নতুন মুদ্রানীতিতে জিইডির ৮ পরামর্শ by হামিদ-উজ-জামান মামুন
নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংককে আট বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছে সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি)। আগামী ৩০ জানুয়ারি ২০১৩ সালের ষান্মাসিক মুদ্রানীতি ঘোষণা প্রেক্ষিতে সরকারের অর্থনৈতিক থিঙ্কট্যাংক হিসেবে খ্যাত সংস্থাটির সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে এসব পরামর্শের বিষয় তুলে ধরা হয়েছে।
এ বিষয়ে জিইডির সদস্য ড. শামসুল আলম জনকণ্ঠকে বলেন, দ্রুত দারিদ্র্য নিরসন, মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার জন্য চলতি বছরে ৭ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাওয়া, না সামগ্রিক চাহিদা নিবৃত করে সঙ্কোচনমূলক মুদ্রা ও রাজস্বনীতি দ্বারা মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার চেষ্টা করা হবে, এ বিষয়ে কিছু মতামত দেয়া হয়েছে এ প্রতিবেদনে। তিনি বলেন, এক সময় পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য, বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নিং বডির একজন সদস্য থকতেন, জিইডির কার্যপরিধির মধ্যে এখনও তা উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে রাখা হয়নি। তারপরও সামগ্রিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনায় মুদ্রানীতির একটি কার্যকর ভূমিকা রয়েছে। তাই এসব পরামর্শ সময়োপযোগী বলেই ভাবছি।মুদ্রানীতি বিষয়ে দেয়া পরামর্শগুলো হচ্ছে প্রথমত, প্রবৃদ্ধির হার পুনরায় নির্ধারণ করতে পারে। কেননা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার হবে ৬ দশমিক ১ থেকে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। নিম্নমুখী এ হার নির্ধারণের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, এটি বিগত এক দশকের গড় প্রবৃদ্ধি হারের মধ্যেই থাকছে। জিইডির মতে, প্রবৃদ্ধির এ হারে সান্ত¡Íনা খুঁজে পাওয়া যায় না। গত দু’বছর বাদ দিলে বলা যায়, বাকি সময়টা (২০০১-২০০৯) পরিকল্পনাবিহীন সময়। পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ফিরে এসে এবং একটি ভাল পরিকল্পনা প্রণয়নের পরও যদি প্রবৃদ্ধির হার, পরিকল্পনাবিহীন সময়ের মতোই হয়, তাহলে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তাই বাংলাদেশ ব্যাংক প্রবৃদ্ধির হার পুনর্নির্ধারণের পূর্বে বিষয়টি ভেবে দেখবে।
দ্বিতীয়ত, এবারের মুদ্রানীতি কিছুটা হলেও সঙ্কোচনমূলক হতে হবে। কেননা যেহেতু মূল্যস্ফীতি বাড়তে দেয়া যাবে না।
তৃতীয়ত, যেহেতু অধিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যকে সমর্থন দিতে হবে, তাই বেসরকারী খাতে ঋণ প্রবাহ কমানো যাবে না, বরং ঋণ প্রবাহের বৃদ্ধি ১৭ থেকে ১৯ শতাংশ পর্যন্ত করা যেতে পারে। এর মধ্যে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে ও কৃষি খাতে অবশ্যই ঋণের প্রবাহ কমানো যাবে না।
চতুর্থত, অধিক ব্যাংক রিজার্ভ থেকেও দেশে মূল্যস্ফীতির কারণ ঘটাতে পারে। সে কারণে বৈদেশিক রিজার্ভ থেকে বিনিয়োগ আয় বাড়ানোর চেষ্টা নিতে হবে।
পঞ্চমত, আমাদের রফতানি খাত উজ্জীবিত রাখতে, (উচ্চ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যে) অধিক রেমিটেন্স প্রাপ্তির প্রণোদনা অব্যাহত রাখতে, রফতানি মূল্য প্রতিযোগিতায় ভারতের সঙ্গে যেন পিছিয়ে না পড়ি, সে কারণে টাকার মূল্য বৃদ্ধি পেতে দেয়া ঠিক হবে না। অন্তত স্থিতিশীল মুদ্রাহার (ডলারে ৮০-৮১ টাকা) যেন বজায় থাকে এ বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
