পরিবর্তনের হাওয়া কি আমাদের স্পর্শ করবে না?-নববর্ষ by আবু সাঈদ খান
এক বছরে এখানে খুব বড় পরিবর্তন ঘটবে না, তবে পরিবর্তনের শর্তগুলো তৈরি হবে। বাংলাদেশের মানুষ যেমন ক্ষমতাবাজির বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করছে, তেমনি বিদেশি শক্তির থাবাকে প্রতিহত করতে সংগঠিতও হচ্ছে।তেল-গ্যাস-বন্দর রক্ষার আন্দোলনের প্রতি বাড়ছে জনসমর্থন। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নেও জনমত আজ প্রবল। এসব কিছুর মধ্যেই পরিবর্তনের জন্য হাওয়া বহমান। ২০১২ সালে আমরা নতুন এক মানবিক সমাজ গড়ার সংগ্রামের
সূচনা দেখতে চাই। দেখতে চাই না আর কোনো লিমন বা কাদেরের ওপর নিপীড়ন। আমরা আর মানতে চাই না দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়ার দাপট
নতুন বছরের প্রথম প্রভাতে লিখছি। এ দিনের বড় জিজ্ঞাসা_ সামনের বছর কেমন বাংলাদেশ পাব, কেমন দুনিয়ায় বাস করব? রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, 'রাতের সব তারাই আছে/দিনের আলোর গভীরে।' তেমনি অনাগত ভবিষ্যতের উপাদানগুলো ফেলে আসা সময়ের গর্ভেই ক্রিয়াশীল; তা কালের যাত্রায় নতুন অবয়ব পায়, নতুন মাত্রা যুক্ত হয়। প্রকৃতির মতো সমাজও বদলায়, তবে এ পরিবর্তনে বস্তুগত অবস্থার সঙ্গে মানুষের ভূমিকা যুক্ত হয়। মানুষ এখানে নতুন সমাজ গড়ার কারিগর। তাই দেশটাকে আমরা কীভাবে গড়ব, পৃথিবীটাকে কীভাবে বদলাব_ সেটি মানুষেরই হাতে। ২০১১ সালজুড়ে পৃথিবীব্যাপী 'পরিবর্তন' কথাটি বারবার উচ্চারিত হয়েছে। আরব বিশ্ব থেকে শুরু পাশ্চাত্যের দেশগুলোতেও পরিবর্তনের স্লোগান উঠেছে। পরিবর্তনের হাওয়া এসে লেগেছে প্রতিবেশী দেশগুলোতেও। বাংলাদেশকে পরিবর্তনের হাওয়া স্পর্শ করেছে বলে মনে হয় না। মাঝে মধ্যে কোনো রাজনৈতিক দল পরিবর্তনের কথা বললেও সেটি স্রেফ কাগজে-কলমেই যেন সীমাবদ্ধ। বরং বদলের হাওয়া ছাপিয়ে ক্ষমতার লড়াইয়েই ব্যস্ত রাজনীতির প্রধান দুই দল।
পরিবর্তনের বিষয়টি প্রধানত রাজনৈতিক। কারণ, রাজনীতিই সমাজ, অর্থনীতিসহ সব বিষয়কে নির্দেশনা দেয়। তাই আমাদের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সর্বাগ্রে রাজনীতির প্রসঙ্গ এসে যায়। অর্থাৎ সমাজের অভ্যন্তরে অনিয়ম, অবিচার, বৈষম্য, লুটপাট, দুর্নীতিসহ যেসব অপতৎপরতা আছে, তা রাজনৈতিক নেতৃত্বকেই মোকাবেলা করে সুনিয়ম, সাম্য, সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠা করতে হয়। কিন্তু আমাদের রাজনীতির প্রচলিত ধারা সে পথে এগোচ্ছে না। পুরনো অনিয়মের পুনরাবৃত্তিই আমাদের রাজনীতির নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে!
