দুদক কি সময়ের দাবি মেটাতে পারবে? by সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ
দুর্নীতি একটি বিশ্ব সমস্যা। বিশেষ করে
বিকাশশীল বা উন্নয়নশীল দেশে এ সমস্যা অত্যন্ত ভয়াবহ আকারে দেখা যাচ্ছে।
অনেক দেশ যে স্বপ্ন নিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে, সে স্বপ্ন ভেস্তে গেছে
রাষ্ট্রীয় দুর্নীতিতে। বাংলাদেশের কথা ধরা যাক।
৩০ লাখ
শহীদের রক্ত ও তিন লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী
সংগ্রামে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। এ স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিয়েছেন
কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র ও সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। বস্তি উজাড় হয়েছে। আর
নির্যাতিত হয়েছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। স্বাধীনতা অর্জনের পর সরকারের ঘোষিত
অর্থনীতি ছিল সমাজতন্ত্র। কিছুটা বাধ্য হয়ে, কেননা অবাঙালি, যারা সিংহভাগ
শিল্প, ব্যাংক, বীমার মালিক ছিল, তাদের দেশত্যাগের ফলে এবং কিছুটা
রাষ্ট্রীয় নীতির কারণে সব কিছু জাতীয়করণ করা হয়। এসব প্রতিষ্ঠানের অসাধু
আমলা ও এক শ্রেণীর অসৎ রাজনীতিকের যৌথ চক্রান্তে সমাজতন্ত্রের নামে
লুটতন্ত্র চালু হয়। পরবর্তী সময়ে সমাজতন্ত্রকে নির্বাসিত করে মুক্তবাজার
অর্থনীতি চালু হয়।
একটি দুর্নীতি দমন অধিদপ্তর ছিল, যা সম্পূর্ণ সরকারি। দাবি উঠেছিল, একটি স্বাধীন স্বায়ত্তশাসিত দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন করা উচিত, যাতে সরকারি প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করতে পারে। এরই আলোকে ২০০৪ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন পাস করা হয়। আইনটির শুরুতে বলা হয়েছে, 'যেহেতু দেশে দুর্নীতি ও দুর্নীতিমূলক কাজ প্রতিরোধের লক্ষ্যে দুর্নীতি ও অন্যান্য সুনির্দিষ্ট অপরাধের অনুসন্ধান এবং তদন্ত পরিচালনার জন্য একটি স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন প্রতিষ্ঠা এবং আনুষঙ্গিক বিষয়াদি সম্পর্কে বিধান করা সমীচীন ও প্রয়োজনীয়, সে জন্য এতদ্বারা নিম্নরূপ আইন করা হলো, যার শিরোনাম দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ২০০৪।' দুদক আইন ২০০৪-এর ২৪ ধারায় বলা হয়েছে, 'এই আইনের বিধানাবলি সাপেক্ষে কমিশনারগণ এই আইনের অধীন দায়িত্ব পালন ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন।' ২৫ ধারায় কমিশনের আর্থিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, 'সরকার প্রতি অর্থবৎসরে কমিশনের ব্যয়ের জন্য উহার অনুকূলে নির্দিষ্টকৃত অর্থ বরাদ্দ করিবে এবং অনুমোদিত ও নির্ধারিত খাতে উক্ত বরাদ্দকৃত অর্থ হইতে ব্যয় করার ক্ষেত্রে সরকারের পূর্বানুমোদন গ্রহণ করা কমিশনের জন্য আবশ্যক হইবে না।'
কমিশনারদের স্বাধীনভাবে কাজ করার ব্যাপারে আর একটি ধারা প্রেরণা বা সহায়কশক্তি হিসেবে কাজ করবে। ৬(৪) ধারায় বলা হয়েছে, 'উক্ত মেয়াদ অতিবাহিত হইবার পর কমিশনারগণ পুনঃনিয়োগের যোগ্য হইবেন না।' এর আগে একই ধারার (৩) উপধারায় উল্লেখ রয়েছে, 'কমিশনারগণ, ধারা ১০-এর বিধান সাপেক্ষে, তাঁহাদের নিয়োগের তারিখ হইতে চার বৎসর মেয়াদের জন্য স্ব-স্ব পদে অধিষ্ঠিত থাকিবেন।' ১০ ধারায় পদত্যাগ ও অপসারণের কথা বলা হয়েছে। ১০(৩) ধারায় সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, 'সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারক যেরূপ কারণ ও পদ্ধতিতে অপসারিত হইতে পারেন, সেইরূপ কারণ ও পদ্ধতি ব্যতীত কোনো কমিশনারকে অপসারণ করা যাইবে না।' লক্ষণীয়, চাকরির মেয়াদকাল নির্বিঘ্নে উত্তীর্ণ হওয়ার যেমন নিশ্চয়তা রয়েছে, তেমনি পুনঃনিয়োগের সুযোগ না থাকায় লোভ-লালসার সুযোগ থাকছে না। এর ফলে দৃঢ়চিত্তে কাজ করার অবকাশ থাকছে।
