চৈতন্যের মুক্ত বাতায়ন-ভারত ও বাংলাদেশে গণতন্ত্রের রূপভিন্নতা by যতীন সরকার
দক্ষিণ এশীয় উপমহাদেশটির অন্তর্গত
দেশগুলোর মধ্যে ভারতই আয়তনে সর্ববৃহৎ এবং এর লোকসংখ্যাও সর্বাধিক। এ দেশটির
এ অঞ্চলে বৃহত্তম ও একমাত্র গণতান্ত্রিক দেশ বলে পরিচিত।
ব্রিটেনের সংসদীয় তথা বুর্জোয়া গণতন্ত্রের ধাঁচেই ভারতের সংবিধানটি প্রণীত
হয়েছে। স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগেই এ দেশটিতে একটি জাতীয়
ধনিক শ্রেণীর উদ্ভব ঘটে গিয়েছিল। সেই ধনিক শ্রেণীর নেতৃত্বেই স্বাধীনতার
আন্দোলন চলেছে দীর্ঘদিন ধরে। আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পরাধীন দেশেও এই শ্রেণীটি
কিছু কিছু গণতান্ত্রিক অধিকার আদায় করে নিতে পেরেছিল। স্বাধীনতার পর এই
শ্রেণীটিই শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে এবং সেই ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করার
লক্ষ্যেই বুর্জোয়া গণতন্ত্রের চর্চায় মনোযোগী হতে পেরেছে।
একসময়ের তৃতীয় বিশ্বের অন্তর্গত দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র ভারতেই একটা জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণীর অধিষ্ঠান আছে। জাতীয় বুর্জোয়া আছে বলেই বুর্জোয়া গণতন্ত্রের শেকড়ও সে দেশে প্রোথিত থাকতে পেরেছে। তা ছাড়া দেশটির বিশেষ ধরনের ভৌগোলিক অবস্থা, বিচিত্র ও বহুধা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত নানা জাতিগোষ্ঠীর মানুষের অধিবাস, অনেক রাজ্যে বিভক্ত ফেডারেল রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা- এসবও দেশটিতে বুর্জোয়াদের শক্তিকে সংহত করেছে, সেনা-অভ্যুত্থানের আশঙ্কা থেকে তারা মুক্ত থাকতে পারছে। এসব বিবেচনায় রেখেই বাংলাদেশ কেন ভারতের মতো গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানে সক্ষম হচ্ছে না- সে প্রশ্নের উত্তর সন্ধানে প্রবৃত্ত হতে হবে।
তবে তার আগে ভারতের কথাই আরো একটু বলে নিই। ভারতেও যে বুর্জোয়া গণতন্ত্র খুব মৃসণ গতিতে এগিয়ে চলছে, তা-ও কিন্তু নয়। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে 'ডক্টর জাকির হোসেন স্মারক বক্তৃতা' প্রদান করেছিলেন সে সময়কার ভারতের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এ এম আহমদী। তাঁর বক্তৃতার বিষয় ছিল 'ভারতীয় গণতন্ত্রের সংকট ও সম্ভাবনা'। বক্তৃতায় তিনি অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করেছিলেন, 'রাজনীতিবিদ, আমলা আর পুলিশের অশুভ আঁতাত ভারতীয় গণতন্ত্রকে তামাশায় পরিণত করেছে।' তামাশা সৃষ্টিকারী এ অশুভ চক্রকে ভেঙে ফেলার আহ্বানও জানিয়েছিলেন তিনি। ১৯৭৫ সালে ভারতে যে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছিল, তার তীব্র নিন্দা করে একে তিনি 'গণতন্ত্রের মৃত্যুঘণ্টা' বলে অভিহিত করেছিলেন। 'আপাত সুবিধার জন্য রাজনীতিকদের নেওয়া জনপ্রিয় সিদ্ধান্তেরও' সমালোচনা করে তিনি বলেন যে 'এ কারণেই ভারতীয় পার্লামেন্টের কাজকর্মে মানের অবনতি ঘটেছে।' সেই অনুষ্ঠানেরই বিশেষ অতিথি ও তখনকার লোকসভার অধ্যক্ষ শিবরাজ পাতিলের বক্তব্য ছিল যে 'অর্থ, পেশিশক্তি ও সংকীর্ণ আদর্শই মুক্ত ও অবাধ নির্বাচনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।' অর্থাৎ ভারতেও বুর্জোয়া গণতন্ত্রকে নানা প্রতিবন্ধকতার ভেতর দিয়ে পথ চলতে হচ্ছে। নির্বাচন তো বুর্জোয়া গণতন্ত্রের প্রধান উপাদান বলে কথিত। অথচ সেই নির্বাচনও যে ভারতে 'মুক্ত ও অবাধ' হতে পারছে না, সে কথা স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছেন সে দেশের সর্বোচ্চ নির্বাচিত জাতীয় সংসদের প্রধান ব্যক্তিটিও।