তবে পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা গণমানুষের মাঝে প্রবল। সে পরিবর্তনের স্বপ্ন বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। কিন্তু যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে সে আকাঙ্ক্ষা বারবার মুখ থুবড়ে পড়ছে। ক্ষমতাবাজি-দলবাজির ডামাডোলে উপেক্ষিত হচ্ছে গণমানুষের পরিবর্তনের রাজনীতি, গণমানুষের স্বার্থের অনুকূলে নীতি।
দেশে গার্মেন্টসহ শিল্পক্ষেত্রে কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে, কিন্তু এখনও লাখ লাখ কর্মক্ষম মানুষ বেকার বা অর্ধবেকার। শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়ে চলেছে, যারা পরিবারের ওপর বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাধারণ মানুষের সবচেয়ে বড় ভাবনা_ বাজারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টিকে থাকতে পারবে কি-না, সন্তানের শিক্ষা খরচ কী করে মেটাবে, বেকার সন্তান কি কাজ পাবে? কিন্তু প্রচলিত রাজনীতি মানুষের এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য প্রস্তুত নয়।
গত বছর আমরা কী দেখেছি? দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়ায় লাগাম পরাতে পারেনি সরকার। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাজারের মূল্যবৃদ্ধিকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে যখন সয়াবিন তেলের দাম কমেছে, তখন কিন্তু বাংলাদেশ কমাতে ব্যর্থ হয়েছে। ব্যবসায়িক সিন্ডিকেটের কাছে সরকার অসহায়। তাই বিভিন্ন সময়ে অযৌক্তিকভাবে চাল, ডাল, তেল ও চিনির দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। একবার যে পণ্যের দাম বেড়েছে তা কমার নজির আমাদের বাজারে দুর্লভ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কৃষকের স্বার্থে অজুহাত তোলা হয়। কিন্তু সরেজমিনে দেখা যায়, কৃষকও ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত। এবারও যথাসময়ে সরকারের ক্রয় কেন্দ্রগুলো ধান কিনল না। ২৮ টাকা দরে চাল ক্রয় নির্ধারিত থাকলেও টাকা আসেনি বলে ক্রয় বন্ধ রেখেছে। ২৪-২৫ টাকা কেজিতে মহাজনরা চাল কিনে রেখেছে। এভাবে ফড়িয়া, মহাজন, মধ্যস্বত্বভোগীরা লাভবান হচ্ছে। সবজির ক্ষেত্রেও কৃষকরা বঞ্চনার শিকার। যখন উৎপাদন কেন্দ্রে এক টাকায় একটি ফুলকপি বিক্রি হয়, তখন রাজধানীর বাজারে দাম ২০ টাকা। মুলার মণ যখন ১৫ টাকা, তখন রাজধানীতে কেজি ১৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এসব খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে, হচ্ছে। কিন্তু নীতিনির্ধারকদের মধ্যে এ নিয়ে কোনো উদ্বেগ নেই।
শহরের গার্মেন্ট শ্রমিক, পরিবহন শ্রমিক, হোটেল-রেস্তোরাঁর কর্মচারী, ফেরিওয়ালা, গৃহকর্মী, কেরানি, ক্ষুদে ব্যবসায়ী, চাকরিজীবীরা দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধিতে ক্ষতবিক্ষত। কেবল নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য নয়, বাস ভাড়া, বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা খরচ, শিক্ষা খরচসহ সর্বক্ষেত্রে ব্যয় বেড়েছে, কিন্তু সে হারে বেতন বাড়েনি।
মানুষের স্বাভাবিক জীবনের জন্য দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। নীতিনির্ধারকরা পৃথিবীর অনেক দেশের উপমা দিয়ে বলেন, আমাদের দেশে চাল-ডালের দাম এখনও কম। কথাটি সত্য। তবে এও সত্য, যেসব দেশের উদাহরণ দেওয়া হয় সেখানে মানুষের মাথপিছু আয়ও বেশি। যেখানে একজন শ্রমিক এক লাখ টাকা আয় করে, সেখানে ১০০ টাকা দরে চাল কেনা তার জন্য সমস্যা নয়। কিন্তু যে দেশে শ্রমিক তিন হাজার টাকা বেতন পায় সে দেশের শ্রমিকের পক্ষে ৩০ টাকা কেজি চাল কেনা কঠিন। দুঃখজনক হলেও সত্য, সত্যের বাকি অর্ধেক নীতিনির্ধারকরা কখনোই উচ্চারণ করেন না।
