ট্রাইব্যুনালের প্রথম রায়ে যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদণ্ড ॥ বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসি- ০ দল হিসেবে জামায়াত যুদ্ধাপরাধ করেছে বলে রায়ে উল্লেখ- ০ জাতির গ্লানি মুক্তির সূত্রপাত by বিকাশ দত্ত
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় পলাতক জামায়াতের সাবেক রুকন বাচ্চু রাজাকার হিসেবে পরিচিত আবুল কালাম আজাদের বিরুদ্ধে আনা আটটি অভিযোগের মধ্যে সাতটিতে অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ঐতিহাসিক আদেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২।
হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ ও লুটপাটের মতো মানবতাবিরোধী অপাধের অভিযোগগুলো প্রমাণিত হয়েছে। এছাড়া রায়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর গণহত্যার প্রত্যক্ষ সহযোগী হিসেবে জামায়াতে ইসলামীকে দায়ী করা হয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত ট্রাইব্যুনালের এটিই প্রথম রায়। চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান শাহীনের নেতৃত্বে তিন সদস্য বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এই আদেশ প্রদান করেন। ট্রাইব্যুনালে অন্য দু’সদস্য ছিলেন বিচারপতি মোঃ মজিবুর রহমান মিয়া ও জেলা জজ মোঃ শাহীনুর ইসলাম।জায়গা সঙ্কুলান না হওয়াতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ সকাল ১০টা ৪৪ মিনিটে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ বসে রায় ঘোষণা করেন। এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের উদ্যোগে ট্রাইব্যুনাল-১-এর এজলাসে বসে রায় ঘোষণা করার ব্যবস্থা করা হয়। সকাল ১০টা ৪৫ মিনিটে চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান শাহীন ভাবগাম্ভীর্য পরিবেশে জনাকীর্ণ আদালতে পিনপতন নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে এই ঐতিহাসিক রায় পড়া শুরু করেন। সকাল ১০টা ৪৫ মিনিটে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান শুরুতেই বলেন. ১১২ পৃষ্ঠার একটি রায় এবং এখানে ৩৩৪টি প্যারা আছে। ১১টা ৫০ মিনিটে সংক্ষিপ্ত রায় পড়া শেষ করেন। রায়ে বলেন, হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ এবং এ ধরনের কাজে সহযোগিতার জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩ অনুসারে আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- ঘোষণা করা হলো। রায়ে আরও বলা হয়, তৃতীয়, চতুর্থ, ষষ্ঠ ও সপ্তম অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় আসামিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ-াদেশ দেয়া হয়েছে। প্রথম, পঞ্চম ও অষ্টম অভিযোগও প্রমাণিত হয়েছে। তবে ইতিমধ্যে মৃত্যুদ-াদেশ দেয়ার কারণে এসব অভিযোগে আলাদা করে কারাদ- দেয়া হচ্ছে না। দ্বিতীয় অভিযোগটি প্রমাণিত হয়নি। তাই ওই অভিযোগ থেকে তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত বাচ্চু রাজাকারের গ্রেফতারের জন্য পুলিশের আইজিপির প্রতিও আদেশ দেয়া হয়েছে। রায় ঘোষণার পর দেশের প্রধান আইন কর্মকর্তা, আইনজীবী প্রসিকিউটর রাজনীতিবিদ ও সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ বলেছেন, এই রায়ের মাধ্যমে দেশ হবে যুদ্ধাপরাধী মুক্ত, জাতি হবে কলঙ্কমুক্ত। বাংলাদেশ নতুন বিজয়ের দিকে এগিয়ে যাবে।
