তদারকহীন হাজারো কারখানার দায় কার by রাজীব আহমেদ
মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধ এলাকায় 'স্মার্ট এক্সপোর্ট ফ্যাক্টরি' নামের যে কারখানায় আগুন লেগে সাত শ্রমিক মারা গেছেন, সেখানে পোশাক তৈরি হচ্ছিল ইনডিটেক্স নামের একটি আন্তর্জাতিক ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের জন্য। ওই প্রতিষ্ঠান ১০০টিরও বেশি কম্পানি ও আটটি ব্র্যান্ডের পোশাকের মালিক।
বছরে ২০ বিলিয়ন ডলারের মতো ব্যবসা তাদের। অথচ তাদের জন্য পোশাক তৈরি হচ্ছিল সম্পূর্ণ অনুমোদনহীন একটি কারখানায়। কারখানাটি পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএরও সদস্য নয়। তবু বাড়তি রপ্তানি আদেশের চাপ সামলাতে এসব নামসর্বস্ব ও বেওয়ারিশ দর্জিদোকান থেকে পোশাক বানিয়ে ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারে পাঠাতে বিজিএমইএ বা বড় বড় ব্র্যান্ডের এজেন্টদের সমস্যা হয় না। সমস্যা হয় তখনই, যখন বড় ধরনের দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ঘটে। তখন এর দায় কেউ নেয় না। যেমন সাত শ্রমিকের প্রাণহানির দায় এবারও নেয়নি বিজিএমইএ। তাদের কোনো সদস্য যে এ কারখানা থেকে পোশাক নিত, তা-ও স্বীকার করেনি সংগঠনটি। ইতিমধ্যে একটি বিদেশি সংবাদ সংস্থা পরিবেশিত খবরে সারা বিশ্বের মানুষ জেনে গেছে, ম্যাক-টেক্স নামের একটি পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ভস্মীভূত কারখানাটি থেকে পোশাক কিনে ইনডিটেক্সে পাঠাত। ঢাকায় এ নামে একাধিক পোশাক কারখানা ও বায়িং হাউস আছে।
তাজরীনে আগুন লেগে ১১২ শ্রমিকের প্রাণহানির পর সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করেছিল ওয়ালমার্ট। ভয়াবহ এ দুর্ঘটনার পর ইউরোপ-আমেরিকা জুড়ে শ্রম অধিকার সংগঠনগুলোর চাপে সেসব দেশের সরকারও উদ্বেগ প্রকাশ করায় নড়েচড়ে বসেছিল সরকার ও পোশাক কারখানা মালিকদের সংগঠন। দুই মাসের মাথায় খোদ রাজধানীর বুকে আরেকটি অগ্নিকাণ্ডে সাত শ্রমিকের প্রাণহানি প্রমাণ করল, বৈশ্বিক ব্র্যান্ড, ক্রেতা দেশগুলোর সরকার ও অধিকার সংগঠনগুলোর উদ্বেগ বা সতর্কবাণী আমলে নেননি পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা। অনুমোদনহীন কারখানা থেকে পোশাক তৈরি করিয়ে নেওয়া অব্যাহত রেখেছেন তাঁরা। সরকারও এতে খুব একটা গা করছে না।
স্মার্ট এক্সপোর্ট ফ্যাক্টরির মতো রাজধানীর আবাসিক এলাকার দু-একটা ফ্লোর ভাড়া নিয়ে অথবা ছোট একটা জমিতে ৭০-৮০টি মেশিন নিয়ে গড়ে উঠেছে বহু কারখানা। এসব কারখানায় শ্রম আইনের কোনো বালাই নেই। সরাসরি রপ্তানিতে জড়িত নয় বলে এদের ওপর ক্রেতাদের চাপও নেই। বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর সদস্য নয় বলে সামান্য বাধ্যবাধকতাটুকুও মানে না তারা। কিন্তু এসব কারখানায় তৈরি হওয়া পোশাক যায় ইউরোপ ও আমেরিকায়। এদের প্রচলিত নাম সাব-কনট্রাক্ট ফ্যাক্টরি। এদের সংখ্যা কত তা জানা নেই কারো। তবে ধারণা করা হয়, এ সংখ্যা ৭০০-৮০০ হবে।