এটা আমাদের দুর্ভাগ্য যে বিভিন্ন সাংবিধানিক কিংবা বিধিবদ্ধ পদে যাঁরা নিয়োগ পেয়েছেন, তাঁরা কেউ স্বকীয় সত্তা ও স্বাধীনচেতার কোনো পরিচয় দেননি। যেকোনো মূল্যে হোক পদটাকে আঁকড়ে ধরে সময়টা কাটিয়ে দিয়েছেন। শুধু কিছু সুযোগ-সুবিধা যেমন দামি গাড়ি, রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ ইত্যাদি নিয়ে একটিবারও ভাবেননি যে পরম করুণাময় আল্লাহ তাঁদের এ সম্মানিত পদে আসীন করেছেন কিছু মহৎ কাজের জন্য, জনগণের কল্যাণের জন্য। মাঝেমধ্যেই পাবলিক সার্ভিস কমিশন মুখ থুবড়ে পড়ে এ কারণে।
দুর্নীতি বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে বিশ্বের দরবারে। বাংলাদেশের জনগণের একান্ত কামনা যে এই কলঙ্কের অবসান হোক। একেবারে দুর্নীতিমুক্ত কোনো সমাজ হয় না। তবে তা সহনশীল হতে হবে। আর সবচেয়ে বড় কথা- অন্যায় করে কেউ যেন পার না পায়। জাপানে অনেক মন্ত্রী, এমনকি প্রবীণ মন্ত্রী পর্যন্ত দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়েছেন, তাঁদের বিচার হয়েছে। আইন নিজস্ব গতিতে চলেছে। সমাজে দুর্নীতি থাকে বলে তার প্রতিকারের ব্যবস্থা রয়েছে। ব্রিটেনে ডিপার্টমেন্ট অব ফ্রড রয়েছে জালিয়াতিকে উৎসাহিত করার জন্য নয়, যারা করে তাদের বিচার করার জন্য এবং যাতে আর না হয়, সেটা প্রতিরোধ করার জন্য। ২০০১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভয়াবহ করপোরেট জালিয়াতি হয়েছিল; যার সঙ্গে জড়িত বিশ্বের সপ্তম বৃহৎ করপোরেট প্রতিষ্ঠান এনরনসহ আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। মার্কিন সরকার জানত যে মার্কিন অর্থনীতি ব্যাপকভাবে করপোরেট প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীল। তাই মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ বুশ ও কংগ্রেস কঠোরভাবে আইন প্রণয়ন করে ভবিষ্যতে যেন এ রকম না ঘটে, তার ব্যবস্থা করেন এবং তাদের তো কাঠগড়ায় উঠতে হয়েছিল।
বাংলাদেশের দুদকের সদ্য দায়িত্ব গ্রহণকারী চেয়ারম্যান বলেছেন, কমিশন সব ধরনের চাপমুক্ত থেকে কাজ করবে। আমরা গভীরভাবে প্রত্যাশা করি, তিনি তাঁর কথা রাখবেন।
লেখক : সাবেক সরকারি কর্মকর্তা
একটি দুর্নীতি দমন অধিদপ্তর ছিল, যা সম্পূর্ণ সরকারি। দাবি উঠেছিল, একটি স্বাধীন স্বায়ত্তশাসিত দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন করা উচিত, যাতে সরকারি প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করতে পারে। এরই আলোকে ২০০৪ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন পাস করা হয়। আইনটির শুরুতে বলা হয়েছে, 'যেহেতু দেশে দুর্নীতি ও দুর্নীতিমূলক কাজ প্রতিরোধের লক্ষ্যে দুর্নীতি ও অন্যান্য সুনির্দিষ্ট অপরাধের অনুসন্ধান এবং তদন্ত পরিচালনার জন্য একটি স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন প্রতিষ্ঠা এবং আনুষঙ্গিক বিষয়াদি সম্পর্কে বিধান করা সমীচীন ও প্রয়োজনীয়, সে জন্য এতদ্বারা নিম্নরূপ আইন করা হলো, যার শিরোনাম দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ২০০৪।' দুদক আইন ২০০৪-এর ২৪ ধারায় বলা হয়েছে, 'এই আইনের বিধানাবলি সাপেক্ষে কমিশনারগণ এই আইনের অধীন দায়িত্ব পালন ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন।' ২৫ ধারায় কমিশনের আর্থিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, 'সরকার প্রতি অর্থবৎসরে কমিশনের ব্যয়ের জন্য উহার অনুকূলে নির্দিষ্টকৃত অর্থ বরাদ্দ করিবে এবং অনুমোদিত ও নির্ধারিত খাতে উক্ত বরাদ্দকৃত অর্থ হইতে ব্যয় করার ক্ষেত্রে সরকারের পূর্বানুমোদন গ্রহণ করা কমিশনের জন্য আবশ্যক হইবে না।'