এ রায়ের পর আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহম্মেদ জনকণ্ঠকে বলেছেন, এই রায়ের মাধ্যমে জাতি কলঙ্ক মুক্ত করার জন্য যে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তা শুরু হলো। আপীলের বিষয়ে তিনি বলেন, আজ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে আপীল করতে হবে। এর মধ্যে আপীল না করলে আর আপীল গ্রহণের সুযোগ নেই। তবে আপীল করতে হলে আগে তাকে আত্মসমর্পণ করতে হবে। এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, আজকের এ রায়ের মাধ্যমে আমাদের চেতনার সার্বভৌমত্বের বিজয় অর্জিত হয়েছে। এ বিবেচনায় আজ একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং ঐতিহাসিক দিন। ‘রায় ঘোষণার ৩০ দিনের মধ্যে এ আসামি রায়ের বিরুদ্ধে আত্মসমর্পণপূর্বক জেল আপীল করার সুযোগ পাবেন। এর ব্যত্যয় ঘটলে বিষয়টি সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করবে। সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার এম আমির-উল-ইসলাম বলেন, একাত্তরের যে জঘন্যতম গণহত্যা হয়েছিল তার প্রথম রায়ের মধ্য দিয়ে জাতির ৪২ বছরের গ্লানি মুক্তির সূত্রপাত ঘটেছে আজ। জাতির মৌলিক মূল্যবোধ পুনর্¯’াপন করার পথে এক ধাপ এগিয়ে গেছে। কোন অপরাধী আইনের উর্ধে থাকবে না। যুদ্ধের সময় যারা নির্যাতিত তাদের অনেকে জীবিত নেই। এ রায়ের মাধ্যমে তাদের আত্মা স্বস্তি ও শান্তি পাবে। এটা প্রতিশোধমূলক নয়, তবে এটা প্রতিষেধকমূলক। এর মাধ্যমে বিভিন্ন অপরাধ প্রশমিত হবে।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সহ সভাপতি অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, বাচ্চু রাজাকারকে দেয়া ফাঁসির রায় সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের কাছে মাইলফলক হয়ে থাকবে। কবি সুফিয়া কামাল, শহীদ জননী জাহানারা ইমাম, অধ্যাপক কবীর চৌধুরীসহ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গত ৪০ বছর ধরে যারা এই আন্দোলনকে বিভিন্ন সময় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাদের স্মরণ করে তিনি বলেন, গত ৪০ বছর ধরে যুদ্ধাপরাধী তথা মানবতাবিরোধীদের বিচারের দাবিতে চলমান আন্দোলনের ফসল হচ্ছে আজকের এ রায়।
ট্রাইব্যুনালের চীফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু সাংবাদিকদের বলেন, দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর এ রায়ের মধ্য দিয়ে জাতি কলঙ্কমুক্ত হওয়ার পথ উন্মোচিত হলো। রায়ের দিন হিসেবে আজকের দিনটি বাঙালী জাতির ইতিহাসে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। তদন্ত সংস্থার প্রধান এমএ হান্নান খান বলেছেন, এই রায়ে আমি অত্যন্ত খুশি। এতে প্রমাণিত হয়েছে আমাদের তদন্ত সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ছিল।
সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক শ.ম রেজাউল করিম বলেছেন, ভবিষ্যতে বিচার বিভাগের জন্য এ রায় মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে। ডেপুটি রেজিস্ট্রার (যুগ্ম জেলা জজ) ব্যারিস্টার মেজবাহ উদ্দিন আহম্মেদ বলেছেন, আমি প্রথম ট্রাইব্যুনালে যোগদানের পর বেশিরভাগ দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রারের দািয়ত্ব পালন করেছি। দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালের রায় বাংলাদেশের ইতিহাসে যুগান্তকারী পদক্ষেপ। উল্লেখ্য, ট্রাইব্যুনাল-২ গঠন হওযার পর ব্যারিস্টার মেজবাহ উদ্দিন আহম্মেদ একাই রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব পালন করেন।