দ্রব্যমূল্যের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য রেশনের ব্যবস্থা করতে হয়, ন্যায্যমূল্যের দোকান চালু করতে হয়। পাকিস্তান আমলে কর্মচারীর জন্য শহরে রেশন প্রথা ছিল, স্বাধীনতা-উত্তর তা চালু ছিল, ন্যায্যমূল্যের দোকান খোলা হয়েছিল। এখনও পৃথিবীর বহু দেশে এ নজির আছে। কিন্তু আমাদের দেশে সবকিছুই উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এমনকি সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসাও সংকুচিত হয়ে এসেছে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত শিক্ষার আওতা গুটিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
যেখানে মানবসম্পদ বিকশিত হয় না, পুষ্টিতে, শিক্ষায়, চিকিৎসায় পিছিয়ে থাকে, সেখানে দারিদ্র্য কীভাবে কমবে? কী করেই-বা বৈষম্য রোখা যাবে? এটি অস্বীকার করার জো নেই যে, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশ ৭% প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে। উল্লেখযোগ্যভাবে ধনীর সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু সেই সঙ্গে ধনী-দরিদ্র বৈষম্য বেড়েছে, বৈষম্য বেড়ে চলেছে শহর ও গ্রামের মধ্যেও। সুশাসনের মূল বিষয়ই হচ্ছে সেবা ও মানবসমাজের উন্নয়ন। কিন্তু দেশের প্রাণ যে জনগণ তাদের ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, কুশিক্ষার বেড়াজালে বন্দি করে আদৌ কি উন্নয়ন সম্ভব?
উন্নয়নের মডেল হতে হবে বাংলাদেশের মতো করে। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষকে অপুষ্টি, অশিক্ষা, অন্ধকারে রেখে দেশের উন্নয়ন হতে পারে না। দেশের মালিক জনগণ, আর মালিকানা অর্জন করেছে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। আমরা ভুলে যেতে পারি না যে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের বর্বরোচিত হামলার পর রাজনৈতিক ও ছাত্র আন্দোলনের কর্মীরা গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিল, তাদের আশ্রয় দিয়েছিল, কৃষক-মজুরের সন্তানরা হালের গুটি ছেড়ে রাইফেল ধরেছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের শতকরা ৮০ ভাগই কৃষক ও শ্রমিক। এ কৃষকই দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছে। গ্রামের হতদরিদ্র পরিবারের তরুণ-তরুণীরা দেশের বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী, গার্মেন্ট শিল্পের প্রাণশক্তি। রেমিট্যান্সের আরেক জোগানদাতা প্রবাসী শ্রমিক। অতএব, কৃষক-শ্রমিকের উন্নয়ন হতে হবে সব রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দু, যে স্বপ্ন আমরা একাত্তরে দেখেছি, তখন যেভাবে বৈষম্যহীন সমাজের কথা ভেবেছি, সে ভাবনার বৃত্তের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। আর সেটি হলে তা হবে আত্মঘাতী, একাত্তরের চেতনার প্রতি প্রতারণার শামিল।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকৃতি নিয়ে কোনো কথা নেই। আমাদের মনে রাখতে হবে, দাতাদের দেওয়া মডেল নয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাতেই পথ চলতে হবে, বৈষম্যের অবসান ঘটাতে হবে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গের মধ্যকার বিভাজনরেখা ঘুচে ফেলতে হবে।
বৈষম্যের বিরুদ্ধে আজ পশ্চিমা দুনিয়ায় গণজাগরণ। তারা বলছে, আমরা ৯৯ ভাগ আর দেয়ালের ওপারে এক ভাগ। তাই শুরু হয়েছে, করপোরেট ব্যবস্থা দখলের আন্দোলন_ অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট।
সোভিয়েত পতনের পর বলা হয়েছিল, পুঁজিবাদীই শেষ কথা। আজ সেই সাম্রাজ্যবাদ পুঁজিবাদের বুক চিরে নতুন আওয়াজ উঠেছে। সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদের ভাঙনের সুর শোনা যাচ্ছে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথাকথিত বিদ্রোহীদের শায়েস্তা করতে ইরাক, লিবিয়া ও আফগানিস্তানে হামলা সংঘটিত করছে_ তার গৃহেই বিদ্রোহের আগুন। জানি না, পশ্চিমা দুনিয়া এ আগুন নেভাতে পারবে, নাকি আরও দাউদাউ করে জ্বলে উঠবে? জ্বলে যে উঠবে, নতুন সমাজের সূচনা করবে তা নিয়ে সংশয় নেই। তবে তা কতদূর সে যাত্রা_ সেটি নিশ্চিত করে বলা কঠিন। প্রশ্ন হচ্ছে, এ আগুন আমাদের কি স্পর্শ করবে না? দুনিয়া বদলানোর সংগ্রাম থেকে কোনো দেশই কি দূরে থাকতে পারবে? তবে কি আশার আলো একেবারেই নেই?