এসব কারখানা টিকে আছে কমপ্লায়েন্ট কারখানাগুলোর আশীর্বাদেই। নিজেদের একটি কারখানাকে কমপ্লায়েন্ট দেখিয়ে অনেক বড় কাজ বাগিয়ে নেয় তারা। পরে ওই সব কাজের ভাগ দেওয়া হয় এসব ছোট কারখানায়। পোশাক তৈরি না করেই অর্ডার এনে হাতিয়ে নেওয়া হয় বড় অঙ্কের টাকা। একটি কারখানা অন্য কারখানায় কাজ নিলে বন্ড ট্রান্সফার করতে হয়। অথচ এসব কারখানায় কাজ যাচ্ছে বন্ড ট্রান্সফার না করেই।
বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী জানান, এক কারখানা থেকে অন্য কারখানায় কাজ নিতে হলে ইন্টার বন্ড করতে হবে। ইন্টার বন্ডের অনুমতি দেয় বিজিএমইএ। ইন্টার বন্ডে কারখানার নাম, কাজের পরিমাণ, খরচ, কাঁচামালের পরিমাণ ইত্যাদি উল্লেখ থাকে। রাস্তায় কাস্টম বা পুলিশ ধরলে ওই ইন্টার বন্ড দেখানো হলে তারা ছেড়ে দেয়। ইন্টার বন্ড হতে হয় বিজিএমইএর সদস্য কারখানাগুলোর মধ্যে। কিন্তু কোনো বন্ডের ধার না ধেরেই কাজ নেওয়া হয় অনুমোদনহীন, নন-কমপ্লায়েন্ট কারখানাগুলোতে।
এ রকম অনুমোদনহীন কাজের ঘটনা ঘটেছিল তাজরীন ফ্যাশনসে। যেখানে আগুন লেগে গত ২৪ নভেম্বর ১১২ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়। যার কারণে দেশের পোশাক খাত ইউরোপে শুল্কমুক্ত সুবিধা হারানোর ঝুঁকিতে পড়েছে। তাজরীনের মালিকের প্রতিষ্ঠান তুবা গ্রুপ কাজ পেয়েছিল সিমকো নামের একটি কারখানা থেকে। সিমকো সাকসেস অ্যাপারেলের কাছ থেকে যে কাজ পায়, তার ৭ শতাংশ সরবরাহ করে তুবা গ্রুপকে। তুবা গ্রুপ ওয়ালমার্টের 'ইয়েলো রেটেড' কারখানা। কিন্তু তুবা গ্রুপ 'না জানিয়ে' ওই কাজের একটি অংশ সরিয়ে তাদের অন্য কারখানা তাজরীন ফ্যাশনসে নিয়ে যায়। তুবা গ্রুপের এই 'অসততার' কারণে নিঃস্ব হওয়ার পথে সিমকো গ্রুপ। অগ্নিকাণ্ডে প্রাণহানির ঘটনার পর ওয়ালমার্ট তাদের সরবরাহকারী সাকসেস অ্যাপারেলের সব অর্ডার বাতিল করেছে।
বহু কারখানা আছে, যেগুলো সরাসরি পোশাক রপ্তানি করে না বলে সংশ্লিষ্ট সংগঠন থেকে কাঁচামাল ব্যবহারের সনদ নিতে হয়, যা ইউটিলাইজেশন ডিক্লারেশন বা ইউডি নামে পরিচিত। তাই সংগঠনে সদস্যপদ থাকা বা না থাকা কাজ চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধা সৃষ্টি করে না। কমপ্লায়েন্সের শর্ত পূরণেরও কোনো বাধ্যবাধকতা থাকে না এ ক্ষেত্রে।
বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটির নির্বাহী পরিচালক কল্পনা আক্তার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'স্মার্ট এক্সপোর্ট নামের পোশাক কারখানাটিতে ইনডিটেক্সের দুই ব্র্যান্ডের লোগো পাওয়া গেছে। তবে তারা ওই কাজ বাংলাদেশের কোন কারখানা থেকে এনেছিল, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এভাবে একটি অনুমোদনহীন কারখানায় কাজ আনা সম্পূর্ণ বেআইনি।' তিনি বলেন, এমন কারখানার সংখ্যা কত, তা নিশ্চিত নয়। তবে মোট কারখানার ২০-৩০ শতাংশের কম নয়।
