অধিকার-রাষ্ট্র, সংবিধান ও আদিবাসী by এম এ হাসান

সংবিধানের আলোকে পাহাড়ি জনগণকে যেমন প্রান্তিকীকরণ বন্ধ করতে হবে, তেমনি তাদের জীবন সহজ করার জন্য গ্রহণযোগ্য পদ্ধতিতে তাদের মধ্যে চাষবাসের জমি বণ্টন করতে হবে। একই সঙ্গে পাহাড় ও বনাঞ্চল ধ্বংস রোধে জমির হস্তান্তর এবং অনুমতি ব্যতিরেকে বৃক্ষ কর্তন নিষিদ্ধ করতে হবে


বাংলার আদিবাসী মূলত কারা তা নিয়ে ব্যাপক তর্ক-বিতর্ক থাকলেও এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, এ দেশের নিম্নবিত্ত তথা অবজ্ঞেয় বৃত্তিভিত্তিক সম্প্রদায়গুলো এ দেশের প্রকৃত আদিবাসী। এদের মধ্যে যারা কিরাত, নিষাদ, কৈবর্ত, হাড়ি, ডোম, কোল, ভীল, মুণ্ডা, ভূমিজ, ওঁরাও, শবর, হো মালপাহাড়ি, সাঁওতাল, কোচ, পলিয়া, রাজবংশী, চণ্ড, চাড়াল, বাগদী_ তারাই একেবারে বিশুদ্ধ আদিবাসী। বৃত্তিভিত্তিক আদিবাসীদের মধ্যে মুচি, মেথর, বুনা, নলুয়া, বাঁশফোঁড়, মালো, কেওড়া, যুগী, বারুই, মল্ল, রজক, মোদক, তেলী, কামার, কুমার, নাপিত, নিকারী, জেলে, জোলা, পুরাণের ছত্রিশ জাতেরই অংশ। নিষাদ, কিরাত, কৈবর্তের সঙ্গে মঙ্গোল ও নিগ্রো জনগোষ্ঠীর সংকরই বাংলার জনগোষ্ঠীর মূলস্রোত। অস্ট্রলয়েড ও আদি অস্ট্রলয়েডদের সঙ্গে নিগ্রয়েড ও মঙ্গোলয়েডদের সংকরই প্রাচীন বাংলার নৃতাত্তি্বক শেকড় তৈরি করেছে। অনেক পণ্ডিতের মতে এই অস্ট্রলয়েড ও আদি অস্ট্রলয়েডদের মূলধারাটি ৩০ হাজার বছর আগে আফ্রিকার মাটি থেকে নানা পথে এ দেশের মাটিতে এসেছিল। সভ্যতার বিকাশ ও বুদ্ধিভিত্তিক বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে স্থানভেদে এদের দেহসৌষ্ঠবের যেমন পরিবর্তন হয়েছে, তেমনি পরিবর্তন হয়েছে এদের পরিচয়ের। জাত্যাভিমানী গোষ্ঠীকে এটা বোঝানো কঠিন যে, সিন্ধুসভ্যতা ও দাক্ষিণাত্যের মাদ্রাজি সংস্কৃতি একসূত্রে গাঁথা। এ দেশের ৮০ ভাগ বাঙালির দেহে বইছে ওই সব সভ্যতার প্রবর্তক নিগ্রোগোষ্ঠী এবং আদি অস্ট্রলয়েডদের রক্ত। টলেমি এ দেশকে কিরাত দেশ বলেছেন। এর সঙ্গে মিশ্রিত হয়েছে ইন্দোচীন বৃত্তের মঙ্গোলীয় রক্ত। এ অর্থে সমতলের বাঙালিরাই এ অঞ্চলের আদিবাসী। তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, পুরাকীর্তি সব কিছুতেই এই সংকরের ছাপ পরিস্টম্ফুটিত। অনেকেই এ দেশের ৭৬টি নৃগোষ্ঠীর উপস্থিতির কথা বলেন। নৃগোষ্ঠী হিসেবে, জেনেটিক বৈশিষ্ট্যে, ভাষাগত এবং কৃষ্টিগত স্বাতন্ত্র্যে হয়তো তাই। এটা সত্য যে, বাংলার পার্বত্য অঞ্চলগুলোতে উত্তর-পূর্বের গহিন পর্বতসংকুল অঞ্চলগুলো থেকে বহিরাগতদের আগমন ঘটেছে যুগে যুগে। এর কারণ ছিল ওই সব অঞ্চলের আধিপত্যের সংঘাত, খাদ্যের অভাব এবং ব্রিটিশ কূটনীতি।
