দুই তদন্ত কমিটির উল্টো প্রতিবেদন-তেল লুটপাটের পাঁয়তারা! by আরিফুজ্জামান তুহিন
দেশে বিদ্যুৎ ঘাটতি পূরণের জন্য বেসরকারি
খাতে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল মিলিয়ে মোট ২০টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের
অনুমোদন দেয় সরকার। এর মধ্যে দুটির অনুমোদন হয় গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের
আমলে আর সবগুলো চালু হয় বর্তমান সরকারের আমলে।
এই
কেন্দ্রগুলোতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সরকার বিনা মূল্যে জ্বালানি তেল
সরবরাহ করে থাকে। এক হিসাবে দেখা গেছে, ২০টি রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল
বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রতিদিন ২৫ কোটি টাকার জ্বালানি দেওয়া হয়। অভিযোগ আছে,
কেন্দ্র বন্ধ রাখাসহ নানা রকম কৌশল করে এই জ্বালানি তেলের অনেকটাই লুটপাট
করা হয়। এতে খোদ বিদ্যুৎ বিভাগেরও হাত রয়েছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই
লুটপাট আরেক প্রস্থ বাড়ানোর পাঁয়তারা চলছে। এ উদ্দেশ্যে রীতিমতো কমিটি করে
প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। সেই প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে, রেন্টাল ও
কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে বিনা মূল্যের জ্বালানি তেল আরো বেশি করে
দেওয়া হোক। সংশ্লিষ্ট সচিবালয়ে এ সুপারিশ এখন বাস্তবায়নের অপেক্ষায় রয়েছে
বলে জানা গেছে।
ইতিমধ্যে বিদ্যুৎসচিবের কাছে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল চুক্তির সংশ্লিষ্ট ধারা পরিবর্তন করার সুপারিশ করে প্রতিবেদন দিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগের এ-সংক্রান্ত একটি কমিটি। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এ প্রতিবেদনের সুপারিশ কার্যকর হলে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কেন্দ্রগুলোতে বেশি জ্বালানি তেল ব্যবহারের সুযোগে লুটপাটের পাশাপাশি বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় যেমন বাড়বে, তেমনই সরকারের লোকসানও এ খাতে বেড়ে যাবে।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কেন্দ্রগুলোতে এত দিন বরাদ্দের চেয়ে অতিরিক্ত জ্বালানি তেল ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। এ বিষয়ে কেন্দ্রগুলোর অভিযোগ ছিল, তাদের যে জ্বালানি তেল দেওয়া হয়, তার বিটিইউ (ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট) বা দাহ্যক্ষমতা কম। এ কারণে জ্বালানি বেশি লাগে। বিষয়টি তদন্তের জন্য বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মোফাজ্জেল হোসেনের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। পরে এ কমিটি একটি সাবকমিটি গঠন করে এ বিষয়ে পাওয়ারসেলকে কারিগরি দিকগুলো তদন্তের দায়িত্ব দেয়। মজার বিষয় হচ্ছে, মূল কমিটি রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে জ্বালানি তেলের পরিমাণ বাড়ানোর সুপারিশ করেছে। আর উপকমিটি বলছে, বিটিইউ কম- কেন্দ্রগুলোর এ অভিযোগ অসত্য। চুক্তির অতিরিক্ত জ্বালানি তেলের সীমা বাড়ানোর কোনো সুযোগ নেই।
সরকারের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, জ্বালানি তেলের বিটিইউ কম দেখালে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কেন্দ্রগুলোতে আগে যে পরিমাণ তেল খরচ হতো, এখন তার চেয়ে বেশি তেল খরচ দেখানো যাবে। বাড়তি জ্বালানি তেল নেওয়ার জন্যই ওই কেন্দ্রের মালিকরা বিদ্যুৎ বিভাগের কাছ থেকে এ দাবি আদায় করে নিচ্ছেন। এ জন্য বিদ্যুৎ বিভাগ কৌশলের আশ্রয় নিয়ে বাড়তি জ্বালানি তেল দেওয়ার ব্যবস্থা করতে যাচ্ছে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল ব্যবসায়ীদের।