বাংলাদেশে এখন লুটপাটের রাজনীতি-অর্থনীতির আধিপত্য। সমাজ ও রাজনীতি থেকে মেধাবীরা যখন ছিটকে পড়ছে, তখন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে দেখলাম ভিন্ন দৃশ্য। মাস্তানতন্ত্রের বিরুদ্ধে নারায়ণগঞ্জে জনতা রায় দিয়েছে, মেয়র প্রার্থী আইভীকে রাজনীতির তৃণমূলের নেতাকর্মী, জনতা জিতিয়েছে। এটি সততা, মেধা ও পরিশুদ্ধ রাজনীতির প্রতি রায়। ধারণা করা যায়, সামনের দিনগুলোয় কেবল ক্ষমতা-দলবাজি হবে, না এর বিরুদ্ধে আদর্শবাদের জয়জয়কার শুনব।
এক বছরে এখানে খুব বড় পরিবর্তন ঘটবে না, তবে পরিবর্তনের শর্তগুলো তৈরি হবে। বাংলাদেশের মানুষ যেমন ক্ষমতাবাজির বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করছে, তেমনি বিদেশি শক্তির থাবাকে প্রতিহত করতে সংগঠিতও হচ্ছে। তেল-গ্যাস-বন্দর রক্ষার আন্দোলনের প্রতি বাড়ছে জনসমর্থন। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নেও জনমত আজ প্রবল। এসব কিছুর মধ্যেই পরিবর্তনের জন্য হাওয়া বহমান।
২০১২ সালে আমরা নতুন এক মানবিক সমাজ গড়ার সংগ্রামের সূচনা দেখতে চাই। দেখতে চাই না আর কোনো লিমন বা কাদেরের ওপর নিপীড়ন। আমরা আর মানতে চাই না দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়ার দাপট। আমরা একাত্তরের চেতনায় সবার বাসযোগ্য বৈষম্যহীন মানবিক এক সমাজ গড়ার পথে এগোতে চাই, পেছনে ফিরতে চাই না।
আবু সাঈদ খান : সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com
নতুন বছরের প্রথম প্রভাতে লিখছি। এ দিনের বড় জিজ্ঞাসা_ সামনের বছর কেমন বাংলাদেশ পাব, কেমন দুনিয়ায় বাস করব? রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, 'রাতের সব তারাই আছে/দিনের আলোর গভীরে।' তেমনি অনাগত ভবিষ্যতের উপাদানগুলো ফেলে আসা সময়ের গর্ভেই ক্রিয়াশীল; তা কালের যাত্রায় নতুন অবয়ব পায়, নতুন মাত্রা যুক্ত হয়। প্রকৃতির মতো সমাজও বদলায়, তবে এ পরিবর্তনে বস্তুগত অবস্থার সঙ্গে মানুষের ভূমিকা যুক্ত হয়। মানুষ এখানে নতুন সমাজ গড়ার কারিগর। তাই দেশটাকে আমরা কীভাবে গড়ব, পৃথিবীটাকে কীভাবে বদলাব_ সেটি মানুষেরই হাতে। ২০১১ সালজুড়ে পৃথিবীব্যাপী 'পরিবর্তন' কথাটি বারবার উচ্চারিত হয়েছে। আরব বিশ্ব থেকে শুরু পাশ্চাত্যের দেশগুলোতেও পরিবর্তনের স্লোগান উঠেছে। পরিবর্তনের হাওয়া এসে লেগেছে প্রতিবেশী দেশগুলোতেও। বাংলাদেশকে পরিবর্তনের হাওয়া স্পর্শ করেছে বলে মনে হয় না। মাঝে মধ্যে কোনো রাজনৈতিক দল পরিবর্তনের কথা বললেও সেটি স্রেফ কাগজে-কলমেই যেন সীমাবদ্ধ। বরং বদলের হাওয়া ছাপিয়ে ক্ষমতার লড়াইয়েই ব্যস্ত রাজনীতির প্রধান দুই দল।
পরিবর্তনের বিষয়টি প্রধানত রাজনৈতিক। কারণ, রাজনীতিই সমাজ, অর্থনীতিসহ সব বিষয়কে নির্দেশনা দেয়। তাই আমাদের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সর্বাগ্রে রাজনীতির প্রসঙ্গ এসে যায়। অর্থাৎ সমাজের অভ্যন্তরে অনিয়ম, অবিচার, বৈষম্য, লুটপাট, দুর্নীতিসহ যেসব অপতৎপরতা আছে, তা রাজনৈতিক নেতৃত্বকেই মোকাবেলা করে সুনিয়ম, সাম্য, সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠা করতে হয়। কিন্তু আমাদের রাজনীতির প্রচলিত ধারা সে পথে এগোচ্ছে না। পুরনো অনিয়মের পুনরাবৃত্তিই আমাদের রাজনীতির নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে!