একটি জাতির বা বহুজাতিক নানা গোষ্ঠীর সম্মিলিত আশা-আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে রাজনৈতিক তথা অর্থনৈতিক অধিকার বাস্তবায়ন, ভৌগোলিক সীমানা নির্ধারণ এবং আত্মনিয়ন্ত্রণই স্বাধীন রাষ্ট্রের ভিত্তি রচনা করে। স্বশাসন, আত্মনিয়ন্ত্রণ, বহিরাগত হস্তক্ষেপ ব্যতিরেকে স্বাধীন অস্তিত্ব রক্ষা, জাতির ঐক্যবদ্ধ ইচ্ছা ও অধিকারের প্রকাশ ও প্রয়োগই হলো সরলভাবে সার্বভৌমত্ব। আর এই জাতির স্বশাসনের নিয়মনীতি তথা রাষ্ট্রের নানা অঙ্গের কার্যপ্রণালি বিধি হলো সংবিধান। তারপর এটি সত্য কথা যে, রাষ্ট্রের অন্তর্গত দুর্বল গোষ্ঠীর ইচ্ছা অনেক ক্ষেত্রেই এই সংবিধানে প্রতিফলিত হয় না।
যে সংবিধান জনগণের ইতিহাস, আশা, আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্নকে প্রতিফলিত করে না, জাতির সংগ্রাম ও সংঘাত সমাধানের পথ দেখায় না, শান্তি ও সংহতি নিশ্চিত করে না, ন্যায় ও জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার রক্ষাকবচ হিসেবে বিবেচিত হয় না, সমাজের সব জাতি ও গোষ্ঠীর সমঅধিকার তথা আইনের শাসন সমুন্নত করে না, সর্বোপরি জীবনের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে সুশাসন ও মানব মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করে না, তা নিঃসন্দেহে খণ্ডিত সংবিধান।
আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে যেভাবে জাতিগোষ্ঠীর বিভাজন হয় তা নৃতাত্তি্বক বিভাজন বা ঐতিহাসিক বিভাজনকে প্রতিফলিত করে না। জাতিসংঘ সনদের যেভাবে জাতি, উপজাতি, আদিবাসী ও এথনিক গোষ্ঠীর অধিকারকে সংরক্ষিত করা হয়েছে বা আন্তর্জাতিক উদ্যোগে দেশে দেশে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে তা অনেক ক্ষেত্রে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং অবমাননামূলক। উপজাতি কথাটাই অবমাননামূলক। আদিবাসীর সংজ্ঞাটি শতভাগ বিভ্রান্তিমূলক। একটি জাতি একটি দেশে আপন ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি নিয়ে কতদিন টিকে থাকলে তাকে আদিবাসী বলা যাবে তা স্পষ্ট নয়। মূলত আদিবাসী কথাটি উৎপত্তি হয়েছে বহিরাগত অভিবাসী ও আক্রমণকারীদের দৃষ্টি থেকে। যেমন ২০০ থেকে ২৫০ বছর আগে রেড ইন্ডিয়ানরা আমেরিকার মাটিতে আগত সাদা মানুষের দৃষ্টিতে আদিবাসী ছিল। যেমন অস্ট্রেলিয়ার দখলদারদের দৃষ্টিতে অস্ট্রলয়েডরা বা অনড়ৎমরহং গণ আদিবাসী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। যেমন সামোয়া, তাহিতি দ্বীপের আদিবাসী নিজ দেশে মেলানেশীয় ও পলিনেশীয় গ্রুপ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এথনিক শব্দটি গ্রিক ঊঃযরহবশড়ং শব্দ থেকে উদ্ভূত।