এ বিষয়ে তদন্ত কমিটির প্রধান বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মোফাজ্জেল হোসেনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে গত রাতে কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, 'রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত জ্বালানি ব্যবহারের কারণে জরিমানা দিয়ে আসছিলেন। কিন্তু আমাদের উদ্দেশ্য জরিমানা আদায় করা নয়; আমাদের উদ্দেশ্য বিদ্যুৎ আদায় করা। এ কারণেই তাঁরা যাতে ঠিকমতো বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারেন, তাই তাঁদের জ্বালানি তেলের পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।'
রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কেন্দ্রের ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাংলাদেশে যে ডিজেল ও ফার্নেস অয়েল বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য সরবরাহ করা হয়, তার বিটিইউ বা হিটিং ভ্যালু কম। এ কারণে নির্ধারিত বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। কম হিটিং ভ্যালুর কারণে কেন্দ্রগুলোর জ্বালানি তেল বেশি লাগছে। তবে এসব অভিযোগকে নাকচ করে দিয়েছে এ-সংক্রান্ত গঠিত উপকমিটি পাওয়ারসেল। সম্প্রতি উপকমিটির দেওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের জ্বালানি তেলে নির্ধারিত সীমার চেয়ে হিটিং ভ্যালু বেশি রয়েছে। দেশে সরবরাহকৃত জ্বালানি তেলে হিটিং ভ্যালু কম রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কেন্দ্রের মালিকদের এমন অভিযোগ সত্য নয় বলেও পাওয়ারসেলের উপকমিটির ওই প্রতিবেদনে বলা হয়।
জানা যায়, মোফাজ্জেল হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি গত মঙ্গলবার এক বৈঠকে চুক্তি পরিবর্তনের জন্য সুপারিশ করেছে। ওই বৈঠকের একটি সূত্র জানায়, বর্তমান চুক্তিতে ফার্নেস অয়েলের হিটিং ভ্যালু ১৯,২০০ বিটিইউ নির্ধারিত রয়েছে। কিন্তু চুক্তিতে সর্বনিম্ন কোনো হিটিং ভ্যালু নির্ধারিত নেই- এমন অজুহাত দিয়ে ফার্নেস অয়েলের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ১৬,৭০০ বিটিইউ আর ডিজেলের ক্ষেত্রে ১৮,২০০ বিটিইউ হিটিং ভ্যালু নির্ধারণ করা হয়েছে। বৈঠকে বলা হয়েছে, বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ ঠিক রেখে অন্যান্য মূল্য সমন্বয় করে নিতে হবে। এ জন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের উদ্যোক্তাদের একটি প্রস্তাব দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয় বৈঠকে।
অন্যদিকে পাওয়ারসেল উপকমিটির দেওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়, এক ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সর্বোচ্চ ১৮ শতাংশ বাড়তি জ্বালানি তেল ব্যবহার হয়েছে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয়। আরো বলা হয়, ফার্নেস অয়েলে চুক্তি অনুযায়ী ১৯,২০০ বিটিইউ থাকার কথা থাকলেও সরবরাহকৃত তেলে বিটিইউ আছে ১৯,৮০০। তাই তেলের গুণগত মান নিয়ে তোলা ব্যবসায়ীদের অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই। বর্তমান চুক্তিতে সর্বনিম্ন মাত্রা নির্ধারণ করা না থাকলেও ফার্নেসে ১৮,৪০০ আর ডিজেলে ১৯,২০০ বিটিইউ থাকার কথা বলা আছে। তবে উদ্যোক্তারা এই বক্তব্য মানেননি।