কমিশনারদের স্বাধীনভাবে কাজ করার ব্যাপারে আর একটি ধারা প্রেরণা বা সহায়কশক্তি হিসেবে কাজ করবে। ৬(৪) ধারায় বলা হয়েছে, 'উক্ত মেয়াদ অতিবাহিত হইবার পর কমিশনারগণ পুনঃনিয়োগের যোগ্য হইবেন না।' এর আগে একই ধারার (৩) উপধারায় উল্লেখ রয়েছে, 'কমিশনারগণ, ধারা ১০-এর বিধান সাপেক্ষে, তাঁহাদের নিয়োগের তারিখ হইতে চার বৎসর মেয়াদের জন্য স্ব-স্ব পদে অধিষ্ঠিত থাকিবেন।' ১০ ধারায় পদত্যাগ ও অপসারণের কথা বলা হয়েছে। ১০(৩) ধারায় সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, 'সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারক যেরূপ কারণ ও পদ্ধতিতে অপসারিত হইতে পারেন, সেইরূপ কারণ ও পদ্ধতি ব্যতীত কোনো কমিশনারকে অপসারণ করা যাইবে না।' লক্ষণীয়, চাকরির মেয়াদকাল নির্বিঘ্নে উত্তীর্ণ হওয়ার যেমন নিশ্চয়তা রয়েছে, তেমনি পুনঃনিয়োগের সুযোগ না থাকায় লোভ-লালসার সুযোগ থাকছে না। এর ফলে দৃঢ়চিত্তে কাজ করার অবকাশ থাকছে।
এটা আমাদের দুর্ভাগ্য যে বিভিন্ন সাংবিধানিক কিংবা বিধিবদ্ধ পদে যাঁরা নিয়োগ পেয়েছেন, তাঁরা কেউ স্বকীয় সত্তা ও স্বাধীনচেতার কোনো পরিচয় দেননি। যেকোনো মূল্যে হোক পদটাকে আঁকড়ে ধরে সময়টা কাটিয়ে দিয়েছেন। শুধু কিছু সুযোগ-সুবিধা যেমন দামি গাড়ি, রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ ইত্যাদি নিয়ে একটিবারও ভাবেননি যে পরম করুণাময় আল্লাহ তাঁদের এ সম্মানিত পদে আসীন করেছেন কিছু মহৎ কাজের জন্য, জনগণের কল্যাণের জন্য। মাঝেমধ্যেই পাবলিক সার্ভিস কমিশন মুখ থুবড়ে পড়ে এ কারণে।
দুর্নীতি বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে বিশ্বের দরবারে। বাংলাদেশের জনগণের একান্ত কামনা যে এই কলঙ্কের অবসান হোক। একেবারে দুর্নীতিমুক্ত কোনো সমাজ হয় না। তবে তা সহনশীল হতে হবে। আর সবচেয়ে বড় কথা- অন্যায় করে কেউ যেন পার না পায়। জাপানে অনেক মন্ত্রী, এমনকি প্রবীণ মন্ত্রী পর্যন্ত দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়েছেন, তাঁদের বিচার হয়েছে। আইন নিজস্ব গতিতে চলেছে। সমাজে দুর্নীতি থাকে বলে তার প্রতিকারের ব্যবস্থা রয়েছে। ব্রিটেনে ডিপার্টমেন্ট অব ফ্রড রয়েছে জালিয়াতিকে উৎসাহিত করার জন্য নয়, যারা করে তাদের বিচার করার জন্য এবং যাতে আর না হয়, সেটা প্রতিরোধ করার জন্য। ২০০১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভয়াবহ করপোরেট জালিয়াতি হয়েছিল; যার সঙ্গে জড়িত বিশ্বের সপ্তম বৃহৎ করপোরেট প্রতিষ্ঠান এনরনসহ আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। মার্কিন সরকার জানত যে মার্কিন অর্থনীতি ব্যাপকভাবে করপোরেট প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীল। তাই মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ বুশ ও কংগ্রেস কঠোরভাবে আইন প্রণয়ন করে ভবিষ্যতে যেন এ রকম না ঘটে, তার ব্যবস্থা করেন এবং তাদের তো কাঠগড়ায় উঠতে হয়েছিল।
বাংলাদেশের দুদকের সদ্য দায়িত্ব গ্রহণকারী চেয়ারম্যান বলেছেন, কমিশন সব ধরনের চাপমুক্ত থেকে কাজ করবে। আমরা গভীরভাবে প্রত্যাশা করি, তিনি তাঁর কথা রাখবেন।
লেখক : সাবেক সরকারি কর্মকর্তা
No comments