কঠোর নিরাপত্তা ॥ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রথম রায় ঘোষণা করা হবে সে জন্য কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়। সকাল থেকে ট্রাইব্যুনালের ভেতর ও বাইরে অতিরিক্ত পুলিশের ব্যবস্থা করা হয়। পুলিশ বিভাগে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাবৃন্দ সকাল থেকে শুরু করে রায় ঘোষণা অব্দি পুরো সময় নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করেন। সকাল ১০টার দিকেও সাংবাদিকদের পাস দেয়া হয়নি। এরপর ডেপুটি রেজিস্ট্রার ব্যারিস্টার মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ ঘটনাস্থলে এসে সাংবাদিকদের ট্রাইব্যুনালে প্রবেশের ব্যবস্থা করেন। সাড়ে ১০টা দিকে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আন্তর্জাতিক অপরাধ-২ জায়গা সঙ্কুলান না হওয়াতে ট্রাইব্যুনাল-১ এজলাসে বসার উদ্যোগ নেন। পরে ঐ এজলাসে বসেই ঐতিহাসিক রায় প্রদান করা হয়।
প্রথম রায় ॥ বিচারাধীন ও তদন্ত অবস্থায় ১৪টি মামলার মধ্যে এই প্রথম বাচ্চু রাজাকার হিসেবে পরিচিত আবুল কালাম আজাদের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করা হলো। জনাকীর্ণ আদালতে রায় ঘোষণার সময় উপস্থিত ছিলেন এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, অতিরিক্ত এ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান, মুরাদ রেজা, মমতাজ উদ্দিন মেহেদী, সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক মমতাজ উদ্দিন মেহেদী, চীফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু, প্রসিকিউটর সৈয়দ রেজাউর রহমান, প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত, প্রসিকিউটর হাযদার আলী, প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম, প্রসিকিউটর এ কেএম সাইফুল ইসলাম, প্রসিকিউটর নুর জাহান মুক্তা, প্রমুখ। এছাড়া ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সহ সভঅপতি অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, সম্পাদক কাজী মুকুল, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি নাসির উদ্দিন ইউসুফ, সাধারণ সম্পাদক হাসান আরিফ প্রমুখ।
রেজিস্ট্রারের ব্রিফিং ॥ বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণার পর ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার একেএম নাসির উদ্দিন মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, মামলাটির বিচারকার্য শেষে পক্ষগণের যুক্তিতর্ক শুনানিশেষে মামলাটির রায় ঘোষণার বিষয়টি অপেক্ষমাণ রাখা হয়েছিল। সোমবার এ রায় ঘোষণার বিষয়ে রবিবারই জানিয়ে দেয়া হয়। এ বিবেচনায় আজ একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং ঐতিহাসিক দিন। তিনি বলেন, ‘রায় ঘোষণার ৩০ দিনের মধ্যে এ আসামি রায়ের বিরুদ্ধে আত্মসমর্পণপূর্বক ’জেল আপীল’ করার সুযোগ পাবে। এর ব্যত্যয় ঘটলে বিষয়টি সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করবে।
মামলার প্রসিকিউটর ॥ বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন পক্ষের প্রসিকিউটর সাহিদুর রহমান বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের রায় ঘোষণা করা হয়েছে। প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে যেসব তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করা হয়েছে, তার ভিত্তিতে বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদ-ের আদেশ দিয়েছে। তিনি বলেন, বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আনীত ৭টি অভিযোগ সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
