৭১-এ লন্ডনের ফকির সমিতির আমরা কয়েকজন 'এ কি সত্য সকলই সত্য?'
সুলতান শরীফ লন্ডনে ফিরে গেল গত শনিবার ২৭
ফেব্রুয়ারি। বাংলাদেশে এসেছিল তার আইরিশ স্ত্রী নোরাকে নিয়ে মাস দুয়েক
আগে। গত ৫০ বছর ধরেই সুলতান লন্ডন প্রবাসী।
যুক্তরাজ্য
তথা সারা ইউরোপেই সুলতান শরীফের পরিচয় আওয়ামী লীগের একজন প্রথম সারির নেতা
হিসেবে। ১৯৬৯ সালে লন্ডনের পাকিস্তান হাইকমিশনে আমার প্রথম পোস্টিংয়ে গিয়ে
দেখি সুলতান লন্ডন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আর প্রয়াত মিনহাজ ভাই মানে
মিনহাজ উদ্দিন লন্ডন আওয়ামী লীগের সভাপতি। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের তখন
সভাপতি মরহুম গাউস খান, মাথায় সাদা চুল একজন প্রবীণ ব্যক্তি।
লন্ডনে গিয়েই শুনি সুলতান শরীফ বাংলাদেশের অধিকারের প্রশ্নে একজন আপোসহীন 'একটিভিস্ট।' তার সঙ্গে প্রথম পরিচয় '৬৯-এর অক্টোবরে লন্ডনের অক্সফোর্ড স্ট্রিটের এক হোটেলে, বঙ্গবন্ধুর কামরায়। বঙ্গবন্ধু আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডন গেছেন, আগরতলা ষড়যন্ত্রের মামলায় তার পৰের ব্রিটিশ উকিল স্যার টমাস উইলিয়াম কিউসি, এমপি এবং এই ব্রিটিশ উকিলকে তখন ঢাকা পাঠাতে যেসব প্রবাসী বাঙালী টাকা পয়সা উঠিয়েছেন, আয়োজন এনত্মেজাম করেছেন তাদের ধন্যবাদ জানাতে।
বঙ্গবন্ধুর হোটেল কামরায় আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন মরহুম খুরশীদ হামিদ লন্ডনের পাকিসত্মান হাইকমিশনে সেকেন্ড সেক্রেটারি যার স্থলাভিষিক্ত হতে আমি গিয়েছি। খুরশীদ ভাই পিকিংয়ে পাকিসত্মান দূতাবাসে বদলি হওয়াতে তার পদটা লন্ডন হাইকমিশনে খালি হয়েছিল। খুরশীদ ভাই পিকিংয়ের উদ্দেশে লন্ডন ত্যাগ করার আগে রীতিমাফিক যে ফেয়ারওয়েল পার্টি দিচ্ছিলেন সেই পার্টিতে বঙ্গবন্ধুকে ব্যক্তিগতভাবে দাওয়াত দিতে খুরশীদ ভাই বঙ্গবন্ধুর হোটেলে গেলেন। বঙ্গবন্ধুকে হোটেলে পাওয়া গেল না। বঙ্গবন্ধুর লন্ডন প্রবাসী হাজার হাজার বাঙালী ভক্তের কোন একজনের বাড়িতে চায়ের দাওয়াতে গিয়েছেন। আমরা তখন বঙ্গবন্ধুর অপেৰা করছি। কিছুৰণের মধ্যেই হাতে কতগুলো শপিং ব্যাগ নিয়ে মুখে কাঁচা দাড়ির এক যুবক কামরায় ঢুকলেন। একজনকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম, এই যুবকই হচ্ছে সুলতান মাহমুদ শরীফ; পরে একাত্তরে যুক্তরাজ্যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের এক বিরাট সংগঠক মান্নান ভাই-শেখ আব্দুল মান্নানের কাছেও জানলাম। মান্নান ভাইকে আগে কখনও আমাদের এই প্রিয় বন্ধুটিকে সুরতান শরীফ নামে ডাকতে বা আলোচনায় উলেস্নখ করতে শুনিনি।
সুলতান শরীফের সঙ্গে তারপর ঘনিষ্ঠতা এমন হলো যে, আমার প্রথম মেয়ে অরম্নর জন্মের কয়েকদিন পর তাকে বাসায় আনলাম ঠিকই কিন্তু বাসায় মাত্র কয়েকঘণ্টা কাটিয়ে ছুটলাম সুলতান শরীফ-নোরাদের দৰিণ লন্ডনের বালহামের বাসায়। কারণ আমার স্ত্রী বা আমি অরম্নকে তার জন্মের প্রথম দিকে লালন পালন করতে পারব সেই বিশ্বাস আমাদের ছিল না। লন্ডন সোস্যাল ওয়েলফেয়ার ডিপার্টমেন্ট থেকে এক প্রৌঢ় মহিলা আমাদের বাসায় সেই কয়েকঘণ্টার অবস্থানকালে এসে অরম্নর মাকে প্রশিৰণ দিয়ে গেলেন কী করে বুকের দুধ এবং বোতলের দুধ খাওয়াতে হবে, শিশু অরম্ন কখন কেমন করে কাঁদলে কি বুঝতে হবে ইত্যাদি।
এমন প্রশিৰণ পাওয়ার পরও আমাদের মধ্যে আস্থার দারণ অভাব দেখা গেল। সুলতান শরীফ নোরাকে আগেই বলে রেখেছিলাম। তাদের বাসায় যাওয়ার পর বুঝলাম আমরা তাদের বাসায় এসে সঠিক কাজটি করেছি। কারণ তাদের বাসায় যাওয়ার প্রথম বা দ্বিতীয় মাঝরাতে অরম্ন এমন কান্নাকাটি শুরম্ন করে দিল যে, আমরা তার কান্নার কোন অর্থই করতে পারলাম না। লন্ডন সোস্যাল ওয়েলফেয়ারের সেই ভদ্রমহিলার প্রশিৰণ কোনই কাজে লাগছে না দেখে নোরাকে ঘুম থেকে উঠালাম। নোরা অরম্নকে কোলে নিয়ে কিছুৰণ নাড়াচাড়া করল তারপর কিছু একটা খাওয়াল এবং অরম্নও ঠা-া হলো। সুলতান শরীফ নোরাদের বাসায় এই অবস্থানকালেই নোরা এক সকালে নাসত্মার টেবিলে আমার চা খাওয়া দেখে সেই অবিস্মরণীয় মনত্মব্যটি করেছিল, ণড়ঁ ইধহমধষববং ঢ়ৎড়ফঁপব ঃবধ, নঁঃ ুড়ঁ ফড় হড়ঃ শহড় িযড় িঃড় ঃধশব রঃ. ঐরষভ পঁষভ ড়ভ সরষশ ধহফ যঁষভ পঁঢ় ড়ভ ংঁমধৎ, যিধঃ ড়ভ ঃবধ রং ষবভঃ ঃযবৎব? বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একজন একনিষ্ঠ কর্মী এবং বাংলাদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি ও জীবনধারায় গভীরভাবে বিশ্বাসী নোরা চমৎকার বাংলা বলেন ঘ রোয়া অনুষ্ঠানে বাংলা গানও পরিবেশন করেন। স্বাধীনতার পর কয়েক বছর নোরা আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনও পড়িয়েছেন।