এমনটি কেন হয়? এমনটি হওয়া- বিশেষ করে ভারতের মতো দেশে- একান্ত অপরিহার্য বলেই হয়। ভারতে যদিও বুর্জোয়ারা সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্তৃত্বশীল অবস্থানে আছে, তবু তারা সংখ্যায় একেবারেই লঘু। সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোতেও বুর্জোয়ারা সংখ্যালঘু বটে, কিন্তু তারা তাদের সাম্রাজ্য লুণ্ঠন করে এনেই নিজেদের দেশের সংখ্যাগুরু শ্রমজীবী জনগণকে অনেক পরিমাণে তুষ্ট রাখতে পারে। কিন্তু ভারতের মতো সাম্রাজ্যহীন দেশের পক্ষে তা সম্ভব নয়। সে দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও অশিক্ষা এত প্রবল ও প্রকট যে সেসব দূর করে সবার পরিতুষ্টি বিধানের সংগতি ও ক্ষমতা শাসক বুর্জোয়াদের নেই। তাই মুখে গণতন্ত্রের মিঠে মিঠে বুলি উচ্চারণ করেও বাস্তবে তাদের গণবিরোধী কপটাচরণে লিপ্ত হতে হয়। আবার নিজেদের ভেতরকার গোষ্ঠীদ্বন্দ্বও প্রকট থেকে প্রকটতর হয়ে ওঠে, আর তারও ফলভোগী হতে হয় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণকেই।
তবু এসব সংকট ও বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের বহুমুখী চাপ মোকাবিলা করে ভারতের জাতীয় বুর্জোয়ারা একসময় নিজেদের স্বাধীন অস্তিত্ব ও দেশে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের চর্চা অব্যাহত রাখতে বহুল পরিমাণেই সক্ষম হয়েছিল। সেই সক্ষমতার প্রধান হেতুটি নিহিত ছিল সেই স্নায়ুযুদ্ধের যুগে ভারতের প্রতি বিশ্বসমাজতান্ত্রিক শিবিরের সমর্থন ও সহযোগিতা। সেই সমর্থন ও সহযোগিতা ভারতের স্বাধীন শিল্প উদ্যোগকে একটা দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। এই ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে ভারতের জাতীয় বুর্জোয়ারা যে সঠিক বিদেশনীতি গ্রহণ করেছিল, সে নীতিই স্বদেশের ক্ষেত্রেও অনেক ঝড়ঝঞ্ঝা মোকাবিলায় তাদের সহায়ক হয়েছে। বিশ্বসমাজতান্ত্রিক শিবিরের কার্যকর সহায়তা পেয়েই, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে, একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারত তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখতে পেরেছিল।
কিন্তু বিগত শতকেরই শেষ দশকে বিশ্ব পরিস্থিতির উল্টোমুখী পরিবর্তনের ধাক্কায় পড়ে ভারতীয় বুর্জোয়ারা তাদের সেই আগের অবস্থানটি আর ধরে রাখতে পারছে না। শক্তিশালী সমাজতান্ত্রিক শিবিরের অবর্তমানে সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতার সেই দৃঢ়তা থেকে তাকে সরে আসতে হয়েছে। দেশের অভ্যন্তরে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে জঘন্য সাম্প্রদায়িকতা। সেই সঙ্গে সংকীর্ণ আঞ্চলিকতাও। তবু এর পরও, ভারতীয় জনগণের ভেতরকার অগ্রসর চেতনাদীপ্ত মানুষরা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামের ধারাটিকে ধরে রাখতে প্রাণপণ প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের সে প্রয়াস জয়যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনাও একান্ত উজ্জ্বল।