আসামিপক্ষের আইনজীবী॥ রায় ঘোষণার পর আসামিপক্ষের আইনজীবী (রাষ্ট্র কর্তৃক নিযুক্ত) মোঃ আব্দুস শুকুর বলেন, এই মামলায় উচ্চ আদালতে আপীল করলে সুবিচার পাওয়া যাবে। এখানে আমি সুবিচার পাইনি। আসামিপক্ষ ছাড়া আপীল হয় না। তিনি আরও বলেন সুষ্ঠু বিচার পাইনি। তদন্ত কর্মকর্তা সুষ্ঠুভাবে তদন্ত করেনি। বাচ্চুর পরিবারের পক্ষ থেকে তথ্য-উপাত্ত দিলে ফলাফল অন্য রকম হতো।
বাচ্চু রাজাকারের বিচার কি দ্রুত হয়েছে, এ প্রসঙ্গে আইনজীবী মোঃ আব্দুস শুকুর বলেন, দ্রুত হয়নি। মামলায় প্রসিকিউশন পক্ষে ২২ সাক্ষী প্রদান করেছেন। যে ভাবে মামলা হওয়া উচিত সেভাবেই হয়েছে। তিনি বলেন, আপীল করতে পারব না। আসামি কোথায় আছে তাও বলতে পারব না।
রায়ে যা আছে ॥ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতবিরোধী অপরাধের অভিযোগে পলাতক আসামি বাচ্চু রাজাকার হিসেবে পরিচিত আবুল কালাম আজাদের বিরুদ্ধে রায়ে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় কালে পাকিস্তানী বাহিনীর গণহত্যার প্রত্যক্ষ সহযোগী হিসেবে জামায়াতে ইসলামীকে দায়ী করা হয়েছে। রায়ে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চ লাইটের পরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। ঐ সময় অভিযান চালানো হয়েছিল বাঙালী পুলিশ বাহিনী, সামরিক কর্মকর্তা ও সেনাদের লক্ষ্য করে এবং বাঙালী রাজনীতিবিদ, পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী ও ছাত্রদের হত্যা এবং গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে। জামায়াতের ইসলামী একটি সহযোগী বাহিনী গঠন করে। পাকিস্তান রক্ষার নামে। যা নিরীহ বেসামরিক বাঙালীদের বিরুদ্ধে অভিযানে প্রত্যক্ষভাবে অবদান রাখে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩-এর ৩(২) ধারায় বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধকালে ছয় ধরনের অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ পেশ করে প্রসিকিউশন। অভিযোগগুলো হচ্ছে, গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, আটক রাখা ও নির্যাতন। রায়ে বলা হয়, ১৯৪৭ সালের ৫ মার্চ ফরিদপুরের বড়খাড়দিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণকারী আবুল কালাম আজাদ রাজেন্দ্র কলেজে লেখাপড়া করেন। তিনি জামায়াতের তৎকালীন ছাত্রসংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন। যুদ্ধাপরাধের মামলায় জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মুজাহিদেরও বিচার চলছে।
এর মধ্যে প্রথম, দ্বিতীয় ও অষ্টম অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধকালে অপহরণ, আটক রাখা ও নির্যাতনের অভিযোগ আনা হয়। বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে এ তিনটি অভিযোগের মধ্যে ’৭১’র জুনে রঞ্জিত নাথ ওরফে বাবু নাথকে অপহরণ করে আটক রেখে নির্যাতন, ২৬ জুলাই আবু ইউসুফ ওরফে পাখিকে অপহরণ করে ফরিদপুর স্টেডিয়ামে আটক রেখে নির্যাতন এবং ১৮ মে এক নারীকে আটক রেখে নির্যাতন করার সাক্ষ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করে প্রসিকিউশন। তৃতীয়, চতুর্থ ও ষষ্ঠ অভিযোগে তার বিরুদ্ধে হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়। অভিযোগগুলো হলো, কলারন গ্রামের জমিদার সুধাংশু মোহন রায়, পুরুরা নমপাড়া গ্রামের মাধবচন্দ্র বিশ্বাস ও ফুলবাড়িয়া গ্রামের চিত্তরঞ্জন দাসকে হত্যা। পঞ্চম অভিযোগে বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে নতিবদিয়া গ্রামের দুই নারীকে ধর্ষণের অভিযোগ আনা হয়।
