তবু মাথা নোয়াতে হয় by অনন্ত সুমন
বাবা শখ করে নাম রেখেছিলেন ময়না। ময়না পাখির মত যখন আমার মুখে কথা ফোটে তখনকার কথা আমার বেশ মনে আছে। বাবা আমাকে কাঁধে নিয়ে হাটে যেতেন। গরম জিলাপি কিনে দিতেন।
চুল বাধার ফিতা, লিপস্টিক, চুড়ি আরো কতো কি। বাবা আমার ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলার কথা শুনে কত আনন্দ পেতেন। আমার কথা শোনার জন্যই বাবা আমাকে সব সময় কাছে কাছে রাখতেন। বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে আমাদের অনেক গরম্ন ছিল তখন। দুধ হত, ধান, পাট, সরিষা আরো কত কী। আমি ছিলাম বাড়ির একমাত্র সনত্মান। কার আদর নেব দাদা-দাদী, বাবা-মা, চাচা-চাচী। এর পর আমার ভাইয়ের জন্ম হল, একজন-দুইজন। এর পর থেকে আমার আদর একটু একটু কমতে শুরু করল। কিংবা আদর ভাগাভাগি হয়ে যাবার কারণে কম আদর পেতাম হয়ত।এরপর চোখ কাপড় গুজে কিছুণ চুপ করে থাকে ময়না। জানতে চাই এর পর কি হল। ময়না আবার বলতে শুরু করল। এর পর শুধু ইতিহাস। তখন হাইস্কুলে পড়ি, অল্প কিছুদিনের মধ্যে আমাদের সব জমি জমা নদিগর্ভে চলে গেল। আমরা কোন রকমে পাশের থানায় আমাদের এক আত্মিয়ের বাসায় উঠলাম। দুশ্চিনত্মায় কিছুদিন যেতেই বাবার প্যারালাইসিস হল। আমরা কখনো মানুষের বাড়ি কাজ করিনি। আমার ভাইরাও তাই। কাজ করব কোন কারনে আমাদের বাড়িতেই তো মানুষজন কাজ করত। সেই আত্মিয় আর কতদিন আমাদের ফ্রি খাওয়াবে। আমরা চলে এলাম ঢাকায়। কাউকে চিনি না। এক রিক্সাঅলা আমাদের নিয়ে গেল ঢাকার আগারগাঁও বসত্মিতে। এরপর তিনি তার মেয়ের সাথে আমাকে মিরপুরের একটি গার্মেন্টেসে চাকুরীতে পাঠল। আর ভাইরা প্রথমে গ্যারেজে কাজ করছিল। কিছুদিন যেতেই তারা বিয়ে করে ফেলল। এর পর যখন ভাইদের বউ এল তখন বাড়িতে অশানত্মির আগুন জ্বলতে থাকল। এর পর ভাইরা একে একে আমাদের ছেড়ে চলে গেল। কিন্তু আমি যেতে পারলাম না আমার বাবা-মা'কে ফেলে। আমি এ বাবা মাকে কোথায় ফেলে যাব। তারা কি খাবে। কোথায় থাকবে। এসব চিনত্মা করে আমি সে চাকরী করে যাচ্ছি। হাড় ভাঙ্গা খাটুনীর পর মাস শেষে সামান্য যে টাকা পাই তা দিয়ে কোন রকমে বাবা-মায়ের ওষুধ কিনে তাদের মুখে সামান্য কিছু খাবার তুলে দিতে পারছি, এই আল্লাহ্র কাছে শুকরিয়া।
বয়সতো অনেক হল বিয়েশাদী করবেন না! জানতে চাইলে তিনি মৃদু হাসেন ময়না। সে হাসির ভিতরে যে কার প্রতি ঘৃণা ছড়ানো ছিল তা এ যেন স্পষ্ট দেখা গেল। ময়না বলল, আমার মত কত মেয়ে যে বিয়ে না করে কাটিয়ে দিচ্ছে। তাদের মত না হয় আমিও দেব।