আর আমার সেই মেয়ে অরম্ন এখন আট-দশ বছর ধরে লন্ডন প্রবাসী তার স্বামী টুটুল এবং ৭ বছরের সনত্মান অনত্মিককে নিয়ে। অরম্ন জন্মসূত্রে একজন ব্রিটিশ নাগরিক। ১৯৭১-এর ১ আগস্ট তারিখে আমি পাকিসত্মান হাইকমিশনের দ্বিতীয় সচিবের পদ ছেড়ে দিয়ে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের সরাসরি যোগ দিই, তার তিন সপ্তাহ পর অরম্নর জন্ম।
চাকরি ছেড়ে দেয়ার পর রাষ্ট্রবিহীন আমি তখন ফকির সমিতির সদস্যপদ লাভ করি, আর অরম্ন অর্জন করে ব্রিটিশ নাগরিকত্ব। জন্মের পর অরম্নর নাম রাখি জয়া, নামটি রেখেছিল ফকির সমিতির আর এক সদস্য, বাংলাদেশ স্টুডেন্টস একশন কমিটির কনভেনর এজেড মোহাম্মদ হোসেন মঞ্জু। কিন্তু '৭৩-এর এপ্রিলে লন্ডন থেকে বদলি হয়ে নতুন দিলস্নীতে আমাদের বাংলাদেশ হাইকমিশনে যাওয়ার পথে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে আসি প্রথমবারের মতো। মাত্র কয়েকদিন আগে আব্বা মারা গেছেন। '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকালে আমার কতগুলো শিশু-কিশোর ভাইবোনের বড় একটি পরিবার নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে এখানে ওখানে ছোটাছুটি করে কানত্ম হয়ে পড়েছিলেন আব্বা। তারপর লন্ডনে আমার চাকরি ছেড়ে দেয়ার খবরে তাদের জীবনের ঝুঁকিও বেড়ে গিয়েছিল।
বাংলাদেশে আমাদের আসার পর অরম্নর নানি অরম্নকে প্রথম দেখে এবং তার নাম বদলিয়ে জয়া থেকে অরোরা মহিউদ্দিন রাখে। তার তৃতীয় জেনারেশনের প্রথম সদস্য এই শিশুর নাম পরিবর্তনে আমাদের কোন আপত্তি ছিল না। নাসিরাবাদ ও কক্সবাজার গার্লস হাইস্কুলের হেড মিস্ট্রেস আমার শাশুড়ি তখন বলেছিলেন অরোরা মানে সূর্য।
দুই.
আমাদের ফকির সমিতির কোন সংবিধান ছিল না। ছিল না কোন সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক। আমরা ২৫-৩০ বছর বয়সী প্রায় ৩০ জন, একে অন্যের খুব ঘনিষ্ঠ, মুক্তিযুদ্ধের সেই নয় মাসের প্রায় প্রতিদিন আমাদের দেখা-সাৰাত ঘটে, লন্ডনের কোথাও না কোথাও কোন অনুষ্ঠানে, কোন সভা-সমিতি, সমাবেশ বা মিছিলে। আমাদের তখন কোন রাষ্ট্র নেই, বাংলাদেশ হবে আমরা নিশ্চিত, তবে সেজন্য কত রক্ত দিতে হবে, কতদিন অপেৰা করতে হবে সে সম্পর্কে তেমন কোন ধারণা ছিল না। আর পাকিসত্মানকে তো আমরা স্বীকারই করি না তখন। আমাদের কোন বেতন-ভাতা নেই। বিভিন্ন পাকিসত্মানী দূতাবাস থেকে যেসব বাঙালী কর্মকর্তা এবং স্টাফ চাকরি ছেড়ে লন্ডনে এসে জড়ো হয়েছেন, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী তাদের জন্য সাবসিস্টেন্স এলাউন্সের ব্যবস্থা করেছেন; তবে বাঙালী যারা উচ্চ শিৰার্থে লন্ডনে গিয়েছিলেন তাদের সকলেরই বৃত্তি বা দেশ থেকে টাকা আসা বন্ধ হয়ে গেছে, বন্ধ হয়ে গেছে অনেকের লেখাপড়াও। লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বড় একটা উপকারও হলো, সকলেই তখন ফুলটাইম মুক্তিযুদ্ধের কাজ করতে পারল।
'৭১-এর ২৮ ফেব্রম্নয়ারিতে লন্ডনের হাইড পার্কে যুক্তরাজ্যে প্রবাসী বাঙালীদের একটি সভা অনুষ্ঠিত হয় লন্ডন আওয়ামী লীগের উদ্যোগে। এই সভায় জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে একটি মেমোরেন্ডাম পাঠানোর সিদ্ধানত্ম হয়। এই মেমোরান্ডামে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের কাছে দ্রম্নত ৰমতা হসত্মানত্মরের দাবি করা হয়। যুক্তরাজ্য প্রবাসী বাঙালীদের মধ্যে তখন একটা সন্দেহ দানা বেঁধে ছিল যে, ইয়াহিয়া খান পশ্চিম পাকিসত্মানী সামনত্ম প্রভু, সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তি এবং সবের্াপরি জুলফিকার আলী ভুট্টোর চাপে বাঙালী নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রত্যাশা পূরণ করবেন না; তাদের হাতে ৰমতা হসত্মানত্মর করবেন না।