সপ্তম অভিযোগে তার বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ আনা হয়। ’৭১’র ১৭ মে সে ৩০-৩৫ জন সশস্ত্র রাজাকারকে নিয়ে ফরিদপুরের বোয়ালমারী থানার হাসামদিয়া গ্রামের হিন্দুপাড়ায় হামলা চালায়। সেখানে নির্বিচারে গুলি করে শরৎচন্দ্র পোদ্দার, সুরেশ পোদ্দার, শ্যামাপদ পোদ্দার, যতীন্দ্র মোহন সাহা, নীল রতন সমাদ্দার, সুবল কয়াল ও মল্লিক চক্রবর্তীকে হত্যা করে। এর মধ্যে ’৭১’র ২৬ জুলাই আবু ইউসুফ ওরফে পাখিকে অপহরণ করে ফরিদপুর স্টেডিয়ামে আটক রেখে নির্যাতনের অভিযোগে প্রসিকিউশন আনীত চার্জ নং-২ প্রমাণিত না হওয়ায় এই অভিযোগ থেকে বাচ্চু রাজাকারকে অব্যাহতি দেয়া হয়।
গত বছরের ৪ নবেম্বর বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট এ ৮টি ঘটনায় অভিযোগ গঠন করা হয়। এর আগে গতবছর ২৬ জুলাই তদন্ত সংস্থা বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে তদন্ত কাজ শেষ করে তদন্ত প্রতিবেদন প্রসিকিউশনের কাছে জমা দেয়। তার বিরুদ্ধে ১০টি ঘটনায় ২২টি অভিযোগের ভিত্তিতে মোট ৪৪৮ পৃষ্ঠার অভিযোগ দাখিল করা হয়। গত বছর ৭ অক্টোবর ট্রাইব্যুনাল তার অনুপস্থিতিতে বিচার শুরুর আদেশ দিয়ে তার পক্ষে আইনী লড়াই করতে রাষ্ট্রের খরচে মোঃ আব্দুস শুকুর খানকে আইনজীবী হিসেবে (স্টেট ডিফেন্স) নিয়োগ দেয়। ৯ সেপ্টেম্বর বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেয় ট্রাইব্যুনাল।
তার বিরুদ্ধে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের তদন্ত শুরু হয়েছিল ২০১১ সালের ১০ এপ্রিল। গত বছরের ২৫ মার্চ তার বিরুদ্ধে তদন্তের বিষয়টি ট্রাইব্যুনাল-২-এ আনে প্রসিকিউশন। সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে ওই দিন প্রসিকিউশন তাকে গ্রেফতারের আবেদন পেশ করে। ৩ এপ্রিল ট্রাইব্যুনাল তাকে গ্রেফতারের জন্য পরোয়ানা জারি করে। এরপর থেকে সে পলাতক। গত ২৫ সেপ্টেম্বর দুটি জাতীয় দৈনিকে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে তাকে সাত দিনের মধ্যে ট্রাইব্যুনালে হাজির হতে বলা হয়। কিন্তু সে হাজির না হওয়ায় তাকে পলাতক ঘোষণা করা হয় এবং তার অনুপস্থিতিতে বিচার শুরুর আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল।
প্রসিকিউশন ও আসামি উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে গত ২৬ ডিসেম্বর মামলাটি রায় ঘোষণার জন্য অপেক্ষমাণ রাখা হয়। ট্রাইব্যুনালের আদেশে বলা হয়েছিল, রায়ের দু-এক দিন আগে রায়ের তারিখ জানিয়ে দেয়া হবে। সে অনুযায়ী গতকাল রায়ের তারিখ জানিয়ে দেয়া হয়। এ মামলায় আইনী যুক্তি উপস্থাপন করেন প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী। এর আগে বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে জব্দ তালিকার সাক্ষীসহ মোট ২২ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন। রাষ্ট্র নিযুক্ত (ডিফেন্স ল’ইয়ার) আইনজীবী তাদের জেরাও শেষ করেন। তবে আসামিপক্ষের আইনজীবী কোন সাফাই সাক্ষী হাজির করতে পারেননি।