এসব কারখানায় সরকারি তদারকি নেই বললেই চলে। কারখানা পরিদর্শন কর্তৃপক্ষ একটি দুর্বল প্রতিষ্ঠান। এর ঢাকা অঞ্চলে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণী মিলিয়ে ৪৯ জন কর্মী কাজ করেন। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, ঢাকা অঞ্চলে নিবন্ধিত বিভিন্ন ধরনের ১৮ হাজার কারখানা আছে। মাসে ১০টি কারখানা পরিদর্শন ও আনুষঙ্গিক কাজ করলে একটি কারখানায় দ্বিতীয়বার পরিদর্শনে আসতে সময় লাগবে তিন বছর।
বিজিএমইএর সহসভাপতি সিদ্দিকুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা অনেক দিন আগে থেকেই বলে আসছি, তাদের বাধ্যতামূলকভাবে বিজিএমইএর সদস্য করা হোক। তারা কোনো কমপ্লায়েন্সের শর্ত মানবে না, আইন মানবে না, আর তাদের কারণে পুরো পোশাক খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে- এটা হতে পারে না। এসব কারখানা শনাক্ত করে সদস্য করতে বাধ্য করা হোক।' তিনি আরো বলেন, বিজিএমইএর সদস্য না হলেও কারখানায় শ্রমিক কাজ করলেই কিছু আইন মানতে হয়। যেখানে জীবন আছে, তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা মালিকের দায়িত্ব। সরকারের দায়িত্ব তাদের তদারক করা।
বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ কালের কণ্ঠকে বলেন, বিজিএমইএর সদস্য নয়- এমন কারখানার সংখ্যা ৭০০-৮০০টি হতে পারে। কিভাবে ট্রেড লাইসেন্স পেল, কারখানা নির্মাণের লাইসেন্স পেল- তা খতিয়ে দেখে এগুলো বন্ধ করে দেওয়া উচিত।
একটি কারখানায় শ্রমবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য সরকারি ও বেসরকারি ১১টি সংস্থা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কাজ করে। এ ছাড়া রয়েছে বেশ কিছু আইন। বাণিজ্য সংগঠনের সদস্য হোক বা না হোক, কমপ্লায়েন্স হোক না হোক, আইন মানতে হবে সবাইকে। কিন্তু বাস্তব অবস্থা হচ্ছে, ওই সব আইন মানার কোনো বালাই নেই কারখানাগুলোর।
যেসব সংস্থা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শ্রমবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে জড়িত- সেগুলো হলো কারখানা পরিদর্শন কর্তৃপক্ষ, অগ্নিনির্বাপণ কর্তৃপক্ষ, জমি রেজিস্ট্রেশন কর্তৃপক্ষ, পরিবেশ অধিদপ্তর, বয়লার লাইসেন্স কর্তৃপক্ষ, ইনস্যুরেন্স কম্পানি, রপ্তানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, বিনিয়োগ বোর্ড, রেজিস্টার অব জয়েন্ট স্টক কম্পানিজ, আমদানি রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ ও মালিকদের সংগঠন।
ফায়ার প্রিভেনশন অ্যান্ড ফায়ার ফাইটিং ল' ২০০৩ অনুযায়ী, ছাড়পত্র ছাড়া কোনো কারখানা করা যাবে না। কিন্তু ওই কারখানাটি এত দিন ধরে যে চালু আছে, সেদিকে কারো নজর ছিল না। এমন আরো অনেক কারখানা আছে। আইন অনুযায়ী কোনো মালিক একটি ভবন অনুমোদন ছাড়া কারখানা হিসেবে ব্যবহার করলে তিন বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
