হৃদয়নন্দন বনে-কত চাই আর? by আলী যাকের

আজ এই বর্ষণমুখর সকালে যখন সমকালের জন্য এই কলামটি লিখতে শুরু করেছি তখন মনটা ভারি উৎফুল্ল ছিল। বৃষ্টি, বৃষ্টি! বর্ষা আমায় মাতিয়ে তোলে। বর্ষার শব্দে আমার সমস্ত মন এক অনাবিল আনন্দে ভরে যায়।
বাল্যকাল থেকেই এরকম ছিল। এখনও তা-ই আছে। কিন্তু আজ, এইক্ষণে বর্ষার রিমঝিম শব্দও আমায় পুলকিত করতে পারছে না। আমি কি এক ধরনের বিষণ্নতার দ্বারা তাড়িত হচ্ছি। সেদিন নবপ্রজন্মের এক চিন্তাশীল, শিক্ষিত যুবক কথায় কথায় আমাকে বলেছিল, 'আচ্ছা, আপনি কি লক্ষ্য করেছেন, আমাদের সমাজে মেধা উদ্ভূত চিন্তা-চেতনায় কেমন ধস নেমেছে? এখন আমরা, এই গোটা সমাজটা, কোনো বৃহৎ কিংবা মহৎ চিন্তা করার ক্ষমতাই যেন হারিয়ে ফেলেছি। এখনকার বাঙালি মুসলমান সমাজ এক অন্ধকারাচ্ছন্ন, ক্ষয়িষ্ণু মিডিওক্রিটির শিকার।' কথাটি আমাকে ভাবিত করে। ভাবিত করে এই কারণে যে, আমার বোধবুদ্ধির স্টম্ফুরণের পর কম করে হলেও ৫০-৫৫ বছর এই সমাজটাকে দেখছি আমি। এখানে বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে সত্তর কি আশির দশক পর্যন্ত মেধার একটা মূল্য ছিল। জীবনযাত্রা নিয়ন্ত্রিত হতো মূল্যবোধ দ্বারা। আমাদের সমাজের নেতৃত্বে ছিলেন কিছু জ্ঞান এবং আদর্শে উদ্ভাসিত মানুষ। আপামর জনসাধারণ সেই মানুষগুলোর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকত। বুঝত কি বুঝত না, তবুও তাকিয়ে থাকত। পরে নিজের মতো করে গোটা বিষয়টির ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করত, এ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করত, নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করত এবং যথাসাধ্য চেষ্টা করত এক ধরনের মূল্যবোধ ও আদর্শের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে পথ চলতে। আমার মনে আছে যে, বাল্যকালে আমার বাবার সঙ্গে যখন গ্রামের বাড়ি যেতাম, গ্রামের অনেক খেটে খাওয়া মানুষ সন্ধ্যাবেলায় আমাদের নিকনো উঠানে বাবাকে ঘিরে বসত। নানারকম জিজ্ঞাসা ছিল তাদের। দেশের রাজনীতি নিয়ে, অর্থনীতি নিয়ে, শিক্ষা নিয়ে অত্যন্ত কৌতূহলী ছিলেন তারা। নানারকম প্রশ্ন করতেন। মনে কোনো রকম দ্বিধা থাকলে সেই দ্বিধাকে দূরে সরাবার চেষ্টা করতেন।
বস্তুতপক্ষে শিক্ষিত ও সফল ব্যক্তিরাই তখন সাধারণ মানুষকে দিকনির্দেশনা দিতেন। ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িক শক্তিকে কোনো প্রকার পাত্তাই দিত না সাধারণ মানুষ। এখন এক সামাজিক অবক্ষয় আমাদের চারদিক থেকে আমাদের আক্রমণ করেছে। বেশ কিছু ক্ষেত্রে আমাদের চিন্তা-চেতনা, আমাদের আদর্শ এবং মূল্যবোধ পর্যুদস্ত হয়ে পড়েছে। যার জন্য আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি এবং আশা করেছি যে, একটি মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন সমাজ আমরা গড়ে তুলব, সেই মানসিকতায় ধস নেমেছে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার কিছুদিন পর থেকেই। যখন আমরা ছিলাম পাকিস্তানের উপনিবেশ, তখন আমরা