যারা সাক্ষী ॥ বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে সাক্ষীদের মধ্যে ছিলেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) মোঃ নূর হোসেন ও জব্দ তালিকার সাক্ষী বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের (পিআইবি) বুক সর্টার এসএম আমিরুল ইসলাম। ঘটনার সাক্ষীরা হচ্ছেন, নেপাল চন্দ্র পাঠক, বাচ্চু রাজাকারের হাতে শহীদ চিত্তরঞ্জন দাশের স্ত্রী জ্যোৎস্না রানী দাশ, মোঃ মোজাহের সিকদার, মোঃ ধলা মাতুব্বর, রঞ্জিত কুমার নাথ বাবু, শহীদ মাধব বিশ্বাসের পুত্র ভক্ত রঞ্জন বিশ্বাস, মুক্তিযোদ্ধা আমির হোসেন, প্রফুল্ল রঞ্জন ম-ল, নগেন চন্দ্র ম-ল, প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক তুষ্ট কুমার ম-ল, দেব কুমার দাস, রওশন আলী বিশ্বাস, একজন ক্ষতিগ্রস্ত নারী (ক্যামেরা ট্রায়াল), বিনোদ চন্দ্র বিশ্বাস, প্রবোধ কুমার সরকার, আব্দুল মান্নান, শহীদ পরিবারের সদস্য সুশীল কুমার পোদ্দার, আবু ইউসুফ সিদ্দিকী পাখি, সত্য রঞ্জন সাহা এবং অসিত বরণ সাহা। তাদের সবার বাড়ি ফরিদপুর জেলার বিভিন্ন এলাকায়।
বিচারের প্রক্রিয়া ॥ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ গঠনের দুই বছরের মাথায় ২০১২ সালের ২২ মার্চ মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে গঠিত হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। বাচ্চু রাজাকারের মামলাটি দিয়েই শুরু হয় ট্রাইব্যুনাল-২ এর কার্যক্রম।
গত ২৬ নবেম্বর বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে সূচনা বক্তব্য (ওপেনিং স্টেটমেন্ট) উপস্থাপন করে প্রসিকিউশন। ওই দিন থেকে শুরু করে ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের পক্ষে সাক্ষ্যগ্রহণ অব্যাহত থাকে। অপরদিকে আসামিপক্ষ কোন সাফাইসাক্ষী তালিকা দিতে না পারায় বাচ্চু রাজাকারের পক্ষে সাক্ষ্য ছাড়াই যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরুর নির্দেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল। এরপর ২৩, ২৪ ও ২৬ ডিসেম্বর প্রসিকিউশন এবং ২৪ ও ২৬ ডিসেম্বর আসামিপক্ষ যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে।
একই ট্রাইব্যুনালে মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আটককৃতদের মধ্যে গত ১৭ জানুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে মামলাটি যে কোন দিন রায় ঘোষণার জন্য (সিএভি) রাখা হয়েছে। জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলায় ট্রাইব্যুনালÑ১-এ পুনরায় যুক্তিতর্ক চলছে। এরই মধ্যে গত ১৩ জানুয়ারি থেকে তিন কার্যদিবস প্রসিকিউশন যুক্তিতর্ক পেশ করেছে। বর্তমানে আসামিপক্ষ যুক্তিতর্ক করছে। উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে রায়ের তারিখ ধার্য করা হবে।
অন্য মামলা ॥ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতািবরোধী অপরাধের অভিযোগে এ পর্যন্ত ১৪টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে জামায়াতের সাবেক অধ্যাপক গোলাম আযমের মামলায় সাফাই সাক্ষ্যগ্রহণ, বিএনপি নেতা ও সংসদ সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আব্দুল আলীম, জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িতদের বিচারের লক্ষ্যে ২০১০ সালের ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, তদন্তকারী সংস্থা ও আইনজীবী প্যানেল (প্রসিকিউশন) গঠন করা হয়। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার কার্যক্রমকে আরও ত্বরান্বিত করতে চলতি বছরের ২২ মার্চ আরও একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন-১৯৭৩ ও এর অধীনে প্রণীত রুলস অনুযায়ী এ বিচার কার্যক্রম চলছে। এ বিচার কার্যক্রমে প্রসিকিউশন ও আসামিপক্ষ সব ধরনের আইনী সুবিধার মধ্য দিয়ে নিজ নিজ পক্ষে আইনী লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। গণমাধ্যম, বিভিন্ন পর্যবেক্ষকরা এ বিচারিক কার্যক্রম প্রত্যক্ষ করছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশে এ সংক্রান্ত বিচারে আপীলের বিধান না থাকলেও আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন-১৯৭৩-এ আপীলের বিধান রাখা রয়েছে। ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধরা সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগে আপীল দায়েরের আইনী সুযোগ পাবেন।
