিবিড় থেকে নিবিড়তম হওয়াটাকে বেশ ইতিবাচকভাবেই দেখেন তিনি। সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের সঙ্গে চীনের সম্পর্কও ঘনিষ্ঠ হচ্ছে। ঐতিহাসিক বৈরিতা সত্ত্বেও জাপানের সঙ্গে চীন সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ভারত ও জাপান স্থায়ী সদস্য হতে চায়। কোন দেশের প্রতি চীনের সমর্থন রয়েছে এবং তাদের প্রার্থিতাকে চীন কীভাবে দেখে, জানতে চাইলে মা মিংচিয়াং বলেন, জাতিসংঘে সংস্কার চায় চীন। এই সংস্কারের ক্ষেত্রে চারটি বিষয়কে বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে। জাতিসংঘের শুরু ৭০ বছর আগে, প্রতিষ্ঠার সময়কার কাঠামোতে এখনো এটি চলছে। জাতিসংঘে শক্তি ও ধনী দেশের কণ্ঠই উচ্চকিত শোনা যায়। সংস্কার হতে হলে তা সামগ্রিক হতে হবে। সব শেষ কারণটি হচ্ছে, সংস্কারের পর যাতে দুর্বল ও ছোট দেশগুলোর দাবি জোরালোভাবে শোনা যায়। তাই জাতিসংঘকে একটি স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে এর সামগ্রিক সংস্কার প্রয়োজন।
চীনা রাষ্ট্রদূত আরও বলেন, ‘পাঁচ বছর আগে চীনের ভাইস প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফরের সময় এখানকার লোকজনের আতিথেয়তার পরিচয় পাই। এবার রাষ্ট্রদূত হিসেবে বাংলাদেশে এসে বুঝেছি, চীনের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারে এখানকার সরকার ও বিরোধী দলের পাশাপাশি আপামর জনগণের ভাবনার সংহতি রয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ।’
প্রথম আলোর কার্যালয় পরিদর্শনের জন্য চীনের রাষ্ট্রদূতকে পত্রিকার পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানানো হয়। মা মিংচিয়াং দায়িত্ব পালনের সময় দুই দেশের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হবে বলে আশা প্রকাশ করা হয়।

No comments

Powered by Blogger.