উলেল্গখ করা প্রয়োজন যে, ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী এ দেশের এথনিক জনসংখ্যা পুরো জনসংখ্যার ১.১৩% ছিল। এ প্রেক্ষিতে দেশের সম্পদের ওপর এদের অধিকার সমানুপাতিক হওয়া প্রয়োজন। আর নাগরিক অধিকার হবে সব নাগরিকের সমতুল্য। উলেল্গখ্য, দেশের চাকমারা দেশের বৃহত্তম এথনিক গোষ্ঠী। এদের ভাষা ইন্দোএরিয়ান; অনেকটা বাংলাভাষার অপভ্রংশ। এরা যে মঙ্গোলয়েড গোষ্ঠীর বংশধর তারা বহু আগেই দেশের মূল স্রোতে মিশে গেছে। এদেরই জন্মভূমি রাঙামাটির সন্তান বুদ্ধগুপ্ত ৫ম শতাব্দীতে মহানাবিক বেশে সমুদ্রযান নিয়ে মালয় গিয়েছেন এবং সেখানকার ওয়েলেসলি জেলায় বৌদ্ধ মন্দির স্থাপন করেছেন। তিনি সেখানে ফলকে উৎকীর্ণ করেছেন নিজের নাম, পরিচয় এবং বুদ্ধবাণী। এমন সিদ্ধযাত্রা যে একজনই করেছেন তা ভাবার কারণ নেই। পুরো বাংলা তখন বৌদ্ধ সংস্কৃতিতে আচ্ছন্ন। বাঙালি তখন সমুদ্রপথে ব্রহ্মদেশ, শ্যামদেশ, সিংহলসহ দেশে দেশে সুবর্ণভূমি অনুসন্ধান করছে।
মূলত ১৮৬৮ সালে ব্রিটিশ শাসক পার্বত্য এলাকায় ভূমির ওপর রাষ্ট্রীয় মালিকানা প্রতিষ্ঠা করে। শুধু তাই নয়, পাহাড়িদের দেশের অন্যত্র গমনাগমন এবং জীবনযাপন নিষিদ্ধ ও নিয়ন্ত্রণ করে। ভূমির মালিকানা সংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞাটা এখনও অনেক ক্ষেত্রে বিদ্যমান। তারপরও পাহাড়িদের ভূমি সমতলের লোকদের কাছে হস্তান্তর অব্যাহত রয়েছে। অনেকটা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়। এ ক্ষেত্রে বনভূমি থেকে পাহাড়ি জনগণকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। এমনটা চলতে দেওয়া যায় না।
সংবিধানের আলোকে পাহাড়ি জনগণকে যেমন প্রান্তিকীকরণ বন্ধ করতে হবে, তেমনি তাদের জীবন সহজ করার জন্য গ্রহণযোগ্য পদ্ধতিতে তাদের মধ্যে চাষবাসের জমি বণ্টন করতে হবে। একই সঙ্গে পাহাড় ও বনাঞ্চল ধ্বংস রোধে জমির হস্তান্তর এবং অনুমতি ব্যতিরেকে বৃক্ষ কর্তন নিষিদ্ধ করতে হবে। সামগ্রিকভাবে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করে তাদের দেশের মূল স্রোতে আনতে হবে। শ্রদ্ধা করতে হবে তাদের ভিন্নতা। লালন করতে হবে তাদের ভাষা ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য। শতভাগ নিশ্চিত করতে হবে তাদের মৌলিক অধিকার। আমরা সবাই মিলে হারানো দিনের মতো স্বর্ণনদী ও সুবর্ণভূমি খুঁজে নেব।

ডা. এম এ হাসান : আহ্বায়ক, ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি
aaersci@aitlbd.net
 

No comments

Powered by Blogger.