উপকমিটির দেওয়া প্রতিবেদনে অতিরিক্ত জ্বালানি তেল ব্যবহারকারী কেন্দ্রগুলো সম্পর্কে বলা হয়, শিকলবাহা ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রটি অতিরিক্ত তেল ব্যবহারের তালিকায় এক নম্বরে রয়েছে। কেন্দ্রটিতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য অতিরিক্ত তেল লাগছে ৩৪ দশমিক ৮২ মিলিলিটার। তাদের কাছ থেকে বিগত অর্থবছরে জরিমানা আদায় করা হয় ২২ লাখ ৫৫ হাজার ৭২০ ডলার। দ্বিতীয় অবস্থানে ভেড়ামারা ১১০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রটি প্রতি ইউনিটে অতিরিক্ত তেল নিচ্ছে ২৯ দশমিক ২৯ মিলিলিটার। কেন্দ্রটি থেকে আদায় করা হয়েছে ৫০ লাখ ৫৫ হাজার ২৪২ ডলার। তৃতীয় অবস্থানে আছে সিদ্ধিরগঞ্জ ১০০ মেগাওয়াট কেন্দ্রটি। এখানে ইউনিটপ্রতি অতিরিক্ত তেল লাগছে ২৭ দশমিক ১১ মিলিলিটার। তাদের কাছ থেকে ১১ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭ ডলার জরিমানা আদায় করা হয়। কেন্দ্রগুলোর কাছে আরো অনেক টাকা পাওয়া যাবে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ ছিল। এ ছাড়া ঠাকুরগাঁও ৫০ মেগাওয়াট কেন্দ্রটি ইউনিটপ্রতি অতিরিক্ত তেল নিচ্ছে ১৯ দশমিক ৯৬ মিলিলিটার। এ কেন্দ্র থেকে আদায় করা হয়েছে ২২ লাখ ৪৭ হাজার ৬৭৬ ডলার। নোয়াপাড়া ১০৫ মেগাওয়াট নিচ্ছে ১৮ দশমিক ৭৩ মিলিলিটার। আমনুরা ৫০ মেগাওয়াট নিচ্ছে ১৩ দশমিক ৬১ মিলিলিটার। মেসার্স খান জাহান আলী পাওয়ার কম্পানি লিমিটেড নোয়াপাড়া ৪০ মেগাওয়াট কেন্দ্রটি গত বছর এপ্রিল পর্যন্ত চার লাখ ৪৬ হাজার ৪৭৯ দশমিক ৪০ ডলারের অতিরিক্ত তেল নিয়েছে। সামিটের মদনগঞ্জ ১০২ মেগাওয়াট কেন্দ্রটি প্রতি ইউনিটে নিচ্ছে চার মিলিলিটার। এ ছাড়া আরো দু-তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত জ্বালানি তেল ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের একজন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, উপকমিটির রিপোর্ট তৈরির সময় তাদের হিটিং ভ্যালু কমিয়ে দেখানোর জন্য চাপ প্রয়োগ করা হয়। তবে কমিটি সাফ জানিয়ে দেয়, চুক্তিতে যে হিটিং ভ্যালু নির্ধারণ করা হয়েছে তা পরিবর্তনের কোনো সুযোগ নেই। তিনি বলেন, এর ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) ব্যয় আরো বাড়বে।
জানা যায়, রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয় পুরনো যন্ত্রপাতি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করায় নির্ধারিত বরাদ্দের চেয়ে অতিরিক্ত জ্বালানি তেল ব্যবহার হচ্ছিল। এ জন্য ১৩টি রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রকে অতিরিক্ত জ্বালানি তেল ব্যবহার করার কারণে ১২৭ কোটি টাকা জরিমানা করেছে পিডিবি।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিটিইউ বা হিটিং ভ্যালু কমিয়ে নিতে পারলে রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের মালিকরা জ্বালানি তেল খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়ে বিপুল পরিমাণ টাকা লোপাটের সুযোগ পাবেন। এ জন্যই তাঁদের সঙ্গে যোগসাজশ করে বিদ্যুৎ বিভাগ কৌশলে জ্বালানি তেলে বিটিইউ কমানোর প্রস্তাব দিয়েছে।
ইতিমধ্যে বিদ্যুৎসচিবের কাছে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল চুক্তির সংশ্লিষ্ট ধারা পরিবর্তন করার সুপারিশ করে প্রতিবেদন দিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগের এ-সংক্রান্ত একটি কমিটি। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এ প্রতিবেদনের সুপারিশ কার্যকর হলে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কেন্দ্রগুলোতে বেশি জ্বালানি তেল ব্যবহারের সুযোগে লুটপাটের পাশাপাশি বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় যেমন বাড়বে, তেমনই সরকারের লোকসানও এ খাতে বেড়ে যাবে।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কেন্দ্রগুলোতে এত দিন বরাদ্দের চেয়ে অতিরিক্ত জ্বালানি তেল ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। এ বিষয়ে কেন্দ্রগুলোর অভিযোগ ছিল, তাদের যে জ্বালানি তেল দেওয়া হয়, তার বিটিইউ (ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট) বা দাহ্যক্ষমতা কম। এ কারণে জ্বালানি বেশি লাগে। বিষয়টি তদন্তের জন্য বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মোফাজ্জেল হোসেনের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। পরে এ কমিটি একটি সাবকমিটি গঠন করে এ বিষয়ে পাওয়ারসেলকে কারিগরি দিকগুলো তদন্তের দায়িত্ব দেয়। মজার বিষয় হচ্ছে, মূল কমিটি রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে জ্বালানি তেলের পরিমাণ বাড়ানোর সুপারিশ করেছে। আর উপকমিটি বলছে, বিটিইউ কম- কেন্দ্রগুলোর এ অভিযোগ অসত্য। চুক্তির অতিরিক্ত জ্বালানি তেলের সীমা বাড়ানোর কোনো সুযোগ নেই।