এতক্ষণ ধরে ভারত সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনার পরই নজর ফেরাতে চাই আমাদের মূল প্রসঙ্গে; অর্থাৎ বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা ও অবস্থান্তরের দিকে, গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ প্রাপ্তির সমস্যা, সংকট ও সম্ভাবনার দিকে। মানতেই হবে যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত পরবর্তী সুদিন খুব বেশি দিন থাকেনি। অথচ কোনো কোনো দিকে ভারতের চেয়েও অগ্রসর চিন্তার ধারক একটি রাষ্ট্রীয় সংবিধান রচনা করেছিলেন সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশের কর্ণধাররা। সেই সংবিধান বুর্জোয়া গণতন্ত্রের সুকৃতিগুলো যেমন ধারণ করেছিল, তেমনই বুর্জোয়া গণতন্ত্রের বৃত্তসীমাতেই দেশটি যাতে আটকে পড়ে না থাকে, তারও ব্যবস্থা সে সংবিধানে রাখা হয়েছিল। সমাজতন্ত্রকে লক্ষ্যবিন্দুতে রেখে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথের কাঁটাগুলোকে নির্মূল করে দেওয়ার ব্যবস্থা সংবলিত সেই সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে এমন বিধানে বেঁধে ফেলা হয়েছিল, যাতে রাজনীতিতে ধর্মতন্ত্রের অপব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। আমরা তো জানি, সীমাহীন অর্থের অধিকারী অর্থবানরাই বিভিন্ন দেশে গণ-অধিকার হরণ করে গণতন্ত্রকে অর্থহীন করে ফেলে। এ রকম অর্থহীনতারই প্রতিরোধক ছিল আমাদের সংবিধানে বিধিবদ্ধ সমাজতন্ত্র।
কিন্তু হায়, অচিরেই আমাদের একান্ত গৌরবের সেই সংবিধানটির সলিল সমাধি ঘটল। কারা, কখন, কিভাবে এমনটি ঘটাল- সেসব বিষয় সর্বজনজ্ঞাত ও বহু আলোচিত। তাই সেসবের পুনরালোচনা বা পুনরাবৃত্তির কোনো প্রয়োজন নেই। দীর্ঘদিন পর একুশ শতকের প্রথম দশকেই স্বাধীন বাংলার মহান স্থপতির উত্তরাধিকার বহনকারীদের হাতে জনগণ যখন ভোটের মাধ্যমেই নিরঙ্কুশ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রদান করল, তখন অত্যন্ত সংগতভাবেই আমাদের মনে আশা জেগেছিল যে অতীতের গ্লানি থেকে আমরা মুক্তি পাব; আমাদের গৌরবময় সংবিধানটির পুনরুদ্ধারই ঘটবে না শুধু, সেটি হবে আরো সম্মুখবর্তী, আরো বেগবান ও সর্বপ্রকার ত্রুটিমুক্ত। কিন্তু এবারও আমাদের আশার বেলুনটি ফুটো হয়ে গেল। মূলত তরুণ প্রজন্মের সুদূঢ় সমর্থনে ক্ষমতাসীন হলেন যাঁরা, তাঁরা সেই সমর্থনের মর্যাদা রক্ষায় কিছুদূর অগ্রসর হয়েই বেপথু হয়ে পড়লেন। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে ফিরিয়ে আনা হলো, আবার রাষ্ট্রধর্ম ও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের অধিকারও বহাল রাখা হলো। স্বৈরতন্ত্রবিরোধী বোলচালও ঝাড়া হতে থাকল, অথচ জঘন্য স্বৈরতন্ত্রী সেই পতিত শাসকটিকেও কোলে তুলে নেওয়া হলো। 'রাজনৈতিক কৌশলে'র আশ্রয় নিয়ে এ রকমটি করা হলো, আর কৌশলের গুঁতোয় সব নীতি-আদর্শ গর্তে মুখ লুকাল।