মামলার কর্যক্রম ॥ বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের তদন্ত শুরু হয় ২০১১ সালের ১০ এপ্রিল। এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নূর হোসেন। ২০১২ সালের ২৫ মার্চ প্রসিকিউশন পক্ষ তদন্তের বিষয়টি ট্রাইব্যুনাল-২-এ আনে এবং ‘সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে’ আজাদকে গ্রেফতারের আবেদন করে।
৩ এপ্রিল ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতারের নির্দেশ ট্রাইব্যুনালের আদেশ। ২৭ জুলাই ২০১২ তদন্ত সংস্থা বাচ্চুর বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন জমা। ২৫ সেপ্টেম্বর ডেইলি স্টার ও দৈনিক জনকণ্ঠে বাচ্চুর বিরুদ্ধে হাজির হওয়ার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ। ২৯ সেপ্টেম্বর অভিযোগ আমলে নেয় ট্রাইব্যুনাল। ৭ অক্টোবর বাচ্চুর অনুপস্থিতিতে বিচার চলবে বলে ট্রাইব্যুনালের আদেশ। ১১ অক্টোবর মামলার নথিপত্র ট্রাইব্যুনালে জমা। ৪ নবেম্বর গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, আটক রাখা, নির্যাতন, দেশান্তর, ধর্মান্তরিত করাসহ বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে ৮টি অভিযোগ গঠন করা হয়। ২৬ নবেম্বর প্রসিকিউশনের সূচনা বক্তব্য পেশ। ২৬ নবেম্বর প্রথম সাক্ষীর জবানবন্দী শুরু। ১৯ ডিসেম্বর তদন্ত কর্মকর্তার জবানবন্দী ও জেরা সমাপ্ত। ২৪ ডিসেম্বর যুক্তিতর্ক শুরু। ২৬ ডিসেম্বর যুক্তিতর্ক শেষ। যে কোন দিন রায়। বাচ্চুর বিরুদ্ধে সর্বমোট ২২ সাক্ষী তাদের সাক্ষ্য প্রদান করেন। মাত্র ৫৩ দিনে মামলার রায় ঘোষণার জন্য সিএভিতে রাখা হয়। অবশেষে ৭৯ দিনে মাথায় সোমবার এই ঐতিহাসিক রায় ঘোষণা করা হয়।
বাচ্চুর বিরুদ্ধে ৮ অভিযোগ ॥ অভিযোগ-১ : ১৯৭১ সালের জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে সকাল অনুমান দশটার সময় রঞ্জিত নাথ ওরফে বাবু নাত ফরিদপুর শহরে আসামি আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকার ও তার সহযোগীরা রঞ্জিত নাথ ওরফে বাবু নাথকে ধরে আটক করে। সেখানে তৎকালীন ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি আলী আহসান মুজাহিদ, বসে ছিল। রাত দুটো-আড়াইটার দিকে জানালার শিক বাঁকা করে রঞ্জিত নাথ ওরফে বাবু নাথ আটক অবস্থা থেকে পালিয়ে আসেন।
অভিযোগ-২ ॥ ২৬ জুলাই আবু ইউসুফ পাখিকে অপহরণ করে নির্যাতন করা হয়। পাখিকে স্থানীয় রাজাকাররা আলফাডাঙ্গা থানা এলাকা থেকে ধরে ফরিদপুর স্টেডিয়ামে পাকিস্তানী আর্মিদের কাছে সোপর্দ করে। সেখানে আবু ইউসুফ পাখিকে বেলা ১১টার দিকে আসামি বাচ্চু ও আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ পাকিস্তানী আর্মি মেজর আকরাম কোরাইশির সঙ্গে মিটিং করতে দেখে। আবু ইউসুফ পাখি স্টেডিয়ামের ভেতরের টর্চার সেলে নির্যাতন হয়ে ১ মাস ১৩ দিন আটক থেকে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
অভিযোগ-৩ : একাত্তরের ১৪ মে বেলা তিনটার দিকে ফরিদপুর জেলার সালথা (সাবেক নগরকান্দা) থানার অন্তর্গত খাড়দিয়া গ্রামের আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু প্রায় ১০-১২ সঙ্গীকে নিয়ে বোয়ালখালী থানার কলারন গ্রামে আক্রমণ করে। সুধাংশু ও তার ছেলে বাড়ির দিকে রওনা হলে বাচ্চুর হাতে থাকা রাইফেল দিয়ে গুলি করে। এ সময় গলিতে শুধাংশু হোমন রায় নিহত হন ও তাঁর ছেলে মারাত্মকভাবে আহত হন।