সরকারের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, জ্বালানি তেলের বিটিইউ কম দেখালে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কেন্দ্রগুলোতে আগে যে পরিমাণ তেল খরচ হতো, এখন তার চেয়ে বেশি তেল খরচ দেখানো যাবে। বাড়তি জ্বালানি তেল নেওয়ার জন্যই ওই কেন্দ্রের মালিকরা বিদ্যুৎ বিভাগের কাছ থেকে এ দাবি আদায় করে নিচ্ছেন। এ জন্য বিদ্যুৎ বিভাগ কৌশলের আশ্রয় নিয়ে বাড়তি জ্বালানি তেল দেওয়ার ব্যবস্থা করতে যাচ্ছে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল ব্যবসায়ীদের।
এ বিষয়ে তদন্ত কমিটির প্রধান বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মোফাজ্জেল হোসেনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে গত রাতে কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, 'রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত জ্বালানি ব্যবহারের কারণে জরিমানা দিয়ে আসছিলেন। কিন্তু আমাদের উদ্দেশ্য জরিমানা আদায় করা নয়; আমাদের উদ্দেশ্য বিদ্যুৎ আদায় করা। এ কারণেই তাঁরা যাতে ঠিকমতো বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারেন, তাই তাঁদের জ্বালানি তেলের পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।'
রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কেন্দ্রের ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাংলাদেশে যে ডিজেল ও ফার্নেস অয়েল বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য সরবরাহ করা হয়, তার বিটিইউ বা হিটিং ভ্যালু কম। এ কারণে নির্ধারিত বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। কম হিটিং ভ্যালুর কারণে কেন্দ্রগুলোর জ্বালানি তেল বেশি লাগছে। তবে এসব অভিযোগকে নাকচ করে দিয়েছে এ-সংক্রান্ত গঠিত উপকমিটি পাওয়ারসেল। সম্প্রতি উপকমিটির দেওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের জ্বালানি তেলে নির্ধারিত সীমার চেয়ে হিটিং ভ্যালু বেশি রয়েছে। দেশে সরবরাহকৃত জ্বালানি তেলে হিটিং ভ্যালু কম রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কেন্দ্রের মালিকদের এমন অভিযোগ সত্য নয় বলেও পাওয়ারসেলের উপকমিটির ওই প্রতিবেদনে বলা হয়।
জানা যায়, মোফাজ্জেল হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি গত মঙ্গলবার এক বৈঠকে চুক্তি পরিবর্তনের জন্য সুপারিশ করেছে। ওই বৈঠকের একটি সূত্র জানায়, বর্তমান চুক্তিতে ফার্নেস অয়েলের হিটিং ভ্যালু ১৯,২০০ বিটিইউ নির্ধারিত রয়েছে। কিন্তু চুক্তিতে সর্বনিম্ন কোনো হিটিং ভ্যালু নির্ধারিত নেই- এমন অজুহাত দিয়ে ফার্নেস অয়েলের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ১৬,৭০০ বিটিইউ আর ডিজেলের ক্ষেত্রে ১৮,২০০ বিটিইউ হিটিং ভ্যালু নির্ধারণ করা হয়েছে। বৈঠকে বলা হয়েছে, বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ ঠিক রেখে অন্যান্য মূল্য সমন্বয় করে নিতে হবে। এ জন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের উদ্যোক্তাদের একটি প্রস্তাব দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয় বৈঠকে।