হাজেরা খাতুন গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মাওনাতে একটি গার্মেন্সে চাকরি করেন। আইলাতে তার সবকিছু তছনছ হয়ে গেছে। স্বামীও মারা গেছে আইলাতে। শুধু তিনি তার দুই সনত্মান ও শ্বাশুড়ি বেঁচে আছেন। হাজেরা খাতুনের দিনটা শুরু হয় এভাবে, সারারাত কাজ শেষে সকাল ছয়টায় বাসায় ফিরে নিজের সনত্মান ও শ্বাশুড়ির জন্য সকালের খাবার তৈরি করতে হয়। এরপর ছুটতে হয় কিছুদূরের মেসে। সেখানে তেরজন সদস্যের ভাত রান্না তুলে দিয়ে ঘরদোর সব পরিষ্কার করতে হয়। সেখানে যখন খাবার প্রায় হয়ে আসে তখন আবার পাশের ভবনে একটা পরিবারে ঢুকতে হয়। সেখানকার ঘরদোর পরিষ্কার করতে করতে মেসের খাবার তৈরি হয়ে গেলে সেখানকার থালাবাসন ধুয়ে আবার সে বাড়িতে এসে খাবার তৈরির আয়োজন করতে হয়। হাজেরার কথা শুনতে যতোটা সহজ মনে হল কিন্তু কাজটা করা মোটেই সহজ নয়, যখন জানা গেল তিন বাড়ির এসব কাজ করতে হয় মাত্র তিন ঘন্টা সময়ের মধ্যে। অথর্্যৎ সকাল নয়টার আগে সবাইকে খাবার দেয়া চাই। এপর সে বাড়ির কাপড়চোপড় কাঁচা এবং অন্যান্য কাজ করতে এগারটার মত বাজে। তখন আবার মেচের এবং সে বাড়িতে রান্নার আয়োজন করতে হয়। দুই জায়গার রান্না সারতে সারতে আড়াইটা বেজে যায়। বাড়ি ফিরতে ফিরতে তিনটা। গোসল সেরে নিজের খাবার খেয়ে এরপর তিন ঘন্টার এক ঘুম। ঘুম থেকে উঠে আবার মেচের রান্না, বাসার রান্না এবং নিজের রান্না শেষ করে রাত নয়টার মধ্যে আবার ছুটতে হয় গার্মেন্সের চাকুরীতে। সময়মতো পৌঁছুতে না পারলে চলে মানসিক নির্যাতন, বেতন কাটার সমস্যা। এরপর রাত্রি নয়টা থেকে সকাল ছয়টা পর্যনত্ম ঠাঁয় দাড়িয়ে গার্মেন্সের কাজ করতে হয় তাকে। সাকাল থেকে আবার চলে বাসাবাড়িতে কাজ।
প্রিয় পাঠক যারা হাজেরার দিন-রাত্রীর রম্নটিনটা আরেকটু সহজ করে দিচ্ছি। গ্রামের একজন সহজ সরল মেয়ে যে কখনো শহরের গাড়ি দেখেনি, দালান কোটা দেখেনি, পাকা সড়ক দেখেনি, বিদু্যতের বাতি দেখেনি সেই হাজেরা শহরে এসে ছোট ছোট তিন সনত্মান ও অসুস্থ শ্বাশুড়ির দায়িত্ব নিয়ে উপার্যন করতে হচ্ছে। সনত্মান শ্বাশুড়িকে অনত্মত তিনবেলা খাবার দেবার চেষ্টা করলেও নিজে দিনে খায় মাত্র দুইবার। হাজেরা সারা দিন-রাতে ঘুমায় মাত্র তিন থেকে সাড়ে তিন ঘন্টা। আর সারা রাত গার্মেন্সে কাজ করে আসার পর দিনের বেলা যে মেসটি এবং বাড়িতে কাজ করে সেখান থেকে তাকে খাবার দেয়া হয় না। কত মাছ, কত মাংস, কত রকম সবজি তাকে প্রতিদিন রান্না করতে হয় নাক দিয়ে শুকতে হয়, কিন্তু সেগুলো খাবার অনুমতি তার নেই।
