প্রতিক্রিয়া- অভিমানি পরী একটি স্মৃতিচারণ
গত শুক্রবার ৭ ফাল্গুন ১৪১৬ বঙ্গাব্দের দৈনিক জনকণ্ঠের পাতা উল্টাতেই পৃষ্ঠা ১০-এর অপরাজিতা বিভাগে আমার জানামতে প্রথম পূর্ব বাঙালী মহিলা ভাস্কর নভেরা আহমেদকে নিয়ে মিলু শামসের লেখা 'অভিমানী পরী' শিরোনামের নাতিদীর্ঘ নিবন্ধনটি পাঠ করে শুধুমাত্র অভিভূতই হইনি, সেই সঙ্গে ফিরে গেছি বহু পেছনে ফেলে আসা আমার যৌবনের উষালগ্নে।
দুই. সম্ভবত ১৯৬০-৬১'র মধ্যভাগে হঠাৎ করেই একদিন তৎকালীন পাবলিক লাইব্রেরী কম্পাউন্ডে (যা বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় লাইব্রেরীর অংশ) দেখলাম একটি সুন্দর ভাস্কর্য স্থাপিত হয়েছে। যার রঙ ছিল 'হোয়াইট বাট নেয়ার ক্রিম কালার।' আমি সে সময় নটর ডেম কলেজে ইন্টারমিডিয়েট কাসের ছাত্র (বর্তমানে এইচএসসি)। বাইসাইকেলই ছিল সে সময় স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের চলাচলের বাহন। এমনকি সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রী সালোয়ার-কামিজ পরে বেইলী রোড থেকে পুরাতন বিশ্ববিদ্যালয় ভবনে বাইসাইকেলে চড়ে কাসে আসা-যাওয়া করতেন বলে শুনেছিলাম। ঢাকা-ময়মনসিংহ রেললাইনের পশ্চিমস্থ হাতিরপুল এলাকায় অবস্থিত আমার পিত্রালয় থেকে মতিঝিলস্থ নটর ডেম কলেজে যাতায়াতের সোজা পথ ছিল মিন্টো রোড-বেইলী রোড-শানত্মিনগর হয়ে ইনার সাকর্ুলার রোড অর্থাৎ বর্তমান কাকরাইল-নয়াপল্টন-ফকিরাপুল বাজার রোড ধরেই এগিয়ে যাওয়া। কিন্তু আমরা সে সময় বাহাদুরি দেখাবার জন্য একেকদিন একেক পথ ধরে যত বেশি ঘুরে কলেজে যাতায়াত করা যায় তারই মকশ করতাম। যার ফলে উত্তর-দৰিণে বিসত্মৃত তৎকালীন ময়মনসিংহ রোড (যা বর্তমানে জাতীয় জাদুঘর-কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরী-টিএসসি- বাংলা একাডেমীর পূর্ব পাশ্বর্ে প্রসারিত) দিয়েও প্রতি সপ্তাহে দু'-তিন দিন যাতায়াত করতাম। এ পথে আমাদের চলাচলের মূল আকর্ষণ ছিল মূলত দু'টি। এক, সদ্যনির্মিত ইস্ট পাকিসত্মান কলেজ অব আর্টস এ্যান্ড ক্র্যাফ্টস (যার বর্তমান নাম আর্টস ইন্সটিটু্যট) এবং দুই, পাবলিক লাইব্রেরী ভবন। সনাতন পদ্ধতির বাইরে ভিনদেশী স্টাইলে রেডব্রিক দিয়ে তৈরি ভবন দু'টি সে সময় অনেকের মতো আমাদেরও আকর্ষণ করত। এছাড়াও প্রতিষ্ঠান দু'টিতে বিভিন্ন অনুষ্ঠান ছাড়াও আর্টস কলেজের ছাত্রছাত্রীদের নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠিত হতো চিত্র প্রদর্শনী। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ছিলেন সে সময় কলেজটির প্রিন্সিপাল। চিত্রকলা ও অঙ্কনে অসাধারণ অবদানের জন্য ১৯৫৮ সালে তাঁকে দশ হাজার টাকার 'মনিটারি এ্যাওয়ার্ড'সহ 'প্রেসিডেন্টস মেডাল ফর প্রাইড অব পারফরমেন্স অব পাকিসত্মান'-এ ভূষিত করা হয়। এর পাশাপাশি ঐ একই বছরে তাঁকে পাকিসত্মানের দ্বিতীয় শীর্ষ সিভিল ক্যাটাগরির 'হিলাল-ই-ইমতিয়াজ' খেতাবেও ভূষিত করা হয়, যা ছিল বাঙালীদের জন্য এক বিরল সম্মান।তিন.
যা হোক, এর মাঝেই একদিন দেখলাম পাবলিক লাইবেরী প্রাঙ্গণে পূর্বদিকের দেয়াল ঘেঁষে একটি স্কাল্পচার (ঝপঁষঢ়ঃঁৎব) বা ভাস্কর্য। তুমুল আলোড়ন সৃষ্টিকারী এই ভাস্কর্যটিকে সে সময় 'মূর্তি' বলে আখ্যায়িত করল সমাজের রৰণশীল একটি অংশ। অনেকে আবার বলে বসলেন, 'নাউজুবিলস্নাহ।' ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিসত্মানে এ কী অনাচার? যখন জানা গেল এটির নির্মাতা একজন মহিলা, তখন সবার মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ার মতো অবস্থা। অবশ্যি দিনকয়েক পরেই আমরা জানতে পারলাম এই ভাস্কর্যবিদের নাম নভেরা আহমেদ। সুদূর প্যারিস নিবাসী হলেও তিনি বঙ্গললনা এবং চট্টগ্রামের কন্যা। স্বাভাবিকভাবেই আমরা তাঁকে দেখতে এবং তাঁর পরিচয় জানতে আগ্রহী হয়ে উঠলাম।
চার.
হঠাৎ করেই দিনদুই পরে কলেজ করিডোরে আড্ডারত অবস্থায় চট্টগ্রাম নিবাসী আমাদের এক সতীর্থ আবু তাহের জানাল যে, নভেরা আহমেদ শুধুমাত্র চট্টগ্রাম নিবাসীই নন, বরং তাঁর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। আমরা আনন্দে শুধুমাত্র হৈহৈ রৈরৈ করেই উঠলাম না, দাবি করলাম এই আর্টিস্টের সাথে আমাদের দেখা করিয়ে দিতে হবে। কিন্তু বন্ধুবর আবু তাহের (বর্তমানে প্রফেসর ড. আবু তাহের এবং নিউইয়র্কের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিৰক) আমাদের জানাল যে, নভেরা আহমেদ দিন দুই আগেই ঢাকা ত্যাগ করেছেন।
পাঁচ.
দুর্ভাগ্য আমাদের। এতবড় একজন শিল্পী-ভাস্কর্যবিদের সাৰাত আমরা পেলাম না। আজ জীবনসায়াহ্নে এসে মিলু শামসের লেখাটি আমাকে বারংবার মনে করিয়ে দিচ্ছে জাতীয় কবি কাজী নজরম্নল ইসলামের বিখ্যাত গানের সেই কলি_ 'অতীত দিনের স্মৃতি, কেউ ভোলে না কেউ ভোলে।'
মোহাম্মদ আফজাল হোসেন খোকা
পরিচালক (অব.) পলস্নী বিদু্যতায়ন বোর্ড
No comments