শাহরি রমজান-সিয়াম সাধনায় অদৃশ্যে বিশ্বাসের তাৎপর্য by মুফতি আবদুল ওয়াহিদ কাসেমি
চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের দাবি, অতিরিক্ত খাবার
গ্রহণে মানুষের শরীরে চর্বি বা মেদ বাড়ে। তখন মানুষ অতিরিক্ত মোটা হয়ে পড়ে।
লিভার যন্ত্রের অসুবিধা হয়। ফুসফুসে চাপ পড়ে। শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। কিডনি
ঠিকমতো কাজ করে না।
শরীর থেকে প্রয়োজনীয় বর্জ্য ঠিকমতো
বেরিয়ে যেতে পারে না। কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দেয়। এ বাড়তি মেদ বা চর্বি শরীরের
চর্বিকোষে গিয়ে জমে। পরে খাওয়া কমিয়ে দিলে চর্বি কমলেও চর্বিকোষ আকারে আর
ছোট হয় না। ফলে চামড়া ঝুলে পড়ে। দেখতে বিশ্রী দেখায়। আমরা এখন এসব বিষয়ে
যথেষ্ট সচেতন। তাই এ অসুবিধাগুলো যেন কাবু করতে না পারে সেজন্য আগে থেকেই
প্রতিরোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিৎ। ইসলামের সিয়াম সাধনা তেমনি একটি
শক্তিশালী কার্যকর প্রতিরোধ ব্যবস্থা। সিয়াম পালনের মাধ্যমে এ অসুবিধাগুলো
অনেকাংশে কাটিয়ে ওঠা যায়। তবে সিয়াম পালনের প্রকৃত কারণ এতে নিহিত নয়।
আল্লাহর আদেশ পালন হিসেবে আমরা সিয়াম সাধনা করি। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে,
'হে ইমানদারগণ, তোমাদের ওপর সিয়াম ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল
তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের ওপর; যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার।' (সুরা
বাকারা, আয়াত ১৮৩)
আল্লাহকে আমরা দেখি না। কোরআন শরিফ যে আল্লাহর পবিত্র বাণী, তা অবিশ্বাস করি না। আমরা এ নির্দেশনার ওপর নির্ভর করেই সিয়াম পালন করি। যুক্তি-প্রমাণ খুঁজে বের করায় প্রবৃত্ত না হয়েই তা পালন করি। আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর নির্দেশ অনুযায়ী আমরা অদৃশ্যে বিশ্বাস করি বলেই তা করি। পবিত্র সিয়াম সাধনা ইসলামের কাঙ্ক্ষিত 'ইমান বিল গায়েব' তথা অদৃশ্যে বিশ্বাস নীতি প্রতিষ্ঠিত করতে এক অমোঘ অস্ত্র। সিয়াম আল্লাহর অস্তিত্ব না দেখে বিশ্বাস করার অন্যতম হাতিয়ার। পুরো রমজান মাস অদৃশ্যে বিশ্বাসের অংশ হিসেবেই সিয়াম পালন করি। সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্তের সময় পর্যন্ত আমরা পানাহার ও স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকি। কারণ, আল্লাহ বলেছেন, 'রমজান মাস হলো সে মাস, যাতে নাজিল করা হয়েছে কোরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়েত, সত্যপথযাত্রীদের জন্য সুস্পষ্ট পথনির্দেশ, ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যে পার্থক্য বিধানকারী। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাস পাবে, সে এ মাসের সিয়াম পালন করবে।' (সুরা বাকারা, আয়াত ১৮৫)
'পানাহার কর যতক্ষণ না কালো রেখা থেকে ভোরের শুভ্ররেখা পরিষ্কার দেখা যায়। এরপর সিয়াম পূর্ণ করো রাত পর্যন্ত।' (সুরা বাকারা, আয়াত ১৮৭)। আমরা ভোরের শুভ্ররেখা দেখা যাওয়ার সময় থেকে রাতের আগমন বার্তা বহনকারী সন্ধ্যা পর্যন্ত সিয়াম পূর্ণ করি। এ সময় ক্ষুধায় প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়, তবু আমরা কিছু খাই না। তৃষ্ণায় ছাতি ফেটে যাওয়ার জোগাড় হয়, হাতের কাছে পর্যাপ্ত ঠাণ্ডা পানীয় থাকা সত্ত্বেও স্পর্শ করি