তাতে হাজেরার আফসোস নাই। সে বলে আমার ওসব ভাল ভাল খাবারের প্রয়োজন নাই। আমি কখনো ওসব খাবারের লোভ করি না। চাকরিটা নিয়ে আমার বড্ড ভয়। যদি চাকরিটা চলে যায়, তবে আমার মাসুম বাচ্চা আর বৃদ্ধা শ্বাশুড়িকে নিয়ে কোথায় যাব বলেন। আমার যে আর যাবার জায়গা নাই। হাজেরাকে প্রশ্ন করি এইযে দুইবেলা খান, দিনে রাতে তিন ঘন্টা ঘুমান এতে শরীর যদি অসুস্থ হয়ে যায় তখন কি করবেন। হাজেরা এ কথার উত্তর না দিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে। কিছু পর বলে জানিনা কী হবে। একবার পেটে ব্যথা হল প্রচন্ড, লাভলীরা নিয়ে গেল সরকারী হাসপাতালে, কি কি টেস্ট করে ডাক্তার বলল কিডনিতে সমস্যা। হাজেরার সাথে আর কথা হল না। তিনিই কথা বললেন না, চোখে শাড়ির আঁচল চেপে দ্রুত হাটা ধরল রাসত্মা ধরে।
জুলেখার বাড়ি নাটোরের বড়াইগ্রামে। ঢাকায় এসেছে প্রায় চার বছর। জুলেখারা দুই বোন থাকে একসাথে। একই গার্মেন্সে কাজ করে। থাকে আজিমপুরে। জুলেখা বলল, 'চার বছর আগে বিয়ে হয় প্রেম করে। আমার বাবার যে ভিটাটুকুছাড়া আর কিছু নাই এটা সে জানত। সে সবকিছু মেনে নিয়েই আমাকে বিয়ে করে। বিয়ের ঠিক সতের দিন পর এক সকালে আমার শ্বাশুড়ি জানাল 'ছেলের জন্য লাখ টাকা, ঘর সাজানোর জিনিসপত্রসহ কতশত জিনিস দিয়ে কত বিয়ে এল। কিন্তু ছেলে করল না। তোমাকে বিয়ে করে ছেলে আমার কি পেল শুনি। শোন মেয়ে যদি সংসার করতে চাও তবে ছেলের জন্য কম করে এক লাখ টাকা আনা চাই। যাও আজই বাপের বাড়ি যাও। গিয়ে টাকার ব্যবস্থা করে তারপর ফিরবে।' আমি ভেবেছিলাম এটা হয়ত কথার কথা। স্বামীকে বললে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু যখন ওকে বললাম তখন সে বলে, 'বিয়েতে তো জামাইকে কিছু দেয়া চাই। কিন্তু তোমার বাবা তো কিছুই দিল না। কিছু না দিলে তো আর মান-সম্মান থাকে না। মা যা বলেছেন এরপর আমার আর কোন কথা থাকে না। যাও, তোমার বাবাকে গিয়ে টাকার ব্যবস্থা করতে বল।' এ কথা শুনে আমি চুপ করে ছিলাম। আমি বাবার বাড়ি যাচ্ছি না বলে মা ছেলে মিলে আমাকে খারাপ ভাষায় কথা বলতে থাকল। আমি এর প্রতিবাদ করতেই সেই মানুষটি যাকে আমি আমার জীবনের একটি অংশ মনে করতাম, এত এত ভালোবাসতাম সেই মানুষটি আমাকে কাঠের খড়ি দিয়ে এমন করে পেটাতে থাকল। আমার গা খড়ির আঘাতে ছিলে রক্ত পড়তে থাকল। কিন্তু আমার মনে সে রক্তরণের ব্যথ্যা একটুও লাগল না। আমার অনত্মরে তখন রক্তরণ হতে থাকল। মাত্র কদিন আগে যে মানুষটি আমার জন্য সব ছাড়তে পারে, সব কিছু করতে পারে বলত। সেই মানুষটি আমাকে এমনভাবে মারতে পারে !
