বিচার বিভাগের জন্য মাইলফলক- আইনজ্ঞদের প্রতিক্রিয়া
একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াতে ইসলামীর সাবেক রুকন আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রদানের পর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন দেশের প্রখ্যাত আইনজ্ঞরা।
তাঁরা বলেছেন, একাত্তরের যে জঘন্যতম গণহত্যা হয়েছিল তার প্রথম রায়ের মধ্য দিয়ে জাতির ৪১ বছরের গ্লানি মুক্তির সূত্রপাত ঘটেছে। কোন অপরাধী আইনের উর্ধে থাকবে না তার বার্তা দেয়া হয়েছে। তাঁরা আরও বলেছেন, এ রায় ঘোষণার ফলে জনগণ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছে, জাতি কলঙ্কমুক্ত হয়েছে। জাতির বহুদিনের আকাক্সক্ষার একটা অংশ পূরণ হয়েছে। এ রায় প্রতিশোধমূলক নয়, তবে এটা প্রতিষেধমূলক। ১১২ পৃষ্ঠার এ রায় ভবিষ্যতে বিচার বিভাগের জন্য মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে।বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসির আদেশ প্রদানের পর সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম তাঁর প্রতিক্রিয়ায় জনকণ্ঠকে বলেন, একাত্তরের পৃথিবীর যে জঘন্যতম গণহত্যা, নারী ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছিল তার প্রথম রায়ের মধ্য দিয়ে জাতির ৪১ বছরের গ্লানি মুক্তির সূত্রপাত ঘটেছে আজ। এ রায়ের মাধ্যমে আইনের শাসন নিশ্চিত করা হয়েছে। তিনি বলেন, এ রায়ের ফলে জাতি মৌলিক মূল্যবোধ পুনর্¯’াপন করার পথে এক ধাপ এগিয়ে গেছে। কোন অপরাধী আইনের উর্ধে থাকবে না, এ রায়ের মাধ্যমে এই বার্তাই দেয়া হয়েছে। যুদ্ধের সময় যারা নির্যাতিত তাদের অনেকে জীবিত নেই। এ রায়ের মাধ্যমে তাদের আত্মা স্বস্তি ও শান্তি পাবে।
আমীর-উল ইসলাম বলেন, আমি মনে করি এ বিচার স্বাধীনতার পর পরই না করার ফলে আমাদের দেশে আরও অনেক ছোট আকারের গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে, তার নজির ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে জাতির জনকের বাস ভবনে হত্যাকাণ্ড, ১৯৭৫ সালের ৩ নবেম্বর জাতীয় চার নেতা হত্যাকা- এবং ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা। তিনি বলেন, আমার প্রত্যাশা এই বিচারের মাধ্যমে বিশ্বের কাছে একটা বার্তা পৌঁছে যাবে বাঙালী জাতি সব প্রকার হত্যা, গণহত্যা, নৃশংসতা, ধর্ষণ এবং অগ্নিসংযোগসহ সব অপরাধের বিরুদ্ধে। আমীর-উল ইসলাম বলেন, এ রায় প্রতিশোধমূলক নয়, তবে এটা প্রতিষেধমূলক। এর মাধ্যমে বিভিন্ন অপরাধ প্রশমিত হবে। তিনি আরও বলেন, অতি বড় রকমের একটি কাজ করেছে সরকার। এটা একটি শিক্ষণীয় উদাহরণ। এ রায় প্রদানের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানান এই জ্যেষ্ঠ আইনজীবী।
রায় সম্পর্কে সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক এ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিম জনকণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে এ রায় একটি নতুন ইতিহাসের সূচনা করেছে। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অপরাধের দায় বহন করে চলছিল গোটা জাতি। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মাধ্যমে বিচারপ্রক্রিয়া শুরু এবং একটি মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি আইনের শাসনের জন্য একটি যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত সৃষ্টি হয়েছে।
শ ম রেজাউল বলেন, এ রায়ের মাধ্যমে অনেক আইনগত বিষয়ের যথাযথ ব্যাখ্যা পরিষ্কারভাবে পাওয়া গেছে। প্রথমত, বঙ্গবন্ধু কি একাত্তরের যুদ্ধকালে ঘৃণিত অপরাধ সংগঠনকারীদের ক্ষমা করে ছিলেন? দ্বিতীয়ত, দালাল আইনে কিছু ব্যক্তির বিচার হওয়ার পরে অন্য অপরাধের বিচার করা দ্বৈত বিচার কি না? তৃতীয়ত, যে কোন অপরাধই বিলম্বে হলেও তার বিচার করতে আইনগত কোন বাধা রয়েছে কি না? তিনি বলেন, ঘৃণিত অপরাধীদের বিচার করাটা আইনের ও বিচার বিভাগের স্বার্থেই শুধু নয়, সভ্যতা ও মানবতার স্বার্থেই এ বিচার হওয়া অনিবার্য ছিল।
তিনি আরও বলেন, সর্বোপরি অপরাধ করলে কারওই আত্মরক্ষার সুযোগ থাকে না, দাম্ভিকতা বা ক্ষমতায় আরোহণ করলেও অপরাধের দায় মুক্তি হয় না, এ বিষয়গুলো এ রায়ের মধ্য দিয়েই মীমাংসিত হয়েছে। দেশের মানুষেরই শুধু নয়, শান্তিকামী পৃথিবীর মানুষেরই এই ঘৃণিত অপরাধীদের বিচারের যে প্রত্যাশা ছিল এই রায়ের মধ্য দিয়ে তার প্রতিফলন ঘটেছে। ১১২ পৃষ্ঠার এ রায় ভবিষ্যতে বিচার বিভাগের জন্য পথ নির্দেশক বা মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে বলেও মন্তব্য করেন এই আইনজীবী।
রায় প্রকাশের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, এ রায় ঘোষণার ফলে জনগণ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছে, জাতি কলঙ্কমুক্ত হয়েছে। তিনি বলেন, এ বিজয় ’৭১-এর চেতনার বিজয়, এ বিজয় সার্বভৌমত্বের বিজয়। এ রায় মানবতাবিরোধী অপরাধের বিরুদ্ধে রায়। এর মাধ্যমে সভ্যতাবিরোধী অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে। আবুল কালাম আজাদকে ধরতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলেও জানান এ্যাটর্নি জেনারেল।
No comments