হলমার্কের ৫ হাজার কোটি টাকার সম্পদের সন্ধান- চার্জশীট দেয়ার পর বাজেয়াফত করার আবেদন জানাবে দুদক by মহিউদ্দিন আহমেদ
হলমার্ক গ্রুপের বিভিন্ন ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে সোনালী ব্যাংক থেকে আত্মাসাত করা অর্থের দ্বিগুণ ৫ হাজার কোটি টাকার সম্পদের সন্ধান পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
সম্পদের মধ্যে আছে ২,৯৮২ কোটি ৫০ লাখ টাকার ১৪৯ একর ১২ শতাংশ জমি। ২,২৬০ কোটি টাকার রয়েছে শিল্প-কারখানা, বাড়ি, গাড়ি, ফ্ল্যাট, প্লট, গরুসহ অন্যান্য সম্পদ। চলতি মাসে ১১ মামলার চার্জশীট আদালতে পেশ করার পর সব সম্পদ বাজেয়াফত করতে আদালতে আবেদন করবেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তরা। তদন্ত অনুযায়ী পুরনো আসামিদের সঙ্গে ১০ জনের মতো নতুন আসামি যোগ হতে পারে। এর মধ্যে জড়িয়ে যেতে পারেন সাবেক এক পরিচালক। খবর দুদক সূত্রের। সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখা থেকে হলমার্কের আত্মসাত করা মোট ২,৬৮৬ কোটি ১৪ লাখ টাকার মধ্যে ফান্ডেড অংশের ১ হাজার ৫৬৮ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২৭ জনের বিরুদ্ধে অক্টোবরে ৪ তারিখে ১১টি মামলা দায়ের করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। রাজধানীর রমনা মডেল থানায় দায়ের করা মামলায় হলমার্ক গ্রুপের ৭ এবং সোনালী ব্যাংকের ২০ কর্মকর্তাকে আসামি করা হয়েছে। সব মামলা তদন্তাধীন রয়েছে। এর মধ্যে হলমার্ক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর মাহমুদ ও মহাব্যবস্থাপক তুষার আহমেদ, চেয়ারম্যান জেসমীন ইসলাম এবং সোনালী বাংকের সাময়িক বরখাস্ত চার কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুদক। তাদের অনেকে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দিয়েছেন আদালতে। দুদকের তদন্ত এবং ১৬৪ ধারার জবানবন্দী অনুযায়ী হলমার্ক গ্রুপের বিপুল পরিমাণ সম্পদের অনুসন্ধান পেয়েছেন দুদকের তদন্ত কর্মকর্তারা। সম্পদের মধ্যে রয়েছে সাভারের হেমায়েতপুর ও গাজীপুরে তানভীরের মোট ১৪৯ একর ১২ শতাংশ জমি। গড়ে প্রতি শতাংশের মূল্য ২০ লাখ টাকা হিসেবে ১৪৯ একর ১২ শতাংশ জমির মূল্য হয় ২,৯৮২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। সাভারের হেমায়েতপুরে প্রায় এক শ’ একর জমির ওপর স্থাপিত ৭ তলা বিশিষ্ট ৪টি বিল্ডিং ও ৮০টি পাকা শেডের মূল্য ১ হাজার কোটি টাকা ধরা হয়েছে। রাজধানীর আগারগাঁও ও তালতলা এলাকায় ২ একর ৬৫ শতাংশ জমিতে ১টি ৪তলা, ২টি ৬ তলা ভবন, ৩টি ফ্ল্যাট ও ১৫টি প্লট রয়েছে। এর বর্তমান মূল্য আছে ৮শ’ কোটি টাকার মতো। এছাড়া গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির ভেতরে নিট পোশাক তৈরির এক শ’ লাইন ও ওভেন পোশাক তৈরির আরও এক শ’ লাইনের মেশিন, ৪৫ টন ডায়িং, দুই শ’ নিটিং মেশিন, স্পিনিংসহ ৪শ’ কোটি টাকার অন্যান্য যন্ত্রপাতি। একইসঙ্গে গ্রুপের ৮৪টি গাড়ির মূল্য ধরা হয়েছে ৫০ কোটি টাকা।