ফায়ার সার্ভিসের সম্প্রতি নিয়োগ পাওয়া মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমেদ খান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ওই কারখানাটি নিয়ে তদন্ত চলছে। আজকালের মধ্যে রিপোর্ট পাওয়া যাবে। তবে আমরা শুনেছি কারখানাটির লাইসেন্স ছিল না।'
জেনারেল আলী আহমেদ খান বলেন, 'তাজরীনের ঘটনার পর ফায়ার সার্ভিস দল গঠন করে জরিপ চালানো হয়। ওই এলাকার জরিপের সময় কারখানাটি তালিকায় ছিল না। সেটি সম্ভবত পাঁচ-ছয় মাস আগে হয়েছে। তবে আমাদের জরিপে সব কারখানাই আসবে। বিভিন্ন জেলা থেকে জনবল এনে কাজ করানো হচ্ছে।'
নতুন অস্ত্র পেল যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপ
তাজরীনে আগুন লেগে ১১২ শ্রমিকের প্রাণহানির পর সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করেছিল ওয়ালমার্ট। ভয়াবহ এ দুর্ঘটনার পর ইউরোপ-আমেরিকা জুড়ে শ্রম অধিকার সংগঠনগুলোর চাপে সেসব দেশের সরকারও উদ্বেগ প্রকাশ করায় নড়েচড়ে বসেছিল সরকার ও পোশাক কারখানা মালিকদের সংগঠন। দুই মাসের মাথায় খোদ রাজধানীর বুকে আরেকটি অগ্নিকাণ্ডে সাত শ্রমিকের প্রাণহানি প্রমাণ করল, বৈশ্বিক ব্র্যান্ড, ক্রেতা দেশগুলোর সরকার ও অধিকার সংগঠনগুলোর উদ্বেগ বা সতর্কবাণী আমলে নেননি পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা। অনুমোদনহীন কারখানা থেকে পোশাক তৈরি করিয়ে নেওয়া অব্যাহত রেখেছেন তাঁরা। সরকারও এতে খুব একটা গা করছে না।
স্মার্ট এক্সপোর্ট ফ্যাক্টরির মতো রাজধানীর আবাসিক এলাকার দু-একটা ফ্লোর ভাড়া নিয়ে অথবা ছোট একটা জমিতে ৭০-৮০টি মেশিন নিয়ে গড়ে উঠেছে বহু কারখানা। এসব কারখানায় শ্রম আইনের কোনো বালাই নেই। সরাসরি রপ্তানিতে জড়িত নয় বলে এদের ওপর ক্রেতাদের চাপও নেই। বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর সদস্য নয় বলে সামান্য বাধ্যবাধকতাটুকুও মানে না তারা। কিন্তু এসব কারখানায় তৈরি হওয়া পোশাক যায় ইউরোপ ও আমেরিকায়। এদের প্রচলিত নাম সাব-কনট্রাক্ট ফ্যাক্টরি। এদের সংখ্যা কত তা জানা নেই কারো। তবে ধারণা করা হয়, এ সংখ্যা ৭০০-৮০০ হবে।
এসব কারখানা টিকে আছে কমপ্লায়েন্ট কারখানাগুলোর আশীর্বাদেই। নিজেদের একটি কারখানাকে কমপ্লায়েন্ট দেখিয়ে অনেক বড় কাজ বাগিয়ে নেয় তারা। পরে ওই সব কাজের ভাগ দেওয়া হয় এসব ছোট কারখানায়। পোশাক তৈরি না করেই অর্ডার এনে হাতিয়ে নেওয়া হয় বড় অঙ্কের টাকা। একটি কারখানা অন্য কারখানায় কাজ নিলে বন্ড ট্রান্সফার করতে হয়। অথচ এসব কারখানায় কাজ যাচ্ছে বন্ড ট্রান্সফার না করেই।
বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী জানান, এক কারখানা থেকে অন্য কারখানায় কাজ নিতে হলে ইন্টার বন্ড করতে হবে। ইন্টার বন্ডের অনুমতি দেয় বিজিএমইএ। ইন্টার বন্ডে কারখানার নাম, কাজের পরিমাণ, খরচ, কাঁচামালের পরিমাণ ইত্যাদি উল্লেখ থাকে। রাস্তায় কাস্টম বা পুলিশ ধরলে ওই ইন্টার বন্ড দেখানো হলে তারা ছেড়ে দেয়। ইন্টার বন্ড হতে হয় বিজিএমইএর সদস্য কারখানাগুলোর মধ্যে। কিন্তু কোনো বন্ডের ধার না ধেরেই কাজ নেওয়া হয় অনুমোদনহীন, নন-কমপ্লায়েন্ট কারখানাগুলোতে।
এ রকম অনুমোদনহীন কাজের ঘটনা ঘটেছিল তাজরীন ফ্যাশনসে। যেখানে আগুন লেগে গত ২৪ নভেম্বর ১১২ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়। যার কারণে দেশের পোশাক খাত ইউরোপে শুল্কমুক্ত সুবিধা হারানোর ঝুঁকিতে পড়েছে। তাজরীনের মালিকের প্রতিষ্ঠান তুবা গ্রুপ কাজ পেয়েছিল সিমকো নামের একটি কারখানা থেকে। সিমকো সাকসেস অ্যাপারেলের কাছ থেকে যে কাজ পায়, তার ৭ শতাংশ সরবরাহ করে তুবা গ্রুপকে। তুবা গ্রুপ ওয়ালমার্টের 'ইয়েলো রেটেড' কারখানা। কিন্তু তুবা গ্রুপ 'না জানিয়ে' ওই কাজের একটি অংশ সরিয়ে তাদের অন্য কারখানা তাজরীন ফ্যাশনসে নিয়ে যায়। তুবা গ্রুপের এই 'অসততার' কারণে নিঃস্ব হওয়ার পথে সিমকো গ্রুপ। অগ্নিকাণ্ডে প্রাণহানির ঘটনার পর ওয়ালমার্ট তাদের সরবরাহকারী সাকসেস অ্যাপারেলের সব অর্ডার বাতিল করেছে।
বহু কারখানা আছে, যেগুলো সরাসরি পোশাক রপ্তানি করে না বলে সংশ্লিষ্ট সংগঠন থেকে কাঁচামাল ব্যবহারের সনদ নিতে হয়, যা ইউটিলাইজেশন ডিক্লারেশন বা ইউডি নামে পরিচিত। তাই সংগঠনে সদস্যপদ থাকা বা না থাকা কাজ চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধা সৃষ্টি করে না। কমপ্লায়েন্সের শর্ত পূরণেরও কোনো বাধ্যবাধকতা থাকে না এ ক্ষেত্রে।
বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটির নির্বাহী পরিচালক কল্পনা আক্তার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'স্মার্ট এক্সপোর্ট নামের পোশাক কারখানাটিতে ইনডিটেক্সের দুই ব্র্যান্ডের লোগো পাওয়া গেছে। তবে তারা ওই কাজ বাংলাদেশের কোন কারখানা থেকে এনেছিল, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এভাবে একটি অনুমোদনহীন কারখানায় কাজ আনা সম্পূর্ণ বেআইনি।' তিনি বলেন, এমন কারখানার সংখ্যা কত, তা নিশ্চিত নয়। তবে মোট কারখানার ২০-৩০ শতাংশের কম নয়।
এসব কারখানায় সরকারি তদারকি নেই বললেই চলে। কারখানা পরিদর্শন কর্তৃপক্ষ একটি দুর্বল প্রতিষ্ঠান। এর ঢাকা অঞ্চলে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণী মিলিয়ে ৪৯ জন কর্মী কাজ করেন। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, ঢাকা অঞ্চলে নিবন্ধিত বিভিন্ন ধরনের ১৮ হাজার কারখানা আছে। মাসে ১০টি কারখানা পরিদর্শন ও আনুষঙ্গিক কাজ করলে একটি কারখানায় দ্বিতীয়বার পরিদর্শনে আসতে সময় লাগবে তিন বছর।