সুলতান শরীফের বর্ণনায় হাইড পার্কের সভা শেষে পাকিসত্মান হাইকমিশনে গিয়ে যুক্তরাজ্যে তখনকার পাকিসত্মানী হাইকমিশনার সলমান আলীকে তাদের সেই মেমোরান্ডামটি দিয়ে বালহামের বাড়িতে ফিরে যাওয়ার আগেই খবর পান যে, ইয়াহিয়া খান সেদিনই জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে দিয়েছেন। সুলতান শরীফ তখন বাসায় না গিয়ে হাইকমিশনে ফিরে আসেন, দ্রম্নত আরও কিছু লোক জড়ো করেন এবং তখন থেকেই পাকিসত্মান হাইকমিশনের সামনের ফুটপাথে ভিজিল দিতে থাকেন এবং তা ২৬ মার্চ পর্যনত্ম চলতে থাকে।
এর মধ্যে পাকিসত্মান হাইকমিশনের একটু দূরে অবস্থিত পাকিসত্মান স্টুডেন্টস হোস্টেলে গিয়ে বাঙালী ছাত্ররা জিন্নাহ সাহেবের ছবি দেয়াল থেকে নামিয়ে ভাংচুর করে, পা দিয়ে মাড়ায় এবং বাংলাদেশ স্টুডেন্টস একশন কমিটি গঠন করে, এজেড মোহাম্মদ হোসেন মঞ্জুকে কনভেনর নির্বাচিত করে। বাংলাদেশ স্টুডেন্টস একশন কমিটি তখন ইংল্যান্ডে পাকিসত্মান ক্রিকেট টিমের সফর ভ-ুল করার চেষ্টাও করেছে।
মঞ্জু লন্ডনে গিয়েছিলেন ব্যারিস্টারি পড়বেন বলে। তার আব্বা মরহুম এমএইচ খোন্দকার বাংলাদেশের প্রথম এটর্নি জেনারেল ছিলেন। তার ছোট ভাই এজে মোহাম্মদ আলীও বিএনপির চারদলীয় জোটের আমলে বাংলাদেশের এটর্নি জেনারেল ছিলেন। তবে রাজনীতির প্রশ্নে আমার ধারণা এই দুইভাই দুই মেরম্নতে।
আমার এ প্রসঙ্গে উলেস্নখ করতে গর্ব হচ্ছে যে, আমাদের হাইকোর্ট ডিভিশনের বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকও আমাদের ফকির সমিতির একজন গুরম্নত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন। আমাদের ফকির সমিতির সদস্য ছিলেন না, তবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন আপীলাত বিভাগের এক বিচারপতি এবিএম খায়রম্নল হকও। মানিক ও আফরাজ চৌধুরী ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের বাসার সামনের ফুটপাথে পুরো একদিন অবস্থান ধর্মঘট করে। পিটার সো'র এমপি তাদের সরবত পান করিয়ে এই অনশন ভাঙ্গান। মানিক ও নজরম্নল ইসলাম আলো তখন আমাদের ফকির সমিতির সদস্যদের স্পিরিট চাঙ্গা করতে প্রায়ই দ্বৈত গলায় এই মারফতি গানটি গাইত :
'দ্বীনের নবী মোসত্মফায়
রাসত্মা দিয়ে হাঁইটা যায়
হরিণ একটি বান্ধা ছিল
গাছেরও তলায়'
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের এক নিষ্ঠাবান এবং 'কমিটেড' কর্মী ম্যারিয়েটা প্রকোপের মৃতু্যর পর মানিক ম্যারিয়েটার মেমোরিয়াল সার্ভিসে ম্যারিয়েটার প্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীত 'আজ জ্যোস্না রাতে সবাই গেছে বনে' হারমোনিয়াম সহযোগে আর এক বাঙালী মহিলাসহ দ্বৈতকণ্ঠে পরিবেশন করেছিল। পুরো একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পৰে কাজ করে ম্যারিয়েটা স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ দেখতে আসে '৭২-এর প্রথম দিকে। বাংলাদেশ থেকে লন্ডনে ফিরে গিয়ে কিছুদিনের মধ্যে ম্যারিয়েটা দুঃখজনকভাবে তার জীবনের সমাপ্তি ঘটায়। যে নজরম্নল ইসলাম আলো দ্বৈত সঙ্গীত পরিবেশন করত মানিকের সঙ্গে, সেই নজরম্নলও দেশে এসছিল মাস দুয়েক আগে। একাত্তরে নজরম্নল লন্ডনে তার ভগি্নপতি মরহুম মোজাম্মেল হক সাহেবের মালিকানাধীন ঘোড়াশালের জনতা জুট মিলসের যুক্তরাজ্য প্রতিনিধি। লন্ডনের কেন্দ্রস্থল হোবর্নে নজরম্নলের অফিস। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরম্ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নজরম্নল তার এই অফিসটি দিয়ে দিল এজেডএম মোহাম্মদ হোসেনদের বাংলাদেশ স্টুডেন্টস একশন কমিটিকে। একাত্তরের একদিন নজরম্নল বা মঞ্জু কেউ একজন আমাকে বলেছিল, এক সকালে স্টুডেন্টস একশন কমিটির এই অফিসের দরজা খুলে তারা একটি খাম দেখতে পায়। খামের উপরে বা ভেতরে কোথাও কিছু লেখা নেই, তবে ছিল ১৫০ ব্রিটিশ পাউন্ড। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পৰের একজন সহানুভূতিশীল মানুষ তার-নাম পরিচয় গোপন রেখে এই পাউন্ডগুলো রেখে গেছেন, স্টুডেন্টস একশন কমিটির কাজে সাহায্য করতে এমন উদাহরণ আমরা তখন আরও দেখেছি।
তিন.
