রাজনীতিতে নতুন বিপদ by ড. মো. মইনুল ইসলাম
গত এপ্রিল, ২০১৩-তে অনেকটা আকস্মিকভাবেই
দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে হেফাজতে ইসলাম নামে একটি ধর্মীয় সংগঠন বেশ জোরেশোরে
তাদের আগমন ঘোষণা করে।
যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির
দাবিতে আন্দোলনরত শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের বিপরীত শক্তি হিসেবে ধর্মীয়
মৌলবাদী এই দলটি তথাকথিত নাস্তিকদের হাত থেকে ইসলাম বাঁচানোর নামে
দেশব্যাপী মহা শোরগোল শুরু করে। গত ৬ এপ্রিল তারা মতিঝিলের শাপলা চত্বরে
একটি বড় সমাবেশ করে এবং তাদের কথিত বা কল্পিত নাস্তিকদের মৃত্যুদণ্ডের
বিধান রেখে ব্লাসফেমি বা ধর্ম অবমাননা আইন অবিলম্বে প্রণয়নের জন্য সরকারের
কাছে জোর দাবি জানায়। অন্যথায় তারা আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে ওই আইনটি
প্রণয়নসহ নারী ও শিক্ষানীতি বাতিল করতে সরকারকে বাধ্য করবে বলে ঘোষণা দেয়।
তাদের বেঁধে দেওয়া সময়সীমার মধ্যে উপরোক্ত দাবিগুলো পূরণ না হওয়ায় তারা ৫
মে ঢাকা অবরোধসহ শাপলা চত্বরে পুনরায় গণসমাবেশ করে। এর কিছুদিন আগে
হেফাজতপ্রধান আল্লামা শফী হেলিকপ্টারযোগে বগুড়ায় এক সমাবেশ করে ৫ মের ঢাকা
সমাবেশের ফলে সম্ভাব্য পরিস্থিতির ভয়াবহতার ব্যাপারে সরকারকে হুঁশিয়ার
করেন।
ঢাকায় ৫ মের সমাবেশ ও তাণ্ডব আল্লামা শফীর বগুড়ায় প্রদত্ত হুঁশিয়ারির সত্যতাই প্রমাণ করে।
জামায়াতের পর হেফাজত নামক আরেকটি জঙ্গি গোষ্ঠীর বাংলাদেশে উদ্ভব ঘটুক, সেটা গণতন্ত্রপ্রিয়, উন্নয়নকামী ও শান্তিপ্রয়াসী বাংলাদেশের কোনো নাগরিকের কাম্য হতে পারে না। ত্রয়োদশ শতকে সুফি-সাধকদের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে অহিংসা ও প্রেমের বাণী বহন করে এ দেশে ইসলামের আগমন ঘটে। এরপর এ দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের ভক্তি ও ভালোবাসাই ইসলামকে হেফাজত করেছে। আর স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা নিজেকে তাঁর দ্বীনের হেফাজতকারী বলে ঘোষণা করেছেন। হঠাৎ করে এ দায়িত্ব নেওয়ার জন্য দেশের কয়েকটি কওমি মাদ্রাসার হুজুররা কেন উতলা হয়ে উঠলেন, তা সরলপ্রাণ ধর্মভীরু মানুষের বোধগম্য নয়। তা ছাড়া জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশের উদ্ভব ঘটে একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানের জাতীয় চার নীতির মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতা অন্যতম নীতি বলে স্বীকৃতি পায়। এ স্বীকৃতির মূলে ছিল পাকিস্তান আমলে অভিজ্ঞতার আলোকে প্রাপ্ত আমাদের বিশ্বাস যে রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে ধর্মকে জড়িত করলে তার মারাত্মক কুফল ঘটে, যা ঘটেছিল পাকিস্তানি যুগে। আর এ দেশে যারা অমুসলমান তারাও সমান নাগরিক। তাই শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মকে প্রাধান্য দিলে রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক বলে দাবি করতে পারে না। ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার- এটা হলো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অন্যতম চরিত্র-বৈশিষ্ট্য। এর ব্যত্যয় ঘটলে আমরা মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক চেতনার সঙ্গে প্রতারণা করব। হেফাজতের মনগড়া নাস্তিকরা কিন্তু দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়নি। শাহবাগের আন্দোলনকারীরা ছিল সম্পূর্ণ অহিংস ও শান্তিপূর্ণ। এর বিপরীতে হেফাজতিদের কর্মকাণ্ড ছিল অত্যন্ত সহিংস ও বর্বরোচিত।