না। লোকজনের সামনে শুধু নয়, একদম নির্জনে একাকি অবস্থায়ও কোনো খাদ্য বা পানীয় গ্রহণ থেকে দিনভর বিরত থাকি। সম্পূর্ণ স্বাধীন থেকেও আমরা এমন সাধনা করে থাকি। কারণ, আমরা বিশ্বাস করি, কেউ না দেখলেও আল্লাহ আমাদের দেখছেন। তিনি আমাদের সঙ্গেই আছেন। তিনিই সর্বদ্রষ্টা। তিনি আমাদের পানাহার করা বা না করার সব বিষয় দেখছেন। এ বিশ্বাস অন্তরে দৃঢ় হয়ে আছে বলেই পানাহার করি না। সুযোগ পেয়েও করি না। কেউ আপ্যায়ন করলে এমনকি জোর করলেও তা গ্রহণ করি না। এই আমাদের ইমান; এ বিশ্বাস অদৃশ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। চিরসত্য এ বিশ্বাস বুকে আছে বলেই আল্লাহকে হাজির-নাজির দেখতে পাই। তাঁকে খুব কাছে অনুভব করি। তাঁর সান্নিধ্য অন্তরে-অস্তিত্বে কাঁপন জাগায়। তাঁর দয়া, স্নেহ, করুণা অনুপ্রাণিত করে। বুকে শক্তি জোগায়। ক্ষুধা-তৃষ্ণা কাবু করলেও সহ্য করি। সব কষ্ট ভুলে থাকি। এক মাস সিয়াম সাধনার অগ্নিপরীক্ষার ভেতর দিয়ে আমাদের বিশ্বাস ও অনুভবে আল্লাহর অস্তিত্ব এবং নৈকট্য বাস্তবে রূপলাভ করে।
সিয়াম সাধনার বড় মাধ্যম পানাহার ত্যাগ করা হলেও এটিই সব নয়। রোজাদারের সারা শরীর সিয়াম সাধনায় যুক্ত হয়ে উপকৃত হয়। রমজানে আল্লাহর ভয়ে মানুষ বৈধ যৌনকর্ম থেকেও বিরত থাকে। হাত, পা, চোখ, কানসহ সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সব অপকর্ম থেকে বিরত থাকে। জিহ্বা মিথ্যা ও গিবত থেকে মুক্ত থাকে। রাসুলে কারিম (সা.) বলেছেন, সিয়াম ঢালস্বরূপ, যতক্ষণ না সিয়াম পালনকারী তা ছিদ্র করে। (নাসায়ি শরিফ)। একজনের প্রশ্নের জবাবে নবীজি (সা.) বললেন, 'তা ছিদ্র হয় মিথ্যা ও গিবতের দ্বারা।' তাই কোনো সিয়াম পালনকারী মিথ্যা বলতে পারে না। কারো গিবত করতে পারে না। নিষিদ্ধ বিষয়ে তার দৃষ্টি পড়ে না। তার কান অন্যায় কিছু শোনে না। কেউ তার সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হতে চাইলে তাকে বলতে বলা হয়েছে, 'আমি সিয়াম পালনকারী।' এর সব কিছুই সে অদৃশ্যে বিশ্বাস স্থাপন করে বলেই করে। সিয়াম পালনকারী বিশ্বাস করে, পাপ-পুণ্যের পাশাপাশি মৃত্যুর পর তাকে জবাবদিহি করতে হবে। বিশ্বাস করে, সিয়াম পালন করলে পাপসমূহ মাফ হয়ে যায়। সিয়ামের প্রত্যেক অনুষঙ্গই অদৃশ্যে বিশ্বাসের একেকটি জ্বলন্ত নজির। সিয়াম সাধনা বান্দার ইমান শুদ্ধ ও বলিষ্ঠকরণের শ্রেষ্ঠ কষ্টিপাথর।
লেখক : প্রিন্সিপাল ও শায়খুল হাদিস, জামিয়া ইমদাদিয়া দারুল উলুম, মুসলিম বাজার, মিরপুর, ঢাকা
আল্লাহকে আমরা দেখি না। কোরআন শরিফ যে আল্লাহর পবিত্র বাণী, তা অবিশ্বাস করি না। আমরা এ নির্দেশনার ওপর নির্ভর করেই সিয়াম পালন করি। যুক্তি-প্রমাণ খুঁজে বের করায় প্রবৃত্ত না হয়েই তা পালন করি। আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর নির্দেশ অনুযায়ী আমরা অদৃশ্যে বিশ্বাস করি বলেই তা করি। পবিত্র সিয়াম সাধনা ইসলামের কাঙ্ক্ষিত 'ইমান বিল গায়েব' তথা অদৃশ্যে বিশ্বাস নীতি প্রতিষ্ঠিত করতে এক অমোঘ অস্ত্র। সিয়াম আল্লাহর অস্তিত্ব না দেখে বিশ্বাস করার অন্যতম হাতিয়ার। পুরো রমজান মাস অদৃশ্যে বিশ্বাসের অংশ হিসেবেই সিয়াম পালন করি। সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্তের সময় পর্যন্ত আমরা পানাহার ও স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকি। কারণ, আল্লাহ বলেছেন, 'রমজান মাস হলো সে মাস, যাতে নাজিল করা হয়েছে কোরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়েত, সত্যপথযাত্রীদের জন্য সুস্পষ্ট পথনির্দেশ, ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যে পার্থক্য বিধানকারী। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাস পাবে, সে এ মাসের সিয়াম পালন করবে।' (সুরা বাকারা, আয়াত ১৮৫)