ছিলাম সকলেই বিদ্রোহী। আমরা ছিলাম প্রগতিশীল। আমাদের ওই বিদ্রোহ ছিল কুসংস্কারের বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে এবং বৃহত্তর জীবনবোধের পক্ষে। আজ এই পরিস্থিতির উদ্ভব হলো কেন, তা আমরা সকলেই অল্পবিস্তর জানি। পাকিস্তান ও পাকিস্তানপন্থি কতিপয় মানুষ কখনোই সৎ, স্বাধীন এবং সুচিন্তাকে মেনে নিতে পারেনি। আমাদের সামাজিক জীবন, শিক্ষা এবং ধর্মের আবরণে উপাসনালয়গুলোর মধ্যে ওই অপশক্তি আমাদের সমাজে এই ধসটি নামিয়েছে। আজ আমরা কোনো ধরনের সৎ চিন্তা করতে অপারগ। আমরা কেবলই ছুটছি জাগতিক ঐশ্বর্যের পেছনে। এই ঐশ্বর্য কীভাবে এলো, কোথা থেকে এলো, বৈধ কিনা, তা নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। আমাদের সমাজের বেশিরভাগ মানুষই এই বিষয় নিয়ে কোনো অপ্রিয় প্রশ্ন করতে অপারগ। পকেট স্টম্ফীত হলে, আপাত সুখ এলে, আমরা অবলীলায় ভুলে যাই সেই সুখ কীভাবে অর্জিত হলো। স্বাধীন বাংলাদেশে আমাদের অনেকেই বৈষয়িকভাবে এখন অনেক ভালো অবস্থায় আছেন। বাংলাদেশ স্বাধীন না হলে এখানে আমরা পেঁৗছতে পারতাম কিনা, সে বিষয়ে আমাদের সন্দেহ আছে। কিন্তু তবুও আমাদের চাওয়ার শেষ নেই। অর্থের পেছনে কেবলই ধাবমান আমরা। ভুলে যাই অবলীলায় গত ৪০ বছরে কোন কোন মানুষ কী প্রকার অসদুপায়ে বিত্তবান হয়েছে। যাদের কানাকড়িও ছিল না, তারা আজ দিব্যি প্রতিপত্তি পেয়ে প্রতিষ্ঠিত, পেছন দরজা দিয়ে অর্জন করা বিত্তের প্রাচুর্যে।
প্রসঙ্গত, লিও টলস্টয়ের একটি গল্পের কথা মনে পড়ে গেল। 'একজন মানুষের কতটুকু জমি প্রয়োজন?' আজকাল হয়তো এই গল্পটি অনেকেই ভুলে গেছেন অথবা পড়েনইনি। এই গল্পটি তাদের দেওয়া হলে তারা পড়বেন কিনা আমার সন্দেহ আছে। কিন্তু তা বলে টলস্টয়ের মতো একজন সত্যানুসন্ধানী, অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন লেখক তুচ্ছ হয়ে যাবেন না। তিনি বেঁচে থাকবেন সব শুভকামী মানুষের মাঝে। তার লেখাটা ছিল অনেকটা এ রকম :এক তরুণ রাশিয়ান একবার একটি স্বপ্ন দেখে যে, সে একটি উন্মুক্ত প্রান্তরে ঘুরে বেড়ানোর সময় এক বৃদ্ধকে দেখতে পায়। এই বৃদ্ধের সঙ্গে তার একটি স্বল্প বয়সী ভৃত্য ছিল। বৃদ্ধটির সামনে রাখা ছিল একটি টুপি। তাকে যখন জিজ্ঞেস করা হলো, সে ওই উন্মুক্ত প্রান্তরে বসে কী করছে, তখন সে সামনের উন্মুক্ত মাঠের দিকে ইঙ্গিত করে বলে, সে জমি বিক্রি করছে। তাকে জমির মূল্য সম্বন্ধে প্রশ্ন করা হলে সে বলে, আমি এক হাজার রুবলের বিনিময়ে ঠিক ততখানি জমি বিক্রি করে দেব, যতখানি জমি এখন থেকে শুরু করে সূর্যাস্ত পর্যন্ত তুমি হেঁটে ঘুরে আসতে পারবে। এই প্রস্তাব শুনে তরুণটি আগ্রহী হয়ে ওঠে এবং সোজা পশ্চিম দিকে হাঁটতে শুরু করে। দুপুর পর্যন্ত একই দিকে হাঁটতে হাঁটতে সে ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ে এবং নিজের অজান্তেই মাঠের ওপরে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। বিকেলবেলা তার ঘুম ভাঙলে সে দেখতে পায় সূর্য পশ্চিম দিকে হেলে পড়েছে। সে ভাবে যে, এখন তার ফিরে