অন্যদিকে পাওয়ারসেল উপকমিটির দেওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়, এক ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সর্বোচ্চ ১৮ শতাংশ বাড়তি জ্বালানি তেল ব্যবহার হয়েছে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয়। আরো বলা হয়, ফার্নেস অয়েলে চুক্তি অনুযায়ী ১৯,২০০ বিটিইউ থাকার কথা থাকলেও সরবরাহকৃত তেলে বিটিইউ আছে ১৯,৮০০। তাই তেলের গুণগত মান নিয়ে তোলা ব্যবসায়ীদের অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই। বর্তমান চুক্তিতে সর্বনিম্ন মাত্রা নির্ধারণ করা না থাকলেও ফার্নেসে ১৮,৪০০ আর ডিজেলে ১৯,২০০ বিটিইউ থাকার কথা বলা আছে। তবে উদ্যোক্তারা এই বক্তব্য মানেননি।
উপকমিটির দেওয়া প্রতিবেদনে অতিরিক্ত জ্বালানি তেল ব্যবহারকারী কেন্দ্রগুলো সম্পর্কে বলা হয়, শিকলবাহা ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রটি অতিরিক্ত তেল ব্যবহারের তালিকায় এক নম্বরে রয়েছে। কেন্দ্রটিতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য অতিরিক্ত তেল লাগছে ৩৪ দশমিক ৮২ মিলিলিটার। তাদের কাছ থেকে বিগত অর্থবছরে জরিমানা আদায় করা হয় ২২ লাখ ৫৫ হাজার ৭২০ ডলার। দ্বিতীয় অবস্থানে ভেড়ামারা ১১০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রটি প্রতি ইউনিটে অতিরিক্ত তেল নিচ্ছে ২৯ দশমিক ২৯ মিলিলিটার। কেন্দ্রটি থেকে আদায় করা হয়েছে ৫০ লাখ ৫৫ হাজার ২৪২ ডলার। তৃতীয় অবস্থানে আছে সিদ্ধিরগঞ্জ ১০০ মেগাওয়াট কেন্দ্রটি। এখানে ইউনিটপ্রতি অতিরিক্ত তেল লাগছে ২৭ দশমিক ১১ মিলিলিটার। তাদের কাছ থেকে ১১ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭ ডলার জরিমানা আদায় করা হয়। কেন্দ্রগুলোর কাছে আরো অনেক টাকা পাওয়া যাবে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ ছিল। এ ছাড়া ঠাকুরগাঁও ৫০ মেগাওয়াট কেন্দ্রটি ইউনিটপ্রতি অতিরিক্ত তেল নিচ্ছে ১৯ দশমিক ৯৬ মিলিলিটার। এ কেন্দ্র থেকে আদায় করা হয়েছে ২২ লাখ ৪৭ হাজার ৬৭৬ ডলার। নোয়াপাড়া ১০৫ মেগাওয়াট নিচ্ছে ১৮ দশমিক ৭৩ মিলিলিটার। আমনুরা ৫০ মেগাওয়াট নিচ্ছে ১৩ দশমিক ৬১ মিলিলিটার। মেসার্স খান জাহান আলী পাওয়ার কম্পানি লিমিটেড নোয়াপাড়া ৪০ মেগাওয়াট কেন্দ্রটি গত বছর এপ্রিল পর্যন্ত চার লাখ ৪৬ হাজার ৪৭৯ দশমিক ৪০ ডলারের অতিরিক্ত তেল নিয়েছে। সামিটের মদনগঞ্জ ১০২ মেগাওয়াট কেন্দ্রটি প্রতি ইউনিটে নিচ্ছে চার মিলিলিটার। এ ছাড়া আরো দু-তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত জ্বালানি তেল ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের একজন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, উপকমিটির রিপোর্ট তৈরির সময় তাদের হিটিং ভ্যালু কমিয়ে দেখানোর জন্য চাপ প্রয়োগ করা হয়। তবে কমিটি সাফ জানিয়ে দেয়, চুক্তিতে যে হিটিং ভ্যালু নির্ধারণ করা হয়েছে তা পরিবর্তনের কোনো সুযোগ নেই। তিনি বলেন, এর ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) ব্যয় আরো বাড়বে।
জানা যায়, রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয় পুরনো যন্ত্রপাতি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করায় নির্ধারিত বরাদ্দের চেয়ে অতিরিক্ত জ্বালানি তেল ব্যবহার হচ্ছিল। এ জন্য ১৩টি রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রকে অতিরিক্ত জ্বালানি তেল ব্যবহার করার কারণে ১২৭ কোটি টাকা জরিমানা করেছে পিডিবি।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিটিইউ বা হিটিং ভ্যালু কমিয়ে নিতে পারলে রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের মালিকরা জ্বালানি তেল খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়ে বিপুল পরিমাণ টাকা লোপাটের সুযোগ পাবেন। এ জন্যই তাঁদের সঙ্গে যোগসাজশ করে বিদ্যুৎ বিভাগ কৌশলে জ্বালানি তেলে বিটিইউ কমানোর প্রস্তাব দিয়েছে।
No comments