ঘুষের সঙ্গে বড় অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে পুলিশ by কামরুল হাসান
ভয়ানক অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে পুলিশ |
পুলিশ
বাহিনীর অনেক সদস্যের বিভিন্ন ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়া থামছে না। মামলা
তদন্তে ঘুষ নেওয়া, গ্রেপ্তার বা ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করার
পাশাপাশি ছিনতাই-ডাকাতি, মাদক কেনাবেচা, ধর্ষণসহ বড় ধরনের অপরাধে পুলিশের
জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ উঠেছে। এ ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়া বন্ধ করতে পুলিশ
প্রশাসন থেকে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হলেও তা খুব কাজে আসছে না।
পুলিশের ডিসিপ্লিন অ্যান্ড প্রফেশনাল স্ট্যান্ডার্ড (ডিএপিএস) শাখা থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, বিভিন্ন অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে গত সাড়ে তিন বছরে ৩১২ জন পুলিশ সদস্যকে চাকরিচ্যুত করা এবং বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছে।
চাকরিচ্যুতি ছাড়াও অন্য দণ্ডও দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে গুরুদণ্ড হলো পদাবনতি, বার্ষিক প্রণোদনা (ইনক্রিমেন্ট) বাতিল ও বার্ষিক প্রতিবেদনে কালো দাগ। আর লঘুদণ্ড হলো কিছু সময়ের জন্য আটক রাখা, দায়িত্ব থেকে সরিয়ে রাখা, অতিরিক্ত প্যারেড করানো এবং তিরস্কার ও সতর্ক করা।
‘পুলিশে দলীয়করণের কারণে অপরাধের বেশ কিছু ঘটনা ঘটছে, যা পুলিশের কাছ থেকে কেউ আশা করে না। কিন্তু পুলিশ যদি এভাবে অপরাধে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে সাধারণ মানুষের দাঁড়ানোর কোনো জায়গা থাকবে না’
যোগাযোগ করা হলে পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (প্রশাসন) মোখলেসুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সংখ্যা দিয়ে এ ধরনের বিষয়ের বিচার করা ঠিক হবে না; বরং এসব ব্যবস্থা নেওয়া থেকে প্রমাণিত হয় যে বর্তমান পুলিশ প্রশাসন স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতে বিশ্বাস করে। কোনো ধরনের অপরাধ বরদাশত করে না। তা ছাড়া আগের বছরগুলোর তুলনায় পুলিশের সদস্যও অনেক বেড়েছে।
তবে একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন, ডিএপিএস শাখায় যেসব অভিযোগ নথিভুক্ত হয়, তা প্রকৃত অপরাধের চেয়ে অনেক কম। কাগজে-কলমে অভিযোগের যে সংখ্যা দেখানো হয়েছে, প্রকৃত অভিযোগ তার চেয়ে অনেক বেশি। অনেক অভিযোগ সদর দপ্তর পর্যন্ত আসে না। অভিযোগের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণেই পুলিশ কর্মকর্তারা নিম্নপদের সদস্যদের বারবার সতর্ক করছেন।
পুলিশের মতো র্যাবও একই ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে। র্যাব জানায়, গত সাড়ে তিন বছরে ৩৭১ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এ সময় সাতজনকে চাকরিচ্যুত করা হয়। পুলিশ বাহিনীতে বর্তমানে লোকবল আছে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৮০৯, আরও ৫০ হাজার লোকবল নিয়োগ করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
গত বছরের মার্চে একটি গোয়েন্দা সংস্থা ১০১ জন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করে বলে, তাঁরা বিভিন্ন ব্যক্তিকে আটকের পর টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দিয়েছেন। এ তালিকায় পুলিশ সুপার থেকে কনস্টেবল পর্যন্ত, এমনকি রাষ্ট্রপতি পদক (পিপিএম) পাওয়া কর্মকর্তারাও ছিলেন। এসব কর্মকর্তা ২২৬ জনকে ছেড়ে দেওয়ার বিনিময়ে ১ কোটি ৩৫ লাখ টাকা ঘুষ নেন। দেশের সাতটি বিভাগের ১৯ জেলায় এ ঘটনা ঘটে। গোয়েন্দা সংস্থার ওই প্রতিবেদনটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। এরপর গত বছরের ১৮ মার্চ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী’ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে মন্ত্রণালয়কে জানাতে পুলিশের মহাপরিদর্শককে (আইজিপি) নির্দেশ দেয়।
ডিএপিএস শাখার কর্মকর্তারা জানান, গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন অনুসারে সবার ব্যাপারে তথ্য তাঁরা পাননি। তবে অনেক অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। এ ব্যাপারে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে।