তবে পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা গণমানুষের মাঝে প্রবল। সে পরিবর্তনের স্বপ্ন বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। কিন্তু যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে সে আকাঙ্ক্ষা বারবার মুখ থুবড়ে পড়ছে। ক্ষমতাবাজি-দলবাজির ডামাডোলে উপেক্ষিত হচ্ছে গণমানুষের পরিবর্তনের রাজনীতি, গণমানুষের স্বার্থের অনুকূলে নীতি।
দেশে গার্মেন্টসহ শিল্পক্ষেত্রে কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে, কিন্তু এখনও লাখ লাখ কর্মক্ষম মানুষ বেকার বা অর্ধবেকার। শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়ে চলেছে, যারা পরিবারের ওপর বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাধারণ মানুষের সবচেয়ে বড় ভাবনা_ বাজারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টিকে থাকতে পারবে কি-না, সন্তানের শিক্ষা খরচ কী করে মেটাবে, বেকার সন্তান কি কাজ পাবে? কিন্তু প্রচলিত রাজনীতি মানুষের এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য প্রস্তুত নয়।
গত বছর আমরা কী দেখেছি? দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়ায় লাগাম পরাতে পারেনি সরকার। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাজারের মূল্যবৃদ্ধিকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে যখন সয়াবিন তেলের দাম কমেছে, তখন কিন্তু বাংলাদেশ কমাতে ব্যর্থ হয়েছে। ব্যবসায়িক সিন্ডিকেটের কাছে সরকার অসহায়। তাই বিভিন্ন সময়ে অযৌক্তিকভাবে চাল, ডাল, তেল ও চিনির দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। একবার যে পণ্যের দাম বেড়েছে তা কমার নজির আমাদের বাজারে দুর্লভ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কৃষকের স্বার্থে অজুহাত তোলা হয়। কিন্তু সরেজমিনে দেখা যায়, কৃষকও ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত। এবারও যথাসময়ে সরকারের ক্রয় কেন্দ্রগুলো ধান কিনল না। ২৮ টাকা দরে চাল ক্রয় নির্ধারিত থাকলেও টাকা আসেনি বলে ক্রয় বন্ধ রেখেছে। ২৪-২৫ টাকা কেজিতে মহাজনরা চাল কিনে রেখেছে। এভাবে ফড়িয়া, মহাজন, মধ্যস্বত্বভোগীরা লাভবান হচ্ছে। সবজির ক্ষেত্রেও কৃষকরা বঞ্চনার শিকার। যখন উৎপাদন কেন্দ্রে এক টাকায় একটি ফুলকপি বিক্রি হয়, তখন রাজধানীর বাজারে দাম ২০ টাকা। মুলার মণ যখন ১৫ টাকা, তখন রাজধানীতে কেজি ১৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এসব খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে, হচ্ছে। কিন্তু নীতিনির্ধারকদের মধ্যে এ নিয়ে কোনো উদ্বেগ নেই।