গরু রয়েছে কয়েক হাজার। এর মধ্যে ১ হাজার গাভী থেকে প্রতিদিন পাওয়া যায় ৮শ’ লিটার দুধ যা বনফুল সুইটসের কাছে বিক্রি করা হয়। সব মিলিয়ে বিতর্কিত এ গ্রুপের ৫ হাজার ২৪২ কোটির বেশি টাকা মূল্যের সম্পদ রয়েছে। এসব সম্পদের মধ্যে সোনালী ব্যাংক থেকে আত্মসাত করা ২,৬৮৬ কোটি ১৪ লাখ টাকার জামানত হিসেবে ইতিমধ্যে ১৩০ একর জমির দলিল হস্তান্তর করা হয়েছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষের কাছে। এর মধ্যে ৬০ একর জমির দলিল জামানত হিসেবে অফিসিয়ালি গ্রহণ করা হয়েছে অনেক আগে। ৭০ একর ৬ শতাংশ জমির দলিল জামানত গ্রহণের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। আদালতের আদেশ অনুযায়ী ৭০ একর ৬ শতাংশ জমির দলিল পাওয়া গেছে যা ব্যাংকের আইনজীবী দ্বারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। আবার আদালতের আদেশ অনুযায়ী তা জামানত হিসেবে গ্রহন করা হবে। জামানত হিসেবে হস্তান্তর করা সাভারের হেমায়েতপুরের ওই জমির প্রতি শতাংশের গড় মূল্য ২০ লাখ টাকা হিসেবে ১৩০ একর ৬ শতাংশ জমির মূল্য ২,৬০০ কোটি ১২ লাখ টাকা ধরা হয়েছে।
মামলাগুলোর তদন্ত কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। মামলার চার্জশীটে আরও ১০ জনের মতো আসামি নতুন যুক্ত হতে পারেন। এর মধ্যে থাকার সম্ভাবনা আছে সোনালী ব্যাংকের সাবেক পরিচালক সাইমুম সারোয়ার কমল। হলমার্ক গ্রুুপের মহাব্যবস্থাপক তুষার ১৬৪ ধারার জাবানবন্দীতে এ পরিচালককের সঙ্গে তিন কোটি টাকার রফার কথা স্বীকার করেন। এক কোটি ২০ লাখ টাকা কমলকে দেয়া হয়েছে বলে জবানবন্দী ১১ নম্বর প্যারার শেষ তিন লাইনে উল্লেখ করেন তিনি। (‘ব্যাংকের পরিচালনা পর্যদ ম্যানেজ করতে তিন কোটি টাকা লাগবে এবং এটা বোর্ড সদস্য সাইমুম সরোয়ার কমলকে দিতে হবে।
আমি এক পর্যায়ে রাগারাগী করলাম। তাঁরা আমাকে শান্ত করার চেষ্টা চালায়। তসলিম বলে, ‘সে নাকি ইতোমধ্যে কমলকে এক কোটি ২০ লাখ টাকা দিয়ে দিয়েছে।’ )
এছাড়া জালিয়াতি করে সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখা থেকে টাকা তুলে নিতে সহায়তা করেছেন এ্রকম আরও নয়জনের সন্ধান মিলেছে। তাদের আসামি করার আইনী দিক খতিয়ে দেখছেন তদন্ত কর্মকর্তারা।
এদিকে ননফান্ডেড অংশের প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ অনুসন্ধান করা হচ্ছে। এ ঘটনায়ও আলাদাভাবে মামলা দায়ের করবে দুদক। ইতোমধ্যে জনতা ব্যাংক ও দুটি বেসরকারী ব্যাংক থেকে ননফান্ডেড টাকার অনুসন্ধান কাজ শেষ করা হয়েছে বলে অনুসন্ধান সূত্রে জানা গেছে।
সিনিয়র উপপরিচালক মীর মোঃ জয়নুল আবেদীন শিবলীর নেতৃত্বে আট সদস্যের বিশেষ টিম হলমার্ক কেলেঙ্কারির অভিযোগ অনুসন্ধান ও তদন্ত করছেণ। টিমের অন্য সদস্যরা হলেন, উপপরিচালক আখতার হামিদ ভূইয়া, সহকারি পরিচালক এনামুল হক, মশিউর রহমান, নাজমুস সাদাত, সেলিনা আখতার মনি, উপ- সহকারি পরিচারক মুজিবুর রহমান ও জয়নাল আবেদীন।
হলমার্কের এমডি তানভীর মাহমুদ, চেয়ারম্যান জেসমীন, জিএম তুষার আহমেদ ও সোনালী ব্যাংকের সাময়ীক বরখাস্ত একেএম আজিজুর রহমান, জিএম মীর মহিদুর রহমান, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও অর্থায়ন বিভাগের ডিজিএম শেখ আলতাফ হোসেন এবং সফিক উদ্দিন আহমেদ কারাগারে রয়েছেন। পলাতক রয়েছেন ২০ জন।
No comments