পুলিশের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের অধ্যাপক জিয়াউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ আগে ঘুষ খেত, এখন ইয়াবা ব্যবসা করছে। দেখা যাচ্ছে, এখন শুধু ক্ষেত্র বদল হয়েছে, অপরাধে বৈচিত্র্য এসেছে। তাঁর মতে, পুলিশে পরিবর্তন আনতে হলে এর সংস্কার দরকার।
সম্প্রতি বরিশাল মহানগর পুলিশের ঘুষ আদায়ের তহবিল নিয়ে পুলিশ প্রশাসন বিব্রত। পদোন্নতির জন্য তারা রীতিমতো ব্যাংক হিসাব খুলে ঘুষের জন্য তহবিল করেছে। পরে ঘটনা জানাজানি হলে একজন কমিশনারসহ ১১ জন পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। সেই সঙ্গে মহানগর পুলিশ কমিশনারকেও প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হয়। তবে এখনো কমিশনারকে প্রত্যাহার করা হয়নি। পুলিশ প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলেছেন, এভাবে ঘুষ আদায়ের বিষয়টি ফৌজদারি অপরাধ। তদন্তের পর অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গত ২০ জুন ফেনীর লালপুর এলাকা থেকে পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) এএসআই মাহফুজুর রহমানকে ৬ লাখ ৮০ হাজার ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করে র্যাব। এই ইয়াবার মধ্যে কক্সবাজার পুলিশের জব্দ করা ১৩ পিস ইয়াবাও ছিল। তাঁকে আটকের পর র্যাব সদস্যরা আরও ১০ পুলিশ সদস্য ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বলে তথ্য পান।
জানতে চাইলে র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান প্রথম আলোকে বলেন, এসব অভিযোগ লিখিতভাবে পুলিশ সদর দপ্তরে জানানো হয়েছে। তারা ব্যবস্থা নেবে।
পুলিশ সদর দপ্তরের সূত্র জানায়, ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত পুলিশ সদস্যদের খুঁজে বের করতে সিআইডির ডিআইজি সাইফুল হককে প্রধান করে কমিটি করা হয়েছে। এ ছাড়া মানব পাচার, মাদক ব্যবসা ও অন্যান্য চাঞ্চল্যকর ঘটনা তদন্ত এবং এ ব্যাপারে করণীয় নির্ধারণে বিশেষ শাখার অতিরিক্ত ডিআইজি তৌফিক মাহবুব চৌধুরীকে প্রধান করে আরেকটি কমিটি করা হয়েছে।
গত ১৭ জুন এক নারী পুলিশ কনস্টেবলকে ধর্ষণে জড়িত তাঁর সাবেক স্বামী এএসআই কলিমুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ওই পুলিশ সদস্যকে রিমান্ডেও আনা হয়। ১৪ জুন মোশাররফ হোসেন নামের আরেক এএসআইয়ের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ করেন তাঁর সাবেক স্ত্রী। মোশাররফ এখনো পলাতক।
রাজধানীর খিলগাঁও থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হেলাল উদ্দিন বর্তমানে কারাবন্দী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র আবদুল কাদেরকে নির্মম নির্যাতনের ঘটনায় আদালত হেলাল উদ্দিনকে তিন বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন।
দেশের অন্যান্য স্থানের পাশাপাশি ঢাকা মহানগর পুলিশের বিরুদ্ধেও ছিনতাই, চাঁদাবাজি এবং আটক করে ভয়ভীতি দেখিয়ে টাকা আদায় করে ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। বেশির ভাগ অভিযোগ এএসআই, এসআই ও পরিদর্শক পদমর্যাদার পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে।
এসব অভিযোগ পাওয়ার পর ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া গত ১৭ জুন ঢাকার সব উপকমিশনারকে (ডিসি) চিঠি দিয়ে বলেছেন, মুষ্টিমেয় সদস্যের অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ ডিএমপি তথা বাংলাদেশ পুলিশের ভাবমূর্তি জনসাধারণের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। ফলে সমাজে পুলিশের গ্রহণযোগ্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা কমছে। পুলিশ সদস্যরা যাতে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে না জড়ান, সে ব্যাপারে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সতর্ক থাকার নির্দেশ দেন তিনি।
কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ সদস্যরা যাতে অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে না পড়েন, সে জন্য সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া উপকমিশনারের নির্দেশ ছাড়া সাদা পোশাকে দায়িত্ব পালন থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএমপির একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, কমিশনারের নির্দেশের পরও পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হয়নি। দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ ও পদায়ন পাওয়া পুলিশ সদস্যরাই এসব অপরাধ করছেন। এঁরা পদস্থ কর্মকর্তাদের কথাও শোনেন না।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক এ এস এম শাহজাহান প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশে দলীয়করণের কারণে অপরাধের বেশ কিছু ঘটনা ঘটছে, যা পুলিশের কাছ থেকে কেউ আশা করে না। কিন্তু পুলিশ যদি এভাবে অপরাধে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে সাধারণ মানুষের দাঁড়ানোর কোনো জায়গা থাকবে না। এ জন্য পুলিশের যাঁরা দায়িত্বশীল, তাঁদের তৎপর হতে হবে। কারণ, আইনের শাসন না থাকলে সামাজিক কাঠামো ভেঙে পড়বে।