আমাদের ফকির সমিতির তিন সদস্য সুলতান শরীফ, নোরা এবং নজরম্নলের ঢাকা আগমন উপলৰে গত মাসে দু'টো গেট-টুগেদারের আয়োজন করা হয়েছিল। প্রথমটির আয়োজন করেছিলেন লুৎফুল মতিন; মতিন পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান ছিলেন, সরকারের একজন অতিরিক্ত সচিব হিসেবে অবসর নিয়ে তিনি এখন উত্তরায় আমার প্রতিবেশী। একাত্তরে লন্ডনের পাকিসত্মান হাইকমিশনে তিনি ডিরেক্টর অব অডিট এ্যান্ড একাউন্টস ছিলেন। চাকরি থেকে আমার পদত্যাগের কয়েকদিন পর তিনিও পদত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। মতিন সাহেবের এই বাসায় আয়োজিত এই লাঞ্চে রম্নচিও ছিল তার স্বামী-সনত্মানদের নিয়ে। রম্নচি হচ্ছে আমাদের রউফ ভাইয়ের বড় মেয়ে। রউফ ভাই মানে মরহুম একেএম আব্দুর রউফ, আমাদের পুরো সংবিধানটি যিনি হাত দিয়ে লিখেছিলেন। এই বছর তিনি একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন যথার্থভাবেই। রউফ ভাই '৭০ সালে গিয়েছিলেন কিছু একটা উচ্চশিৰার উদ্দেশে। একাত্তরে তিনি মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন এবং ফকির সমিতির সদস্য হওয়ার যোগ্যতা থাকার কারণে তিনিও শুরম্ন থেকেই সদস্য হয়ে যান। আমাদের দ্বিতীয় অনুষ্ঠানটি ছিল একটি ডিনার, আয়োজন করেছিলেন আব্দুল মজিদ চৌধুরী মঞ্জু তার গুলশানের বাসায়। এই মঞ্জু ম্যারিয়েটাদের বাংলাদেশ একশন কমিটিতে কাজ করত। এই ডিনারে সুলতান শরীফ ছিল, তবে ছিল না নোরা এবং মোহাম্মদ হোসন মঞ্জু। নোরা কয়েকদিন আগে লন্ডনে ফিরে গিয়েছিলেন; মঞ্জুকেও তখন কোন এক বিশেষ কারণে লন্ডন যেতে হয়েছিল। তবে নজরম্নল ইসলাম আলো ছিল, ছিলেন ডাক্তার আহমেদ হোসেন জোয়ারদারও। আর ছিল মরহুম ওয়ালী আশরাফের মেয়ে রিপা। রিপা এখন ব্রিটিশ কাউন্সিলে কাজ করে। লন্ডনের বালহামের ২ নম্বর টেম্পারলি রোড তখন ওয়ালী আশরাফদের বাসা এবং সাপ্তাহিক জনমত পত্রিকার অফিস। আর অফিস আমাদের ফকির সমিতির। রাত দিনের যে কোন সময়ে এই অফিসে যাতায়াত করা যেত। ওয়ালী আশরাফ দম্পতির চোখেমুখে তখন কোনদিন বিরক্তি চিহ্ন দেখিনি। বিরক্তি দেখালেও তা গ্রাহ্য করে কে? আমরা যে ফকির সমিতির সদস্য। ওয়ালী আশরাফরা জায়গা না দিলে আমরা যাবো কোথায়? ডাক্তার জোয়ারদারের হাতেই শিল্পপতি জহুরম্নল ইসলাম আমাদের সদ্য প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ মিশন পরিচালনার জন্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর কাছে পাঁচ হাজার পাউন্ড পাঠিয়েছিলেন, আর বিচারপতি চৌধুরী লুৎফুল মতিন এবং আমাকে তাঁর উত্তর লন্ডনের বাসায় এক সন্ধ্যায় ডেকে ডাক্তার জোয়ারদারের উপস্থিতিতে সেই পাঁচ হাজার পাউন্ড তুলে দিয়েছিলেন। বিচারপতি চৌধুরী তখন সুবিদ আলী নামের একজনের নামে এই পাঁচ হাজার পাউন্ডের একটি রশিদ পরে ডাক্তার জোয়ারদারকে দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। এই সুবিদ আলী সাহেবটি কে যিনি এত বড় পরিমাণের একটি অনুদান দিয়েছেন, জানতে চেয়েছিলাম বিচারপতি চৌধুরীর কাছে। পরে জানাবেন বলে স্যার সেদিন আমাদের প্রশ্নে উত্তর এড়িয়ে গিয়েছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২-এর ৫ জানুয়ারি তারিখের সন্ধ্যায় স্যারের দেশে ফিরে আসার আগের দিন আমাকে তার অফিসে ডেকে তার সামনে উপবিষ্ট সুবিদ আলীকে পরিচয় করিয়ে আমার অনেকদিন আগের একটি সুপ্ত কৌতূহল মিটিয়ে দিয়েছিলেন।
চার.
গত শুক্রবার ২৬ ফেব্রম্নয়ারি আমাদের খোকন ভাই, মানে এই সময়কার একজন পাঠকপ্রিয় কলাম লেখক এজেডএম আব্দুল আলী আমাকে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার একটি সিডি পাঠিয়েছেন। বন্যার এই মামা সরকারের অতিরিক্ত সচিবের পদ থেকে অবসর নিয়ে এখন উত্তরাতে থাকেন। বয়স সত্তর-পঁচাত্তর হবে। মুডে থাকলে এই বয়সেও তিনি হারমোনিয়াম নিয়ে বসে পড়েন এবং আমাদের প্রবীণদের চিনি ছাড়া রং চায়ের আড্ডায় রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করে আনন্দ দেন। বন্যার 'স্বপ্নচারিণী' শিরোনামে এই সিডিটির মোড়ক উন্মোচন করেন আমাদের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত। এই সিডিটির প্রায় সব গানই আমার প্রিয়। আমার স্ত্রী বিলকিসও মাঝে মধ্যে এই গানগুলো গেয়ে থাকে। এই সিডিটির দ্বিতীয় গানটি হচ্ছে 'একি সত্য সকলই সত্য, হে আমার চির ভক্ত।' রামেন্দু মজুমদার দশ বারো বছর আগে দৈনিক সংবাদে এই শিরোনামে একটি কলাম লিখতেন। কলামটি আমরা খুব প্রিয় ছিল। সিডিটি পাওয়ার পর এই গানটি আমি অনেকবার শুনেছি। গানটি আমি শুনি আর ভাবি, একাত্তরে আমরা সাধ্যমত যে যা করেছি তা কি সত্য? সকলই সত্য? সেদিন গাজীপুরের একটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে ২১ শ্রমিকের মর্মানত্মিক মৃতু্যর পর এই সন্দেহটি আমার মনে আরও প্রবল হয়েছে।
লেখক : সাবেক সচিব, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়; কলাম লেখক
লন্ডনে গিয়েই শুনি সুলতান শরীফ বাংলাদেশের অধিকারের প্রশ্নে একজন আপোসহীন 'একটিভিস্ট।' তার সঙ্গে প্রথম পরিচয় '৬৯-এর অক্টোবরে লন্ডনের অক্সফোর্ড স্ট্রিটের এক হোটেলে, বঙ্গবন্ধুর কামরায়। বঙ্গবন্ধু আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডন গেছেন, আগরতলা ষড়যন্ত্রের মামলায় তার পৰের ব্রিটিশ উকিল স্যার টমাস উইলিয়াম কিউসি, এমপি এবং এই ব্রিটিশ উকিলকে তখন ঢাকা পাঠাতে যেসব প্রবাসী বাঙালী টাকা পয়সা উঠিয়েছেন, আয়োজন এনত্মেজাম করেছেন তাদের ধন্যবাদ জানাতে।
বঙ্গবন্ধুর হোটেল কামরায় আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন মরহুম খুরশীদ হামিদ লন্ডনের পাকিসত্মান হাইকমিশনে সেকেন্ড সেক্রেটারি যার স্থলাভিষিক্ত হতে আমি গিয়েছি। খুরশীদ ভাই পিকিংয়ে পাকিসত্মান দূতাবাসে বদলি হওয়াতে তার পদটা লন্ডন হাইকমিশনে খালি হয়েছিল। খুরশীদ ভাই পিকিংয়ের উদ্দেশে লন্ডন ত্যাগ করার আগে রীতিমাফিক যে ফেয়ারওয়েল পার্টি দিচ্ছিলেন সেই পার্টিতে বঙ্গবন্ধুকে ব্যক্তিগতভাবে দাওয়াত দিতে খুরশীদ ভাই বঙ্গবন্ধুর হোটেলে গেলেন। বঙ্গবন্ধুকে হোটেলে পাওয়া গেল না। বঙ্গবন্ধুর লন্ডন প্রবাসী হাজার হাজার বাঙালী ভক্তের কোন একজনের বাড়িতে চায়ের দাওয়াতে গিয়েছেন। আমরা তখন বঙ্গবন্ধুর অপেৰা করছি। কিছুৰণের মধ্যেই হাতে কতগুলো শপিং ব্যাগ নিয়ে মুখে কাঁচা দাড়ির এক যুবক কামরায় ঢুকলেন। একজনকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম, এই যুবকই হচ্ছে সুলতান মাহমুদ শরীফ; পরে একাত্তরে যুক্তরাজ্যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের এক বিরাট সংগঠক মান্নান ভাই-শেখ আব্দুল মান্নানের কাছেও জানলাম। মান্নান ভাইকে আগে কখনও আমাদের এই প্রিয় বন্ধুটিকে সুরতান শরীফ নামে ডাকতে বা আলোচনায় উলেস্নখ করতে শুনিনি।
সুলতান শরীফের সঙ্গে তারপর ঘনিষ্ঠতা এমন হলো যে, আমার প্রথম মেয়ে অরম্নর জন্মের কয়েকদিন পর তাকে বাসায় আনলাম ঠিকই কিন্তু বাসায় মাত্র কয়েকঘণ্টা কাটিয়ে ছুটলাম সুলতান শরীফ-নোরাদের দৰিণ লন্ডনের বালহামের বাসায়। কারণ আমার স্ত্রী বা আমি অরম্নকে তার জন্মের প্রথম দিকে লালন পালন করতে পারব সেই বিশ্বাস আমাদের ছিল না। লন্ডন সোস্যাল ওয়েলফেয়ার ডিপার্টমেন্ট থেকে এক প্রৌঢ় মহিলা আমাদের বাসায় সেই কয়েকঘণ্টার অবস্থানকালে এসে অরম্নর মাকে প্রশিৰণ দিয়ে গেলেন কী করে বুকের দুধ এবং বোতলের দুধ খাওয়াতে হবে, শিশু অরম্ন কখন কেমন করে কাঁদলে কি বুঝতে হবে ইত্যাদি।
