প্রধান শিক্ষককে হাতুড়িপেটা-জঘন্য হামলাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই

কবি শামসুর রাহমান লিখেছিলেন, 'উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ।' কথাটি যে এক বিন্দু মিথ্যা নয়, তারই প্রমাণ পাওয়া যায় সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে। এটা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে রসাতলে যাওয়ার সব আয়োজনই সম্পন্ন করেছে আমাদের প্রিয় স্বদেশের চরম অবক্ষয়কবলিত সমাজ।


টাঙ্গাইলের বিন্দুবাসিনী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে তাঁর অফিসকক্ষে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে গুরুতর আহত করেছে সন্ত্রাসীরা। তাঁর অপরাধ, সন্ত্রাসীদের কথামতো তিন ছাত্রীকে ভর্তি করাতে তিনি অপারগতা প্রকাশ করেছিলেন। সারা দেশেই শিক্ষাঙ্গনের নিরাপত্তা ও শিক্ষার পরিবেশের দ্রুত অবনতি ঘটে চলেছে। কিছুদিন আগে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী এমসি কলেজের ছাত্রাবাস পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সন্ত্রাস, হত্যা, ধর্ষণ- এসব তো এখন শিক্ষাঙ্গনের নিয়মিত ঘটনা। ছাত্রীকে রক্ষা করতে গিয়ে শিক্ষককে প্রাণও দিতে হয়েছে। শিক্ষিকারাও রেহাই পান না সম্ভ্রমহানির মতো ঘটনা থেকে। এ অবস্থায় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা জাতিকে কী উপহার দেবে? বলা হয়, শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। সেই শিক্ষার এহেন অবস্থায় জাতিগতভাবে আমরা কি ক্রমেই মেরুদণ্ডহীন হয়ে পড়ছি না? এখন তো মান-সম্মান নিয়ে শিক্ষকতা করাই একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাতি হিসেবে এর মূল্য কি আমাদের দিতে হবে না?
টাঙ্গাইল শহরের বিন্দুবাসিনী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় অতি পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সারা দেশেই প্রতিষ্ঠানটির যথেষ্ট সুনাম ও সুখ্যাতি রয়েছে। এমন একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক যদি তাঁর অফিসকক্ষেও নিরাপদ হতে না পারেন, তাহলে কোথায় তাঁরা নিরাপত্তা পাবেন? আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো আছে। এই কি ভালো থাকার নমুনা? জানা যায়, পাঁচ-ছয়জন সন্ত্রাসী সন্ধ্যা ৬টার দিকে প্রধান শিক্ষক আফসার আলীর অফিসকক্ষে ঢুকে তাঁর ওপর হামলা চালায়। হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে তাঁর মুখের চোয়াল ও পায়ের গোড়ালিতে মারাত্মক জখম করা হয়। টাঙ্গাইলে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে গুরুতর অবস্থায় তাঁকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, রাত ৮টা পর্যন্ত থানায় মামলা হয়নি। কে জানে, প্রধান শিক্ষক আফসার আলীর অবস্থা দেখে তাঁর পরিবার ভয়ে তটস্থ হয়ে আছে কি না? কারণ সন্ত্রাসীরাই তো এখন এই সমাজে সবচেয়ে প্রভাবশালী! মামলা করে পরিবারের ওপর আরো বিপদ ডেকে আনার মতো ঝুঁকি তারা নিতে চাইবেই বা কেন? মামলা করলেই যে প্রতিকার পাবে তারই বা নিশ্চয়তা কোথায়? সে রকম কয়টা প্রমাণ আমাদের সামনে আছে? বরং উল্টোটাই আমরা প্রতিনিয়ত দেখে আসছি। ছাত্ররাজনীতির নামে চলে নীতিনৈতিকতাহীন কর্মকাণ্ড। কাটা রাইফেল, পিস্তল, তরবারি, চাপাতি, রামদা, লাঠিসোঁটা নিয়ে আমরা শিক্ষাঙ্গনে উচ্ছৃঙ্খল তরুণদের মিছিল করতে দেখি। খুন করে লাশ ফেলে যেতে দেখি। রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠনের নামে স্বার্থ হাসিলের প্রতিযোগিতায় নামতে দেখি চিহ্নিত অপরাধীদের। এদের অন্যায়ের প্রতিকার চাওয়ার মতো সাহস বা বুকের পাটা এই সমাজে কয়জনের আছে? কয়টা পরিবারের আছে? বিশেষ করে রাষ্ট্র যেখানে নাগরিকের নিরাপত্তা বিধানে এমন নিস্পৃহ।
টাঙ্গাইলের বিন্দুবাসিনী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আফসার আলীর ওপর সন্ত্রাসীদের হামলার ঘটনায় আমরা গভীরভাবে মর্মাহত। এটি শুধু একজন ব্যক্তির ওপর হামলা নয়, সমাজের নৈতিকতা ও মানমর্যাদাবোধের ওপর হামলা। জাতি গঠনের শুভ উদ্যোগের বিরুদ্ধে এক বর্বরোচিত আক্রমণ। তাই রাষ্ট্রের কাছে এর উপযুক্ত প্রতিকার আমাদের কাম্য। আমরা আশা করি, অবিলম্বে দোষীদের গ্রেপ্তার করে আইনের হাতে সোপর্দ করা হবে। একই সঙ্গে আমরা আশা করব, রাষ্ট্রীয়ভাবে গুরুতর আহত প্রধান শিক্ষকের উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা করা হবে।

No comments

Powered by Blogger.