অভিযোগ-৪ : একাত্তরের ১৬ মে পুরুরা নমপাড়াতে বাচ্চু রাজাকার দলবল নিয়ে আক্রমণ চালায়। গ্রামের মাদব চন্দ্র বিশ্বাসের বাড়িতে প্রবেশ করে তারা লুটপাট চালায়। মাদব চন্দ্র বিশ্বাসের বাড়ি হতে অনুমান ৩০০ গজ পশ্চিমে তুষ্ট কুমার ম-লের বাড়ির পূর্ব পাশে পুকুর পাড়ে নিয়ে বাচ্চু রাজাকার তার হাতে থাকা রাইফেল দিয়ে মাদব বিশ্বাসকে গুলি করে হত্যা করে। বাচ্চু রাজাকারের ভয়ে গ্রাম থেকে ৫-৬ শত হিন্দু ভারতে চলে যেতে বাধ্য হয়।
অভিযোগ-৫ : ১৯৭১ সালের ৮ জুন বোয়ালখালী থানার নতিবদিয়া গ্রামের সুধীর বিশ্বাসের বাড়িতে প্রবেশ করে বাচ্চু রাজাকার। এ সময় ভয়ে গ্রামের মানুষ পালিয়ে পাট ক্ষেতে চলে যায়। ঐ বাড়ির মহিলারা পালানোর সময় বাচ্চু রাজাকার ও তার দলবল দেবী রানী বিশ্বাস ও শোভারানী বিশ্বাসসহ আরও কয়েক মহিলাকে ধরে ফেলে। বাচ্চু রাজাকার ও তার সঙ্গীয় ৪-৫ রাজাকার দেবী রানী ও শোভারানীকে পালাক্রমে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে।
অভিযোগ-৬ : ১৯৭১ সালের ৩ জুন সকাল ১১টায় বাচ্চু রাজাকারের নেতৃত্বে ২০-২৫ রাজাকার বড় বড় দুটি নৌকা নিয়ে নগরকান্দা থানার ফুলবাড়িয়া গ্রামে প্রবেশ করে। এই সময় বাচ্চু রাজাকারসহ তার রাজাকার বাহিনী নিয়ে চিত্ত রঞ্জন দাসের বাড়িতে প্রবেশ করে। তাকে ঘর থেকে টেনেহিঁচড়ে বাইরে এনে রাইফেলের বাঁট দিয়ে পিটিয়ে আহত করে। পরে রশি দিয়ে হাত বেঁধে বাড়ির পূর্ব পাশে পিত্তি গাছের নিচে বাচ্চু রাজাকার তার হাতে থাকা রাইফেল দিয়ে গুলি করে চিত্তরঞ্জনকে হত্যা করে।
অভিযোগ-৭ ॥ ১৯৭১ সালের ১৭ মে সকাল ৬টার দিকে বাচ্চু রাজাকার তার বাহিনী ৩০-৩২ জন পাকিস্তানী সেনা সদস্য বড় নৌকা নিয়ে ফরিদপুর জেলার হাসামদিয়া হিন্দুপাড়ায় প্রবেশ করে। গ্রামে ঢুকেই শরৎ চন্দ্র পোদ্দার, সুরেশ পোদ্দার, শ্যামাপদ সাহা, যতীন্দ্র মোহন সাহা, নীলরতন সমাদ্দারকে গুলি করে হত্যা করে। তারা সুবল কয়াল ও মল্লিক চক্রবর্তীকে গুলি করে হত্যা করে। এরপর বাচ্চু রাজাকার তার দলবল নিয়ে হীরালাল সাহা, সূর্য কুমার, নীল রতন সমাদ্দার ও ডা. ননী গোপাল সাহাদের বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুন দেয়ার আগে বাড়ি থেকে মূল্যবান জিনিসপত্র লুটপাট করা হয়।
অভিযোগ-৮ : বাচ্চু রাজাকার ১৮ মে ফরিদপুর জেলার সালথা থানাধীন উজিরপুর বাজারপাড়া গ্রামে হামলা চালিয়ে গুরুদাশের মেয়ে অঞ্জলী দাশের ওপর অত্যাচার করে। ভয়ে ও সম্ভ্রম রক্ষার্র্থে অঞ্জলী দাশ বিষপানে আত্মহত্যা করে। ঘটনার বিবরণে জানা যায়, সালথা থানার যদুনন্দী ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডে অবস্থিত। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় গুরুদাশ (মৃত), পিতা-মৃত কালা চরণ দাশ তার পারিবার-পরিজন নিয়ে এই গ্রামেই স্থায়ীভাবে বসবাস করতেন। বর্তমানে তার ছেলে দেব কুমার দাসসহ অন্য ছেলেরা পারিবারবর্গ নিয়ে বসবাস করছেন।
১৯৭১ সালে উক্ত বাড়িতে বিল্ডিংসহ এল প্যাটার্ন একটি টিনের ঘর ঐ বাড়িতে ছিল। ১৯৭১ সালের ১৮ মে বিকেল বেলা বাচ্চু রাজাকার ও তার সহযোগী ৭-৮ জন সশস্ত্র রাজাকারসহ গুরু দাশের বাড়িতে আসে। গুরু দাশের বিয়ে উপযুক্ত মেয়ে অঞ্জলী দাশকে (১৮) তাদের অশুভ লালসা চরিতার্থ করার জন্য অপহরণ করে খাড়দিয়া গ্রামের চান কাজীর বাড়িতে নিয়ে আটক করে নির্যাতন করে। ঐ সময় অঞ্জলী দাশ ভয়ে ও সম্ভ্রম রক্ষার্থে তাদের বিল্ডিংয়ে প্রবেশ করে বিষপানে আত্মহত্যা করেন।
No comments