এমন প্রশিৰণ পাওয়ার পরও আমাদের মধ্যে আস্থার দারণ অভাব দেখা গেল। সুলতান শরীফ নোরাকে আগেই বলে রেখেছিলাম। তাদের বাসায় যাওয়ার পর বুঝলাম আমরা তাদের বাসায় এসে সঠিক কাজটি করেছি। কারণ তাদের বাসায় যাওয়ার প্রথম বা দ্বিতীয় মাঝরাতে অরম্ন এমন কান্নাকাটি শুরম্ন করে দিল যে, আমরা তার কান্নার কোন অর্থই করতে পারলাম না। লন্ডন সোস্যাল ওয়েলফেয়ারের সেই ভদ্রমহিলার প্রশিৰণ কোনই কাজে লাগছে না দেখে নোরাকে ঘুম থেকে উঠালাম। নোরা অরম্নকে কোলে নিয়ে কিছুৰণ নাড়াচাড়া করল তারপর কিছু একটা খাওয়াল এবং অরম্নও ঠা-া হলো। সুলতান শরীফ নোরাদের বাসায় এই অবস্থানকালেই নোরা এক সকালে নাসত্মার টেবিলে আমার চা খাওয়া দেখে সেই অবিস্মরণীয় মনত্মব্যটি করেছিল, ণড়ঁ ইধহমধষববং ঢ়ৎড়ফঁপব ঃবধ, নঁঃ ুড়ঁ ফড় হড়ঃ শহড় িযড় িঃড় ঃধশব রঃ. ঐরষভ পঁষভ ড়ভ সরষশ ধহফ যঁষভ পঁঢ় ড়ভ ংঁমধৎ, যিধঃ ড়ভ ঃবধ রং ষবভঃ ঃযবৎব? বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একজন একনিষ্ঠ কর্মী এবং বাংলাদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি ও জীবনধারায় গভীরভাবে বিশ্বাসী নোরা চমৎকার বাংলা বলেন ঘ রোয়া অনুষ্ঠানে বাংলা গানও পরিবেশন করেন। স্বাধীনতার পর কয়েক বছর নোরা আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনও পড়িয়েছেন।
আর আমার সেই মেয়ে অরম্ন এখন আট-দশ বছর ধরে লন্ডন প্রবাসী তার স্বামী টুটুল এবং ৭ বছরের সনত্মান অনত্মিককে নিয়ে। অরম্ন জন্মসূত্রে একজন ব্রিটিশ নাগরিক। ১৯৭১-এর ১ আগস্ট তারিখে আমি পাকিসত্মান হাইকমিশনের দ্বিতীয় সচিবের পদ ছেড়ে দিয়ে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের সরাসরি যোগ দিই, তার তিন সপ্তাহ পর অরম্নর জন্ম।
চাকরি ছেড়ে দেয়ার পর রাষ্ট্রবিহীন আমি তখন ফকির সমিতির সদস্যপদ লাভ করি, আর অরম্ন অর্জন করে ব্রিটিশ নাগরিকত্ব। জন্মের পর অরম্নর নাম রাখি জয়া, নামটি রেখেছিল ফকির সমিতির আর এক সদস্য, বাংলাদেশ স্টুডেন্টস একশন কমিটির কনভেনর এজেড মোহাম্মদ হোসেন মঞ্জু। কিন্তু '৭৩-এর এপ্রিলে লন্ডন থেকে বদলি হয়ে নতুন দিলস্নীতে আমাদের বাংলাদেশ হাইকমিশনে যাওয়ার পথে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে আসি প্রথমবারের মতো। মাত্র কয়েকদিন আগে আব্বা মারা গেছেন। '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকালে আমার কতগুলো শিশু-কিশোর ভাইবোনের বড় একটি পরিবার নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে এখানে ওখানে ছোটাছুটি করে কানত্ম হয়ে পড়েছিলেন আব্বা। তারপর লন্ডনে আমার চাকরি ছেড়ে দেয়ার খবরে তাদের জীবনের ঝুঁকিও বেড়ে গিয়েছিল।
বাংলাদেশে আমাদের আসার পর অরম্নর নানি অরম্নকে প্রথম দেখে এবং তার নাম বদলিয়ে জয়া থেকে অরোরা মহিউদ্দিন রাখে। তার তৃতীয় জেনারেশনের প্রথম সদস্য এই শিশুর নাম পরিবর্তনে আমাদের কোন আপত্তি ছিল না। নাসিরাবাদ ও কক্সবাজার গার্লস হাইস্কুলের হেড মিস্ট্রেস আমার শাশুড়ি তখন বলেছিলেন অরোরা মানে সূর্য।
দুই.
আমাদের ফকির সমিতির কোন সংবিধান ছিল না। ছিল না কোন সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক। আমরা ২৫-৩০ বছর বয়সী প্রায় ৩০ জন, একে অন্যের খুব ঘনিষ্ঠ, মুক্তিযুদ্ধের সেই নয় মাসের প্রায় প্রতিদিন আমাদের দেখা-সাৰাত ঘটে, লন্ডনের কোথাও না কোথাও কোন অনুষ্ঠানে, কোন সভা-সমিতি, সমাবেশ বা মিছিলে। আমাদের তখন কোন রাষ্ট্র নেই, বাংলাদেশ হবে আমরা নিশ্চিত, তবে সেজন্য কত রক্ত দিতে হবে, কতদিন অপেৰা করতে হবে সে সম্পর্কে তেমন কোন ধারণা ছিল না। আর পাকিসত্মানকে তো আমরা স্বীকারই করি না তখন। আমাদের কোন বেতন-ভাতা নেই। বিভিন্ন পাকিসত্মানী দূতাবাস থেকে যেসব বাঙালী কর্মকর্তা এবং স্টাফ চাকরি ছেড়ে লন্ডনে এসে জড়ো হয়েছেন, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী তাদের জন্য সাবসিস্টেন্স এলাউন্সের ব্যবস্থা করেছেন; তবে বাঙালী যারা উচ্চ শিৰার্থে লন্ডনে গিয়েছিলেন তাদের সকলেরই বৃত্তি বা দেশ থেকে টাকা আসা বন্ধ হয়ে গেছে, বন্ধ হয়ে গেছে অনেকের লেখাপড়াও। লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বড় একটা উপকারও হলো, সকলেই তখন ফুলটাইম মুক্তিযুদ্ধের কাজ করতে পারল।
'৭১-এর ২৮ ফেব্রম্নয়ারিতে লন্ডনের হাইড পার্কে যুক্তরাজ্যে প্রবাসী বাঙালীদের একটি সভা অনুষ্ঠিত হয় লন্ডন আওয়ামী লীগের উদ্যোগে। এই সভায় জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে একটি মেমোরেন্ডাম পাঠানোর সিদ্ধানত্ম হয়। এই মেমোরান্ডামে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের কাছে দ্রম্নত ৰমতা হসত্মানত্মরের দাবি করা হয়। যুক্তরাজ্য প্রবাসী বাঙালীদের মধ্যে তখন একটা সন্দেহ দানা বেঁধে ছিল যে, ইয়াহিয়া খান পশ্চিম পাকিসত্মানী সামনত্ম প্রভু, সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তি এবং সবের্াপরি জুলফিকার আলী ভুট্টোর চাপে বাঙালী নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রত্যাশা পূরণ করবেন না; তাদের হাতে ৰমতা হসত্মানত্মর করবেন না।
সুলতান শরীফের বর্ণনায় হাইড পার্কের সভা শেষে পাকিসত্মান হাইকমিশনে গিয়ে যুক্তরাজ্যে তখনকার পাকিসত্মানী হাইকমিশনার সলমান আলীকে তাদের সেই মেমোরান্ডামটি দিয়ে বালহামের বাড়িতে ফিরে যাওয়ার আগেই খবর পান যে, ইয়াহিয়া খান সেদিনই জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে দিয়েছেন। সুলতান শরীফ তখন বাসায় না গিয়ে হাইকমিশনে ফিরে আসেন, দ্রম্নত আরও কিছু লোক জড়ো করেন এবং তখন থেকেই পাকিসত্মান হাইকমিশনের সামনের ফুটপাথে ভিজিল দিতে থাকেন এবং তা ২৬ মার্চ পর্যনত্ম চলতে থাকে।
এর মধ্যে পাকিসত্মান হাইকমিশনের একটু দূরে অবস্থিত পাকিসত্মান স্টুডেন্টস হোস্টেলে গিয়ে বাঙালী ছাত্ররা জিন্নাহ সাহেবের ছবি দেয়াল থেকে নামিয়ে ভাংচুর করে, পা দিয়ে মাড়ায় এবং বাংলাদেশ স্টুডেন্টস একশন কমিটি গঠন করে, এজেড মোহাম্মদ হোসেন মঞ্জুকে কনভেনর নির্বাচিত করে। বাংলাদেশ স্টুডেন্টস একশন কমিটি তখন ইংল্যান্ডে পাকিসত্মান ক্রিকেট টিমের সফর ভ-ুল করার চেষ্টাও করেছে।
মঞ্জু লন্ডনে গিয়েছিলেন ব্যারিস্টারি পড়বেন বলে। তার আব্বা মরহুম এমএইচ খোন্দকার বাংলাদেশের প্রথম এটর্নি জেনারেল ছিলেন। তার ছোট ভাই এজে মোহাম্মদ আলীও বিএনপির চারদলীয় জোটের আমলে বাংলাদেশের এটর্নি জেনারেল ছিলেন। তবে রাজনীতির প্রশ্নে আমার ধারণা এই দুইভাই দুই মেরম্নতে।
আমার এ প্রসঙ্গে উলেস্নখ করতে গর্ব হচ্ছে যে, আমাদের হাইকোর্ট ডিভিশনের বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকও আমাদের ফকির সমিতির একজন গুরম্নত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন। আমাদের ফকির সমিতির সদস্য ছিলেন না, তবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন আপীলাত বিভাগের এক বিচারপতি এবিএম খায়রম্নল হকও। মানিক ও আফরাজ চৌধুরী ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের বাসার সামনের ফুটপাথে পুরো একদিন অবস্থান ধর্মঘট করে। পিটার সো'র এমপি তাদের সরবত পান করিয়ে এই অনশন ভাঙ্গান। মানিক ও নজরম্নল ইসলাম আলো তখন আমাদের ফকির সমিতির সদস্যদের স্পিরিট চাঙ্গা করতে প্রায়ই দ্বৈত গলায় এই মারফতি গানটি গাইত :
'দ্বীনের নবী মোসত্মফায়
রাসত্মা দিয়ে হাঁইটা যায়
হরিণ একটি বান্ধা ছিল
গাছেরও তলায়'
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের এক নিষ্ঠাবান এবং 'কমিটেড' কর্মী ম্যারিয়েটা প্রকোপের মৃতু্যর পর মানিক ম্যারিয়েটার মেমোরিয়াল সার্ভিসে ম্যারিয়েটার প্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীত 'আজ জ্যোস্না রাতে সবাই গেছে বনে' হারমোনিয়াম সহযোগে আর এক বাঙালী মহিলাসহ দ্বৈতকণ্ঠে পরিবেশন করেছিল। পুরো একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পৰে কাজ করে ম্যারিয়েটা স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ দেখতে আসে '৭২-এর প্রথম দিকে। বাংলাদেশ থেকে লন্ডনে ফিরে গিয়ে কিছুদিনের মধ্যে ম্যারিয়েটা দুঃখজনকভাবে তার জীবনের সমাপ্তি ঘটায়। যে নজরম্নল ইসলাম আলো দ্বৈত সঙ্গীত পরিবেশন করত মানিকের সঙ্গে, সেই নজরম্নলও দেশে এসছিল মাস দুয়েক আগে। একাত্তরে নজরম্নল লন্ডনে তার ভগি্নপতি মরহুম মোজাম্মেল হক সাহেবের মালিকানাধীন ঘোড়াশালের জনতা জুট মিলসের যুক্তরাজ্য প্রতিনিধি। লন্ডনের কেন্দ্রস্থল হোবর্নে নজরম্নলের অফিস। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরম্ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নজরম্নল তার এই অফিসটি দিয়ে দিল এজেডএম মোহাম্মদ হোসেনদের বাংলাদেশ স্টুডেন্টস একশন কমিটিকে। একাত্তরের একদিন নজরম্নল বা মঞ্জু কেউ একজন আমাকে বলেছিল, এক সকালে স্টুডেন্টস একশন কমিটির এই অফিসের দরজা খুলে তারা একটি খাম দেখতে পায়। খামের উপরে বা ভেতরে কোথাও কিছু লেখা নেই, তবে ছিল ১৫০ ব্রিটিশ পাউন্ড। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পৰের একজন সহানুভূতিশীল মানুষ তার-নাম পরিচয় গোপন রেখে এই পাউন্ডগুলো রেখে গেছেন, স্টুডেন্টস একশন কমিটির কাজে সাহায্য করতে এমন উদাহরণ আমরা তখন আরও দেখেছি।
তিন.