ষষ্ঠত, দেশের প্রবৃদ্ধি অর্জনের স্বার্থে আর একটি বিষয় গুরুত্ব দিতে হবে তা হচ্ছে, বিনিয়োগের সুদের হার কমিয়ে আনার কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া।
সপ্তমত, বাংলাদেশ ব্যাংককে পূর্বের মতোই অনুৎপাদনশীল খাতে ঋণ কমিয়ে আনা এবং বিলাসী পণ্য আমদানি নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা অব্যাহত রাখতে হবে।
অষ্টমত, আমরা চাই উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জনের সব প্রচেষ্টাই অব্যাহত থাকুক এবং সেই সঙ্গে মূল্যস্ফীতি যেন অন্তত ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে না যায় সে বিষয়ে মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতি বাস্তবায়ন ও পরিচালনা করা হবে। প্রবৃদ্ধির জন্যই অভ্যন্তরীণ অর্থ বাজারে যেন তারল্য সঙ্কট সৃষ্টি না হয়, সঙ্কোচনমূলক মুদ্রানীতি বাস্তবায়নকালে সেটিও লক্ষ্য রাখতে হবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আর্থিক বাস্তবতায় উচ্চ প্রবৃদ্ধি না না মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, কোনটা দরকার। সমস্যাটা হলো, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বেশি জোর দিলে (সঙ্কোচনমূলক মুদ্রানীতি) প্রবৃদ্ধির হার কমে আসে। বর্তমান সরকার চার বছর পূর্বে দায়িত্ব প্রাপ্ত হলে দারিদ্র্য নিরসনে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনই তাদের পরিকল্পনায় উন্নয়নের প্রধাণ কৌশল হিসেবে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা গৃহীত হয়। স্বল্পোন্নত দেশে দারিদ্র্য নিরসনে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনই বড় নিয়ামক। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এ কথা সত্য। বাংলাদেশে মাথাপিছু ১ শতাংশ আয় বৃদ্ধি হওয়া মানে শূন্য দশমিক ৮৯ শতাংশ দারিদ্র্য কমে যাওয়া। এক শতাংশ দেশজ প্রবৃদ্ধি হওয়া মানে ২ লাখ পঞ্চাশ হাজার নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হওয়া। এসব বিবেচনায় ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় যথাযথভাবেই উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জনকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
অন্যদিকে প্রবৃদ্ধি অর্জনের জোর প্রচেষ্টা, ২০১০ ও ২০১১ আর্থিক বছরে ব্যারেলপ্রতি জ্বালানি তেল ও খাদ্য পণ্যের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধিতে, বাংলাদেশের সাধারণ মূল্যস্ফীতি ২০১১ আর্থিক বছরে দুই অঙ্কের ঘরে (১২ দশমিক ৫১ শতাংশ) উন্নীত হয়। ওই সময়ে ভারত ও চীনসহ উন্নয়নশীল অনেক দেশেই মূল্যস্ফীতি প্রথমবারের মতো দুই অঙ্কের ঘরে পৌঁছে যায়। আর্থিক বছর ২০১২-এর শেষার্ধ থেকে অবশ্য মূল্যস্ফীতি কমতে থাকে, তবে তখনও বাংলাদেশে সাধারণ গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৫৬ শতাংশ, যা ২০১০ অর্থবছরে ছিল ১০ দশমিক ১৭ শতাংশ। ২০১২তে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় যদিও মূল্যস্ফীতির প্রাক্কলন করা হয়েছিল ৭ দশমিক ৫ শতাংশ এবং চলতি বছরে ৭ শতাংশ। তার মানে মূল্যস্ফীতি এখনও প্রত্যাশার বাইরেই রয়েছে।
No comments