এ রকমটিই তো হতে হবে। বুর্জোয়া গণতন্ত্রকে সামান্য পরিমাণে অগ্রসর করে নেওয়ার মতো প্রকৃত বুর্জোয়া যে দেশে নেই, সে দেশে এ রকমটি না হয়েই পারে না। বাংলাদেশের নিতান্ত পাতি বুর্জোয়াটিও বৃহৎ বুর্জোয়া হওয়ার খায়েশে তাড়িত হতে পারে বটে কিন্তু সে খায়েশ বাস্তব করে তোলার কোনো সুযোগই তার সামনে খোলা নেই। সে তো আর অন্য দেশের সম্পদ লুট করে এনে নিজের চিকনাই বাড়াতে পারে না। তাই তাকে নিজের দেশে লুটপাট চালিয়ে অধিকাংশ মানুষকে হাড্ডিসার বানিয়ে ফেলতে হচ্ছে। বিশেষ করে তথাকথিত বিশ্বায়নের যুগে সাম্রাজ্যবাদের সেবাদাস হয়ে থাকা ছাড়া তার গত্যন্তর নেই। এ রকম সেবাদাস হয়েই রাজনীতিতে টিকে থাকতে হয় ক্ষমতায় আরোহীদেরও, ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়াদেরও। বিগত শতকের আশির দশকের শেষে ও নব্বইয়ের শুরুতে স্বৈরতন্ত্র হটানোর প্রয়াসে বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠীর যে সমবায় ঘটেছিল, ভোটের অধিকার প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে সে সমবায় আর রইল না। তখন থেকে যা হচ্ছে, প্রয়াত আহমদ ছফা তাকে তুলনা করেছিলেন, 'নিলামে হাট বা বাজার ইজারা' নেওয়ার সঙ্গে। কোনো অর্থশালী মানুষ হয়তো কোনো হাট বা বাজার এক লাখ টাকার বিনিময়ে ইজারা নেয় তিন বছরে সেখান থেকে পাঁচ লাখ টাকা আয় করবে বলে। রাজনীতিকরাও নির্বাচনে এমনটিই করে থাকেন। এতে 'গণতন্ত্রের প্রহসন'ই হয় কেবল, প্রকৃত গণতন্ত্র হয় না। আহমদ ছফা এর উদাহরণ টেনেছিলেন এভাবে- 'ধরুন একজন সাংসদ নির্বাচিত হতে বিশ লাখ টাকা খরচ করলেন। নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁর ধ্যানজ্ঞান হয়ে দাঁড়ায় এই বিশ লাখ টাকা খরচ করে কী করে অন্তত এক কোটি তিনি আয় করবেন। তিনি যদি এক কোটি টাকার বদলে দুই কোটি টাকার মালিক হতে পারেন, সেটাকেই মনে করেন জাতির প্রতি তাঁর মস্ত সেবা।'
এই উদাহরণটিই মনে রাখলে বাংলাদেশের গণতন্ত্র সম্পর্কে আর বিশেষ কিছু না বললেও চলে। আর এতেই ভারতের জাতীয় বুর্জোয়াদের সঙ্গে বাংলাদেশের লুটপাটতন্ত্রী বুর্জোয়াদের পার্থক্যের ব্যাপারটিও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কেন এখানে বারবার স্বৈরতন্ত্রের উত্থানের ভয়ে আমাদের কুঁকড়ে থাকতে হয়, তাও মোটেই অস্পষ্ট থাকে না।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও সাংস্কৃতিক সংগঠক
একসময়ের তৃতীয় বিশ্বের অন্তর্গত দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র ভারতেই একটা জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণীর অধিষ্ঠান আছে। জাতীয় বুর্জোয়া আছে বলেই বুর্জোয়া গণতন্ত্রের শেকড়ও সে দেশে প্রোথিত থাকতে পেরেছে। তা ছাড়া দেশটির বিশেষ ধরনের ভৌগোলিক অবস্থা, বিচিত্র ও বহুধা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত নানা জাতিগোষ্ঠীর মানুষের অধিবাস, অনেক রাজ্যে বিভক্ত ফেডারেল রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা- এসবও দেশটিতে বুর্জোয়াদের শক্তিকে সংহত করেছে, সেনা-অভ্যুত্থানের আশঙ্কা থেকে তারা মুক্ত থাকতে পারছে। এসব বিবেচনায় রেখেই বাংলাদেশ কেন ভারতের মতো গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানে সক্ষম হচ্ছে না- সে প্রশ্নের উত্তর সন্ধানে প্রবৃত্ত হতে হবে।
তবে তার আগে ভারতের কথাই আরো একটু বলে নিই। ভারতেও যে বুর্জোয়া গণতন্ত্র খুব মৃসণ গতিতে এগিয়ে চলছে, তা-ও কিন্তু নয়। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে 'ডক্টর জাকির হোসেন স্মারক বক্তৃতা' প্রদান করেছিলেন সে সময়কার ভারতের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এ এম আহমদী। তাঁর বক্তৃতার বিষয় ছিল 'ভারতীয় গণতন্ত্রের সংকট ও সম্ভাবনা'। বক্তৃতায় তিনি অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করেছিলেন, 'রাজনীতিবিদ, আমলা আর পুলিশের অশুভ আঁতাত ভারতীয় গণতন্ত্রকে তামাশায় পরিণত করেছে।' তামাশা সৃষ্টিকারী এ অশুভ চক্রকে ভেঙে ফেলার আহ্বানও জানিয়েছিলেন তিনি। ১৯৭৫ সালে ভারতে যে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছিল, তার তীব্র নিন্দা করে একে তিনি 'গণতন্ত্রের মৃত্যুঘণ্টা' বলে অভিহিত করেছিলেন। 'আপাত সুবিধার জন্য রাজনীতিকদের নেওয়া জনপ্রিয় সিদ্ধান্তেরও' সমালোচনা করে তিনি বলেন যে 'এ কারণেই ভারতীয় পার্লামেন্টের কাজকর্মে মানের অবনতি ঘটেছে।' সেই অনুষ্ঠানেরই বিশেষ অতিথি ও তখনকার লোকসভার অধ্যক্ষ শিবরাজ পাতিলের বক্তব্য ছিল যে 'অর্থ, পেশিশক্তি ও সংকীর্ণ আদর্শই মুক্ত ও অবাধ নির্বাচনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।' অর্থাৎ ভারতেও বুর্জোয়া গণতন্ত্রকে নানা প্রতিবন্ধকতার ভেতর দিয়ে পথ চলতে হচ্ছে। নির্বাচন তো বুর্জোয়া গণতন্ত্রের প্রধান উপাদান বলে কথিত। অথচ সেই নির্বাচনও যে ভারতে 'মুক্ত ও অবাধ' হতে পারছে না, সে কথা স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছেন সে দেশের সর্বোচ্চ নির্বাচিত জাতীয় সংসদের প্রধান ব্যক্তিটিও।
এমনটি কেন হয়? এমনটি হওয়া- বিশেষ করে ভারতের মতো দেশে- একান্ত অপরিহার্য বলেই হয়। ভারতে যদিও বুর্জোয়ারা সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্তৃত্বশীল অবস্থানে আছে, তবু তারা সংখ্যায় একেবারেই লঘু। সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোতেও বুর্জোয়ারা সংখ্যালঘু বটে, কিন্তু তারা তাদের সাম্রাজ্য লুণ্ঠন করে এনেই নিজেদের দেশের সংখ্যাগুরু শ্রমজীবী জনগণকে অনেক পরিমাণে তুষ্ট রাখতে পারে। কিন্তু ভারতের মতো সাম্রাজ্যহীন দেশের পক্ষে তা সম্ভব নয়। সে দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও অশিক্ষা এত প্রবল ও প্রকট যে সেসব দূর করে সবার পরিতুষ্টি বিধানের সংগতি ও ক্ষমতা শাসক বুর্জোয়াদের নেই। তাই মুখে গণতন্ত্রের মিঠে মিঠে বুলি উচ্চারণ করেও বাস্তবে তাদের গণবিরোধী কপটাচরণে লিপ্ত হতে হয়। আবার নিজেদের ভেতরকার গোষ্ঠীদ্বন্দ্বও প্রকট থেকে প্রকটতর হয়ে ওঠে, আর তারও ফলভোগী হতে হয় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণকেই।
তবু এসব সংকট ও বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের বহুমুখী চাপ মোকাবিলা করে ভারতের জাতীয় বুর্জোয়ারা একসময় নিজেদের স্বাধীন অস্তিত্ব ও দেশে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের চর্চা অব্যাহত রাখতে বহুল পরিমাণেই সক্ষম হয়েছিল। সেই সক্ষমতার প্রধান হেতুটি নিহিত ছিল সেই স্নায়ুযুদ্ধের যুগে ভারতের প্রতি বিশ্বসমাজতান্ত্রিক শিবিরের সমর্থন ও সহযোগিতা। সেই সমর্থন ও সহযোগিতা ভারতের স্বাধীন শিল্প উদ্যোগকে একটা দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। এই ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে ভারতের জাতীয় বুর্জোয়ারা যে সঠিক বিদেশনীতি গ্রহণ করেছিল, সে নীতিই স্বদেশের ক্ষেত্রেও অনেক ঝড়ঝঞ্ঝা মোকাবিলায় তাদের সহায়ক হয়েছে। বিশ্বসমাজতান্ত্রিক শিবিরের কার্যকর সহায়তা পেয়েই, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে, একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারত তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখতে পেরেছিল।
