ত্রিপুরী বসতি ডলুছড়া by আহমদ সিরাজ

বাংলাদেশের মধ্যে ক্ষুদ্র নৃতাত্তি্বক জাতিগোষ্ঠীর বর্ণিল অবস্থান হিসেবে মৌলভীবাজার জেলা খ্যাত হলেও কমলগঞ্জ উপজেলায় রয়েছে মণিপুরি, খাসিয়া, চা শ্রমিক, গারো, সাঁওতাল, ত্রিপুরী, মুণ্ডাসহ নানা জাতিগোষ্ঠীর বসবাস। কমলগঞ্জ সীমানার পাশে শ্রীমঙ্গলের ডলুছড়া বা ডলুবাড়িতে ত্রিপুরীদের রয়েছে চিহ্নিত অবস্থান।


এই চিহ্নিত ত্রিপুরী এলাকাতে সরেজমিন যাওয়ার ইচ্ছা পূরণ হয় ২২ এপ্রিল ২০১২। কমলগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও দৈনিক সমকাল প্রতিনিধি প্রনীত রঞ্জন দেবনাথের মোটরসাইকেলের পেছনে বসেই শ্রীমঙ্গলের পিচঢালা রাস্তা দিয়ে যাত্রা শুরু হলেও আমাদের চোখে পড়ে রাস্তাটি ফাঁকা, যানবাহনহীন। যে মাগুরছড়া, লাউয়াছড়া প্রতিদিন ঝাঁকে ঝাঁকে পর্যটক, তরুণ-তরুণীর কলকাকলিতে মুখর থাকে, রাস্তায় যানজট পর্যন্ত লেগে থাকে; সেই লাউয়াছড়ায় পর্যটকের কোনো চিহ্ন পর্যন্ত চোখে পড়েনি। এভাবেই আমরা প্রায় ১২ কিলোমিটার সর্পিল পাহাড়ি রাস্তা অতিক্রম করে নূরজাহান চা বাগানমুখী রাস্তায় এসে পূর্বদিকে ডলুছড়ার দিকে মোটরসাইকেল চালিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে ডলুছড়ায় ত্রিপুরীদের গ্রামে পেঁৗছে যাই।
আমরা প্রথমেই স্বরূপানন্দ ত্রিপুরীর ঘরে গিয়ে উঠি। ৮৫ বছরের প্রবীণ এই ব্যক্তি ডলুছড়ার চৌধুরী বা প্রধান। ডলুছড়ার সমাজের নেতৃত্বদানকারী হিসেবে মনোনীত। এখানে প্রায় সবাই দেববর্মা পদবি ব্যবহার করলেও তিনি ত্রিপুরী ব্যবহার করেন। ১১টি ধর্মান্তরিত খ্রিস্টান পরিবারও নামের শেষে দেববর্মা ব্যবহার করে। স্বরূপানন্দ জানান, ডলুছড়ায় ত্রিপুরীদের উপস্থিতিতেই শত শত বছর আগের অর্থাৎ ত্রিপুরা রাজবংশের আমল থেকেই তাদের বসবাস চলে আসছে। এই হিসেবে ডলুছড়ার ত্রিপুরী প্রাচীন আদি জনগোষ্ঠী। এখানে তারা আছেন ৮৫টি পরিবার। লোকসংখ্যার হিসাবে ৪৫০ জনের মতো। তবে মহিলার সংখ্যা পুরুষের চেয়ে কিছু বেশি।
তারা সনাতন হিন্দু ধর্মের অনুসারী হলেও হিন্দুদের দুর্গাপূজা, কালীপূজা, লক্ষ্মীপূজাসহ সব পূজা-পার্বণ আচরণীয় হয়ে এলেও এগুলোতে রয়েছে বন দেবতার আদল। তাদের অনেক পূজা-পার্বণে নিজেদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের চিহ্ন বহন করছে।
এখানে তাদের গড়িয়া পূজা বা নাচ, কের পূজা, গ্রাম পূজা, বসন্ত পূজা ইত্যাদি নাচ-গানে 'বাঁশ' ব্যবহার করা হয়। ত্রিপুরীদের বোতল নৃত্য জনপ্রিয়। এই নৃত্য দেশে-বিদেশেও পরিচিত। মাথায় বোতল রেখে নাচ দিতে হয়।
নাচ-গান আদিম জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতির অংশ হলেও চাষাবাদও তাদের বেঁচে থাকার উপায়। ত্রিপুরীদের মধ্যে 'জুম চাষ' প্রচলিত। চাষাবাদকে কেন্দ্র করে নৃত্যও প্রচলিত। জুম ধানের চারা রোপণ করতে গিয়ে নৃত্য ও গান তারা পরিবেশন করত। ত্রিপুরী পরিবারের প্রতিটি ঘরেই আছে কোমর তাঁত। বড় তাঁতও আছে কিছু কিছু। ডলুছড়ায় ত্রিপুরীদের নিজস্ব ভাষা আছে। তারা 'ককবরক' ভাষায় কথা বলে। তারা বাংলায়ও কথা বলতে জানে। নিজেদের ভাষার চর্চা ও প্রসারে তারা গর্ববোধ করে। ত্রিপুরীদের বড় উৎসব 'বইসুক'। এ উৎসবটি বছরে মধ্য-এপ্রিলে করে থাকে। তিন দিনব্যাপী এ উৎসব নাচে-গানে মুখর থাকে। তাদের খাবারদাবার বাঙালির মতোই। এখানে প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে ঠিকই, তবে প্রাথমিক শিক্ষা লাভের পর অনেকেই ঝরে পড়ে। উচ্চশিক্ষা নিতে হলে শ্রীমঙ্গল যেতে হয়।
এখানে অনেক ত্রিপুরী মহিলার সঙ্গে কথা বলি। আমাদের আলাপ করে বুঝে নিতে হয়, তারা এখানে তাঁতের কাপড় তৈরিতে সরকারের ঋণ সুবিধা চায়, যে সুযোগ থেকে তারা বঞ্চিত। 'হামহাম' জলপ্রপাতের সন্ধানদাতা এখানকার শ্যামল দেববর্মা জানান, কমলগঞ্জে দুই হাজারের মতো এবং শ্রীমঙ্গল উপজেলায় তিন হাজারের মতো ত্রিপুরী বসবাস করে। ত্রিপুরীরা সরকারের উন্নয়ন নীতির নজরে এলে তাঁত শিল্পে মণিপুরিদের মতো অবদান রাখতে পারত। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান কমলগঞ্জে এসে মণিপুরিদের এসএমই ঋণ বিতরণ করেন। কিন্তু পাশাপাশি দুই হাজারের মতো বাঙালি তাঁতি, নারী উদ্যোক্তা ব্যাংক ঋণের কিনারা করতে পারল না। দূর অরণ্যে প্রকৃতিকে বুকে আপন করে নিয়ে বাস করছে ডলুছড়ার ত্রিপুরীরা। নৈসর্গিক শিকড়ে বসবাসকারী শুদ্ধতার সি্নগ্ধ মুগ্ধতায় আবিষ্ট করে রাখে, তা বুঝতেই পারিনি।

আহমদ সিরাজ :লোক গবেষক ও সংগঠক
 

No comments

Powered by Blogger.