তারপর আর সহ্য করতে পারিনি। চলে এসেছি বাবার বাড়ি। টাকার কথা বাবার কাছে বলতে পারিনি। বলব কি ভাবে বিভিন্ন এনজিওর কাছে ঋণ আছে অনেক টাকা। সে টাকা পরিশোধ করতেই বৃদ্ধ বাবাকে বয়সে কত কষ্ট করতে হয়। ঠিক এক মাস ১৩ দিন পর শুনি সে মানুষটি বিয়ে করেছে। হঁ্যা পেয়েছেও এক লাখ টাকা, ঘর সাজানোর আসবাবপত্র। আমি আর প্রতিবাদ করিনি। কারণ, এ সমাজে আমাদের মত দিনহীন দরিদ্রদের বিয়ে করার যোগ্যতা নেই। যে সমাজে জামাই শ্বাশুড় বাড়ি থেকে যৌতুক না পেলে মান-সম্মান থাকে না, সে সমাজে আমরা বিয়ের কথা মুখে আনি কীভাবে। এরপর আমার এ ছোট বোনও বিয়ে করতে সাহস পায়নি।
এখন আমরা যা কিছু আয় করি তা থেকে অধিকাংশই দিতে হয় বাড়িতে। বাড়িতে অসুস্থ বাবা মা'র খাবার ওষুধের টাকা দিতে হয়। এনজিওর অনেক টাকা ঋণ রয়েছে সেগুলো পরিশোধ করার চেষ্টা করছি। সেগুলো পরিশোধ হয়ে গেলেই কিছু টাকা জমা করে বাড়ি গিয়ে ব্যবসা করব। এরপর গ্রামের মানুষদের জামা শেলাই করব, এইতো আর কটা দিন। কারো দয়া বা করুণা নিয়ে বাঁচতে চাইনা। নিজের পায়ে দাড়াতে চাই। দু'টো শেলাই মেশিন কিনব দুই বোন। আপনার কথা শুনে মনে হল পড়ালেখা আছে আপনার, কতদূর করেছেন! এই এসএসসি পাশ করেছি।
শিরোনাম দেখে অনেকেরই হয়তো কপাল কুঁচকে, গেছে। কিন্তু এই প্রত্যেকটা গার্মেন্টস কমর্ীরই আছে এমন একটা করে গল্প। অতি দরিদ্র পরিবারের কিছু মানুষ আসে এ কাজ করতে। দিন রাত কাজ করে পায় সামান্য কিছু অর্থ। যা দেড় হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকার মধ্যে। এ অর্থ দিয়ে নিজের পরিধেয়, খাবার, বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে হয়, এরপর আবার গ্রামের বাড়িতে পরিজনের জন্য পাঠাতে হয়। কিন্তু গার্মেন্টস মালিকরা কোটি কোটি ডলার আয় করলেও এসব কর্মীদের বেতন ভাতা বাড়ানোর প্রশ্নে সবসময় নিরব। এ বেতনের সামান্য কটা টাকা আবার রাখে বাঁকি। এসব কমর্ীদের কার দিনে দুইবেলা খাবার জোটে। নারী গার্মেন্টস কমর্ীরা দিনরাত সবসময় নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। বিশেষ করে রাতের শিফটে কাজ করতে গেলে রাসত্মা ঘাটে প্রতিদিন তাদের উত্যক্ত করে বখাটেরা। প্রকাশ্যে হাত ধরে টানাটানি করে। এমন কি জোর করে ধরে নিয়ে যায় সবার মাঝ থেকে। এমন ঘটনা প্রায়ই বিভিন্ন পত্রিকায় এলেও কোন ব্যবস্থা নেয়ার হয় না। তাদের নিরাপত্তায় উদাসিন থাকে নিরাপত্তাদাতারা।
গার্মেন্টস কমর্ীদের নিয়ে ভাবার সময় কই আমাদের সামাজের কর্তাদের। গার্মেন্টস কর্মী মানেই সমাজের যে কয়েকটি নিচু শ্রেণীর জাত আছে তাদের মধ্যে একটি, এমনটিই ভাবনা আমাদের। তাদের শরীরে কঠিন অসুখ থাকতেই পারে। তারা একবেলা না খেয়ে থাকতেই পারে। দিনে-রাতে দু'চার ঘন্টার বেশি ঘুমানোর দরকার নেই তাদের। এমন হাজার হাজার বা লাখ লাখ মেয়ে যৌতুকের অভাবে বিয়ে না করে কাটিয়ে দিতেই পারে।
দেশের সর্ববৃহৎ রপ্তানিখাতের কমর্ীদের নিয়ে আমাদের যদি হয় এমনটি ভাবনা, আর কমর্ীদের এমন গল্প যদি চলতেই থাকে তবে তাদের রক্তঝরা শ্রমের ফসল বিদেশে প্রতি বছর মিলিয়ন বিলিয়ন ডলার মূল্যের পোশাক রপ্তানি করার কতটা স্বার্থকতা থাকে।
No comments