দহনের রাত by মুস্তাফিজ শফি

হৃদয়পুরে একটুখানি আলো ফেলো পূর্ণিমার চাঁদ। আমরা পাঠ করি কুশিয়ারার জলে জাল ফেলে তুলো আনা সেইসব নীল নীল পদ্য। আর তার ভেতরকার গুঢ়তর অনুবাদ।
পূর্বজন্মে তুমি নদী ছিলে আর আমি তরঙ্গে ভাসা কচুরিপানা। হাজার বেদেনীর দাঁতে ঝিলিক দেওয়া হাসিতে রাতের নির্জনতা ভেঙ্গে এখনও তুমি দোলে দোলে ওঠো, আর আমি হাবুডুবু খেতে খেতে ভালোবাসার নামে পাঠ করি কোনো এক আশ্চর্য আখ্যান।

এখনও মধ্যরাতে চাঁদের যৌবন পূর্ণ হলে স্বর্ণের থালাবাটি হাতে তোমার বুক থেকে উঠে আসে আদিমমুদ্রায় নৃত্যরত সেইসব নারীরা। রাধার কুঞ্জে ওরা সব কৃষ্ণের সাথী হতে চায়।

অন্য আরেক জন্মে ধুধু হাওয়া হয়ে ভাটির বিলের বুক বরাবর ভেসে বেড়িয়েছো তুমি, আর আমি দীর্ঘ তালগাছ হয়ে শূন্যতাকে আগলে রেখে পান করেছি তোমার ঘ্রাণ।

অথচ দেখো এই জন্মে জুয়াড়ি হতে গিয়ে তোমাকে বানিয়ে ফেলেছি স্মৃতির কলসে বন্দি সোনালী চড়ুই।



প্রেম

সেই কী তবে প্রেম? যাকে তুমি একদিন পায়ে ঠেলেছিলে, ধূসর বালুচরে পথ হাঁটতে হাঁটতে চলে গিয়েছিলো দূরে বহুদূরে।

সেই ঘুমহারা রাত, সিগারেটে পোড়া হাত, তোমার চোখের সামনে মেলে ধরা ক্ষত। বুকের বাম পকেটে সাদা মেঘ আর ডান পকেটে রোদ্দুর নিয়ে যে এসেছিল ফিরতে চায়নি সেতো। তবুও ফেরালে তুমিÑ কতো বৃষ্টিতে ঝরেছে সে অশ্র কতো ঝড়ে উড়েছে সে বিষন্নতা।

বহুদিন পর ফেলে যাওয়া নিজস্ব ধুলো ভেতর তবে কেনো আজ আঁকতে এলে আল্পনা, তবে কেনো আজ এই নক্ষত্রের রাতে বিষণœ ঝাউবনে দোলা দিয়ে গাইতে এলে গান? মৃত্যু নয়, শাপগ্রস্ত দিন শেষে বেদনা বৃক্ষের পাতায় আজ তবে লাগবে বৃষ্টির ছোঁয়া। এই কী তবে প্রেম, এই কী তবে হৃদয়ের টান!
বহুমাত্রিক নির্জনতা

আত্মার গান আর বিষণœতার মৌন সঙ্গীত ছাড়া তবে কি আর কোনো প্রার্থনা আছে? বর্ণময় সন্ধ্যা শেষে ঝরাপাতার হাহাকার বুকে নিয়ে এই যে নেমে আসে রাত, তাকে আমি ব্যবচ্ছেদ করব কোন পরাবাস্তব ছুরি দিয়ে? সাগরতীরে দাঁড়িয়ে হুহু করে ছুটে আসা বাতাসের দিকে দু’হাত প্রসারিত করে তুমি বলতে মানুষমাত্রেই শূন্যতাভুখ, আর এখন সব শূন্যতা উগরে দেয় মর্গের উৎকট গন্ধ।

এই শূন্য শহরও কি তবে বরফে ঢেকে যাবে? সভাসদগণ শীতরাত্রির প্রার্থনায় নত হবেন পানশালার টেবিলে? অতঃপর মৃত শরীর নিয়ে বরফের ওপর গড়াতে গড়াতে ফিরবেন বাড়ি?

রাতের স্তব্ধতা আর নৈঃশব্দ্যে মাতাল সেন্ট্রালের সেবিকারা। রোগীরা সব ঘোরের ভেতর ছুটে যায় নক্ষত্র ছড়ানো হাকালুকির প্রান্তরে। ওরাও হাহাকার করে ওঠে। এই যে অদৃশ্য যূথবদ্ধতা, এই যে নীরবে ঝরে পড়া অশ্রুবিন্দু, সেগুলোর যোগফল কি আসলেই মেলে না? এভাবেই কি দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে নির্জনতা বহুমাত্রিকতা পায়?

আমি জানি না, জানি না।



বাতাসও তখন কাঁদে
চুম্বনতো ক্ষণিকের মীমাংসা, আমি চেয়েছিলাম তোমার সঙ্গে একটি সম্পূর্ণ অধ্যায়। বর্ষার রাতে বাতাস আর বৃষ্টির দাপাদাপির মতো প্রগাঢ় মুগ্ধতা। মনে পড়ে সাতটি তারার ছন্দিত আকাশ পাবো বলে আমি তোমাকে সাত হাজার বার চুমু খেয়েছি। কিন্তু তারপরও তুমি রইলে কবিতার মতো অস্তব্ধ।
তোমার সেই চিঠি পেয়ে আমিও কেঁদেছি অনেক। আর একাকি নির্জন রাতে হাওরের বুক বরাবর হাঁটতে হাঁটতে শুনেছি প্রকৃতির হাহাকার।
গ্রীষ্মের প্রবল দাহে রাত্রী যখন ঘেমে ওঠে, বেদনার বালিগুলোকে পৃথিবীর বুক থেকে উড়িয়ে নিতে নিতে বাতাসও তখন কাঁদে।



এক টুকরো আয়না
আবারও কি নামবে এমন নক্ষত্রের রাত। আর আমি থরো থরো পায়ে মাড়াতে থাকবো স্মৃতির নীলগীরি পথ। জ্যোৎস্নার মতো নামবে ঋতুস্রাব এবং আজ আবার হবে, হবে রাঙা ভোর।

আবার জমলে দহনের উৎসব, তার কাছে আমি চাইবো মায়াবি মুখের ছবি আঁকা একটুকরো আয়না।

No comments

Powered by Blogger.