শহরের গার্মেন্ট শ্রমিক, পরিবহন শ্রমিক, হোটেল-রেস্তোরাঁর কর্মচারী, ফেরিওয়ালা, গৃহকর্মী, কেরানি, ক্ষুদে ব্যবসায়ী, চাকরিজীবীরা দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধিতে ক্ষতবিক্ষত। কেবল নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য নয়, বাস ভাড়া, বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা খরচ, শিক্ষা খরচসহ সর্বক্ষেত্রে ব্যয় বেড়েছে, কিন্তু সে হারে বেতন বাড়েনি।
মানুষের স্বাভাবিক জীবনের জন্য দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। নীতিনির্ধারকরা পৃথিবীর অনেক দেশের উপমা দিয়ে বলেন, আমাদের দেশে চাল-ডালের দাম এখনও কম। কথাটি সত্য। তবে এও সত্য, যেসব দেশের উদাহরণ দেওয়া হয় সেখানে মানুষের মাথপিছু আয়ও বেশি। যেখানে একজন শ্রমিক এক লাখ টাকা আয় করে, সেখানে ১০০ টাকা দরে চাল কেনা তার জন্য সমস্যা নয়। কিন্তু যে দেশে শ্রমিক তিন হাজার টাকা বেতন পায় সে দেশের শ্রমিকের পক্ষে ৩০ টাকা কেজি চাল কেনা কঠিন। দুঃখজনক হলেও সত্য, সত্যের বাকি অর্ধেক নীতিনির্ধারকরা কখনোই উচ্চারণ করেন না।
দ্রব্যমূল্যের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য রেশনের ব্যবস্থা করতে হয়, ন্যায্যমূল্যের দোকান চালু করতে হয়। পাকিস্তান আমলে কর্মচারীর জন্য শহরে রেশন প্রথা ছিল, স্বাধীনতা-উত্তর তা চালু ছিল, ন্যায্যমূল্যের দোকান খোলা হয়েছিল। এখনও পৃথিবীর বহু দেশে এ নজির আছে। কিন্তু আমাদের দেশে সবকিছুই উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এমনকি সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসাও সংকুচিত হয়ে এসেছে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত শিক্ষার আওতা গুটিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
যেখানে মানবসম্পদ বিকশিত হয় না, পুষ্টিতে, শিক্ষায়, চিকিৎসায় পিছিয়ে থাকে, সেখানে দারিদ্র্য কীভাবে কমবে? কী করেই-বা বৈষম্য রোখা যাবে? এটি অস্বীকার করার জো নেই যে, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশ ৭% প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে। উল্লেখযোগ্যভাবে ধনীর সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু সেই সঙ্গে ধনী-দরিদ্র বৈষম্য বেড়েছে, বৈষম্য বেড়ে চলেছে শহর ও গ্রামের মধ্যেও। সুশাসনের মূল বিষয়ই হচ্ছে সেবা ও মানবসমাজের উন্নয়ন। কিন্তু দেশের প্রাণ যে জনগণ তাদের ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, কুশিক্ষার বেড়াজালে বন্দি করে আদৌ কি উন্নয়ন সম্ভব?