'পানাহার কর যতক্ষণ না কালো রেখা থেকে ভোরের শুভ্ররেখা পরিষ্কার দেখা যায়। এরপর সিয়াম পূর্ণ করো রাত পর্যন্ত।' (সুরা বাকারা, আয়াত ১৮৭)। আমরা ভোরের শুভ্ররেখা দেখা যাওয়ার সময় থেকে রাতের আগমন বার্তা বহনকারী সন্ধ্যা পর্যন্ত সিয়াম পূর্ণ করি। এ সময় ক্ষুধায় প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়, তবু আমরা কিছু খাই না। তৃষ্ণায় ছাতি ফেটে যাওয়ার জোগাড় হয়, হাতের কাছে পর্যাপ্ত ঠাণ্ডা পানীয় থাকা সত্ত্বেও স্পর্শ করি না। লোকজনের সামনে শুধু নয়, একদম নির্জনে একাকি অবস্থায়ও কোনো খাদ্য বা পানীয় গ্রহণ থেকে দিনভর বিরত থাকি। সম্পূর্ণ স্বাধীন থেকেও আমরা এমন সাধনা করে থাকি। কারণ, আমরা বিশ্বাস করি, কেউ না দেখলেও আল্লাহ আমাদের দেখছেন। তিনি আমাদের সঙ্গেই আছেন। তিনিই সর্বদ্রষ্টা। তিনি আমাদের পানাহার করা বা না করার সব বিষয় দেখছেন। এ বিশ্বাস অন্তরে দৃঢ় হয়ে আছে বলেই পানাহার করি না। সুযোগ পেয়েও করি না। কেউ আপ্যায়ন করলে এমনকি জোর করলেও তা গ্রহণ করি না। এই আমাদের ইমান; এ বিশ্বাস অদৃশ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। চিরসত্য এ বিশ্বাস বুকে আছে বলেই আল্লাহকে হাজির-নাজির দেখতে পাই। তাঁকে খুব কাছে অনুভব করি। তাঁর সান্নিধ্য অন্তরে-অস্তিত্বে কাঁপন জাগায়। তাঁর দয়া, স্নেহ, করুণা অনুপ্রাণিত করে। বুকে শক্তি জোগায়। ক্ষুধা-তৃষ্ণা কাবু করলেও সহ্য করি। সব কষ্ট ভুলে থাকি। এক মাস সিয়াম সাধনার অগ্নিপরীক্ষার ভেতর দিয়ে আমাদের বিশ্বাস ও অনুভবে আল্লাহর অস্তিত্ব এবং নৈকট্য বাস্তবে রূপলাভ করে।
সিয়াম সাধনার বড় মাধ্যম পানাহার ত্যাগ করা হলেও এটিই সব নয়। রোজাদারের সারা শরীর সিয়াম সাধনায় যুক্ত হয়ে উপকৃত হয়। রমজানে আল্লাহর ভয়ে মানুষ বৈধ যৌনকর্ম থেকেও বিরত থাকে। হাত, পা, চোখ, কানসহ সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সব অপকর্ম থেকে বিরত থাকে। জিহ্বা মিথ্যা ও গিবত থেকে মুক্ত থাকে। রাসুলে কারিম (সা.) বলেছেন, সিয়াম ঢালস্বরূপ, যতক্ষণ না সিয়াম পালনকারী তা ছিদ্র করে। (নাসায়ি শরিফ)। একজনের প্রশ্নের জবাবে নবীজি (সা.) বললেন, 'তা ছিদ্র হয় মিথ্যা ও গিবতের দ্বারা।' তাই কোনো সিয়াম পালনকারী মিথ্যা বলতে পারে না। কারো গিবত করতে পারে না। নিষিদ্ধ বিষয়ে তার দৃষ্টি পড়ে না। তার কান অন্যায় কিছু শোনে না। কেউ তার সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হতে চাইলে তাকে বলতে বলা হয়েছে, 'আমি সিয়াম পালনকারী।' এর সব কিছুই সে অদৃশ্যে বিশ্বাস স্থাপন করে বলেই করে। সিয়াম পালনকারী বিশ্বাস করে, পাপ-পুণ্যের পাশাপাশি মৃত্যুর পর তাকে জবাবদিহি করতে হবে। বিশ্বাস করে, সিয়াম পালন করলে পাপসমূহ মাফ হয়ে যায়। সিয়ামের প্রত্যেক অনুষঙ্গই অদৃশ্যে বিশ্বাসের একেকটি জ্বলন্ত নজির। সিয়াম সাধনা বান্দার ইমান শুদ্ধ ও বলিষ্ঠকরণের শ্রেষ্ঠ কষ্টিপাথর।
লেখক : প্রিন্সিপাল ও শায়খুল হাদিস, জামিয়া ইমদাদিয়া দারুল উলুম, মুসলিম বাজার, মিরপুর, ঢাকা
No comments