মুক্ত প্রাণের আভা বিজয়ের নতুন স্বাদ
দীর্ঘ ৪১ বছর অপেক্ষার পর মুক্ত প্রাণের আভায় প্রজন্মের এগিয়ে চলার নতুন পথ তৈরি হলো নতুন বছর ২০১৩ সালের ২১ জানুয়ারির দিনটি। এই মাইলফলক বাঙালী জাতির ওপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসা ৭১-এর মানবাধিকার অপরাধ সৃষ্টিকারীদের একে একে অপসারিত করে প্রজন্মের কাছে দায়মুক্ত করবে।
’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর যারা বিজয় দেখে নি সেই প্রজন্ম বিজয়ের স্বাদ নিতে শুরু করেছে। ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলার ফুলবাড়িয়া গ্রামের জ্যোৎস্না বিশ্বাস ১২ বছর আগে বলেছিলেন, ‘বাচ্চু রাজাকারের বিচার কেউ করলে মরেও শান্তি পেতাম।’ একই উপজেলার দাদপুর, যদুনন্দী ইউনিয়নের খাড়দিয়া, সোনাপুর, সালথা, কাগদি, বিষ্ণুদি, মাঝারদিয়া, যোগারদিয়া, উজিরপুর, পিসনাইল, কাসাইদিয়া, রাজনগর, পুরুরা, বোয়ালমারি উপজেলার ময়েনদিয়া, শ্রীনগর, হাসামদিয়া, রাজাপুর, রাজাবিনী, হোগলাকান্দি, কালিনগর, কলারন, জয়পাশা, তেলজুড়ি, পরমেশ্বরী, ডহরনগর, তামারাজি. মোড়া, নতিবদিয়া, আলফাডাঙ্গা এবং কাশিয়ানী উপজেলার কয়েকটি গ্রামসহ ৫০ গ্রামে হত্যা ধর্ষণ ও আগুন লাগিয়ে ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয় বাচ্চু রাজাকার ও তাঁর সন্ত্রাসী বাহিনী। ওই গ্রামগুলোর প্রবীণরা নীরব সাক্ষী হয়ে আছেন। এতকাল তাঁদের একটাই প্রশ্ন ছিল ‘অসংখ্য মা বোনের সম্ভ্রম লুটেরা, নরঘাতক তথাকথিত ‘মাওলানা’ আবুল কালাম আজাদ ওরফে খারদিয়ার বাচ্চু রাজাকারের বিচার কি হবে না! অনেক প্রবীণ বিচার দেখার অপেক্ষা করে পরলোকগমন করেছেন। অনেকেই মনে করেছিল ‘রাজাকারদের বিচার দেখে যেতে পারবেন না।’ সোমবারের দিনটি তাদের কাছে তো সেই কাক্সিক্ষত বিজয়ের দিনই, সারাদেশের মানুষের কাছে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার পাওয়ার প্রত্যাশা পূরণের দিন। বর্তমান প্রজন্মের কাছে কলঙ্কমুক্ত পথে এগিয়ে চলার দিনের শুরু। এই দিনে বগুড়ার প্রবীণ ব্যক্তি মুক্তিযোদ্ধা, প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তা খন্দকার গোলাম কাদের (৯০) বললেন, ‘আমার এই দীর্ঘদিন বেঁচে থাকা সার্থক। সেই ৪১ বছর আগে বিজয়ের দিনে মুক্ত দেশের মাটিতে পা ফেলে যে মুক্ত শ্বাস নিতে পেরেছিলাম, প্রজন্মের কাছে দায়মুক্ত করার যে অবশিষ্ট কাজ বাকি ছিল আজ তার পূর্ণতা পাওয়ার পথ তৈরি হলো। আজকের দিনে প্রাণ খুলে তরুণ প্রজন্মেকে বলতে ইচ্ছে করছে তোমাদের জন্য নিস্কন্টক পথ তৈরি হলো। আমরা সেই পথ দেখে গেলাম।’ কথাগুলো বলার সময় তাঁর চোখের কোণে বয়ে এলো আনন্দের দু’ ফোটা জল। মুছে নিয়ে বললেন, ‘লিখে দিও এই প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধার কথা সরকার যেন বাকি কাজ সমাপ্ত করে। ৪১ বছরে যে পরিবর্তন আসেনি, সেই পরিবর্তন যখন এলো তা রক্ষার দায়িত্বভারও নিতে হবে। পরিবর্তনের প্রজন্ম সঙ্গেই আছে।’ বগুড়ার আরেক প্রবীণ ব্যক্তি মুক্তিযোদ্ধা মাহফুজুল বারী (৯১) বললেন, ‘জীবনে সাধ ছিল রাজাকারদের বিচার যেন দেখে যেতে পারি। তবেই সার্থক হবে জন্ম। আজ সত্যিই জন্ম সার্থক। এই বাচ্চু রাজাকার যখন টেলিভিশনের পর্দায় আসত তখন থুথু ছিটিয়েছি। কিভাবে এই নরঘাতককে টিভি কর্তৃপক্ষ স্থান করে দিত তা ভাবতেও ঘৃণা হয়।’ তিনি বললেন, ‘লিখে দাও একজন প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধা আজ মুক্তিযুদ্ধে মহাবিজয়ের স্বাদ পেয়েছে।’ মুক্তিযোদ্ধা বগুড়া সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের আহ্বায়ক মাসুদার রহমান হেলাল বললেন, ‘আমি ফরিদপুরের গ্রামের সেইসব মানুষের আনন্দের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করছি যাঁরা এবং যাঁদের স্বজনরা বাচ্চু রাজাকারের হাতে নির্মমভাবে নির্যাতিত হয়েছেন। দীর্ঘকাল পর সেই রাজাকারের মৃত্যুদন্ডাদেশ জাতিকে কালিমামুক্ত করে প্রজন্মের চলার পথের জঞ্জাল অপসারণের কাজ শুরু করেছে।’ বগুড়ার সোনাতলার প্রবীণ ব্যক্তি শামসুজ্জোহা মনি (৮৪) বললেন, ‘কেউ কিছু মানল কি না মানল সেটা বড় কথা নয়। সেটাই বড় যা প্রকৃতি থেকে আসে। প্রকৃতির বিচার হবেই হবে, তা যে ভাবেই হোক। বাচ্চু রাজাকারসহ সকল রাজাকার যে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে তাদের বিচারের পালা শুরু হলো। বাচ্চু রাজাকারের বিচারের রায় প্রমাণ করল প্রকৃতি ঠিকই বিচার করে তা দীর্ঘ সময় পরে হলেও। আজ প্রজন্মের কাছে আমাদের নতুন পথ উন্মোচনের দিন। মুক্ত প্রাণের আভায় ওদের পথ চলা শুরু হোক। যে আভা এনে দেবে আগামীর সুন্দর দিন। আমরা থাকব না। ওরা জেনে যাবে পূর্বসূরিরা মসৃণ পথ তৈরি করে গিয়েছে। উত্তরসূরিরা এই পথেই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।’ আরেক প্রবীণ ব্যক্তি আব্দুল জলিল বললেন, এত দুঃখকষ্টের মধ্যেও বাঙালীর অর্জন কম নয়। যে জাতি মুক্তিযুদ্ধ করে বিজয় অর্জন করেছে সে জাতিকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না। রবীন্দ্রনাথের কথায় বলতে হয়, ‘দুঃখের তিমিরে যদি জ্বলে তব মঙ্গল আলোক তবে তাই হোক....।’
No comments