উন্নয়নের মডেল হতে হবে বাংলাদেশের মতো করে। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষকে অপুষ্টি, অশিক্ষা, অন্ধকারে রেখে দেশের উন্নয়ন হতে পারে না। দেশের মালিক জনগণ, আর মালিকানা অর্জন করেছে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। আমরা ভুলে যেতে পারি না যে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের বর্বরোচিত হামলার পর রাজনৈতিক ও ছাত্র আন্দোলনের কর্মীরা গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিল, তাদের আশ্রয় দিয়েছিল, কৃষক-মজুরের সন্তানরা হালের গুটি ছেড়ে রাইফেল ধরেছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের শতকরা ৮০ ভাগই কৃষক ও শ্রমিক। এ কৃষকই দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছে। গ্রামের হতদরিদ্র পরিবারের তরুণ-তরুণীরা দেশের বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী, গার্মেন্ট শিল্পের প্রাণশক্তি। রেমিট্যান্সের আরেক জোগানদাতা প্রবাসী শ্রমিক। অতএব, কৃষক-শ্রমিকের উন্নয়ন হতে হবে সব রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দু, যে স্বপ্ন আমরা একাত্তরে দেখেছি, তখন যেভাবে বৈষম্যহীন সমাজের কথা ভেবেছি, সে ভাবনার বৃত্তের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। আর সেটি হলে তা হবে আত্মঘাতী, একাত্তরের চেতনার প্রতি প্রতারণার শামিল।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকৃতি নিয়ে কোনো কথা নেই। আমাদের মনে রাখতে হবে, দাতাদের দেওয়া মডেল নয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাতেই পথ চলতে হবে, বৈষম্যের অবসান ঘটাতে হবে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গের মধ্যকার বিভাজনরেখা ঘুচে ফেলতে হবে।
বৈষম্যের বিরুদ্ধে আজ পশ্চিমা দুনিয়ায় গণজাগরণ। তারা বলছে, আমরা ৯৯ ভাগ আর দেয়ালের ওপারে এক ভাগ। তাই শুরু হয়েছে, করপোরেট ব্যবস্থা দখলের আন্দোলন_ অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট।
সোভিয়েত পতনের পর বলা হয়েছিল, পুঁজিবাদীই শেষ কথা। আজ সেই সাম্রাজ্যবাদ পুঁজিবাদের বুক চিরে নতুন আওয়াজ উঠেছে। সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদের ভাঙনের সুর শোনা যাচ্ছে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথাকথিত বিদ্রোহীদের শায়েস্তা করতে ইরাক, লিবিয়া ও আফগানিস্তানে হামলা সংঘটিত করছে_ তার গৃহেই বিদ্রোহের আগুন। জানি না, পশ্চিমা দুনিয়া এ আগুন নেভাতে পারবে, নাকি আরও দাউদাউ করে জ্বলে উঠবে? জ্বলে যে উঠবে, নতুন সমাজের সূচনা করবে তা নিয়ে সংশয় নেই। তবে তা কতদূর সে যাত্রা_ সেটি নিশ্চিত করে বলা কঠিন। প্রশ্ন হচ্ছে, এ আগুন আমাদের কি স্পর্শ করবে না? দুনিয়া বদলানোর সংগ্রাম থেকে কোনো দেশই কি দূরে থাকতে পারবে? তবে কি আশার আলো একেবারেই নেই?
বাংলাদেশে এখন লুটপাটের রাজনীতি-অর্থনীতির আধিপত্য। সমাজ ও রাজনীতি থেকে মেধাবীরা যখন ছিটকে পড়ছে, তখন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে দেখলাম ভিন্ন দৃশ্য। মাস্তানতন্ত্রের বিরুদ্ধে নারায়ণগঞ্জে জনতা রায় দিয়েছে, মেয়র প্রার্থী আইভীকে রাজনীতির তৃণমূলের নেতাকর্মী, জনতা জিতিয়েছে। এটি সততা, মেধা ও পরিশুদ্ধ রাজনীতির প্রতি রায়। ধারণা করা যায়, সামনের দিনগুলোয় কেবল ক্ষমতা-দলবাজি হবে, না এর বিরুদ্ধে আদর্শবাদের জয়জয়কার শুনব।
এক বছরে এখানে খুব বড় পরিবর্তন ঘটবে না, তবে পরিবর্তনের শর্তগুলো তৈরি হবে। বাংলাদেশের মানুষ যেমন ক্ষমতাবাজির বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করছে, তেমনি বিদেশি শক্তির থাবাকে প্রতিহত করতে সংগঠিতও হচ্ছে। তেল-গ্যাস-বন্দর রক্ষার আন্দোলনের প্রতি বাড়ছে জনসমর্থন। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নেও জনমত আজ প্রবল। এসব কিছুর মধ্যেই পরিবর্তনের জন্য হাওয়া বহমান।
২০১২ সালে আমরা নতুন এক মানবিক সমাজ গড়ার সংগ্রামের সূচনা দেখতে চাই। দেখতে চাই না আর কোনো লিমন বা কাদেরের ওপর নিপীড়ন। আমরা আর মানতে চাই না দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়ার দাপট। আমরা একাত্তরের চেতনায় সবার বাসযোগ্য বৈষম্যহীন মানবিক এক সমাজ গড়ার পথে এগোতে চাই, পেছনে ফিরতে চাই না।
আবু সাঈদ খান : সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com
No comments