কিন্তু বিগত শতকেরই শেষ দশকে বিশ্ব পরিস্থিতির উল্টোমুখী পরিবর্তনের ধাক্কায় পড়ে ভারতীয় বুর্জোয়ারা তাদের সেই আগের অবস্থানটি আর ধরে রাখতে পারছে না। শক্তিশালী সমাজতান্ত্রিক শিবিরের অবর্তমানে সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতার সেই দৃঢ়তা থেকে তাকে সরে আসতে হয়েছে। দেশের অভ্যন্তরে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে জঘন্য সাম্প্রদায়িকতা। সেই সঙ্গে সংকীর্ণ আঞ্চলিকতাও। তবু এর পরও, ভারতীয় জনগণের ভেতরকার অগ্রসর চেতনাদীপ্ত মানুষরা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামের ধারাটিকে ধরে রাখতে প্রাণপণ প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের সে প্রয়াস জয়যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনাও একান্ত উজ্জ্বল।
এতক্ষণ ধরে ভারত সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনার পরই নজর ফেরাতে চাই আমাদের মূল প্রসঙ্গে; অর্থাৎ বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা ও অবস্থান্তরের দিকে, গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ প্রাপ্তির সমস্যা, সংকট ও সম্ভাবনার দিকে। মানতেই হবে যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত পরবর্তী সুদিন খুব বেশি দিন থাকেনি। অথচ কোনো কোনো দিকে ভারতের চেয়েও অগ্রসর চিন্তার ধারক একটি রাষ্ট্রীয় সংবিধান রচনা করেছিলেন সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশের কর্ণধাররা। সেই সংবিধান বুর্জোয়া গণতন্ত্রের সুকৃতিগুলো যেমন ধারণ করেছিল, তেমনই বুর্জোয়া গণতন্ত্রের বৃত্তসীমাতেই দেশটি যাতে আটকে পড়ে না থাকে, তারও ব্যবস্থা সে সংবিধানে রাখা হয়েছিল। সমাজতন্ত্রকে লক্ষ্যবিন্দুতে রেখে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথের কাঁটাগুলোকে নির্মূল করে দেওয়ার ব্যবস্থা সংবলিত সেই সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে এমন বিধানে বেঁধে ফেলা হয়েছিল, যাতে রাজনীতিতে ধর্মতন্ত্রের অপব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। আমরা তো জানি, সীমাহীন অর্থের অধিকারী অর্থবানরাই বিভিন্ন দেশে গণ-অধিকার হরণ করে গণতন্ত্রকে অর্থহীন করে ফেলে। এ রকম অর্থহীনতারই প্রতিরোধক ছিল আমাদের সংবিধানে বিধিবদ্ধ সমাজতন্ত্র।
কিন্তু হায়, অচিরেই আমাদের একান্ত গৌরবের সেই সংবিধানটির সলিল সমাধি ঘটল। কারা, কখন, কিভাবে এমনটি ঘটাল- সেসব বিষয় সর্বজনজ্ঞাত ও বহু আলোচিত। তাই সেসবের পুনরালোচনা বা পুনরাবৃত্তির কোনো প্রয়োজন নেই। দীর্ঘদিন পর একুশ শতকের প্রথম দশকেই স্বাধীন বাংলার মহান স্থপতির উত্তরাধিকার বহনকারীদের হাতে জনগণ যখন ভোটের মাধ্যমেই নিরঙ্কুশ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রদান করল, তখন অত্যন্ত সংগতভাবেই আমাদের মনে আশা জেগেছিল যে অতীতের গ্লানি থেকে আমরা মুক্তি পাব; আমাদের গৌরবময় সংবিধানটির পুনরুদ্ধারই ঘটবে না শুধু, সেটি হবে আরো সম্মুখবর্তী, আরো বেগবান ও সর্বপ্রকার ত্রুটিমুক্ত। কিন্তু এবারও আমাদের আশার বেলুনটি ফুটো হয়ে গেল। মূলত তরুণ প্রজন্মের সুদূঢ় সমর্থনে ক্ষমতাসীন হলেন যাঁরা, তাঁরা সেই সমর্থনের মর্যাদা রক্ষায় কিছুদূর অগ্রসর হয়েই বেপথু হয়ে পড়লেন। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে ফিরিয়ে আনা হলো, আবার রাষ্ট্রধর্ম ও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের অধিকারও বহাল রাখা হলো। স্বৈরতন্ত্রবিরোধী বোলচালও ঝাড়া হতে থাকল, অথচ জঘন্য স্বৈরতন্ত্রী সেই পতিত শাসকটিকেও কোলে তুলে নেওয়া হলো। 'রাজনৈতিক কৌশলে'র আশ্রয় নিয়ে এ রকমটি করা হলো, আর কৌশলের গুঁতোয় সব নীতি-আদর্শ গর্তে মুখ লুকাল।
এ রকমটিই তো হতে হবে। বুর্জোয়া গণতন্ত্রকে সামান্য পরিমাণে অগ্রসর করে নেওয়ার মতো প্রকৃত বুর্জোয়া যে দেশে নেই, সে দেশে এ রকমটি না হয়েই পারে না। বাংলাদেশের নিতান্ত পাতি বুর্জোয়াটিও বৃহৎ বুর্জোয়া হওয়ার খায়েশে তাড়িত হতে পারে বটে কিন্তু সে খায়েশ বাস্তব করে তোলার কোনো সুযোগই তার সামনে খোলা নেই। সে তো আর অন্য দেশের সম্পদ লুট করে এনে নিজের চিকনাই বাড়াতে পারে না। তাই তাকে নিজের দেশে লুটপাট চালিয়ে অধিকাংশ মানুষকে হাড্ডিসার বানিয়ে ফেলতে হচ্ছে। বিশেষ করে তথাকথিত বিশ্বায়নের যুগে সাম্রাজ্যবাদের সেবাদাস হয়ে থাকা ছাড়া তার গত্যন্তর নেই। এ রকম সেবাদাস হয়েই রাজনীতিতে টিকে থাকতে হয় ক্ষমতায় আরোহীদেরও, ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়াদেরও। বিগত শতকের আশির দশকের শেষে ও নব্বইয়ের শুরুতে স্বৈরতন্ত্র হটানোর প্রয়াসে বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠীর যে সমবায় ঘটেছিল, ভোটের অধিকার প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে সে সমবায় আর রইল না। তখন থেকে যা হচ্ছে, প্রয়াত আহমদ ছফা তাকে তুলনা করেছিলেন, 'নিলামে হাট বা বাজার ইজারা' নেওয়ার সঙ্গে। কোনো অর্থশালী মানুষ হয়তো কোনো হাট বা বাজার এক লাখ টাকার বিনিময়ে ইজারা নেয় তিন বছরে সেখান থেকে পাঁচ লাখ টাকা আয় করবে বলে। রাজনীতিকরাও নির্বাচনে এমনটিই করে থাকেন। এতে 'গণতন্ত্রের প্রহসন'ই হয় কেবল, প্রকৃত গণতন্ত্র হয় না। আহমদ ছফা এর উদাহরণ টেনেছিলেন এভাবে- 'ধরুন একজন সাংসদ নির্বাচিত হতে বিশ লাখ টাকা খরচ করলেন। নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁর ধ্যানজ্ঞান হয়ে দাঁড়ায় এই বিশ লাখ টাকা খরচ করে কী করে অন্তত এক কোটি তিনি আয় করবেন। তিনি যদি এক কোটি টাকার বদলে দুই কোটি টাকার মালিক হতে পারেন, সেটাকেই মনে করেন জাতির প্রতি তাঁর মস্ত সেবা।'
এই উদাহরণটিই মনে রাখলে বাংলাদেশের গণতন্ত্র সম্পর্কে আর বিশেষ কিছু না বললেও চলে। আর এতেই ভারতের জাতীয় বুর্জোয়াদের সঙ্গে বাংলাদেশের লুটপাটতন্ত্রী বুর্জোয়াদের পার্থক্যের ব্যাপারটিও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কেন এখানে বারবার স্বৈরতন্ত্রের উত্থানের ভয়ে আমাদের কুঁকড়ে থাকতে হয়, তাও মোটেই অস্পষ্ট থাকে না।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও সাংস্কৃতিক সংগঠক
No comments