পুলিশের ডিসিপ্লিন অ্যান্ড প্রফেশনাল স্ট্যান্ডার্ড (ডিএপিএস) শাখা থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, বিভিন্ন অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে গত সাড়ে তিন বছরে ৩১২ জন পুলিশ সদস্যকে চাকরিচ্যুত করা এবং বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছে।
চাকরিচ্যুতি ছাড়াও অন্য দণ্ডও দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে গুরুদণ্ড হলো পদাবনতি, বার্ষিক প্রণোদনা (ইনক্রিমেন্ট) বাতিল ও বার্ষিক প্রতিবেদনে কালো দাগ। আর লঘুদণ্ড হলো কিছু সময়ের জন্য আটক রাখা, দায়িত্ব থেকে সরিয়ে রাখা, অতিরিক্ত প্যারেড করানো এবং তিরস্কার ও সতর্ক করা।
‘পুলিশে দলীয়করণের কারণে অপরাধের বেশ কিছু ঘটনা ঘটছে, যা পুলিশের কাছ থেকে কেউ আশা করে না। কিন্তু পুলিশ যদি এভাবে অপরাধে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে সাধারণ মানুষের দাঁড়ানোর কোনো জায়গা থাকবে না’
যোগাযোগ করা হলে পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (প্রশাসন) মোখলেসুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সংখ্যা দিয়ে এ ধরনের বিষয়ের বিচার করা ঠিক হবে না; বরং এসব ব্যবস্থা নেওয়া থেকে প্রমাণিত হয় যে বর্তমান পুলিশ প্রশাসন স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতে বিশ্বাস করে। কোনো ধরনের অপরাধ বরদাশত করে না। তা ছাড়া আগের বছরগুলোর তুলনায় পুলিশের সদস্যও অনেক বেড়েছে।
তবে একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন, ডিএপিএস শাখায় যেসব অভিযোগ নথিভুক্ত হয়, তা প্রকৃত অপরাধের চেয়ে অনেক কম। কাগজে-কলমে অভিযোগের যে সংখ্যা দেখানো হয়েছে, প্রকৃত অভিযোগ তার চেয়ে অনেক বেশি। অনেক অভিযোগ সদর দপ্তর পর্যন্ত আসে না। অভিযোগের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণেই পুলিশ কর্মকর্তারা নিম্নপদের সদস্যদের বারবার সতর্ক করছেন।
পুলিশের মতো র্যাবও একই ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে। র্যাব জানায়, গত সাড়ে তিন বছরে ৩৭১ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এ সময় সাতজনকে চাকরিচ্যুত করা হয়। পুলিশ বাহিনীতে বর্তমানে লোকবল আছে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৮০৯, আরও ৫০ হাজার লোকবল নিয়োগ করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
গত বছরের মার্চে একটি গোয়েন্দা সংস্থা ১০১ জন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করে বলে, তাঁরা বিভিন্ন ব্যক্তিকে আটকের পর টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দিয়েছেন। এ তালিকায় পুলিশ সুপার থেকে কনস্টেবল পর্যন্ত, এমনকি রাষ্ট্রপতি পদক (পিপিএম) পাওয়া কর্মকর্তারাও ছিলেন। এসব কর্মকর্তা ২২৬ জনকে ছেড়ে দেওয়ার বিনিময়ে ১ কোটি ৩৫ লাখ টাকা ঘুষ নেন। দেশের সাতটি বিভাগের ১৯ জেলায় এ ঘটনা ঘটে। গোয়েন্দা সংস্থার ওই প্রতিবেদনটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। এরপর গত বছরের ১৮ মার্চ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী’ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে মন্ত্রণালয়কে জানাতে পুলিশের মহাপরিদর্শককে (আইজিপি) নির্দেশ দেয়।
ডিএপিএস শাখার কর্মকর্তারা জানান, গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন অনুসারে সবার ব্যাপারে তথ্য তাঁরা পাননি। তবে অনেক অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। এ ব্যাপারে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে।
পুলিশের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের অধ্যাপক জিয়াউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ আগে ঘুষ খেত, এখন ইয়াবা ব্যবসা করছে। দেখা যাচ্ছে, এখন শুধু ক্ষেত্র বদল হয়েছে, অপরাধে বৈচিত্র্য এসেছে। তাঁর মতে, পুলিশে পরিবর্তন আনতে হলে এর সংস্কার দরকার।