যাওয়া উচিত। সূর্যাস্তের আগে সেই বৃদ্ধের কাছে পেঁৗছতে পারলে এক হাজার রুবলের বিনিময়ে সে মেলা জমি কিনতে পারবে। কিন্তু উঠে দাঁড়াবার পর সামনের দিকে তাকাতেই তার মনে লোভের সঞ্চার হয়। সে ভাবে, আরও একটু হেঁটেই দেখি না কেন? তাহলে হয়তো আরও একটু বেশি জমি পাওয়া যাবে? এভাবে আরও কিছুদূর হেঁটে যাওয়ার পর সূর্য যখন পশ্চিম দিগন্ত ছুঁই ছুঁই তখন তার মনে হয়, 'না, যথেষ্ট হয়েছে। এবারে বৃদ্ধের কাছে ফেরা যাক।' সে পেছন দিকে হাঁটতে শুরু করে। এদিকে সূর্য দ্রুত অস্তগামী। সে হাঁটার বেগ বাড়িয়ে দেয়। তাতেও কুলাতে পারে না। তারপর দৌড়াতে শুরু করে। এ রকম দৌড়াতে দৌড়াতে যখন সে বৃদ্ধকে দেখতে পায়, তখন হঠাৎ করে প্রচণ্ড ক্লান্তিতে সে জমির ওপরে পড়ে যায়। তারপর সে হামাগুড়ি দিয়ে কোনোমতে বৃদ্ধের দিকে এগিয়ে চলে। এদিকে পশ্চিম আকাশে সূর্যের শেষ রেখাটি দেখা যাচ্ছে তখন। তরুণ যখন বৃদ্ধের থেকে ফুট তিনেক দূরে তখন সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। পড়ে আছে তরুণ, নিথর তার দেহ। তারপর কোনোমতে একটা হাত বাড়িয়ে বৃদ্ধের টুপিটিকে ছোঁয় সে। পরমুহূর্তেই নিস্পন্দ হয়ে যায় সেই তরুণ। বৃদ্ধ আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায়। মুখে মৃদু হাসি। হাতে তুলে নেয় একটা কোদাল। সে তার ভৃত্যকে বলে, 'ওর জন্য একটি কবর খোঁড়। ও মারা গেছে। শেষ পর্যন্ত ওর ওইটুকু জমিই প্রয়োজন ছিল। ছয় ফুট বাই তিন ফুট বাই তিন ফুট।'
টলস্টয়ের প্রায় হারিয়ে যাওয়া এই গল্পটি হঠাৎ করেই আমার স্মরণ হয়, যখন আমি আজকের সমাজ, সমাজের কিছু বিত্তবান মানুষ, রাজনীতিবিদ, তাদের লোভ ইত্যাদি বিষয়ে চিন্তা করি। তারা বোধহয় ভুলেই যান যে শেষ পর্যন্ত তাদের প্রয়োজন কেবল ওই ছয় ফুট বাই তিন ফুট বাই তিন ফুট জমি। টলস্টয়ের তরুণের মতো লোভী একদল দুর্বৃত্ত আজ বাংলাদেশের সব দুঃশাসন এবং দুরবস্থার জন্য দায়ী। এদের অনেকেই এখনও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থেকে তাদের কুকীর্তি চালিয়ে যাচ্ছে অবলীলায়। আবার কেউ আপাতত দেশ ছেড়ে পরদেশবাসী, সুযোগের অপেক্ষায়। ফিরে এসে এই দেশটির সবকিছু শুষে খেয়ে একে ছিবড়ে বানিয়ে দেওয়ার জন্য। দুর্ভাগা এ দেশ, ঘটনাচক্রে এরাই আমাদের নেতা আজ। সাধারণ মানুষ, যারা এদের পেছনে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়ায়, তারা এতই ক্ষমতাহীন হতদরিদ্র যে, যেমন রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, 'সমৃদ্ধির টেবিল থেকে মেঝের ওপর ঝেড়ে ফেলা উচ্ছিষ্ট' পেয়েই তারা আহ্লাদে আটখানা। ভোট কেনাবেচা এখন আলু-পটোল কেনাবেচার চেয়েও সহজ। যারা জনপ্রতিনিধি হওয়ার স্বপ্ন দেখেন, তারা নির্বাচিত হয়েই কোটি কোটি টাকা কামানোর কাজে লেগে যান। ফলে মাথাপ্রতি এক একটি ভোটের জন্য একশ', দুইশ' কি পাঁচশ' টাকা তাদের জন্য কোনো বিষয়ই নয়। আমাদের এই চরম দুর্ভোগ থেকে মুক্তি কোথায়, কীভাবে কে জানে।


আলী যাকের
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.