ইহজগতে মানুষের সেবা ও কল্যাণ সাধনসহ আধ্যাত্মিক মুক্তি ও মঙ্গলের জন্য যে ধর্মের আগমন, তার প্রতিষ্ঠা ও পরিচর্যার উদ্দেশ্য নিয়ে হেফাজত ও জামায়াত রাজনীতির মাঠে নামেনি। তাদের উদ্দেশ্য একেবারেই ইহজাগতিক এবং তা হলো আপাতত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল এবং আখেরে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা।
ইতিমধ্যে হেফাজতের মহাসচিব জুনাইদ বাবুনগরী ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের কাছে জবানবন্দিতে স্বীকার করেছেন, মতিঝিল-পল্টন এলাকায় ৫ মে হেফাজতের অবরোধ কর্মসূচি চলাকালে সহিংস তাণ্ডব ঘটানোর মূলে ছিল ছাত্রদল, যুবদল ও জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা, যাতে হেফাজতের কিছু কর্মীও অংশ নেয়। আর এই কর্মসূচির জন্য টাকা দেয় ১৮ দলীয় জোট। তাঁর মতে, ১৩ দফার নামে হলেও সমাবেশ ১৩ দফার বাইরে চলে যায় এবং সরকার পতনের আন্দোলনে পরিণত হয়। আর তাই বিরোধী ১৮ দলীয় জোট সমাবেশ অব্যাহত রাখার শর্তে সকালের নাশতা, দুপুরের খাবার ও আরো টাকার প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে আসে (প্রথম আলো, ২২.৫.১৩)। বাবুনগরীর এ জবানবন্দি পুলিশি নির্যাতনের ফল বলা হলেও জবানবন্দির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে তাঁকে আদালত তিন ঘণ্টা সময় দিয়েছিলেন। সত্যিকার ধার্মিক লোক, সত্যের ব্যাপারে মৃত্যুর মুখেও অবিচল থাকে।
ধর্মের অপব্যাখ্যার মাধ্যমে মানুষের আবেগ-অনুভূতি উস্কে দিয়ে আয়-রোজগার, অর্থবিত্ত ও সামাজিক গুরুত্বহীন একদল ধর্মযাজক বাংলাদেশে তাদের আন্দোলন-সংঘাতের মাধ্যমে জাতির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মঙ্গল ও মুক্তিকে বাধাগ্রস্ত করছে। হেফাজতের আন্দোলন প্রগতিশীলতার বিরুদ্ধে সম্পদ, ক্ষমতা ও মর্যাদালোভী একদল ধর্মব্যবসায়ীর আন্দোলন। ধর্ম যদি বৃহৎ ও মহৎকে ধারণ করা হয়, তাহলে হেফাজতের আচরণ ও আন্দোলনে তার লেশমাত্র নেই। যা আছে, তা হলো, আমাদের অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্র গঠনের প্রচেষ্টাকে বানচাল করার অপপ্রয়াস। হেফাজত আসলে দেশের রাজনীতিতে এক নতুন বিপদ হিসেবে দেখা দিয়েছে।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ঢাকায় ৫ মের সমাবেশ ও তাণ্ডব আল্লামা শফীর বগুড়ায় প্রদত্ত হুঁশিয়ারির সত্যতাই প্রমাণ করে।
জামায়াতের পর হেফাজত নামক আরেকটি জঙ্গি গোষ্ঠীর বাংলাদেশে উদ্ভব ঘটুক, সেটা গণতন্ত্রপ্রিয়, উন্নয়নকামী ও শান্তিপ্রয়াসী বাংলাদেশের কোনো নাগরিকের কাম্য হতে পারে না। ত্রয়োদশ শতকে সুফি-সাধকদের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে অহিংসা ও প্রেমের বাণী বহন করে এ দেশে ইসলামের আগমন ঘটে। এরপর এ দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের ভক্তি ও ভালোবাসাই ইসলামকে হেফাজত করেছে। আর স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা নিজেকে তাঁর দ্বীনের হেফাজতকারী বলে ঘোষণা করেছেন। হঠাৎ করে এ দায়িত্ব নেওয়ার জন্য দেশের কয়েকটি কওমি মাদ্রাসার হুজুররা কেন উতলা হয়ে উঠলেন, তা সরলপ্রাণ ধর্মভীরু মানুষের বোধগম্য নয়। তা ছাড়া জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশের উদ্ভব ঘটে একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানের জাতীয় চার নীতির মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতা অন্যতম নীতি বলে স্বীকৃতি পায়। এ স্বীকৃতির মূলে ছিল পাকিস্তান আমলে অভিজ্ঞতার আলোকে প্রাপ্ত আমাদের বিশ্বাস যে রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে ধর্মকে জড়িত করলে তার মারাত্মক কুফল ঘটে, যা ঘটেছিল পাকিস্তানি যুগে। আর এ দেশে যারা অমুসলমান তারাও সমান নাগরিক। তাই শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মকে প্রাধান্য দিলে রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক বলে দাবি করতে পারে না। ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার- এটা হলো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অন্যতম চরিত্র-বৈশিষ্ট্য। এর ব্যত্যয় ঘটলে আমরা মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক চেতনার সঙ্গে প্রতারণা করব। হেফাজতের মনগড়া নাস্তিকরা কিন্তু দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়নি। শাহবাগের আন্দোলনকারীরা ছিল সম্পূর্ণ অহিংস ও শান্তিপূর্ণ। এর বিপরীতে হেফাজতিদের কর্মকাণ্ড ছিল অত্যন্ত সহিংস ও বর্বরোচিত।
ইহজগতে মানুষের সেবা ও কল্যাণ সাধনসহ আধ্যাত্মিক মুক্তি ও মঙ্গলের জন্য যে ধর্মের আগমন, তার প্রতিষ্ঠা ও পরিচর্যার উদ্দেশ্য নিয়ে হেফাজত ও জামায়াত রাজনীতির মাঠে নামেনি। তাদের উদ্দেশ্য একেবারেই ইহজাগতিক এবং তা হলো আপাতত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল এবং আখেরে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা।
ইতিমধ্যে হেফাজতের মহাসচিব জুনাইদ বাবুনগরী ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের কাছে জবানবন্দিতে স্বীকার করেছেন, মতিঝিল-পল্টন এলাকায় ৫ মে হেফাজতের অবরোধ কর্মসূচি চলাকালে সহিংস তাণ্ডব ঘটানোর মূলে ছিল ছাত্রদল, যুবদল ও জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা, যাতে হেফাজতের কিছু কর্মীও অংশ নেয়। আর এই কর্মসূচির জন্য টাকা দেয় ১৮ দলীয় জোট। তাঁর মতে, ১৩ দফার নামে হলেও সমাবেশ ১৩ দফার বাইরে চলে যায় এবং সরকার পতনের আন্দোলনে পরিণত হয়। আর তাই বিরোধী ১৮ দলীয় জোট সমাবেশ অব্যাহত রাখার শর্তে সকালের নাশতা, দুপুরের খাবার ও আরো টাকার প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে আসে (প্রথম আলো, ২২.৫.১৩)। বাবুনগরীর এ জবানবন্দি পুলিশি নির্যাতনের ফল বলা হলেও জবানবন্দির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে তাঁকে আদালত তিন ঘণ্টা সময় দিয়েছিলেন। সত্যিকার ধার্মিক লোক, সত্যের ব্যাপারে মৃত্যুর মুখেও অবিচল থাকে।
ধর্মের অপব্যাখ্যার মাধ্যমে মানুষের আবেগ-অনুভূতি উস্কে দিয়ে আয়-রোজগার, অর্থবিত্ত ও সামাজিক গুরুত্বহীন একদল ধর্মযাজক বাংলাদেশে তাদের আন্দোলন-সংঘাতের মাধ্যমে জাতির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মঙ্গল ও মুক্তিকে বাধাগ্রস্ত করছে। হেফাজতের আন্দোলন প্রগতিশীলতার বিরুদ্ধে সম্পদ, ক্ষমতা ও মর্যাদালোভী একদল ধর্মব্যবসায়ীর আন্দোলন। ধর্ম যদি বৃহৎ ও মহৎকে ধারণ করা হয়, তাহলে হেফাজতের আচরণ ও আন্দোলনে তার লেশমাত্র নেই। যা আছে, তা হলো, আমাদের অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্র গঠনের প্রচেষ্টাকে বানচাল করার অপপ্রয়াস। হেফাজত আসলে দেশের রাজনীতিতে এক নতুন বিপদ হিসেবে দেখা দিয়েছে।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments