ইউনূসের বিষয়ে নমনীয় হচ্ছে সরকার
নোবেল বিজয়ী গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক
ব্যবস্থাপনা পরিচালক অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিষয়ে নমনীয় হচ্ছে সরকার।
তাকে নিয়ে সরকারের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের
কথাবার্তা ও কর্মকাণ্ডও বদলে গেছে অনেকটাই।
এখন আর তাকে
নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে চান না তারা। বরং তাকে সম্মানের আসনে ফিরিয়ে দিতে
চান। গত সপ্তাহে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (এনবিআর) তার ব্যবস্থাপনা পরিচালক
পদে কর্মরত থাকা অবস্থায় ওয়েজ আর্নারের সুবিধা গ্রহণ সংক্রান্ত বিষয়টি
ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে নিষ্পত্তির প্রস্তাব করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে একটি
সারসংক্ষেপ পাঠিয়েছে। এ কারণে সরকারের নমনীয় হওয়ার বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে
উঠেছে। এনবিআরের ওই প্রস্তাবে গত সপ্তাহের প্রথম দিকে অনুমোদন দিয়েছেন
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত। এ ছাড়াও তিনি বিষয়টি মন্ত্রিপরিষদে পেশ
করার জন্য অনুমোদন দিয়েছেন। অর্থ বিভাগের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে,
এনবিআরের সারসংক্ষেপটি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়েছে। ২১শে জানুয়ারি
মন্ত্রিসভার বৈঠকে আলোচনার জন্য বিষয়টি উঠবে। এর আগে গত বছরের ২রা আগস্ট
মন্ত্রিসভায় গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। ওই বৈঠকে
নেয়া সিদ্ধান্তে বলা হয়েছিল, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ তথা জাতীয় রাজস্ব
বোর্ড, সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মন্ত্রণালয়/বিভাগ ও সংস্থার সহায়তা নিয়ে ড.
মুহাম্মদ ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে কর্মরত থাকা
অবস্থায় ওয়েজ আর্নারের সুবিধা নিয়ে বিদেশ থেকে কি পরিমাণ অর্থ দেশে এনেছেন,
এ উপলক্ষে কি পরিমাণ আয়কর অব্যাহতি সুবিধা নিয়েছেন এবং তাকে কর অব্যাহতি
দেয়া বৈধ হয়েছে কিনা তা নির্ধারণপূর্বক বিস্তারিত প্রতিবেদন যত দ্রুত সম্ভব
মন্ত্রিসভা বৈঠকে উপস্থাপন করবে। এর ভিত্তিতে এনবিআর মন্ত্রিসভার জন্য
সারসংক্ষেপ তৈরি করে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মন্ত্রিসভার বৈঠকের
সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্তৃক ব্যাংক ও আর্থিক
প্রতিষ্ঠান বিভাগের সহযোগিতায় গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কিত বিভিন্ন অধ্যাদেশ ও
এর সংশোধনীগুলো, গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কিত বিভিন্ন সরকারি আদেশ, আয়কর
অধ্যাদেশ ১৯৮৪, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ব্যক্তিগত আয়কর নথিগুলো, ব্যাংকের অডিট
রিপোর্ট ও গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের কার্য বিবরণী
পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে মন্ত্রিসভার জন্য বর্তমান প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ড. মুহাম্মদ ইউনূস ২০০৪ সালের জুলাই থেকে ২০১১
সালের জুন পর্যন্ত (৭ অর্থবছর) সময়কালে ১৩৩টি বৈদেশিক প্রতিষ্ঠান থেকে
সম্মানী, ১০টি প্রতিষ্ঠান থেকে পুরস্কার ও ১৩টি প্রতিষ্ঠান থেকে রয়্যালিটি
বাবদ মোট ৫০ কোটি ৬১ লাখ ৮৫ হাজার ৫৮৮ টাকা করমুক্ত আয় হিসেবে আয়কর নথিতে
প্রদর্শন করে মোট ১২ কোটি ৬৫ লাখ ৪৬ হাজার ৩৯৭ টাকা আয়কর অব্যাহতির সুবিধা
নিয়েছেন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ২০০৪ সালের ১৩ই জুলাই ২১৬- আইন/
আয়কর/২০০৪/নম্বর এস, আর, ও মূলে সরকার আবাসিক/ অনাবাসিক মর্যাদা নির্বিশেষে
এদেশের কোন নাগরিকের বাংলাদেশের বাইরে উদভূত আয়কে ইনকাম ট্যাক্স
অর্ডিন্যান্স, ১৯৮৪-এর আওতায় প্রদেয় আয়কর থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। এতে
উল্লেখ করা হয়েছে, গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের সভার কার্য বিবরণী ও
অন্যান্য তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায় গত সাত বছরে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বৈদেশিক
প্রতিষ্ঠান থেকে সম্মানী, পুরস্কার ও রয়্যালিটি বাবদ অর্থ গ্রহণের জন্য যে
বিদেশ ভ্রমণ করেছেন এজন্য তিনি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যথাযথ কর্তৃপক্ষের
(পরিচালনা পর্ষদ) পূর্বানুমতি নেননি। এতে বলা হয়েছে, গ্রামীণ ব্যাংক
অধ্যাদেশ এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ২০১১ সালের ৫ই মে দেয়া
রায় অনুযায়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস একজন পাবলিক সার্ভেন্ট হিসেবে তার বেতন
ভাতার অতিরিক্ত কোন সম্মানী, পুরস্কার ও রয়্যালিটি গ্রহণের আগে সরকারের
অনুমতি প্রয়োজন হলেও তা গ্রহণ করেননি। প্রতিবেদনে ড. ইউনূস সম্পর্কে বলা
হয়, প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ড. মুহাম্মদ ইউনূস গ্রামীণ
ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের
সুদীর্ঘ কর্মকালে গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকাণ্ডের প্রসার ঘটে। আন্তর্জাতিক
পরিমণ্ডলে ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় এবং গ্রামীণ ব্যাংক
সুনাম অর্জন করে। ফলে গ্রামীণ ব্যাংক এবং ড. মুহাম্মদ ইউনূস যৌথভাবে নোবেল
পুরস্কার লাভ করে। এসব পরিপ্রেক্ষিতে গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনায় ড. মুহাম্মদ
ইউনূসের বিভিন্ন কার্যক্রম সম্পর্কে সরকারের বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ থেকে কেউ
কখনও হস্তক্ষেপ করেনি এবং প্রশ্নও তোলেনি। এছাড়া, গ্রামীণ ব্যাংকের বিভিন্ন
কর্মকাণ্ড পরিচালনায় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিভিন্ন উদ্যোগকে সরকারের
বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ থেকে ইতিবাচকভাবে দেখা হয়েছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস ২০০৪
সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত তার আয়কর বিবরণীতে বৈদেশিক প্রতিষ্ঠান থেকে
অর্জিত আয়ের বিষয়টি প্রদর্শন করে আয়কর অব্যাহতির সুযোগ নিয়েছেন। তার বিদেশ
থেকে সম্মানী, পুরস্কার ও রয়্যালিটি পাওয়া আয়ের বিপরীতে কর অব্যাহতি সুযোগ
গ্রহণের বিষয়টি কোন পর্যায় থেকে নিবিড়ভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষাপূর্বক খতিয়ে
দেখা হয়নি। বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের
দায়িত্বপালনকালে তিনি পাবলিক সার্ভেন্ট হিসেবে গণ্য ছিলেন বিধায় বিভিন্ন
সময়ে তার বিদেশ ভ্রমণ, বিদেশ থেকে সম্মানী, পুরস্কার ও রয়্যালিটি বাবদ অর্থ
গ্রহণের ক্ষেত্রে সরকারের পূর্বানুমতি গ্রহণ না করার বিষয়টি প্রশ্নের
সম্মুখীন। বিষয়টি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে নিষ্পত্তির লক্ষ্যে সরকার
সিদ্ধান্ত নিতে পারে। শেষে বলা হয়েছে, সার সংক্ষেপটি অর্থমন্ত্রী দেখেছেন
এবং মন্ত্রিপরিষদে পেশ করার সদয় অনুমোদন দিয়েছেন। ওদিকে প্রতিবেদনে গ্রামীণ
ব্যাংকের উত্থান সম্পর্কে বলা হয়েছে, গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সহজ শর্তে
ঋণ দেয়ার জন্য অধ্যাপক ইউনূস চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি কার্যক্রমের
আওতায় ১৯৭৬ সালে একটি প্রকল্প গ্রহণ করেন। এতে সাফল্য পাওয়া গেলে তিনি এই
কার্যক্রমটি আরও বিস্তৃত করার পরিকল্পনা নেন। এ অনুযায়ী ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ
ব্যাংকের সহায়তায় টাঙ্গাইল জেলায় গ্রামীণ প্রকল্প শুরু হয়। ওই প্রকল্পের
মাধ্যমে এদেশে জামানতবিহীন ঋণ দেয়া ও তা আদায় নিশ্চিত করার ধারণার উদ্ভব
হয়। এতে গ্রামাঞ্চলে নারীর ক্ষমতায়ন ও গ্রামীণ অর্থনীতিতে কর্মচাঞ্চল্য
সৃষ্টি হয়। অধ্যাপক ইউনূসের প্রস্তাব মতো বাংলাদেশ সরকার এ প্রকল্পকে একটি
ব্যাংকে রূপান্তর করে ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রমের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচনের
উদ্যোগ নেয়। ফলে ঋণ এবং সঞ্চয়ভিত্তিক সমাজ কাঠামোকে যুগোপযোগী ও টেকসই রূপ
দেয়ার জন্য ১৯৮৩ সালে এক অধ্যাদেশ বলে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়।
গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম সারা বিশ্বে পরিচিতি লাভ করায়
গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও গ্রামীণ ব্যাংক ২০০৬ সালে নোবেল
পুরস্কার অর্জন করে। এতে বলা হয়, গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ ১৯৮৩ এর ধারা
৪-এর ৩ উপ-ধারার মাধ্যমে গ্রামীণ ব্যাংককে ব্যাংক কোম্পানি আইন ও অন্যান্য
সকল আইনের বিধি-বিধানের আওতামুক্ত রাখা হয়। এমনকি একই অধ্যাদেশের ৩৩ ধারার
আওতায় গ্রামীণ ব্যাংককে আয়কর অব্যাহতি দেয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে এবং সময়ে
সময়ে বিভিন্ন দাপ্তরিক আদেশবলেও গ্রামীণ ব্যাংক এবং এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক
বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন। ব্যাংকিং-এর শুরু থেকে অধ্যাপক মুহাম্মদ
ইউনূস ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এ হিসেবে তাকে ব্যাপকভাবে
স্বশাসনের ক্ষমতা দেয়া হয়। তিনি নিজের মতো করে গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রম
প্রসারিত করেন এবং বিভিন্ন ট্র্যাডিশনের সৃষ্টি করেন। ক্ষুদ্রঋণ তার
প্রচেষ্টার ফলে টেকসই বলে প্রতীয়মান হয় এবং তিনি সারা বিশ্বে খ্যাতি লাভ
করেন। সরকারের ও পরিচালনা বোর্ডের তরফ থেকে অধ্যাপক ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাংক
কার্যক্রম কখনও তেমনভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি বা তা খতিয়ে দেখা হয়নি।
মোটামুটিভাবে গ্রামীণ ব্যাংকের সব ধরনের সিদ্ধান্ত ড. ইউনূসই নেন। এ
ব্যাপারে সরকার বা পরিচালনা পর্ষদ বেশি সময়ই অন্ধকারে থেকে যায়। নব্বই-এর
দশকে নরওয়ে গ্রামীণ ব্যাংকের কিছু বিষয় খতিয়ে দেখতে চায়। সরকার তখন নরওয়ের
বিষয়টি গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করে সমাধান করতে বলে। মন্ত্রিসভার
সারসংক্ষেপে বলা হয়, ১৯৯৯ সালে ব্যাংকের চাকরি বিধিমালা অনুসরণ না করে
পরিচালনা পর্ষদ অধ্যাপক ইউনূসকে ৬০ বছরের পরে অনির্দিষ্টকালের জন্য
ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে নিয়োগ করে। এ নিযুক্তিতে আইনের তোয়াক্কা করা হয়নি
এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনও নেয়া হয়নি। এই অনিয়মিত নিযুক্তির বিরুদ্ধে
বাংলাদেশ ব্যাংক ১৯৯৯ সালেই তাদের পরিদর্শনকালে মন্তব্য রাখে। কিন্তু
যেহেতু সরকার বা পরিচালনা পর্ষদ অধ্যাপক ইউনূসকে কখনও কোন বিষয়ে প্রশ্ন করা
থেকে বিরত রাখে তাই এক দশকের বেশি সময় এ ব্যাপারে কেউ উচ্চবাচ্য করেননি।
২০১০ সালে নরওয়ে টেলিভিশনে প্রচারিত একটি প্রোগ্রামের মাধ্যমে এই বিষয়টি
সামনে আসে এবং তখন এই বিষয়ে তদন্তের নানা দাবি ওঠে। এরই প্রতিফলন হিসেবে
২০১১ সালে অধ্যাপক ইউনূসকে এই বিষয়টি সুরাহা করার জন্য পদত্যাগ করতে বলা
হয়। অধ্যাপক ইউনূস তখন আদালতের আশ্রয় নেন এবং আদালতের রায় অনুযায়ী ২০১১
সালের এপ্রিলে পদত্যাগ করেন। কিন্তু তারপরেই তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের
কার্যক্রম ব্যাহত হয় এমন নানা কাজে লিপ্ত হন।
No comments