বিজিএমইএর সহসভাপতি সিদ্দিকুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা অনেক দিন আগে থেকেই বলে আসছি, তাদের বাধ্যতামূলকভাবে বিজিএমইএর সদস্য করা হোক। তারা কোনো কমপ্লায়েন্সের শর্ত মানবে না, আইন মানবে না, আর তাদের কারণে পুরো পোশাক খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে- এটা হতে পারে না। এসব কারখানা শনাক্ত করে সদস্য করতে বাধ্য করা হোক।' তিনি আরো বলেন, বিজিএমইএর সদস্য না হলেও কারখানায় শ্রমিক কাজ করলেই কিছু আইন মানতে হয়। যেখানে জীবন আছে, তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা মালিকের দায়িত্ব। সরকারের দায়িত্ব তাদের তদারক করা।
বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ কালের কণ্ঠকে বলেন, বিজিএমইএর সদস্য নয়- এমন কারখানার সংখ্যা ৭০০-৮০০টি হতে পারে। কিভাবে ট্রেড লাইসেন্স পেল, কারখানা নির্মাণের লাইসেন্স পেল- তা খতিয়ে দেখে এগুলো বন্ধ করে দেওয়া উচিত।
একটি কারখানায় শ্রমবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য সরকারি ও বেসরকারি ১১টি সংস্থা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কাজ করে। এ ছাড়া রয়েছে বেশ কিছু আইন। বাণিজ্য সংগঠনের সদস্য হোক বা না হোক, কমপ্লায়েন্স হোক না হোক, আইন মানতে হবে সবাইকে। কিন্তু বাস্তব অবস্থা হচ্ছে, ওই সব আইন মানার কোনো বালাই নেই কারখানাগুলোর।
যেসব সংস্থা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শ্রমবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে জড়িত- সেগুলো হলো কারখানা পরিদর্শন কর্তৃপক্ষ, অগ্নিনির্বাপণ কর্তৃপক্ষ, জমি রেজিস্ট্রেশন কর্তৃপক্ষ, পরিবেশ অধিদপ্তর, বয়লার লাইসেন্স কর্তৃপক্ষ, ইনস্যুরেন্স কম্পানি, রপ্তানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, বিনিয়োগ বোর্ড, রেজিস্টার অব জয়েন্ট স্টক কম্পানিজ, আমদানি রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ ও মালিকদের সংগঠন।
ফায়ার প্রিভেনশন অ্যান্ড ফায়ার ফাইটিং ল' ২০০৩ অনুযায়ী, ছাড়পত্র ছাড়া কোনো কারখানা করা যাবে না। কিন্তু ওই কারখানাটি এত দিন ধরে যে চালু আছে, সেদিকে কারো নজর ছিল না। এমন আরো অনেক কারখানা আছে। আইন অনুযায়ী কোনো মালিক একটি ভবন অনুমোদন ছাড়া কারখানা হিসেবে ব্যবহার করলে তিন বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
ফায়ার সার্ভিসের সম্প্রতি নিয়োগ পাওয়া মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমেদ খান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ওই কারখানাটি নিয়ে তদন্ত চলছে। আজকালের মধ্যে রিপোর্ট পাওয়া যাবে। তবে আমরা শুনেছি কারখানাটির লাইসেন্স ছিল না।'
জেনারেল আলী আহমেদ খান বলেন, 'তাজরীনের ঘটনার পর ফায়ার সার্ভিস দল গঠন করে জরিপ চালানো হয়। ওই এলাকার জরিপের সময় কারখানাটি তালিকায় ছিল না। সেটি সম্ভবত পাঁচ-ছয় মাস আগে হয়েছে। তবে আমাদের জরিপে সব কারখানাই আসবে। বিভিন্ন জেলা থেকে জনবল এনে কাজ করানো হচ্ছে।'
নতুন অস্ত্র পেল যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপ
No comments