সম্প্রতি বরিশাল মহানগর পুলিশের ঘুষ আদায়ের তহবিল নিয়ে পুলিশ প্রশাসন বিব্রত। পদোন্নতির জন্য তারা রীতিমতো ব্যাংক হিসাব খুলে ঘুষের জন্য তহবিল করেছে। পরে ঘটনা জানাজানি হলে একজন কমিশনারসহ ১১ জন পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। সেই সঙ্গে মহানগর পুলিশ কমিশনারকেও প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হয়। তবে এখনো কমিশনারকে প্রত্যাহার করা হয়নি। পুলিশ প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলেছেন, এভাবে ঘুষ আদায়ের বিষয়টি ফৌজদারি অপরাধ। তদন্তের পর অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গত ২০ জুন ফেনীর লালপুর এলাকা থেকে পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) এএসআই মাহফুজুর রহমানকে ৬ লাখ ৮০ হাজার ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করে র্যাব। এই ইয়াবার মধ্যে কক্সবাজার পুলিশের জব্দ করা ১৩ পিস ইয়াবাও ছিল। তাঁকে আটকের পর র্যাব সদস্যরা আরও ১০ পুলিশ সদস্য ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বলে তথ্য পান।
জানতে চাইলে র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান প্রথম আলোকে বলেন, এসব অভিযোগ লিখিতভাবে পুলিশ সদর দপ্তরে জানানো হয়েছে। তারা ব্যবস্থা নেবে।
পুলিশ সদর দপ্তরের সূত্র জানায়, ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত পুলিশ সদস্যদের খুঁজে বের করতে সিআইডির ডিআইজি সাইফুল হককে প্রধান করে কমিটি করা হয়েছে। এ ছাড়া মানব পাচার, মাদক ব্যবসা ও অন্যান্য চাঞ্চল্যকর ঘটনা তদন্ত এবং এ ব্যাপারে করণীয় নির্ধারণে বিশেষ শাখার অতিরিক্ত ডিআইজি তৌফিক মাহবুব চৌধুরীকে প্রধান করে আরেকটি কমিটি করা হয়েছে।
গত ১৭ জুন এক নারী পুলিশ কনস্টেবলকে ধর্ষণে জড়িত তাঁর সাবেক স্বামী এএসআই কলিমুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ওই পুলিশ সদস্যকে রিমান্ডেও আনা হয়। ১৪ জুন মোশাররফ হোসেন নামের আরেক এএসআইয়ের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ করেন তাঁর সাবেক স্ত্রী। মোশাররফ এখনো পলাতক।
রাজধানীর খিলগাঁও থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হেলাল উদ্দিন বর্তমানে কারাবন্দী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র আবদুল কাদেরকে নির্মম নির্যাতনের ঘটনায় আদালত হেলাল উদ্দিনকে তিন বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন।
দেশের অন্যান্য স্থানের পাশাপাশি ঢাকা মহানগর পুলিশের বিরুদ্ধেও ছিনতাই, চাঁদাবাজি এবং আটক করে ভয়ভীতি দেখিয়ে টাকা আদায় করে ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। বেশির ভাগ অভিযোগ এএসআই, এসআই ও পরিদর্শক পদমর্যাদার পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে।
এসব অভিযোগ পাওয়ার পর ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া গত ১৭ জুন ঢাকার সব উপকমিশনারকে (ডিসি) চিঠি দিয়ে বলেছেন, মুষ্টিমেয় সদস্যের অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ ডিএমপি তথা বাংলাদেশ পুলিশের ভাবমূর্তি জনসাধারণের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। ফলে সমাজে পুলিশের গ্রহণযোগ্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা কমছে। পুলিশ সদস্যরা যাতে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে না জড়ান, সে ব্যাপারে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সতর্ক থাকার নির্দেশ দেন তিনি।
কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ সদস্যরা যাতে অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে না পড়েন, সে জন্য সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া উপকমিশনারের নির্দেশ ছাড়া সাদা পোশাকে দায়িত্ব পালন থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএমপির একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, কমিশনারের নির্দেশের পরও পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হয়নি। দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ ও পদায়ন পাওয়া পুলিশ সদস্যরাই এসব অপরাধ করছেন। এঁরা পদস্থ কর্মকর্তাদের কথাও শোনেন না।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক এ এস এম শাহজাহান প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশে দলীয়করণের কারণে অপরাধের বেশ কিছু ঘটনা ঘটছে, যা পুলিশের কাছ থেকে কেউ আশা করে না। কিন্তু পুলিশ যদি এভাবে অপরাধে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে সাধারণ মানুষের দাঁড়ানোর কোনো জায়গা থাকবে না। এ জন্য পুলিশের যাঁরা দায়িত্বশীল, তাঁদের তৎপর হতে হবে। কারণ, আইনের শাসন না থাকলে সামাজিক কাঠামো ভেঙে পড়বে।
No comments