আমাদের ফকির সমিতির তিন সদস্য সুলতান শরীফ, নোরা এবং নজরম্নলের ঢাকা আগমন উপলৰে গত মাসে দু'টো গেট-টুগেদারের আয়োজন করা হয়েছিল। প্রথমটির আয়োজন করেছিলেন লুৎফুল মতিন; মতিন পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান ছিলেন, সরকারের একজন অতিরিক্ত সচিব হিসেবে অবসর নিয়ে তিনি এখন উত্তরায় আমার প্রতিবেশী। একাত্তরে লন্ডনের পাকিসত্মান হাইকমিশনে তিনি ডিরেক্টর অব অডিট এ্যান্ড একাউন্টস ছিলেন। চাকরি থেকে আমার পদত্যাগের কয়েকদিন পর তিনিও পদত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। মতিন সাহেবের এই বাসায় আয়োজিত এই লাঞ্চে রম্নচিও ছিল তার স্বামী-সনত্মানদের নিয়ে। রম্নচি হচ্ছে আমাদের রউফ ভাইয়ের বড় মেয়ে। রউফ ভাই মানে মরহুম একেএম আব্দুর রউফ, আমাদের পুরো সংবিধানটি যিনি হাত দিয়ে লিখেছিলেন। এই বছর তিনি একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন যথার্থভাবেই। রউফ ভাই '৭০ সালে গিয়েছিলেন কিছু একটা উচ্চশিৰার উদ্দেশে। একাত্তরে তিনি মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন এবং ফকির সমিতির সদস্য হওয়ার যোগ্যতা থাকার কারণে তিনিও শুরম্ন থেকেই সদস্য হয়ে যান। আমাদের দ্বিতীয় অনুষ্ঠানটি ছিল একটি ডিনার, আয়োজন করেছিলেন আব্দুল মজিদ চৌধুরী মঞ্জু তার গুলশানের বাসায়। এই মঞ্জু ম্যারিয়েটাদের বাংলাদেশ একশন কমিটিতে কাজ করত। এই ডিনারে সুলতান শরীফ ছিল, তবে ছিল না নোরা এবং মোহাম্মদ হোসন মঞ্জু। নোরা কয়েকদিন আগে লন্ডনে ফিরে গিয়েছিলেন; মঞ্জুকেও তখন কোন এক বিশেষ কারণে লন্ডন যেতে হয়েছিল। তবে নজরম্নল ইসলাম আলো ছিল, ছিলেন ডাক্তার আহমেদ হোসেন জোয়ারদারও। আর ছিল মরহুম ওয়ালী আশরাফের মেয়ে রিপা। রিপা এখন ব্রিটিশ কাউন্সিলে কাজ করে। লন্ডনের বালহামের ২ নম্বর টেম্পারলি রোড তখন ওয়ালী আশরাফদের বাসা এবং সাপ্তাহিক জনমত পত্রিকার অফিস। আর অফিস আমাদের ফকির সমিতির। রাত দিনের যে কোন সময়ে এই অফিসে যাতায়াত করা যেত। ওয়ালী আশরাফ দম্পতির চোখেমুখে তখন কোনদিন বিরক্তি চিহ্ন দেখিনি। বিরক্তি দেখালেও তা গ্রাহ্য করে কে? আমরা যে ফকির সমিতির সদস্য। ওয়ালী আশরাফরা জায়গা না দিলে আমরা যাবো কোথায়? ডাক্তার জোয়ারদারের হাতেই শিল্পপতি জহুরম্নল ইসলাম আমাদের সদ্য প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ মিশন পরিচালনার জন্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর কাছে পাঁচ হাজার পাউন্ড পাঠিয়েছিলেন, আর বিচারপতি চৌধুরী লুৎফুল মতিন এবং আমাকে তাঁর উত্তর লন্ডনের বাসায় এক সন্ধ্যায় ডেকে ডাক্তার জোয়ারদারের উপস্থিতিতে সেই পাঁচ হাজার পাউন্ড তুলে দিয়েছিলেন। বিচারপতি চৌধুরী তখন সুবিদ আলী নামের একজনের নামে এই পাঁচ হাজার পাউন্ডের একটি রশিদ পরে ডাক্তার জোয়ারদারকে দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। এই সুবিদ আলী সাহেবটি কে যিনি এত বড় পরিমাণের একটি অনুদান দিয়েছেন, জানতে চেয়েছিলাম বিচারপতি চৌধুরীর কাছে। পরে জানাবেন বলে স্যার সেদিন আমাদের প্রশ্নে উত্তর এড়িয়ে গিয়েছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২-এর ৫ জানুয়ারি তারিখের সন্ধ্যায় স্যারের দেশে ফিরে আসার আগের দিন আমাকে তার অফিসে ডেকে তার সামনে উপবিষ্ট সুবিদ আলীকে পরিচয় করিয়ে আমার অনেকদিন আগের একটি সুপ্ত কৌতূহল মিটিয়ে দিয়েছিলেন।
চার.
গত শুক্রবার ২৬ ফেব্রম্নয়ারি আমাদের খোকন ভাই, মানে এই সময়কার একজন পাঠকপ্রিয় কলাম লেখক এজেডএম আব্দুল আলী আমাকে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার একটি সিডি পাঠিয়েছেন। বন্যার এই মামা সরকারের অতিরিক্ত সচিবের পদ থেকে অবসর নিয়ে এখন উত্তরাতে থাকেন। বয়স সত্তর-পঁচাত্তর হবে। মুডে থাকলে এই বয়সেও তিনি হারমোনিয়াম নিয়ে বসে পড়েন এবং আমাদের প্রবীণদের চিনি ছাড়া রং চায়ের আড্ডায় রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করে আনন্দ দেন। বন্যার 'স্বপ্নচারিণী' শিরোনামে এই সিডিটির মোড়ক উন্মোচন করেন আমাদের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত। এই সিডিটির প্রায় সব গানই আমার প্রিয়। আমার স্ত্রী বিলকিসও মাঝে মধ্যে এই গানগুলো গেয়ে থাকে। এই সিডিটির দ্বিতীয় গানটি হচ্ছে 'একি সত্য সকলই সত্য, হে আমার চির ভক্ত।' রামেন্দু মজুমদার দশ বারো বছর আগে দৈনিক সংবাদে এই শিরোনামে একটি কলাম লিখতেন। কলামটি আমরা খুব প্রিয় ছিল। সিডিটি পাওয়ার পর এই গানটি আমি অনেকবার শুনেছি। গানটি আমি শুনি আর ভাবি, একাত্তরে আমরা সাধ্যমত যে যা করেছি তা কি সত্য? সকলই সত্য? সেদিন গাজীপুরের একটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে ২১ শ্রমিকের মর্মানত্মিক মৃতু্যর পর এই সন্দেহটি আমার মনে আরও প্রবল হয়েছে।
লেখক : সাবেক সচিব, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়; কলাম লেখক
No comments